[নিম্নোক্ত প্রবন্ধটি প্রখ্যাত ইসলামী চিন্তাবিদ ও গবেষক শাইখ তাকী উদ্দীন আন-নাবহানি (রাহিমাহুল্লাহ) কর্তৃক লিখিত ‘আদ-দাওলাতুল ইসলামীয়্যাহ’ (ইসলামী রাষ্ট্র) বইটির খসড়া অনুবাদ-এর একাংশ হতে নেয়া হয়েছে]
আল্লাহর রাসুল (সা)-এর নিকট ওহী নাযিলের শুরু থেকেই ইসলামের দাওয়াত মানুষের কাছে পরিচিত ছিল। মক্কার মানুষ প্রথম থেকেই জানতো যে, মুহাম্মদ (সা) মানুষকে এক নতুন দ্বীনের দিকে আহবান জানাচ্ছেন এবং বেশ কিছু সংখ্যক মানুষ ইসলামকে দ্বীন হিসাবে গ্রহন করেছে। তারা আরও জানতো যে, তিনি এসব মুসলিমদের সাথে একত্রে মিলিত হন, তাদের দেখাশোনা করেন এবং মুসলিমরা যে কুরাইশ সমাজের লোকচক্ষুর আড়ালে একত্রিত হয়ে নতুন দ্বীন শিক্ষা করে এটাও তারা জানতো।
মক্কার লোকেরা ইসলামি দাওয়াতের ব্যাপারে এবং যারা ইসলাম গ্রহন করছে তাদের ব্যাপারে সচেতন ছিল, কিন্তু তারা কখনো জানতে পারেনি কোথায় তারা মিলিত হয় এবং কারা মিলিত হয়। এজন্যই মুহাম্মদ (সা) যখন প্রকাশ্যে মক্কার মানুষকে নতুন এ দ্বীনের দিকে তাদের আহবান জানালেন তখন এটা তাদের কাছে আশ্চর্যজনক কোনও বিষয় ছিল না। মূলতঃ যেটা তাদেরকে বিস্মিত করেছিল সেটা হল মুসলিমদের নতুন একটি দল হিসাবে আত্মপ্রকাশ করা। মুসলিমদের এ নতুন দলটি আরও শক্তিশালী হয় যখন হামযাহ্ ইবন ‘আবদ আল মুত্তালিব এবং এর ধারাবাহিকতায় ‘উমর ইবন আল খাত্তাব ইসলাম ধর্ম গ্রহন করে। এরপর আলাহ কুরআনের নিম্নোক্ত আয়াতটি নাযিল করলেন,
“অতএব তোমাকে যে বিষয়ে আদেশ করা হয়েছে, তা প্রকাশ্যে ঘোষনা কর এবং মুশরিকদের থেকে মুখ ফিরিয়ে নাও। বিদ্রুপকারীদের বিরুদ্ধে আমিই তোমার জন্য যথেষ্ট। যারা আল্লাহর সাথে অন্য উপাস্য সাব্যস্ত করে। অতএব অতিসত্তর তারা জেনে নেবে।” [সুরা হিজরঃ ৯৪-৯৬]
আলাহর রাসুল (সা) আল্লাহর এ আদেশ যথাযথ ভাবে পালন করেন এবং তার দলকে সমস্ত মক্কারবাসীদের সাথে পরিচিত করান। তিনি তাঁর সাহাবীদের দুটি লাইনে সজ্জিত করেন, একদিকের নেতৃত্বে থাকেন ‘উমর ইবন আল খাত্তাব আর একদিকের নেতৃত্বে থাকেন হামযাহ্ ইবন ‘আবদ আল মুত্তালিব। এবং এ দলটি নিয়ে তিনি এমন ভাবে পথ চলতে থাকেন যা মক্কাবাসীদেরকে বিস্মিত করে। এভাবে তিনি তাঁর সাহাবীদের সঙ্গে করে কাবাঘর পরিভ্রমন করেন।
এটা ছিল এমন এক পর্যায় যখন মুহাম্মদ (সা) তাঁর সাহাবীদের সাথে গোপনীয়তা থেকে প্রকাশ্য দাওয়াতের দিকে অগ্রসর হন এবং ইসলাম গ্রহন করার মতো মনমানসিকতা সম্পন্ন লোকদের আহবানের পরিবর্তে সাধারন ভাবে সমাজের সমস্ত মানুষকে ইসলামের দিকে আহবান করেন। এ পর্যায়ে ইসলামি দাওয়াত এক নতুন দিকে মোড় নেয়, শুরু হয় সমাজে ঈমান আর কুফরের মধ্যে দ্বন্দ, ভ্রান্ত আর ঘুঁণে ধরা আদর্শ গুলোর সাথে সংঘর্ষ হতে থাকে সত্য আদর্শের। বস্তুতঃ এই সময় থেকেই শুরু হয় মুহাম্মদ (সা) এর দাওয়াতের দ্বিতীয় পর্যায়, যাকে বলা যায় প্রকাশ্য দাওয়াত আর সংঘাতের পর্যায়।
ইসলামের এ আহবানকে বাঁধাগ্রস্থ করার জন্য অবিশ্বাসী মুশরিকরা রাসুল (সা) এবং তাঁর সাহাবাদের উপর সর্বপ্রকার নির্যাতন এবং অত্যাচার শুরু করে। বস্তুতঃ এটা ছিল চরমতম কঠিন একটা সময়। রাসুল (সা) এর বাসগৃহে পাথর নিক্ষেপ করা হয় এবং আবু লাহাবের স্ত্রী উম্মু জামিল মুহাম্মদ (সা) এর গৃহের সামনে নানা নোংরা আর্বজনা নিক্ষেপ করে তাকে উক্ত্যক্ত করতে থাকে। তিনি (সা) এ সব কিছু নীরবে উপেক্ষা করেন এবং নিজহাতে সেগুলো পরিষ্কার করেন। একবার আবু জাহল তাঁর দিকে কাবার মূর্তিদের উদ্দেশ্যে বলিকৃত ছাগলের নাড়িভুড়ি নিক্ষেপ করে।
মুহাম্মদ (সা) এসব সহ তাঁর কন্যা ফাতিমার বাড়ীতে উপস্থিত হলে তাঁর কন্যা সেগুলো নিজহাতে পরিষ্কার করে দেন। এ সমস্ত অত্যাচার ও নির্যাতন মুহাম্মদ (সা)-কে প্রতিনিয়ত আরও শক্তিশালী করে তুলে এবং তিনি আরও দৃঢ় ভাবে দাওয়াতী কার্যক্রম চালিয়ে যেতে থাকেন।
ইসলাম গ্রহনকারী মুসলিমরাও হতে থাকে হুমকি আর নির্যাতনের সম্মূখীন। প্রতিটি গোত্রের লোকেরা তাদের স্বগোত্রীয় মুসলিমদের উপর অত্যাচার আর নির্যাতন শুরু করে। ইসলাম গ্রহন করার অপরাধে মক্কার এক মুশরিক তার দাস বিলাল (রা)-কে উত্তপ্ত বালির উপর শুইয়ে তার বুকের উপর পাথর চাপা দিয়ে রাখে। এতো নির্মম অত্যাচার সত্ত্বেও তিনি নিরবিচ্ছিন্নভাবে বলতে থাকেন, “আহাদ! আহাদ!”। বিলাল (রা) শুধু তার রবের জন্য অবলীলায় এ সমস্ত নির্মম অত্যাচার সহ্য করেন। আর একজন মহিলা ইসলাম ত্যাগ করে তার পূর্ব পুরুষের ধর্মে ফিরে যেতে অস্বীকার করায় তাকে নির্মম ভাবে অত্যাচার করে হত্যা করা হয়।
মুসলিমরা তাদের রবের সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যে অত্যাচার, নির্যাতন, উপহাস আর বঞ্চনার এ পর্যায় ধৈর্য আর সহিঞ্চুষতার সাথে অতিক্রম করে।