নারী কিসে আটকায়?

খবর:

সম্প্রতি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ট্রেন্ডিং বা আলোচনায় আছে যে বিষয়টি তা হলো, নারী কিসে আটকায়। কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টইন ট্রুডো ও তাঁর স্ত্রী সোভি গ্রেগয়ের ট্রুডোর আলাদা থাকার ঘোষণার পরই আলোচনাটির সূত্রপাত। এর জের হিসেবে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বইতে শুরু করে মিম, ট্রল আর পোস্ট–পাল্টা পোস্টের ঝড়। এর মধ্যে একটি পোস্টের বক্তব্য ছিল এমন, ‘জাস্টিন ট্রুডোর ক্ষমতা, বিল গেটসের টাকা, হাকিমির জনপ্রিয়তা হুমায়ুন ফরিদীর ভালোবাসা, তাহসানের কণ্ঠ কিংবা হৃত্বিক রোশানের স্মার্টনেস। কোনো কিছুই নারীকে আটকাতে পারে নাই, বলতে পারবেন নারী কিসে আটকায়?’ (https://www.prothomalo.com/onnoalo/treatise/f8o1qkyren

মন্তব্য:

“বিবাহবন্ধন” শব্দটি আমাদের বর্তমান সেক্যুলার সমাজে সত্যিকার অর্থেই ‘বন্ধন’ বা ‘handcuff’ এর চেয়ে অতিরিক্ত কোন তাৎপর্য বহন করছেনা। বিয়ে বর্তমানে নারী-পুরুষ উভয়ের কাছে শৃংখলার নামান্তর। ‘নারী কিসে আটকায়’ ট্রেন্ডিং এর বিপরীতে প্রথম আলোর ‘পুরুষ যেখানে আটকায়’ শীর্ষক প্রতিবেদনও আছে যেখানে বলা হচ্ছে, “আফসোস! কেউ বলছে না, পুরুষ কিসে আটকায়? কিন্তু যে কথাটা সবাই জানে এবং মানে, কিন্তু বলে না; সেটি হলো সম্পর্কের ফাটকে দীর্ঘমেয়াদে সে আটকা থাকে বটে; কিন্তু সেই থাকায় তার সায় থাকে না” অর্থাৎ, নারী ও পুরুষ উভয়েই হতাশ যে বিয়ের পর তারা পারিবারিক দ্বায়িত্ববোধের কাছে আটকা পড়ে যাচ্ছে, বৈবাহিক সম্পর্ক প্রশান্তির বদলে হয়ে যাচ্ছে এক শৃংখলাবৃত কয়েদখানা।

একটি স্বাভাবিক দৃষ্টিকোণ থেকে আমরা যদি দেখি, মানুষ হিসেবে আমাদের সহজাত প্রবৃত্তি হচ্ছে আমরা সঙ্গী খুঁজি, বংশবৃদ্ধি করতে চাই; স্বামী/স্ত্রী-সন্তানসন্ততি নিয়ে পরিবার গঠন করতে চাই। এই পরিবার গঠনের মাধ্যমে একদিকে আমাদের যেমন প্রজনন প্রবৃত্তি পূরণ হয়, তেমনি একে অপরের প্রতি ভালোবাসা, নির্ভরশীলতা ও দায়দায়িত্বও তৈরি হয়। একসাথে থাকতে গেলে স্বাভাবিকভাবেই অনেক সময় সুবিধা-অসুবিধা, পছন্দ-অপছন্দ কিংবা মতের অমিল হয়, যার যার নিজের জায়গা থেকে কিছু বিষয় ছাড় দিতে হয়। এটা যেকোনো পরিবারের মধ্যকার স্বাভাবিক একটা বিষয়। কিন্তু বর্তমান ধর্মনিরপেক্ষ ব্যবস্থার অন্যতম স্তম্ভ ‘ব্যক্তি স্বাধীনতা’ মানুষকে শেখায়, ‘প্রত্যেক ব্যক্তিই নাকি চায় তার নিজের মত করে জীবন কাটাতে, সমস্ত সিদ্ধান্ত নিজের মত করে, নিজের ইচ্ছায় নিতে’। নারী-পুরুষের সম্পর্কের উদ্দেশ্যকে এখানে শুধুমাত্র যৌন চাহিদা পূরণকে কেন্দ্র করে আবর্তিত করা হয়েছে। যার ফলস্বরূপ, বিবাহ-পরবর্তী পারিবারিক প্রত্যাশা বা দায়িত্ব নারী-পুরুষ উভয়ের কাছে স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ মনে হতে থাকে। ব্যক্তিস্বাধীনতার এই চিন্তা থেকে সংসারের, সঙ্গীর কিংবা সন্তানের প্রয়োজনে নিজের পছন্দ-অপছন্দ, চাকরি, বেড়ানো এমনকি শপিং এর মত ছোটখাট বিষয়ে ছাড় দেওয়া, একে অপরকে প্রাধান্য দেওয়া, দোষত্রুটি ক্ষমা করা, পরিবারের কল্যানে শ্রম দেওয়া ইত্যাদি স্বাভাবিক বিষয়গুলোও কঠিন হয়ে যায়। সর্বক্ষণ কি পেলাম, কি দিলাম এর হিসাব নিকাশ চলতে থাকে। নিজের মত করে জীবন কাটানোর ব্যক্তি-স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষা এবং পারিবারিক দায়িত্ববোধ – এই দুই বিষয়ে তখন দ্বৈরথ তৈরি হয়। তাছাড়া, সৃষ্টিকর্তা বিবর্জিত ধর্মনিরপেক্ষবাদ যখন সমাজের ভিত্তি অর্থাৎ আখিরাতের সাথে জীবনের কোন সম্পর্ক নাই, তখন ছোটবড় এই স্যাক্রিফাইসগুলো মানুষের জীবনে বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়ায়। কেননা, এর বিনিময়ে আল্লাহ্‌’র কাছ থেকে উত্তম কোন প্রতিদান পাওয়ার ব্যাপারে সে ভরসা খুঁজে পায় না। কোনকিছু নিজের পছন্দমত না হলে নিজেকে সে সবসময় বঞ্চিত মনে করে। এভাবে অনেক ‘না পাওয়া’ বা ‘করতে না পারা’র বাধা যখন পুঞ্জিভূত হয়ে বড় আকার ধারণ করে, ব্যক্তি তখন সম্পর্কের ব্যাপারে শ্বাসরুদ্ধ বা শৃঙ্খলিত বোধ করে, পারস্পরিক দ্বন্দ্ব বৃদ্ধি পায় এবং একপর্যায়ে সে সম্পর্ক থেকে মুক্তি পেতে চায়। যার কারণে আমরা দেখি, ব্যক্তিস্বাধীনতার ধারণার কর্ণধার ফ্রান্সে বিবাহবিচ্ছেদের হার ৫৫ শতাংশ। মার্কিন ডিভোর্স‌ এটর্নি স্কট স্ট্যাডলারের মতে, যুক্তরাষ্ট্রের বিবাহিত দম্পতিদের মধ্যে প্রথম বিবাহে ডিভোর্সের হার ৫০ শতাংশ এবং দ্বিতীয় বিয়েতে ৬৭ শতাংশ এবং তৃতীয় বিয়েতে সেটা ৭৩ শতাংশে গিয়ে ঠেকছে। আমাদের দেশেও গত এক বছরে ডিভোর্সের হার বেড়ে গেছে দ্বিগুন। ঢাকা শহরে প্রতি ৪০ মিনিটে একটা করে ডিভোর্স হচ্ছে। তাদের এই দূষিত চিন্তা গ্রহণ করার ফলে তাদের মতই আমাদের পরিবারব্যবস্থা এবং গোটা সমাজব্যবস্থায় ভাঙ্গন ধরতে শুরু করেছে।

অথচ, একটি তাক্বওয়াভিত্তিক সমাজে ব্যক্তিস্বাধীনতা বা মানুষের নিজেদের খেয়ালখুশি দিয়ে পরিচালিত হবার সুযোগ নেই। কারণ, মুসলিম মাত্রই সে আল্লাহ্‌’র দাস এবং আল্লাহ্‌’র আদেশ-নিষেধের কাছে আত্মসমর্পনকারী। মহান আল্লাহ্‌’র আদেশ মেনে নারী ও পুরুষ বিয়ে করে, যার উদ্দেশ্য শুধুমাত্র যৌন চাহিদা পূরণ নয়, বরং দায়িত্বশীলতার মাধ্যমে পরিবার গঠন ও এর যত্ন করা। আল্লাহ্‌’র সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে তারা তখন একে-অপরের যত্ন নেয়, ছাড় দেয়, ভুল-ত্রুটি ক্ষমা করে, কিছু অপ্রাপ্তি থাকলেও আখিরাতের কথা ভেবে বিচলিত হয়না এবং এভাবেই স্বেচ্ছাচারিতার বদলে একটি সুস্থ সুন্দর দায়িত্বশীল পরিবার তথা সমাজব্যবস্থা গড়ে উঠে। আল্লাহ্‌ সুবহানাহু ওয়া তা‘আলা পবিত্র কুরআনে বলেন, “তোমরা তোমাদের সঙ্গীদের সাথে সদ্ভাবে জীবন-যাপন কর। অতঃপর, যদি তাদেরকে অপছন্দ কর, তবে হয়ত তোমরা এমন এক জিনিসকে অপছন্দ করছ, যেখানে আল্লাহ্‌ তোমাদের জন্য অনেক কল্যাণ রেখেছেন” (সুরা আন-নিসা, আয়াত ১৯)। সুতরাং, বিশ্বব্যাপী ধর্মনিরপেক্ষ মতবাদের ভিত্তিতে গড়ে উঠা সমাজগুলোতে পরিবার ভাংগনের যে সামাজিক মহামারী চলছে, তার প্রতিষেধক রয়েছে কেবলমাত্র আল্লাহ্‌’র দেয়া জীবনব্যবস্থায়। সচেতন মুসলিম হিসেবে আমাদের উচিত নিজেদের আক্বীদার প্রতি আত্মবিশ্বাস রাখা এবং ইসলাম প্রদত্ত ভারসাম্যপূর্ণ সামাজিক ব্যবস্থার পরিপূর্ণ বাস্তবায়নের ডাক সমাজের সর্বত্র পৌঁছে দেওয়া। পরিবার ও সমাজ ব্যবস্থা গঠনে ইসলামের নেতৃত্ব আজ শুধু মুসলিমদেরই প্রয়োজন নয়, বরং পুরো মানবজাতির একমাত্র বিকল্প। 

 –    যায়নাব মায়সূরা 

Leave a Reply