মানব রচিত জীবন ব্যবস্থার এই সমাজ যেন বড় আকারের জেলখানা

রমজানের ঈদের তিন দিন পর ভ্যান গাড়িতে করে কলা বিক্রেতার কাছ থেকে দুই ডজন পাকা সাগর কলা কিনেছি। ত্রিশ টাকা করে ষাট টাকা। হালি প্রতি পরেছে ১০ টাকা। দাম-দর করলে আরেকটু কমানো যেতো বোধহয়। এই কলাই রমজানে কিনতে হয়েছে ষাট টাকা ডজন হিসেবে। এর পর দিন দেখলাম আরেকজন বিক্রেতা ভ্যান গাড়িতে করে সাগর কলা বিক্রি করছে। হালি আট টাকা করে দাম চাচ্ছে। দাম-দর করিনি। ৬টাকা করে বললেও হয়তো দিয়ে দেবে। কারণ তার ভ্যান ভর্তি পাকা কলায়। আজকের মধ্যে বিক্রি করতে না পারলে পচে যাবে। লস হবে।

গত বছর রমজানের ঈদের কথা মনে পরে। ঈদের কয়েকদিন পর ঢাকার ফার্মগেট থেকে একইভাবে ভ্যানে করে পাকা পেপে বিক্রেতার কাছ থেকে ৫-১০ টাকা করে বড় বড় পেপে কিনেছিলাম। যেই পেপে রমজানে ৫০-৬০ টাকা বললেও বিক্রেতা দেয়নি। ৮০-১০০ টাকা করে বিক্রি করেছে। এখন ৫-১০ টাকায় দেয়ার কারণ জিজ্ঞেস করলে জানালো কাওরান বাজারে কয়েক ট্রাক পরিমাণ পেপে জমে গেছে। রমজানে চড়া মূল্য ধরে রাখার জন্য যা ছাড়া হয় নি। এখন সে গুলো পচে যাওয়ার আশংকায় কম দামে বিক্রি করছে। আর তা ভ্যানে করে এনে ভ্যান চালক বিক্রি করছে। এভাবে নাকি অনেক এলাকাতেই বিক্রি হচ্ছে।

উপরোক্ত ঘটনা দু’টি আমার নিজের চাক্ষুষ অভিজ্ঞতা। এই হলো আমাদের সমাজের অবস্থা। আল্লাহর স্বার্বভৌমত্বকে চ্যালেঞ্জ করে, আল্লাহর দেয়া আইন-কানুন, বিধানাবলীকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে মানব রচিত শাসনব্যবস্থা আর মানব রচিত মতবাদের দ্বারা দেশ চালানোর ফলে সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে আজ এমন প্রকাশ্য জুলুম আর দূর্ণীতি স্বাভাবিক বিষয় হয়ে গেছে। সকলের সারা জীবনের লক্ষ্য উদ্দেশ্য একটিই টাকা আর টাকা। যেভাবেই হোক অধিক থেকে অধিক টাকা উপার্জন করতে হবে। এজন্য প্রয়োজনে জাল-জালিয়াতি, ধোকা-প্রতারণা, মজুদদারি, ফটকাবাজারি যাই করতে হয় তাই করবে।

উপরোক্ত পুঁজিবাদী দৃষ্টিভঙ্গি ও চিন্তাধারা থেকে উদ্ভুত ব্যবসায়ী মানসিকতার ফল পাচ্ছি আমরা। আমাদের মতো নিরীহ জনগণের আজ যেনো করার কিছুই নেই। ব্যবসায়ীরা দাম বাড়াবার জন্য মজুদদারি করছে। পন্যের বিশাল সরবরাহ থাকা সত্ত্বেও তা আটকে রাখছে। দাম বাড়িয়ে তারপর অল্প অল্প করে বাজারে ছাড়ছে। ফলে আমরা বাধ্য হয়ে দ্বিগুন-তিনগুণ দাম দিয়ে নিত্য-প্রয়োজনীয় পন্য কিনতে বাধ্য হচ্ছি। তাদের অতি মুনাফার এই জুলুম সংযমের মাস রমজান এলে যেনো লাগাম ছাড়া হয়ে যায়। বাড়তে থাকে লাফিয়ে লাফিয়ে। রমজানের আগে যেই পটল-বরবটি কিনেছি ২০-২৪ টাকা কেজি রমজান ও তারপর সেই সবজি কিনতে হচ্ছে ৪০-৫০ টাকা কেজি। অনেক সব্জি ৮০ টাকা করেও কিনতে হচ্ছে। কি পরিমাণ জুলুম করা হচ্ছে সমাজের অধিকাংশ অসহায় নাগরিকের উপর!

সমাজে দৈনন্দিন দ্রব্যমূল্যের এমন উর্দ্ধগতির পেছনে অনেক গুলো বিষয় কাজ করছে। এর মধ্যে মজুদদারি, ফটকাবাজি ও অতি মুনাফা লোভী ব্যবসায়ীদের কারসাজির কথা আমরা প্রায় সবাই জানি। কিন্তু এর চেয়েও বেশি গুরুতর সমস্যাটির কথা আমাদের অনেকের কাছেই অজানা। তা হচ্ছে ডলার নির্ভর অর্থনীতি। আজকে অনেকেই বলেন যে, স্বর্ণের দাম বেড়ে গেছে, জমির দাম বেড়ে গেছে, অমুক জিনিষের দাম বেড়ে গেছে। আসলে প্রকৃত অর্থে আমাদের টাকার মান কমে গেছে। স্বর্ণ যেমন ছিলো, জমি যেমন ছিলো তেমনি আছে। কিন্তু মানব সৃষ্ট কারসাজিতে আমাদের টাকার মূল্যমান কমে যাচ্ছে। এরও মূল কারণ হচ্ছে ডলার নির্ভর অর্থনীতি। এ ব্যাপারে সামনে একটি পোষ্ট দেয়ার ইচ্ছা আছে। এই সকল চতুর্মুখি জুলুম আর শোষণের যাতাকলে পরে আজ আমরা একটি বৃহৎ জেলখানায় অবস্থান করছি। কারো জেলখানার সীমানা ছোট আর কারো বড়। এই হচ্ছে ব্যবধান। জালিম শাসক ও দূর্নীতিবাজ লুটেরা গুলো ইচ্ছে মতো শোষণ-নিপীড়ণ চালিয়ে যাচ্ছে। বলার কেউ নেই।

মানব রচিত জীবন ব্যবস্থার এই সমাজ তাই আজ পরিণত হয়েছে একটি বড় আকারের জেলখানায়। এক আল্লাহর স্বার্বভৌমত্ব ও দাসত্ব প্রতিষ্ঠার জন্য আজ প্রয়োজন এই জেলখানার শৃংখল ভেঙ্গে বেরিয়ে আসা। আল্লাহ আমাদেরকে তাওফীক দিন। আমীন।

ইসহাক খান
১০ সেপ্টেম্বর, ২০১১

Print Friendly, PDF & Email

Leave a Reply