সাম্রাজ্যবাদী শক্তির বিরুদ্ধে সংগ্রামের অপরিহার্যতা

ইসলামের জন্মলগ্ন থেকেই ঈমান ও কুফরের মধ্যে আপোষহীন দ্বন্দ ও সংগ্রাম চলে আসছে। আল্লাহ্‌ (সুবহানাহু ওয়া তা’আলা) পবিত্র কুর’আনের মাধ্যমে ইসলাম ও কুফরের দ্বন্দের বিষয়টি সুস্পষ্টরূপে প্রকাশ করে দিয়েছেন এবং মুসলমানদেরকে এ মর্মে সতর্ক করে দিয়েছেন যে তারা যেন কখনই কাফের শক্তিকে নিজেদের বন্ধু বা মিত্র হিসাবে না নেয়। আল্লাহ্‌ (সুবহানাহু ওয়া তা’আলা) বলেন,

“হে ইমানদারগণ, তোমরা নিজেদেরকে ব্যতীত অন্য কাউকে অন্তরঙ্গ বন্ধু হিসাবে গ্রহণ করোনা। তারা তোমাদের সাথে শত্রুতা করতে বিন্দুমাত্র ত্রুটি করেনা; তারা শুধুমাত্র তোমাদের ধ্বংসই কামনা করে। বাস্তবে শত্রুতা তাদের মুখ হতে প্রকাশ হয়ে পড়েছে আর তাদের অন্তরে যা আছে তা আরও ভয়াবহ।” [সুরা আল ইমরান : ১১৮]

খিলাফত প্রতিষ্ঠার আন্দোলনকারীদের এটা সুস্পষ্টরূপে বুঝে নেয়া প্রয়োজন যে, বর্তমান পৃথিবীতে ইসলাম ও মুসলমানদের সবচেয়ে বড় শত্রু হচ্ছে সাম্রাজ্যবাদী কাফের রাষ্ট্রসমূহ। এরাই সংঘবদ্ধ হয়ে মুসলামানদেরকে বিভক্ত করার জন্য, তাদের ভূমিতে নিজেদের দখলদারিত্ব প্রতিষ্ঠার জন্য এবং পৃথিবীতে ইসলামের নেতৃত্ব মাথা তুলে না দাঁড়াতে দেয়ার জন্য ১৯২৪ সালে খিলাফত ব্যবস্থার পতন ঘটিয়েছে। এদেরই পূর্বপূরুষরা শতকের পর শতক ইসলাম ও মুসলমানদের নিশ্চি‎হ্ন করার জন্য ক্রুসেড পরিচালনা করেছে। ইসলামের আবির্ভাবকালে ইসলামবিরোধী যে শক্তিগুলো ছিলো, যথা- মক্কার কাফের নেতৃত্ব এবং তৎকালীন পরাশক্তি রোম ও পারস্য – বর্তমান যুগে সাম্রাজ্যবাদী কাফের রাষ্ট্রসমূহ হচ্ছে তাদেরই আরো শক্তিশালী ও সংঘবদ্ধ প্রতিরূপ। এসব কাফের শক্তি ও রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে প্রধান হচ্ছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, ভারত, ইসরাইল, রাশিয়া এবং ফ্রান্স।

এই সাম্রাজ্যবাদীরা বিশেষতঃ তাদের মোড়ল আমেরিকা ব্যাপক প্রচারাভিযান চালিয়ে যাচ্ছে যাতে শুধুমাত্র পুঁজিবাদকেই মুসলিম ভূমিসমূহের উপর চাপিয়ে দিতে পারে। তারা মুসলিম উম্মাহ’র পুনর্জাগরণ এবং খিলাফত রাষ্ট্রের অধীনে অন্যান্য জাতি থেকে স্বতন্ত্র্য একটি একক ঐক্যবদ্ধ জাতি হিসেবে বিশ্বমঞ্চে মুসলিমদের পুনরাবির্ভাবের ভয়ে ভীত। সাম্রাজ্যবাদীরা এই ভেবে আতংকিত যে বিশ্বের নেতৃত্বে মুসলিমরা হয়তো আবারো ফিরে আসবে এবং শুধু মুসলিম ভূমিগুলোতেই নয় বরং পুরো বিশ্বের উপরই তাদের বর্তমান প্রভাব ও স্বার্থের অবসান ঘটাবে। এই সত্যটি বুঝতে পেরে আমেরিকাসহ বাকী সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলো মুসলিম উম্মাহ’কে সুস্পষ্ট লক্ষ্য বানিয়ে পুঁজিবাদকে মুসলিম ভূমিগুলোতে প্রতিষ্ঠিত করার মিশনে নেমেছে। এর পাশাপাশি এই মিশনের আরো যা উদ্দেশ্য তা হলো, প্রাকৃতিক ও বিবিধ সম্পদে সমৃদ্ধ মুসলিম ভূমিগুলোর সম্পদ লাভে আমেরিকা ও অন্যান্য পুঁজিবাদী রাষ্ট্রগুলোর অন্তহীন লোভ ও উচ্চাভিলাষ, মুসলিম ভূমিগুলোর ভৌগোলিক অবস্থান ও কৌশলগত সুবিধাকে করায়ত্ত করা, মুসলিম রাষ্ট্রগুলোকে পুঁজিবাদী রাষ্ট্রগুলোর বিশাল মার্কেটে পরিণত করা এবং নিজেদের শিল্পকারখানা পরিচালনার জন্য মুসলিমদের বিশাল তেল সম্পদ ও অন্যান্য কাঁচামাল হস্তগত করা।

এসব সাম্র্রাজ্যবাদী কাফের রাষ্ট্রগুলো নিজেরা সরাসরি অথবা বিভিন্ন আন্তর্জাতিক জোট, অর্থনৈতিক ও সামরিক সংস্থাকে ব্যবহার করে সম্ভাব্য সকল উপায়ে পৃথিবীতে মুসলমানদের ক্রমাগত শক্তিহীন করার চেষ্টা করছে। একের পর এক তাদের ভূমিগুলোতে হানা দিচ্ছে, রক্তের বন্যা বইয়ে দিচ্ছে, তাদের সম্পদ লুটে নিয়ে যাচ্ছে। আর তাদের এ সকল কাজে তাদেরকে সাহায্য করে যাচ্ছে বর্তমান মুসলিম ভূমিগুলোতে তাদেরই বসানো তাঁবেদার শাসকবর্গ।

এসব জালেম শাসকগোষ্ঠী এবং তাদের বংশধরেরা যুগ যুগ ধরে যেমন সাম্রাজ্যবাদের উদ্দেশ্য বাস্তবায়নে তাদের ক্রীড়নক হয়ে কাজ করছে অন্যদিকে তারা নিজেদের মুসলিম জনগণকে সব ধরণের অধিকার বঞ্চিত করছে। মুসলিমদের সম্পদ বিদেশী দখলদারদের হাতে তুলে দিয়ে তাদের উপর শোষণ নির্যাতন চালিয়ে যাচ্ছে। তারা সাম্রাজ্যবাদীদের ক্রীড়নক হিসেবে মুসলিমদেরকে তাদের দ্বীন থেকে সরিয়ে পুঁজিবাদের দিকে ঠেলে দিচ্ছে; মুসলিমদের উপর কাফেরদের আধিপত্য বিস্তারের জন্য বিশ্ব জুড়ে মুসলিম রাষ্ট্রগুলোকে কাফেরদের অনুকূলে একের পর এক দাসত্বের চুক্তিতে আবদ্ধ করছে, মুসলিম উম্মাহ’কে দূর্বল ও ধ্বংস করার জন্য কাফেরদের সব চক্রান্ত বাস্তবায়ন করছে, এবং জনগণের মধ্যে মুখ বুঝে সয়ে নেয়া বা মেনে নেয়ার পরিবেশ সৃষ্টি করে যাচ্ছে যাতে করে কেউ মুখ খুলে সত্য উচ্চারণের সাহস না করে। এতসব বৈরী আচরণের একটাই উদ্দেশ্য আর তা হলো উম্মাহ’কে কুফর ও কাফেরদের কাছে মাথা নত করতে বাধ্য করা।

অতএব, খিলাফত প্রতিষ্ঠার আন্দোলনকারীদের জন্য সাম্রাজ্যবাদী কাফেরদের এবং তাদের তাঁবেদার শাসকদের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক সংগ্রাম করা অপরিহার্য যেন এর মাধ্যমে মুসলিম দেশগুলো থেকে সাম্রাজ্যবাদী কাফেরদের চিন্তাগত, সাংস্কৃতিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক এবং সামরিক ভিতগুলোর মূলোৎপাটন করা সম্ভব হয়।

এই আন্দোলনের নেতা ও কর্মীদেরকে সাম্রাজ্যবাদী শক্তি এবং তাদের দেশীয় রাষ্ট্রদূত বা কূটনৈতিক কতৃক সংলাপকে উৎসাহিত করা, রাজনৈতিক সংস্কার সাধন, সুশাসন ও গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা ইত্যাদির নামে মুসলিম দেশগুলোর আভ্যন্তরীন রাজনীতিতে যেকোন ধরণের হস্তক্ষেপের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে হবে। একই সাথে ভারত-মার্কিন-ইইউ-ইসরাইল তথা কোন শত্রু রাষ্ট্রের সাথে যখন কোন অযৌক্তিক বা মুসলমানদের স্বার্থবিরোধী চুক্তি সম্পাদিত হয় সেগুলো বাতিল করার জন্য রাজনৈতিক সংগ্রাম চালাতে হবে। ভারত-মার্কিন-ইইউ-ইসরাইল তথা কোন শত্রু রাষ্ট্রের সাথে কোন ধরনের সামরিক চুক্তি কিংবা ট্রানজিট ইত্যাদির বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে হবে। কেননা এসব হস্তক্ষেপ, চুক্তি বা সমঝোতার একটা মাত্র উদ্দেশ্য হচ্ছে আমাদেও দেশের উপর সাম্রাজ্যবাদী কাফেরদের প্রভাবকে প্রতিষ্ঠা করা এবং তা চালিয়ে যাওয়া অথচ আল্লাহ্‌ (সুবহানাহু ওয়া তা’আলা) স্পষ্টতই মুসলমানদেরকে এটা অনুমোদন করতে নিষেধ করেছেন এই বলে যে,

“আল্লাহ্‌ কখনোই মু’মিনদের বিরুদ্ধে কাফেরদের জন্য কোন পথ রাখবেন না।” [সূরা নিসা : ১৪১]

আন্দোলনকারীদেরকে এই সংগ্রামে দেশীয় অর্থনীতির উপর সম্রাজ্যবাদী কাফেরদের অর্থনৈতিক হস্তক্ষেপকে প্রত্যাখ্যানের জোরালো আহ্বান জানাতে হবে। তাদের মুক্তবাজার অর্থনীতির প্রত্যক্ষ প্রভাব রয়েছে মুসলিমদের উপর। মুক্তবাজার অর্থনীতি আমাদের নিজস্ব অর্থনীতিকে উৎপাদনমুখী অর্থনীতিতে পরিণত হতে বাধা দেয় বৃহৎ শিল্প স্থাপনে বাধা সৃষ্টি করে যার পরিপ্রেক্ষিতে সাম্রাজ্যবাদী ধনী রাষ্ট্রগুলো আমাদের দেশের উপর তাদের অর্থনৈতিক ও ব্যবসায়িক আধিপত্য বজায় রাখে, আমাদেরকে তাদের পণ্যের বাজারে পরিনত করে এবং পরিণামে মুসলিম জনগণ ও তাদের ভূমির উপর কাফেরদের নিয়ন্ত্রন প্রতিষ্ঠিত হয়।

মুসলমানদের অর্থনীতিতে সাম্রাজ্যবাদী প্রতিষ্ঠানসমূহের (যেমন আই.এম.এফ, ওয়ার্ল্ড ব্যাংক, এ.ডি.বি. ইত্যাদি) যে কোন ধরণের খবরদারী সম্পূর্ণরূপে বন্ধ করার জন্য শাসকদের বিরুদ্ধে আন্দোলন ও চাপ সৃষ্টি করতে হবে। সকল প্রকার অসম বাণিজ্য ও অর্থনৈতিক চুক্তি বাতিল করার জন্য শাসকদের বিরুদ্ধে জনগণকে সংগঠিত করে আন্দোলনে নামাতে হবে। একইভাবে মুসলমানদের জ্বালানী সম্পদ তেল-গ্যাস-কয়লা-ইউরেনিয়াম ও অন্যান্য খনিজ সম্পদ কখনোই বিদেশী কোম্পানীর হাতে তুলে দেয়া যাবেনা। রাসূলুলাহ্‌ (সা) ইরশাদ করেন, “তিনটি জিনিষের মাঝে সকল মানুষ শরীক। এগুলো হচ্ছে পানি, চারণ ভূমি এবং আগুন।” সুতরাং, জ্বালানী হচ্ছে গণমালিকানাধীন একটি সম্পদ এবং এ সম্পদ বিদেশীদের হাতে তুলে দেয়ার সকল ষড়যন্ত্র প্রতিহত করতে হবে। মোটকথা, আন্দোলনকে এমনভাবে সুসংগঠিত করতে হবে যেন সাম্রাজ্যবাদী এসব কোম্পানীকে এদেশ থেকে চিরতরে বের করে দেয়া যায় এবং আমাদের নিজেদের সম্পদের উপর নিজেদের পূর্ণ প্রতিষ্ঠিত হয়।

এভাবে খিলাফত প্রতিষ্ঠার আন্দোলনের অন্যতম কর্মসূচী হতে হবে জনগণকে সাম্রাজ্যবাদী কাফের শক্তির বিরুদ্ধে সচেতন করা ও তাদের বিরুদ্ধে ক্ষেপিয়ে তোলা এবং তাদের দেশীয় তাঁবেদার শাসকদের বিরুদ্ধে জনগণকে সংগঠিত করে গণআন্দোলন ও গণপ্রতিরোধের মাধ্যমে চূড়ান্তভাবে তাদেরকে অপসারণ করা। সেমিনার, লিফলেট, পোস্টার, বক্তৃতা, সমাবেশ, মিছিল, ইত্যাদি সম্ভাব্য সকল উপায়ে নিজ দেশের অভ্যন্তরে সাম্রাজ্যবাদীদের সব নতুন নতুন পরিকল্পনা ও চুক্তির মুখোশ উম্মোচন করে তা তুলে ধরতে হবে জনগণের সামনে, দেখিয়ে দিতে হবে কীভাবে অধিকার বঞ্চিত হচ্ছে তারা, কীভাবে তাদের ঈমান ও ইসলামের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র চলছে, কীভাবে তাদের উপর সাম্রাজ্যবাদীদের থাবা বিস্তার করছে ক্রমান্বয়ে। একই সাথে জনগণকে আহ্বান করতে হবে এসবের বিরুদ্ধে সোচ্চার হওয়ার, নিজেদের ভূমিতে তাঁবেদার শাসকদের প্রত্যাখ্যান করার, তাদের যে কোন দেশবিরোধী-গণবিরোধী-ইসলামবিরোধী সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে আন্দোলন করার।

যখন সাম্রাজ্যবাদীদের সকল ষড়যন্ত্র ও তাদের বসানো তাঁবেদার শাসকদেরকে জনগণ নিজেদের ও ইসলামের চরম শত্রু হিসেবে চিহ্নিত করতে পারবে এবং এদের বিরুদ্ধে বিক্ষুদ্ধ ও সংগঠিত হয়ে এদের কাছ থেকে মুক্তির পথ খুঁজবে তখনই সেই জনগণকে নিয়ে একটি গণ-আন্দোলন পরিচালনা করে খিলাফত রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার দিকে তাদের নিয়ে যেতে হবে। এই খিলাফত তাদেরকে জালেম শাসকদের হাত থেকে মুক্ত করবে, তাদের অধিকার ফিরিয়ে দেবে এবং একই সাথে ঐ শক্তিশালী খিলাফত রাষ্ট্র পৃথিবীতে ইসলাম ও মুসলামানদের চিরশত্রু সাম্রাজ্যবাদী কাফের রাষ্ট্র ও শক্তিগুলোর বিদায় ঘন্টা বাজাবে যাতে করে পৃথিবীতে ইসলামই একমাত্র বিজয়ী জীবনব্যবস্থা হিসেবে কতৃত্ব করতে পারে।

Print Friendly, PDF & Email

Leave a Reply