ইউরোপে সেকুলারিজমের উত্থান

পুঁজিবাদী রাষ্ট্রগুলো তাদের রাজনৈতিক ও সামাজিক মুল্যবোধ চাপিয়ে দিতে প্রতিনিয়ত ইসলাম ও মুসলিমদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র ও আঘাত করে  চলেছে। সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর আমেরিকার রাষ্ট্রদূতগণ একের পর এক সোভিয়েত নিয়ন্ত্রিত মুসলিম ভুমিগুলোতে সফর শুরু করে। তাদের উদ্দেশ্য ছিল মুসলিমদের ইসলামী জীবনাদর্শ দূরে রাখা এবং সেকুলার পুঁজিবাদী আদর্শ মুসলিমদের উপর চাপিয়ে দেওয়া। আমরা এই আর্টিকেলে ইউরোপে সেকুলার চিন্তার উত্থান নিয়ে আলোচনা করব। সেকুলার পুঁজিবাদী চিন্তা কত ঠুনকো, প্রতিক্রিয়াশীল এবং কোন স্বাভাবিক/বুদ্ধিবৃত্তিক চিন্তার ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত নয়; আমরা তা আলোকপাত করব।

সুদীর্ঘ সময় চার্চের জুলুম অত্যাচারের ফলে ১৮ শতকে ইউরোপের মানুষের মাঝে একধরনের চিন্তার বিপ্লব ঘটে। ফলে চার্চ সবক্ষেত্রে তার জুলুমে নিয়ন্ত্রিত রাজনৈতিক ও শাসন কর্তৃত্ব হারায়। এই উত্থান ছিল মুলতঃ চার্চের বিরুদ্ধে তৎকালীন বুদ্ধিজীবীদের দীর্ঘ সংগ্রামের ফল। তাদের এই উত্থান মানব, জীবন ও মহাবিশ্ব সম্পর্কে মানুষের পুর্ববর্তী দৃষ্টিভংগী পালটে দিতে থাকে। ইউরোপের জনগণ চার্চের চাপিয়ে দেওয়া সব নিয়মকানুনের বিরদ্ধে চলে যায়। দীর্ঘ সময় ধরে রাজতন্ত্র; চার্চ এবং খৃষ্টানধর্মকে জনগণের উপর জুলুমের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করার ফলে তৎকালীন চিন্তাবিদ ও দার্শনিকগণ এই প্রতিষ্ঠানগুলোর উপর পুরোপরি আস্থা হারিয়ে ফেলে। তারা এই প্রতিষ্ঠানগুলোকে সমাজ থেকে উচ্ছেদের সিদ্ধান্ত নেয়। পরবর্তিতে এই চিন্তাবিদগণ দুইভাগে বিভক্ত হয়ে পড়ে। তাদের একপক্ষ চার্চকে সম্পূর্ণভাবে বিলুপ্ত করার ডাক দেয় এবং অপরপক্ষ ধর্ম থেকে রাষ্ট্রকে পৃথক করার দাবি তুলে। যারা সম্পূর্ণরূপে চার্চকে বিলুপ্তির কথা বলে তাদের থেকে পরবর্তিতে কমিউনিজম এবং রাষ্ট্র থেকে ধর্মকে পৃথক করার পক্ষ থেকে সেকুলার পুজিবাদের উত্থান ঘটে। বর্তমানে তাদের  ধর্মনিরপেক্ষ/সেকুলার গণতন্ত্রের তল্পিবাহক রুপে আমরা দেখতে পাই। সেকুলারদের উত্থান সম্পর্কে জানতে মধ্যযুগের ইউরোপে চার্চের ভুমিকা ও ইতিহাস নিয়ে আমরা আলোকপাত করব।

চার্চের ভুমিকা:

তৃতীয় শতকে রোমান সাম্রাজের কর্তৃত্ব কমে আশার সাথে সাথে রাষ্ট্রীয় কর্মকান্ডে চার্চের ভুমিকা বৃদ্ধি পেতে থাকে। রাজা কন্সটানটিনের পর থেকে চার্চ এবং রাষ্ট্র সরকারীভাবে একীভুত হয়ে পড়ে। চার্চ এবং রাজতন্ত্রের এই জোটবদ্ধ মুহুর্ত থেকে ইউরোপীয় জনগণের উপর অবর্ণনীয় দুঃখ-দুর্দশা নেমে আসে। ৪৭৬ খ্রিস্টাব্দে ইউরোপের অভ্যন্তরে বিভক্তি শুরু হয় (internal divide and rule by church) ফলে নতুন নতুন দূর্বল সামন্ত রাজ্যের উত্থান ঘটে। সামন্ত রাজ্যগুলোর দূর্বলতার কারণে চার্চ আরো বেশি আধিপত্য বিস্তারের সুযোগ পায়।

খ্রিস্টান ধর্মে জনগণের কর্মকান্ড দেখাশুনা করার মত কোন পদ্ধতি নেই। রাষ্ট্র পরিচালনার ক্ষেত্রে চার্চ পুরোনো রোমান সাম্রাজ্যের নিয়মকানুনগুলো ধার করে নিয়ে আসে। চার্চ জ্ঞানের প্রচার এবং আইন-কানুন তৈরির উপর বিধিনিষেধ আরোপ করে। স্বাভাবিকভাবেই নতুন নতুন উত্থান ঘটা সামন্ত রাজাগণ তাদের রাজ্যগুলো পরিচালনার নিয়মকানুন ধারণ করার ক্ষেত্রে পুরোপুরি চার্চের উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ে।

শুরুর দিক পোপ রোমান সাম্রাজ্যের অল্প সল্প জায়গা শাসন করলেও সময়ের সাথে সাথে ইংল্যান্ড, সিসিলি ও জেরুজালেমের উপর চার্চ শাসন কতৃত্ব লাভ করে। ধীরে ধীরে চার্চ হয়ে উঠে ইউরোপের বুকে সবচেয়ে বড় কর্তৃত্বপরায়ণ সরকার; সে চাইলেই যেকোন সামন্ত রাজকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। একসময় চার্চের লোকাল কার্ডিনালরা (পাদ্রী) সামন্ত রাজাদের নিয়োগ দেওয়ার কর্তৃত্বও পেয়ে যায়, এমনকি সামন্ত রাজাদের নামকরণও হয়ে উঠে চার্চ প্রিন্স নামে। অন্যদিকে এইসব কার্ডিনালরা সরাসরি পোপ কর্তৃত্ব নিয়োগ প্রাপ্ত হত। চার্চ ইউরোপের ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দু পরিণত হয়। পোপ হয়ে উঠে শক্তির উৎস। পোপ চাইলে যেকোন বিশপদের নিয়োগ দিতে ও পাদ্রীদের নিয়ন্ত্রণ করতে পারত, লোকাল চার্চগুলোর উপর ট্যাক্স আরোপ করত এবং পোপ চাইলেই জীবনের সবক্ষেত্রে (আধ্যাত্মিক ও রাজনৈতিক) যেকোন নিয়মকানুন জারী করতে পারত। বিশ্বাস করা হত পোপের সাথে সরাসরি খোদার যোগাযোগ আছে। ধর্মের নামে ও  জান্নাতের ওয়াদা করে নির্দোষ জনগণকে শোষণ করা হত। ধীরে ধীরে চার্চ সকল সীমারেখা অতিক্রম করে বর্বরতা ও নিষ্ঠুরতার আধিপত্য বিস্তার করতে থাকে। ইতিহাসে যা নজীরবিহীন।

ধনী খৃষ্টানদের অর্থ-সম্পদের বিনিময়ে জান্নাতের চাবি বিক্রি ছিল চার্চের আয়ের অন্যতম প্রধান উৎস। ইউরোপের বেশিরভাগ উর্বর জমি ও সম্পদে চার্চগুলো পুঞ্জিভুত হতে থাকে। চার্চের ঘোষণার মাধ্যমে বিশাল সংখ্যক মুক্তবুদ্ধির নারীদের ডাইনী নাম দিয়ে অত্যাচার এবং হত্যা করা হয়। চার্চের নিয়মের বিরুদ্ধে যায় এমন কোন তত্ত্ব, কোন বিজ্ঞানী প্রচার করলে তাকে হত্যা করা হত। শত অত্যচার সত্বেও চার্চের জুলুম-নিপীড়নের ভয়ে কেউ প্রতিবাদের সাহস পেত না। চার্চ দ্বারা সংঘটিত নৃশংসতা বলে শেষ করা যাবে না। এই যুগটাকেই ইউরোপিয়ানরা মধ্যযুগ বা অন্ধকার যুগ নামে চিহ্নিত করে।

এভাবে ১৪শতকে অসন্তোষ দানা বাধার আগ পর্যন্ত চার্চের শাসন চলতে থাকে। এই যুগকে ইউরোপীয় ইতিহাসবিদ্গণ মধ্যযুগের শেষ সময় হিসেবে চিহ্নিত করে।

দ্যা গ্রেট খিলাফত রাষ্ট্রের হাতে বারবার ক্রুসেডে হারের ফল ছিল চার্চের বিরুদ্ধে ততকালীন ইউরোপীয় চিন্তাবিদের বিদ্রোহের অন্যতম প্রধান কারণ। অন্যদিকে খৃষ্টানধর্ম যেহেতু সমাজের সকল সমাধান দিতে অক্ষম ছিল, ফলে সামাজিক সমস্যাগুলো দিনদিন আরো বেশি বিপর্যয়কর হয়ে উঠে। এই সম্মিলিত কারণগুলোর ফলে ইউরোপের বুকে চার্চ এবং খৃষ্টানধর্মের পতন দেখা দিতে শুরু করে।

ত্রিশ বছরের যুদ্ধ:

১৬শতকে; ইউরোপে ধর্মতাত্ত্বিক (ধর্মের ভুমিকা কী হবে) বিতর্ক তীব্র হতে থাকে। এতে চার্চ দূর্বল হয়ে পড়ে। প্রত্যেক সামন্ত রাজ্য অন্য রাজ্যগুলো নিয়ন্ত্রণ নিতে চার্চকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা শুরু করে। ১৬১৮ খ্রিস্টাব্দে পুরো ইউরোপ পরস্পরের বিরুদ্ধে যুদ্ধ লিপ্ত হয়। এই যুদ্ধের তীব্রতা পূর্বে ঘটা যেকোন সামন্ত বিবাদকে ছাড়িয়ে যেতে থাকে। এই যুদ্ধে জার্মানী সহ পুরো ইউরোপ ধংসের ধারপ্রান্তে চলে যায়, শহরের পর শহর ও মিল-কারখানাগুলো ধংস হয়ে যায়। যুদ্ধের তীব্রতা, যুদ্ধের ফলে প্লেগ ও দুর্ভিক্ষের কারণে ইউরোপের এক তৃতীয়াংশ মানুষ মৃত্যু মুখে পতিত হয়। এমনকি স্পেন ও ফ্রান্সের মধ্যে ১৬৫৯ পর্যন্ত এই যুদ্ধ চলমান ছিল।

কম্প্রোমাইজ বা আপস:

যুদ্ধটি শেষের কোন লক্ষণ দেখা না যাওয়ায় ফলে চিন্তাবিদগণ আপোষের সিদ্ধান্ত নেয়। এই আপোষের ফল ছিল ধর্মকে রাষ্ট্রের সকল কর্মকান্ড থেকে আলাদা করে ফেলা। প্রোটেন্সটেন্ট সংস্কারবাদী মার্টিন লুথার ও ক্যালভিন; চার্চের রাজনীতি করাকে লজ্জার বলে ঘোষনা দেয়। তারা আরো বলেন; খৃষ্টানদের প্রধান দ্বায়িত্ব হচ্ছে কর্তৃত্বশীলদের আনুগত্য করা। তারা এই ক্ষেত্রে ধুর্ততা অবলম্বন করে। ফলে সবচেয়ে বড় যে প্রশ্নের জন্ম দেয়; কার শাসন করা উচিত? মানুষের না খোদার? এবং এই প্রশ্নের উত্তর ছাড়াই অপ্রাসঙ্গিক ভাবেই কোন চিন্তা-ভাবনাহীন সম্পূর্ণ নতুন একটি মতাদর্শের জন্ম হয়।

গ্রীক দর্শনের আবির্ভাব:

পশ্চিমা চিন্তাশূন্য সিদ্ধান্তহীন এই অবস্থান থেকে চার্চকে মানুষের জীবন থেকে অপসারণ করা হয়। তৎকালীন চিন্তাবিদগণ অন্যকোন উৎসের সন্ধান না করে হাজার বছরের পুরোনো গ্রীক দর্শন থেকে এই সমস্যার সমাধানের পদক্ষেপ নেয় (প্রকৃত সত্য ইসলামকে তারা বর্জন করে)। পর্বরতীতে এই সব চিন্তাবিদগণ দুটি পক্ষে বিভক্ত হয়ে পড়ে। একপক্ষ প্রকৃতিবাদকে ধারণ করে এবং মানুষই সব সমস্যার সমাধান দিতে পারে বলে দাবি করে, অপরপক্ষ যারা চার্চের পক্ষে অবস্থান নেয় তারা বাস্তববাদীতাকে ধারণ করে এবং সৃষ্টকর্তাকে বর্জনে অক্ষমতা প্রকাশ করে। ফলে সংশয়পূর্ণ সেকুলার চিন্তার উদ্ভব ঘটে।

ধর্মকে রাষ্ট্র থেকে সম্পূর্ণভাবে বিলুপ্ত করা বা ধর্মকে রাষ্ট্র থেকে পৃথক করার চিন্তা নিয়ে এই সমাজ আগাতে থাকে। মানুষের জীবনের সাথে মহাবিশ্বের সম্পর্কটিও অস্বচ্ছ ও গুরুত্বহীন হয়ে পড়ে। এই অস্বচ্ছ অবস্থায় ইউরোপে নতুন নতুন দার্শনিকদের উন্মেষ ঘটে। জীবনের উদ্দেশ্য ও গুরুত্ব নিয়ে দার্শনিকগণ নতুন নতুন তত্ত্ব নিয়ে হাযির হন। তাদের মধ্যে ফ্রান্সের দার্শনিক রেনে ডেকার্তে অভিমত দেয় যে; “জনগণের ভিন্নতার ভিত্তিতে বাস্তবতাও ভিন্ন হতে পারে। সৃষ্টিকর্তার ধারণা সম্পূর্ণরুপে ব্যাক্তির নিজস্ব চিন্তা চেতনার উপর ছেড়ে দেওয়া উত্তম।” এই চিন্তার ফলে সৃষ্টিকর্তার বিশ্বাসকে ব্যক্তি স্বাধীনতার উপর ছেড়ে দেওয়া হয়। দার্শনিক ইমানুয়েল কান্ট দাবি করেন; “মানুষের মন হচ্ছে বস্তুর অস্তিত্বের কারণ, আর বস্তুর ভোগই ইন্দ্রীয় সুখ।”

পুঁজিবাদের প্রাথমিক লক্ষণ:

মধ্যযুগীয় চার্চের শাসক কর্তৃত্ব শেষ হওয়ার সাথে সাথেই সেকুলারিজমের ভিত্তিতে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান গুলো প্রতিষ্ঠা হয় এবং ইউরোপে পুঁজিবাদী নতুন আদর্শের উত্থান ঘটে। রাষ্ট্রগুলো শুধুমাত্র তাদের নাগরিকদের কথা চিন্তা শুরু করে। বর্ণ এবং নিজস্ব জাতিগত অবস্থা, ভৌগলিকভাবে আলাদা হওয়া, নিজস্ব প্রতিষ্ঠান ও ভিন্নতার কারণে তারা একে অপর থেকে শ্রেষ্ঠ ও নিখুঁত জাতি দাবি করা শুরু করে। নিজ নিজ স্বাধীনতা রক্ষায় তারা সচেতন হয়। এমনকি ১৪শতকে জার্মান প্রকাশকগণ তাদের রাজাদের শাসন করার পারদর্শিতা উপস্থাপন করে দাবি করে, তারা জাতি হিসেবে বীরত্বপূর্ণ এবং জার্মানরা অন্য জাতিদের শাসন করার অধিকার রাখে। রাইন নদীর তীর নিয়ন্ত্রণ ও ফরাসী জনগণের বানিজ্য করার অধিকার পাওয়ার কারণে ফরাসী জনগণ জনপ্রিয়তা পায় ফলে তারাও শ্রেষ্ঠত্বের দাবি শুরু করে। ব্রিটেনও কম যায়না; চিন্তাবিদ জন ফরটেস এর মতে ব্রিটেনের সংবিধান ও আইন অন্যদের থেকে শ্রেষ্ঠ। মুলতঃ ইউরোপীয়রা এরিসটটলের পার্টিকুলারিজম (নিজেদের কমন স্বার্থকেন্দ্রিক) চিন্তা ধারণ করার কারণে তাদের মধ্যে জাতিয়তাবাদের প্রবণতার উদ্ভব ঘটে।

রাজতন্ত্রের উপর চার্চ সম্পূর্ণরুপে আধিপত্য হারায়, উলটো জনগণকে নিয়ন্ত্রণে সেকুলার রাষ্ট্রগুলো চার্চকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা শুরু করে। পুঁজিবাদের আসফালনের ফলে, সেকুলার রাষ্ট্র ও আইন কানুনের সাথে তাল মিলিয়ে চলা ছাড়া চার্চের আর কোন গতি ছিল না। যার নজির আমরা চার্চের ঘোষণার মাধ্যমে দেখতে পাই; চার্চ বলে যার সেকুলার রাষ্ট্রে সততা ও বিশ্বসতার সাথে জীবন যাপন করবে তারা সৃষ্টিকর্তার সামনে ধার্মিক হিসেবে থাকবে। তাছাড়া প্রতিনিয়ত চার্চকে সংশোধন  করে সেকুলার রাষ্ট্রের সাথে খাপ খাইয়ে নেওয়ার প্রচেষ্টা অব্যহত আছে।

পুঁজিবাদের রাজনৈতিক চিন্তা:

ইতালীর পৌত্তলিক মেকিয়্যভেলি তার The discourses on the First Ten Books of Livy এবং The Prince এই দুটি বিখ্যাত বইয়ের মাধ্যমে আধুনিক পুঁজিবাদের চিন্তা ধারা প্রতিষ্ঠা করে।

ম্যাকেয়াভেলির মতে রাজনীতি সম্পূর্ণ একটি সেকুলার কর্মকান্ড। তার মতে রাজনীতি মানুষের ক্ষমতা দখলের প্রচেষ্টা মাত্র। ম্যাকিয়াভেলির মতে মানুষ প্রকৃতপক্ষে বর্বর, স্বার্থপর কেন্দ্রিক রাজনীতি সবার মধ্যে বিরাজমান। তার মতে সফল শাসক জনগণকে জানার চেষ্টা করে; তার প্রতিদ্বন্দ্বীদের সবসময় পর্যবেক্ষণে রাখে এবং দূর্বলদের শোষণের চেষ্টা করে।

বর্তমান পুঁজিবাদী সমাজে রাজনীতিবিদরা হুবহু ম্যাকিয়াভেলীর আদর্শকে ধারণ করে রাজনীতি করে। একজন আর্টিস্ট শুধুমাত্র শিল্পের কারণে আর্ট করে, যা জনগণের কোন বিষয়ের সাথে সম্পর্কিত নয়। লেখকরা সমাজের ভালোর জন্য না লিখে, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা জন্য লিখে। খাচায় বন্দি বুদ্ধিজীবীরা সমাধান না দিয়ে শুধুমাত্র প্রতিশ্রুতি দেয়। পুঁজিবাদী এই সমাজে সরকারগুলোর ১% ধনীদের স্বার্থ হাসিলের উপকরণ হিসেবে ব্যবহার হয়, এই সমাজের মানুষগুলো পরিবার ও সমাজকে বাদ দিয়ে শুধুমাত্র নিজের জন্য বাঁচে।

পরবর্তীতে ১৭৯০ সালে ফরাসী বিপ্লবের মাধ্যমে রাজতন্ত্রের পতন ঘটে এবং বর্তমান পার্লামেন্টারী পদ্ধতিকে তারা গ্রহণ করে। আমেরিকা সহ সব ইউরোপীয় দেশগুলো এই রেভুলেশন দ্বারা প্রভাবিত হয়। নেপোলিয়ানের শাসনের পর থেকে, ফ্রান্সসহ পশ্চিমা দেশগুলো সারা বিশ্বে পুঁজিবাদকে বহন করে চলেছে। অর্থনৈতিক শোষণের উদ্দেশ্যে উপনিবেশ স্থাপন করাই পুঁজিবাদের উদ্দেশ্য। বর্তমানে তারা কলোনী স্থাপন পদ্ধতিতে একটু পরিবর্তন করে পুঁজিবাদকে আরো কার্যকারীভাবে বাস্তবায়ন করে চলেছে।

বর্তমান ইউরোপ চার্চ দ্বারা নিয়ন্ত্রিত নয়। করপোরেট কোম্পানী ও ব্যাংকগুলো চার্চের স্থান দখল করেছে মাত্র। এটাই সেই পুঁজিবাদ যার দিকে পশ্চিমারা সারা বিশ্ব ও মুসলিমদের ডাকছে। বর্তমান বিশ্বও আগের মতই আরেকটি দ্বন্দ্ব শুরুর দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে। আমরা আশা করি তারা নতুন কোন কম্প্রোমাইজের দিকে না গিয়ে তাঁদের চিন্তা শক্তিকে ব্যবহার করবে। আমরা মুসলিমরা এই সেকুলার পুঁজিবাদী জাহেলিয়াতকে সম্পূর্ণভাবে বর্জন করেছি। আমরা মানবজাতির জন্য আল্লাহ প্রদত্ত জীবন ব্যবস্থা ইসলামকে ধারণ করি। আল্লাহর দ্বীনের জন্য কাজ করি। যেন আল্লাহর দ্বীন বাস্তবায়নের মাধ্যমে সারা বিশ্ব প্রকৃত হকের দিকে ফিরে আসে।

উৎস: আর-রায়া ম্যাগাজিন, এপ্রিল ১৯৯৪

Print Friendly, PDF & Email

Leave a Reply