করোনা, ব্যর্থ সেকুলার রাষ্ট্রব্যবস্থাপনা এবং এর প্রকৃত সমাধান

করোনা মহামারিতে লক ডাউনে কার্যত স্থবির একটা বাস্তবতায় আপনাদের সাথে কিছু প্রয়োজনীয় আলাপ নিয়ে উপস্থিত হয়েছি। করোনা ভাইরাস যাতে বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে পরতে না পারে তার জন্য ২৬শে মার্চ থেকে ২৫শে এপ্রিল পর্যন্ত সাধারণ ছুটি ঘোষনা করেছে সরকার। স্বাস্থ্য অদিদপ্তরের ভাষ্য মতে এখন পর্যন্ত দেশের অন্তত ১৯টি জেলা কার্যত লক ডাউন রয়েছে আর আংশিক লক ডাউন অবস্থায় রয়েছে ১৬টি জেলা। এখন প্রশ্ন হল একটার পর একটা জেলা লক ডাউনে যাওয়ার প্রেক্ষাপট কি?

চীনের উহানে কোভিড-১৯ এর প্রাদূর্ভাব দেখা দেওয়ার পর যখন দক্ষিন কোরিয়া যখন করোনা মোকাবেলায় সর্বাত্মক প্রস্তুতি গ্রহণ করছে তখন বাংলাদেশ সরকারের ফোকাস পয়েন্ট ছিল মুজিববর্ষ উদযাপন। আর করোনা মোকাবেলায় এইটাই সরকারের দায়িত্বহীনতার প্রথম দৃষ্টান্ত।

আমরা জানি, এই ভাইরাস মানুষ থেকে মানুষে ছড়াচ্ছে আর এর উৎপত্তিস্থল নারায়নগঞ্জ বা চুয়াডাঙা, গাইবান্ধা জেলা না। করোনা প্রকোপকালে আক্রান্ত দেশগুলো থেকে যে লক্ষাধিক কর্মজীবি মানুষ দেশে এসেছেন তাদের করোনা টেস্ট এবং আইসোলশনে নিশ্চিত করা গেলে আজকের এই মানবিক বিপর্যয়ের প্রেক্ষাপট তৈরী হতোনা। চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষায় বললে “ফইল্লে বান কাডি দিইয়ে, ফরে বালতি দিয়েরে ফানি হেছের” অর্থ্যাৎ ফসলের মাঠে বাধ কেটে খালের পানি প্রবেশের সুযোগ দিয়ে এখন বালতি দিয়ে পানি সরানো হচ্ছে। সরকার এর ‘No Test, No Corona’ নীতি বাস্তবায়ন করে যাচ্ছে IEDCR। নির্বাচন নিয়ে নির্বাচন কমিশনের ভূমিকা আর করোনা টেস্ট নিয়ে IEDCR এর ভূমিকা একই রকম। নিয়মিত আপনারা যারা পত্রিকা পড়ছেন আপনারা জানতে পারছেন কিভাবে খোদ ঢাকা শহরেই করোনা টেস্ট নিয়ে জনগণকে দূর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে। প্রতিদিন করোনার উপসর্গ জ্বর, সর্দি, কাশি, শ্বাসকষ্ট নিয়ে দেশের বিভিন্ন জেলায় মানুষ মারা যাচ্ছে।

পুঁজিবাদী রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশ স্বাস্থ্য খাতে ব্যক্তি মালিকানাকে উৎসাহিত করেছে এবং সরকারী হাসপাতালের সক্ষমতাকে দূর্বল করেছে, যার ফলাফলে চিকিৎসা একটা ব্যয়বহুল বিষয়ে পরিনত হয়েছে এবং বিপুল সংখ্যক মানুষ সুলভে চিকিৎসা সেবা থেকে বঞ্চিত। এমনকি এই করোনা দূর্যোগের সময়েও ঢাকা থেকে শুরু করে উপজেলা সদর পর্যন্ত করোনা চিকিৎসার জন্য হাসপাতালকে প্রস্তুত রাখার ক্ষেত্রে সরকারের ব্যাপক ব্যর্থতা পরিলক্ষিত হচ্ছে। পিপিই, আইসোলেশন শয্যা, আইসিইউ এবং ভেন্টিলেটর এ সব কিছুর অপ্রতুলতা একটা প্রকাশিত সত্য। করোনা সংকট মোকাবেলায় সরকার ৭২ হাজার ৭৫০ কোটি টাকার প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষনা করেছে, কিন্তু তা মূলত ব্যবসায়ীদের জন্য স্বল্প সুদে ঋণ সহায়তা। লক ডাউনে অচল স্থবির হয়ে পরা অর্থনৈতিক বাস্তবতায় কোটি কোটি মানুষের আয়-উপার্জন সরকার শুধুমাত্র ব্যবসায়ীদের হাতে ছেড়ে দিয়েছে। এই করোনা সংকটের মধ্যেও বকেয়া বেতনের দাবিতে উত্তরার আজমপুরে, টঙ্গীর বিসিক শিল্প নগরীতে শ্রমিকেরা বিক্ষোভ করেছে। ৪% সুদে কৃষকের জন্য প্রণোদনা প্যাকেজটিও একটা ঋণ সহায়তা। আমরা জানি, কৃষক ধান উৎপাদন করে ধারাবাহিকভাবে ভাবেই লোকসানে আছেন, তার উপর খাদ্য সংকটের হুমকিতে থাকার পরিস্থিতিতে সরকার কৃষকদের নগদ অর্থ প্রদানের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেনি। সরকারের পুঁজিবাদী দৃষ্টিভঙ্গির কারণে সুদভিত্তিক ঋণ প্রদান করাই অর্থনৈতিক সংকট মোকাবেলা সর্বপ্রথম হাতিয়ার। দেশের ৬ কোটি শ্রমশক্তির ৫ কোটি ২০ লক্ষ্য অনানুষ্ঠানিক খাতে নিয়োজিত। তাদের কাজ বন্ধ থাকায় তাদের খাদ্যের যোগান কোথা থেকে হবে সে ব্যপারে সরকার নির্বিকার। অথচ এই মূহুর্তে প্রয়োজন ছিল জরুরি ভিত্তিতে নগদ টাকা এবং খাদ্য সহায়তা। ওয়ার্ড থেকে ইউনিয়ন পর্যন্ত স্থানীয় প্রশাসন ও সেনাবাহিনীর সহায়তায় দ্রুত দরিদ্র পরিবারের তালিকা করে এই সহায়তা পৌছানোর সক্ষমতা থাকা সত্বেও মুনাফাকেন্দ্রিক পুঁজিবাদী দৃষ্টিভঙ্গির কারণে সরকার দ্রুততার সাথে এই পদক্ষেপ গ্রহণ করেনি। এক কোটি দরিদ্র পরিবারকে ১০ হাজার টাকা করে দিলে লাগে ১০ হাজার কোটি টাকা। এই “মেগা প্রকল্প’’ এর দেশে এই পদক্ষেপ অসম্ভব কিছু হওয়ার কথা ছিলা না। এমনকি সরকারের জনসেবার বিজ্ঞাপন ১০ টাকা কেজিতে ও.এম.এস এর চাল বিতরণ কর্মসূচি সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখার অজুহাতে (প্রকৃতার্থে ব্যপক চাল চুরির কারণে) তা বন্ধ করে দিয়েছে খাদ্য মন্ত্রনালয়।

এপ্রিল থেকে মে মাস বাংলাদেশের কৃষির জন্য গুরত্বপূর্ণ দুই মাস। হাওরের ধান পেকে মাটিতে পড়ে যাচ্ছে কারণ কাটার জন্য দেশের দক্ষিনাঞ্চলের কৃষি শ্রমিকেরা সেখানে যেতে পারছেন না। সরকারের দায়িত্বহীনতার আরেকটি নিদর্শন হচ্ছে এই পরিস্থিতি মোকাবেলায় সরকারের কোন সিদ্ধান্ত আসেনি। ব্যাপক হারে করোনা টেস্ট, আইসোলেশনের মাধ্যমে হাওর অঞ্চলকে করোনামুক্তাঞ্চল ঘোষণা করা, কৃষি-শ্রমিক, কৃষি-যান্ত্রিক কারিগরদের যথাযথ স্বাস্থ্য পরীক্ষা করে হাওর অঞ্চলে পৌছে দেওয়া, স্কুল কলেজ শিক্ষার্থীদের ধান কাটার জন্য মাঠে না নামালে হাওরের ২০% বোরো ধানের যোগান বন্ধ হয়ে যাবে এবং হাওর অঞ্চলে খাদ্যভাব দেখা দিতে পারে।

এই ধরনের বাস্তবতায় ইসলামের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে কিছু বিষয় আলোকপাত করছি।

খিলাফত রাষ্ট্রকাঠামোর অধীনে খলীফা, খলিফার সহকারীগণ এবং ওয়ালী বা গভর্নরবৃন্দ জনগনের সার্বিক বিষয়ে দেখাশুনা করেন আহকাম শরীয়াহ এর মাধ্যমে। জনগনের দেখাশোনা করাকে ইংরেজীতে politics বা আরবীতে সিয়াসাহ (سياسة) বলা হয়। রাষ্ট্র এই কাজ কার্যকরীভাবে বাস্তবায়ন করে এবং শাসককে জবাবদিহিতার মুখোমুখি করে। রাসূল (সা) বলেছেন: “তোমাদের প্রত্যকেই দায়িত্বশীল এবং তোমাদের প্রত্যেককে তার দায়িত্বের ব্যপারে জবাবদিহি করতে হবে।” তিনি আরো বলেন: “ইমাম তথা শাসক জনগণের ব্যাপারে দায়িত্বশীল এবং তাকে তার দায়িত্বের ব্যপারে প্রশ্ন করা হবে।“ তিনি বলেন: “ইমাম হচ্ছেন অভিভাবক এবং তার জনগণের ব্যপারে দায়িত্বশীল।”

পুঁজিবাদী দৃষ্টিকোন থেকে মুনাফা অর্জন করাই মানবজীবনের কাজের একমাত্র মানদন্ড। তাই চিকিৎসা ব্যবস্থাকে একটা প্রাইভেট সেক্টর হিসেবে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে যাতে মুনাফা অর্জন করা যায়। এই দূর্যোগকালীন সময়ে বাংলাদেশের চিকিৎসা ব্যবস্থার অক্ষমতা এই মুনাফাকেন্দ্রিক নীতির ব্যর্থতাকে পুরোপুরি প্রকাশ করছে। শরীয়াহ দলীলের ভিত্তিতে ইসলাম চিকিৎসা বা স্বাস্থ্যখাতকে জনগণের অধিকার হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। তাই খিলাফত রাষ্ট্র রাষ্ট্রীয় হাসপাতালগুলোকে বিনামূল্যে জনগণের চিকিৎসা প্রদানের জন্য উপযোক্ত করে গড়ে তুলবে। সুলভে প্রয়োজনীয় মেডিসিন, ভ্যাকসিন তৈরীর জন্য রিসার্চ সেন্টার, ল্যবোরেটরী স্থাপন করবে। পৃথিবী তখন কিউবা মডেলের পরিবর্তে খিলাফত মডেলের বিষয়ে উৎসাহিত হবে।

রাসূল (সা) বলেছেন: “যে ব্যক্তি মহামারীর প্রাদুর্ভাব রয়েছে এমন অঞ্চলে বসবাস করছে সে যেন সেখানেই অবস্থান করে এবং সেই অঞ্চল পরিত্যাগ করে না বরং ধৈর্যধারণ করে এবং আল্লাহর পুরষ্কারের আশা করে এবং বিশ্বাস রাখে যে, তার উপর কোন কিছুই আপতিত হবে না যা আল্লাহ তার জন্য নির্ধারন করে রেখেছেন, তখন সে এমন পুরষ্কার প্রাপ্ত হবে যা একজন শহীদের জন্য রয়েছে”।

মহামারী থেকে একটা অঞ্চলকে রক্ষা করার মৌলিক নীতি আমরা এই হাদিস থেকে বুঝতে পারছি। আক্রান্ত অঞ্চল থেকে আগত লক্ষ লক্ষ মানুষকে হোম কোয়ারাইন্টাইনের প্রেস্ক্রিপশন  দিয়ে নিজ নিজ এলাকায়  পাঠিয়ে দেয়া হয়েছে। রাষ্ট্রে প্রবেশের বিষয়টি লক করা হয়নি এবং যারা আসছে তাদের করোনা টেস্ট করা হয় নি। আজকে পুরো দেশকে লক ডাউন করে অগণিত মানুষকে ক্ষুদার্থ, অভুক্ত রেখে এই ভাইরাসকে মোকাবেলা করছে সরকার। আক্রান্ত দেশ থেকে আগত মানুষকে বিনা পরীক্ষায় বাড়ি পাঠিয়ে দিয়ে ঘরে ঘরে করোনা প্রবেশের সুযোগ করে দিয়েছে এই গণতান্ত্রিক সরকার। ব্যপক টেস্ট, আইসোলেশন ট্রিটমেন্ট এর মাধ্যমে অসুস্থদের আলাদা করে চিকিৎসা দেওয়া এবং সুস্থদের দৈনন্দিন যাবতীয় কাজে সক্রিয় রাখা এটাই সঠিক সমাধান এবং এই নীতিই খিলাফত ব্যবস্থা গ্রহণ করবে।

দ্রুততর সময়ে ব্যপক পরীক্ষার মাধ্যমে হাওর অঞ্চলকে করোনামুক্তাঞ্চল ঘোষনা না করলে, হাওর অঞ্চলে কৃষি শ্রমিকদের প্রবেশের সুযোগ না দিলে ব্যপক খাদ্য সংকট তৈরীর সম্ভাবনা রয়েছে। হাদিসে বর্ণিত নীতিমালা অনুসরণের মাধ্যমে খিলাফত রাষ্ট্র সহজেই এই ধরণের স্থবিরতা থেকে সমাজকে সুরক্ষা দিবে এবং অর্থনীতির চাকা সচল রাখবে।

খাদ্যের ব্যপারে ইসলামের হুকুম হচ্ছে খাদ্য হতে হবে হালাল এবং পবিত্র। খিলাফত রাষ্ট্র কাজি উল হিসবাহ এর মাধ্যমে বাজারে খাদ্য সরবরাহর ক্ষেত্রে ইসলামের নীতি অনুসরণকে মনিটর করবে। খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান ইসলামের দৃষ্টিকোন থেকে সকল মানুষের মৌলিক অধিকার। তাই মহামারীসহ যেকোন দূর্যোগকালীন সময়ে দরিদ্র মানুষের ঘরে খাদ্য ও নগদ অর্থ পৌছে দিতে খলীফা শরীয়াহগতভাবে বাধ্য যাতে মানুষ খেয়ে পড়ে বেঁচে থাকতে পারে।

বর্তমান ধর্মনিরপেক্ষ শাসকগোষ্টি তার দায়িত্বশীলতার বিজ্ঞাপন প্রচারের জন্য OMS এর চাল বিতরণের একটি ব্যর্থ চেষ্টা করছে। ১ কোটি দরিদ্র পরিবারকে ১০,০০০ টাকা করে দিয়ে ১০ হাজার কোটি টাকা  সক্ষমতা থাকা সত্বেও কঠোর পুঁজিবাদী দৃষ্টিভঙ্গির কারণে সরকার এই পদক্ষেপ গ্রহন করেনি। তার পরিবর্তে জনরোষ ও গণবিদ্রোহ ঠেকানোর দৃষ্টিকোণ থেকে সরকারের পরবর্তী পদক্ষেপ মূল্যায়ন করতে হবে।

কোভিড-১৯ ভাইরাস আল্লাহ (সুবহানাহু ওয়া তা’আলার)-এর একটি অতিক্ষুদ্র সৃষ্টি যা বিশ্বব্যপী পুঁজিবাদী ব্যবস্থার অক্ষমতাকে প্রকাশ করেছে। আল্লাহ (সুবহানাহু ওয়া তা’আলা)-ই এই সমগ্র বিশ্বজগতের স্রষ্টা, মালিক। তিনি তার সৃষ্ট মানুষের জন্য ইসলামকেই একমাত্র জীবনব্যবস্থা/মতাদর্শ হিসেবে পাঠিয়েছেন। খিলাফত রাষ্ট্র কাঠামোর মাধ্যমে এই জীবনব্যবস্থাকে ফিরিয়ে আনা ছাড়া মানবজাতিকে সঠিক পথ দেখানো সম্ভব নয়। এই দায়িত্ব মুসলিম উম্মাহকেই পালন করতে হবে।

আল্লাহ (সুবহানাহু ওয়া তা’আলা) বলেন: “এইভাবে আমি তোমাদেরকে উম্মাতান ওয়াসাতান বা ন্যায়পরায়ণ জাতি করেছি যাতে তোমরা সাক্ষ্যদাতা হও মানবমন্ডলীর জন্য এবং যাতে রাসূল সাক্ষদাতা হন তোমাদের জন্য’’। (সূরা বাকারা: ১৪৩)

Leave a Reply