পরীক্ষায় সাফল্য অর্জন করাই কি সব?

বর্তমান সমাজে আমরা সব সময়ই পরীক্ষার সম্মুখীন এবং অনেক ছাত্ররা তাদের সমস্থ সময় ব্যয় করছে পরীক্ষায় ভালোভাবে পাশ করার জন্য। প্রাতিষ্ঠানিক চাপ, সমকক্ষদের চাপ ছাড়াও মা-বাবাদের পক্ষ থেকে থাকবে উৎসাহমূলক চাপ যাতে তাদের সন্তানরা অবসর সময়টাকেও পড়ালেখার পিছনে ব্যয় করে একটা ভাল ফলাফল করতে পারে। ভবিষ্যৎ ক্যারিয়ার গঠনের উপর খুব বেশী জোর দেয়া হয় যেন অন্য সব কিছুই তার কাছে গুরুত্বহীন হয়ে পড়ে।

পরীক্ষাগুলোর বাস্তবতা: পুঁজিবাদী সমাজ ব্যবস্থায় পরীক্ষা পাশটাকে প্রধান বিষয় হিসেবে জোর দেয়া হয়। ভাল ক্যারিয়ার অর্জনের মাধ্যমে এবং নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত থাকার মধ্যে দিয়ে বস্তুতান্ত্রিক মূল্যেবোধ খোঁজার মধ্যে এই ধরনের সাফল্যের একটা যোগসূত্র আছে। এই ধরনের জীবন ব্যবস্থায় প্রাথমিক উদ্দেশ্য হচ্ছে আনন্দ উপভোগ করা এবং কঠোর পরিশ্রমের মাধ্যমে অর্জিত এই আনন্দটাকে পুরুস্কার হিসেবে উপস্থাপন করা। খুব কম বয়সেই শিশুদেরকে পরীক্ষা প্রস্তুতির কঠোর পরিশ্রমের সম্মুখীন হতে হয়। পাঁচ বছর বয়স থেকে পনের বছর বয়স পর্যন্ত অনেকগুলো পরীক্ষার আয়োজন করা হয়। অল্প কিছু সিটের জন্য হাজার হাজার কচি শিশুদের স্কুলের ভর্তি পরীক্ষার জন্য অভিভাবকদের লাইনের পর লাইনে দাড়িয়ে থাকা আমাদের বর্তমান সমাজের একটি পরিচিত ও বিব্রতকর চিত্র। এছাড়াও বিভিন্ন সমাপনী পরীক্ষার পর তাকে পনের-ষোল বছর বয়সে মাধ্যমিক পরীক্ষায় পাশ করতে হয় এবং যদি সে আরও পড়াশুনা করতে চায় তাহলে তার জন্য অপেক্ষা করতে থাকে এ লেভেল এবং ডিগ্রি পরীক্ষা। খুব কম বয়সেই শিশুদের পরীক্ষার সম্মুখীন হওয়ার প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কিত একটি প্রশ্ন উত্থাপিত হয়েছে যা আমাদের সমাজে এখন একটি বিতর্কের বিষয়।

এই সম্পূর্ণ উদ্দেশ্যের পিছনে রয়েছে একটি পুঁজিবাদী সমাজ ব্যবস্থা যেখানে ব্যক্তিকেন্দ্রিকতাবাদের চর্চা করা হয় এবং যেখানে ব্যক্তিকে কঠিন পরিশ্রম করতে হয় বস্তুতান্ত্রিক মূল্যেবোধ ও ব্যক্তিকেন্দ্রিক সুযোগ সুবিধা খোঁজার জন্য। এই ধরনের ব্যবস্থা করা হয় একটি ভোগবাদী সমাজের জন্য যেখানে পুঁজিবাদীরা একটি লক্ষ্য মাত্রা অর্জন করতে পারে।

স্কুলে শিশুদের বিভিন্ন বিষয় সম্পর্কিত প্রশ্নের উত্তর শেখানো হয়, কিন্তু আমাদের জীবনের উদ্দেশ্য এবং আল্লাহর অস্তিত্ব সম্পর্কিত গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নগুলো এখনও পর্যন্ত উত্তরহীন এবং এসব বিষয়কে গুরুত্বহীন আলোচনা বলে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করা হচ্ছে। এটি নির্দেশ করে দ্বীনকে জীবন থেকে আলাদা করে ফেলার এবং একটি ধর্মরিপেক্ষ দৃষ্টিভঙ্গি যেখানে ব্যক্তি তার আকাঙ্খাকে সন্তুষ্ট করার জন্য স্বাধীনভাবে যে কোন কাজ করে থাকে। তাই ব্যক্তি এই দৃষ্টিভঙ্গিটাকে অনুমোদন করার মাধ্যমে ব্যক্তিকেন্দ্রিকতাবাদের দিকে ঝুঁকে এবং প্রাথমিক উদ্দেশ্য হিসেবে ব্যক্তিগত সুযোগ সুবিধা এবং আনন্দ উপভোগের অনুসন্ধান করে।

জীবনটা একটা পরীক্ষা: নিজের জীবনের পরীক্ষাই হচ্ছে জীবনের সবচেয়ে বড় পরীক্ষা। মানুষ হিসেবে আমদের অস্তিত্ব নিয়ে চিন্তা করতে হবে এবং আমদের অস্তিত্ব ও জীবনের উদ্দেশ্য সম্পর্কে নিজেদের প্রশ্ন করতে হবে। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’য়ালার অস্তিত্বের সাথে আমাদের জীবনের বাস্তবতা সন্দেহাতীতভাবে জড়িত এবং তাই ইসলাম বাণী হয়ে এসেছে সমস্থ মানবজাতির জন্য।

আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’য়ালা আল কুরআনে বলেন:

আমি জিন এবং মানুষকে সৃষ্টি করেছি শুধুমাত্র আমারই ইবাদত করার জন্য।” [৫১:৫৬]

যখন কোন একজন এটা গ্রহণ করবে যে, সর্বোত্তম কাজ হচ্ছে আল্লাহর দাসত্ব করা এবং তাকে সৃষ্টির উদ্দেশ্য হচ্ছে আল্লাহর ইবাদত করা তখন সে জীবনকে পরীক্ষা হিসেবে বিবেচনা করবে যেখানে ব্যর্থতা ও সফলতা নির্ভর করবে ইসলামের উপর। পরীক্ষা শুরু হবে যখন সে বয়ঃসন্ধিকালে উপনীত হবে এবং শেষ হবে যখন সে মরে যাবে। সে পাশ করেছে নাকি ফেল করেছে তার ফলাফল দেয়া হবে বিচার দিবসে। কৃতকার্যের ফল স্বরূপ তাকে দেয়া হবে জান্নাত এবং অকৃতকার্যের ফল স্বরূপ দেয়া হবে জাহান্নাম। হযরত মুহাম্মদ (সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম) আমাদের জন্য অনুসরণ করতে কুরআন এবং তার সুন্নাহকে রেখে গেছেন। আমরা যদি সেই আদেশ ও নিষেধগুলো মেনে চলি তাহলে ইহকালে এবং পরকালে সাফল্য অর্জন করতে পারব।

আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’য়ালার সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য প্রাণপণে চেষ্টা করাটা হতে হবে প্রত্যেক মুসলমানের জীবনের জন্য গুরুত্বপূর্ণ কাজ। ইসলাম নির্দেশ করে মানুষের জীবনের উদ্দেশ্যে হিসেবে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’য়ালার ইবাদত করার। এই ইবাদতের অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে জীবনে যোগ্যতা অর্জনের মাধ্যমে সাফল্য অর্জন করতে হয় এবং ইসলামী জীবন ব্যবস্থা অনুসারে ক্যারিয়ার খুঁজতে হয়। সভ্য নাগরিক হওয়ার জন্য নিজের যত্ন নেয়ার পাশাপাশি পরিবারের যত্ন নেয়াটা একটা কর্তব্য। একজন মুসলমান হিসেবে অন্য সব বাধ্যবাধকতাকে অবহেলা না করে এসব কর্তব্য অবশ্যই পালন করতে হবে। অনেক সময় দেখা যায় পিতামাতা সন্তানদেরকে ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার- এর মতো ভাল পেশা অর্জনের জন্য চাপ প্রয়োগ করে থাকে। কিন্তু জীবনের গুরুত্বপূর্ণ অংশ হিসেবে ইসলামকে ধরে রাখার মাধ্যমে আল্লাহর ইবাদত পরিপূর্ণভাবে করার ও ইসলামিক পরিচিতি রক্ষা করার গুরুত্ব অনুধাবন করতে তারা ব্যর্থ হয়।

যদি আমরা ইতিহাসের দিকে তাকাই, মুসলিমগণ ইসলামী শিক্ষার অধীনে অন্যদের চেয়ে অনেক ভাল করত। মুসলিমরা গণিতবিদ্যা, ভূ-বিদ্যা, আলোকবিদ্যা, জ্যোতির্বিদ্যা, চিকিৎসা বিজ্ঞান, পদার্থবিদ্যা, প্রকৃতি বিজ্ঞান, প্রকৌশল বিদ্যা ইত্যাদি আরোও বিভিন্ন ক্ষেত্রে অনেক এগিয়ে গিয়েছিল। তাই ভাল পড়ালেখা করে সাফল্যের সাথে কৃতকার্য হওয়া মুসলমানদের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ইসলাম আমাদের আল্লাহর সন্তুষ্টির অর্জনের মধ্যে দিয়ে অধ্যয়ণ করা ও পরীক্ষায় কৃতকার্য হওয়ার এবং ইসলামকে সমুন্নত রাখার সঠিক প্রেরণা যোগায়।

হযরত মুহম্মদ সাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম সমস্ত মুসলমানদের উপর জ্ঞান অর্জন ফরজ করেছেন, এবং এই জ্ঞান অর্জন করার জন্য যদি সাধনা করতে হয় তাহলে তা অর্জন করার ব্যাপারে সবসময়ে উৎসাহ দিয়েছেন। এসব আদেশ এবং ঐতিহ্যে অনুসরণ করে মুসলিম শাসকরা প্রত্যেক মুসলিম শিশুদের উপর বিদ্যা অর্জন করার গুরুত্ব আরোপ করেন এবং শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোকে এবং অন্যান্য শিক্ষার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ সমর্থন দিয়েছিলেন। আমাদের প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মদ (সা) সন্তানদের প্রতি যত্নবান হওয়ার ওপর জোর দিয়ে বলেছিলেন, একজন পিতা তার সন্তানকে যেসব শিক্ষা দিতে পারে সেগুলোর মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে উত্তম শিক্ষা এবং প্রশিক্ষণ।

শিক্ষিত জনগণের গুরুত্ব: একজন জ্ঞানহীন ব্যক্তি এমন একজনের মতো যে সম্পূর্ণ অন্ধকার পথে হাঁটে; যার কোন লক্ষ্য নেই যে সে কোথায় যাচ্ছে যার ফলে সে সহজে শয়তান দ্বারা প্রভাবিত হয়। এই ধরনের বড় বিপদ দেখা যায় কারণ ইসলামী শিক্ষার অভাব এবং কুরআন ও সুন্নাহর নির্দেশের প্রতি অসতর্কতা থাকার দরুণ। যদি কেউ আলোকিত জ্ঞান দ্বারা হেদায়েতপ্রাপ্ত হয় তাহলে সে তার জীবনের প্রত্যেক মুহূর্তে একটি সহজ সরল পথ খুঁজে নিতে পারবে। সে অবশ্যই কুফর এবং শিরককে চিহ্নিত করে এসব বিপদজনক রাস্তা পরিহার করতে পারবে, যা সেটা সহজে অতিক্রম করতে পারে। এই ধরনের জ্ঞানে দৃঢ় সংকল্প থাকা যায় যদি সে সত্যিকারের মুসলিম হিসেবে আচরণ করে এবং সহজ সরল পথে অবস্থান করে। তাই এটি একটি তুচ্ছ বিষয় নয় যা অবহেলা করা যায়। কেউ-ই ব্যবসা বাণিজ্য, পেশাগত এবং প্রাতিষ্ঠানিক সাফল্য অর্জনের লক্ষ্যে যা যা গুরুত্বপূর্ণ সেইসব প্রয়োজনীয় কাজগুলোকে অবহেলা করে না। তাহলে কেন ঐ জ্ঞান অর্জন করার জন্য অমনোযোগী হওয়া উচিত যার উপর নির্ভর করে আছে চূড়ান্ত পরীক্ষার সাফল্য। ইসলাম সবসময় শিক্ষা এবং জ্ঞান অন্বেষণের জন্য পরিবেশ সৃষ্টি করেছে এবং উৎসাহ যুগিয়েছে। প্রকৃতপক্ষে খিলাফত যখন প্রতিষ্ঠিত হবে ইনশাআল্লাহ তখন মুসলিম উম্মাহকে জ্ঞান ও শিক্ষায় শিক্ষিত করে তোলাই হবে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ যাতে অন্য রাষ্ট্রের সাথে প্রতিযোগিতার মাধ্যমে নেতৃত্ববান শক্তিশালী রাষ্ট্র হতে পারে। সুতরাং প্রত্যেককে দ্বীনি শিক্ষায় শিক্ষিত হওয়া এবং অন্যকে শিক্ষিত করে তোলার জন্য কঠোর পরিশ্রম করতে হবে যেন প্রত্যেকেই ইসলামের জন্য দাওয়াত বহন করতে পারে; যা একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ হিসেবে বিবেচিত।

আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’য়ালা আল কুরআনে আমাদের স্মরণ করিয়ে দিচ্ছেন:

বল, তোমাদের পিতা, তোমাদের সন্তান, তোমাদের ভ্রাতা, তোমাদের পত্নী, তোমাদের স্বগোষ্ঠী, তোমাদের অর্জিত সম্পদ, তোমাদের ব্যবসা-বাণিজ্য যার মন্দার পড়ার আশংকা কর ও তোমাদের বাসস্থান যা তোমরা ভালবাস, (এসব) তোমাদের নিকট যদি আল্লাহ, তাঁর রাসূল এবং আল্লাহর পথে জিহাদ করা অপেক্ষা অধিক প্রিয় হয় তবে অপেক্ষা কর আল্লাহর বিধান আসা পর্যন্ত। আর আল্লাহ পাপাচারী সম্প্রদায়কে সৎপথ প্রদর্শন করেন না। [তওবা:২৪]

Print Friendly, PDF & Email

Leave a Reply