মানুষের মধ্যে জীবনী শক্তি আছে যা তাকে কাজের ক্ষেত্রে চালিত করে এবং তুষ্টি কামনা করে। এই জীবন শক্তির দুটি দিক রয়েছে: তাদের মধ্যে একটির অনিবার্য তুষ্টি প্রয়োজন, এবং এটি তুষ্ট না হলে মানুষ মারা যাবে। এটি জৈবিক চাহিদা, যেমন খাওয়া, পান করা এবং প্রকৃতির ডাকে সাড়া দেওয়া। দ্বিতীয়টিরও তুষ্টি প্রয়োজন, কিন্তু তা তুষ্ট না হওয়ার কারণে মানুষ মরে না, যদিও তা তুষ্ট না হওয়া পর্যন্ত সে তাড়িত থাকবে; আর এটি হল প্রবৃত্তি, যা স্বাভাবিক অনুভূতির মাধ্যমে ক্রিয়াশীল থাকে এবং উদগীরণের তুষ্টি অন্বেষন করে। যাইহোক, তাড়নাভেদে প্রবৃত্তি জৈবিক চাহিদার থেকে ভিন্ন। এর কারণ হল জৈবিক চাহিদা ভিতর থেকে তাড়িত হয়, আর প্রবৃত্তিকে তাড়িত করে কিংবা এর তুষ্টির প্রয়োজন অনুভূত হয় এমন চিন্তা অথবা ভৌত বাস্তবতা দ্বারা যা তুষ্টির জন্য আবেগকে উদ্দীপিত করে। প্রজনন প্রবৃত্তি (গারীজাত-আল-নাও’) উদাহরণস্বরূপ, একটি সুন্দর মেয়ের কথা বা যৌন সম্পর্কিত কিছু চিন্তা করে কিংবা একটি সুন্দরী মেয়েকে দেখে বা যৌন সম্পর্কিত কিছু দেখে উত্তেজিত হয়। যদি এরূপ কিছু না ঘটে থাকে, তাহলে প্রবৃত্তিকে উত্তেজিত করার মতো কিছুই ঘটবে না। একইভাবে ধার্মিকতার প্রবৃত্তি (গারীজাত আল-তাদাউয়্যুন) আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’আলার আয়াত, কেয়ামত বা এর সাথে সম্পর্কিত কিছু, আসমান ও জমিনে আল্লাহর নিখুঁত সৃষ্টি অথবা এর সাথে সম্পর্কিত কিছু সম্পর্কে চিন্তাভাবনা করে আন্দোলিত হয়। এভাবে, প্রবৃত্তির প্রভাব দেখা দেয় যখন এমন কিছু থাকে যা একে তাড়িত করে। যা একে তাড়িত করে তার অনুপস্থিতির ক্ষেত্রে, কিংবা যা একে উত্তেজিত করে সে বিষয়টি এমনভাবে ব্যাখ্যা করলে তথা যা ব্যক্তির প্রবৃত্তিকে উদ্দীপিত করে তার মূল বৈশিষ্ট্যের ধারণাটি হারিয়ে ফেললে আমরা এর প্রভাব আর দেখতে পাই না।
ধর্মীয় প্রবৃত্তি প্রাকৃতিক এবং অপরিবর্তনীয়, এটি স্রষ্টা ও পালনকর্তার প্রতি চাহিদার অনুভূতি থেকে আগত, তা সে স্রষ্টা ও পালনকর্তার ব্যাপারে ধারণা যা-ই হোক না কেন।
এই অনুভূতি মানুষ হিসাবে তার মধ্যে সহজাত, সে স্রষ্টার অস্তিত্বে বিশ্বাস করুক কিংবা তাকে অবিশ্বাস করুক, কিংবা সে বস্তু বা প্রকৃতিতে বিশ্বাস করুক। মানুষের মধ্যে এই অনুভূতির উপস্থিতি অনিবার্য, কারণ এটি একটি মানুষের মধ্যে তার সৃষ্টির অংশ হিসাবে সৃষ্ট; এবং তার থেকে একে আলাদা বা বিচ্ছিন্ন করা সম্ভব নয়। এটাই ধার্মিকতা।
এই ধার্মিকতার বহিঃপ্রকাশ হল স্রষ্টা ও পালনকর্তা বলে যাকে বিশ্বাস করা হয় কিংবা স্রষ্টা ও পালনকর্তাকে অবতার হিসেবে যার মধ্যে কল্পনা করা হয় তার প্রতি চুড়ান্ত ভক্তি প্রদর্শন (তাকদীস)। এই তাকদীস তার প্রকৃত রূপে আবির্ভূত হতে পারে, তখন একে বলা হয় উপাসনা (’ইবাদাহ)। এটি হতে পারে কোনো নিম্নতর রূপে প্রদর্শিত হতে পারে, যেমন শ্রদ্ধা ও বন্দনা।
তাকদীস হলো মানুষের অন্তরের চূড়ান্ত ভক্তির বহিঃপ্রকাশ। এটা ভীতি থেকে নয়, বরং ধার্মিকতা থেকে। কারণ ভয়ের প্রকাশ তাকদীস নয়, বরং চাটুকারি, সুরক্ষার রেহাইপ্রাপ্তি; এসব তাকদীস-এর বাস্তবতার বিরোধী। সুতরাং, তাকদীস ধার্মিকতার প্রকাশ, ভয়ের নয়। অতএব, ধার্মিকতা বেঁচে থাকার প্রবৃত্তি থেকে স্বাধীন একটি প্রবৃত্তি, আর ভয় হচ্ছে (বেঁচে থাকার প্রবৃত্তির) প্রকাশগুলোর মধ্যে একটি। এই কারণেই মানুষ ধার্মিক হয়, এবং আমরা তাকে কিছু না কিছু উপাসনা করতে দেখি যখন থেকে আল্লাহ তাকে পৃথিবীতে নিয়ে এসেছেন। সে সূর্য, গ্রহ, আগুন ও মূর্তি পূজা করেছে। সে আল্লাহর ইবাদতও করেছে। আমরা কোনো যুগে, কোনো জাতি বা সম্প্রদায়কে কোনো না কোনো কিছুর উপাসনা করা ছাড়া দেখি না। এমনকি জনগণ, যখন কর্তৃপক্ষ তাদের ধার্মিকতা ত্যাগ করতে বাধ্য করেছিল, তা তাদের উপর চাপিয়ে দেওয়া সত্ত্বেও তারা ধার্মিক ছিল এবং কিছু না কিছুর উপাসনা করেছে। ইবাদত-বন্দেগি করার প্রয়াসে তাদের অনেক দুর্ভোগের শিকার হতে হয়েছে। এমন কোন শক্তি নেই যা মানুষের কাছ থেকে ধার্মিকতাকে ছিনিয়ে নিতে পারে, তার থেকে সৃষ্টিকর্তার তাকদীস (তথা চুড়ান্ত ভক্তি প্রদর্শন) দূর করতে পারে এবং তাকে উপাসনা থেকে বিরত রাখতে পারে। এটি একটি সময়ের জন্য (বড়জোড়) দমন করতে পারবে। এর কারণ হল উপাসনা (’ইবাদাত) হল ধার্মিকতার একটি স্বাভাবিক প্রকাশ, যা মানুষের একটি স্বাভাবিক প্রবৃত্তি।
উপাসনার অনুপস্থিতি বা উপাসনাকে উপহাস করার যে বিষয়টি কিছু নাস্তিকদের মধ্যে দেখা যায়, এ ধরনের লোকেদের মধ্যে ধার্মিকতার প্রবৃত্তি আল্লাহর উপাসনা থেকে সৃষ্টির উপাসনার দিকে সরে গেছে। প্রকৃতি, বীরত্বপূর্ণ মহান বিষয়াদি এবং অনুরূপ ক্ষেত্রে তাদের তাকদীস (তথা চুড়ান্ত ভক্তি প্রদর্শন)-এর প্রকাশ ঘটেছে। এ উদ্দেশ্য সাধনের জন্য বিক্ষিপ্ততা, বিকৃতি এবং বিষয়াদির ভুল ব্যাখ্যাকে ব্যবহার করা হয়েছে।
অতএব, কুফর (কুফর) ঈমানের (বিশ্বাস) চেয়েও কঠিন, কারণ এটি মানুষকে তার সহজাত স্বভাব (ফিতরাহ) থেকে বিক্ষিপ্ত করে এবং এর প্রকৃত প্রকাশ থেকে সরিয়ে রাখে। এর জন্য অনেক বড় প্রচেষ্টা প্রয়োজন হয়। তার সহজাত প্রকৃতির (ফিতরাহ) জন্য যা প্রয়োজনীয় তা থেকে দূরে সরে যাওয়া মানুষের পক্ষে কতইনা কঠিন!
অতএব, আমরা দেখি নাস্তিকদের কাছে সত্য (হক্ক) প্রকাশ পেলে, এবং যখন তারা আল্লাহর অস্তিত্ব অনুভব করে অর্থাৎ বুদ্ধিবৃত্তিক চিন্তা দ্বারা যখন তাঁর অস্তিত্ব নিশ্চিতভাবে উপলব্ধি করে, দেখবেন তারা সাচ্ছন্দ্য ও প্রশান্তি সহকারে ঈমানের দিকে ছুটে যায়; এবং একটি ভারী দুঃস্বপ্ন যা তাদের বোঝা আকারে চেপে ছিল, তা অদৃশ্য হয়ে যায়। এ ধরনের লোকদের ঈমান শক্তিশালী এবং অবিচল হয়, কারণ তা সংবেদনশীলতা এবং নিশ্চিত হবার মাধ্যমে আসে। এর কারণ হল তাদের চিন্তা তাদের আবেগের সাথে সংযুক্ত থাকে, তাই তারা যখন নিশ্চিতভাবে আল্লাহর অস্তিত্ব উপলব্ধি করে, তাঁর অস্তিত্ব সম্পর্কে তাদের একটি অনুভূতি তৈরি হয়। এভাবে তাদের সহজাত প্রকৃতি (ফিতরাহ) তাদের চিন্তার সাথে মিলিত হয়, তাই শক্তিশালী ঈমান তৈরি হয়।
Taken from the book “Islamic Thought”