৮ম অধ্যায়: দলের জন্য প্রয়োজনীয় চিন্তাভাবনাসমূহ গ্রহণ করার বাধ্যবাধকতা

যেকোনো ধরনের দল হলেই চলবে এমন ধারণা শরীআ’হ দেয় না। বরং শরীয়াহ এমন একটি দল প্রতিষ্ঠার দাবী করে যার উদ্দেশ্য হবে একটি সুনির্দিষ্ট নির্দেশ বাস্তবায়ন করা। নিচের দলীলটি আমাদেরকে এ বিষয়ে স্পষ্ট ধারণা দেয়। আল্লাহ (সুবহানাহু ওয়া তাআলা) বলেন; 

“আর তোমাদের মধ্যে এমন একটা দল থাকবে যারা আহবান জানাবে সৎকর্মের প্রতি, নির্দেশ দেবে ভাল কাজের এবং বারণ করবে অন্যায় কাজ থেকে, আর তারাই হলো সফলকাম।”
(আল কুরআন ৩:১০৪)

ইসলামী আদর্শের ভিত্তিতে এমন একটি রাজনৈতিক দল প্রতিষ্ঠা করতে শরীয়াহ আমাদেরকে বাধ্য করে যে দলটি তাকে  প্রতিষ্ঠিত করার উদ্দেশ্য পূরণের জন্য অর্থাৎ ইসলামের আধিপত্য ও প্রতিষ্ঠালাভ এবং ক্ষমতা অর্জনের জন্য প্রয়োজনীয় চিন্তা ও শরঈ হুকুম বহন করবে। নিছক দল গঠনের জন্যই দল গঠন করতে বলা হয়নি বরং দলের উদ্দেশ্য যা হচ্ছে দাওয়াত এবং সৎকাজের আদেশ এবং অসৎকাজের নিষেধ তা বাস্তবায়ন করতে বলা হয়েছে। একইভাবে কেবল দাওয়াত ও সৎকাজের আদেশ ও অসৎকাজের নিষেধের জন্যই তা করতে বলা হয়নি বরং যে উদ্দেশ্যে দাওয়াত ও সৎকাজের আদেশ এবং অসৎকাজের নিষেধের দায়িত্বটি সম্পন্ন করতে বলা হয়েছে তা হল আধিপত্য ও ক্ষমতা অর্জন এবং তা সুসংহতকরণ।

রাসূল (সা) বলেছেন;

“পৃথিবীর যেকোনো অংশে যদি তিনজন লোক থাকে, তাহলে নিজেদের মধ্য থেকে একজনকে আমির (নেতা) নিযুক্ত না করে থাকাটা তাদের জন্য বৈধ হবে না।”
[আহমাদ ইবনে হাম্বল থেকে বর্ণিত]

যেকোনো সামষ্টিক দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে মুসলিমদেরকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে যেন তারা একজন আমীরের নেতৃত্বে তা সম্পাদন করে। যেসমস্ত লোকের উপরে, যেসব বিষয়ের জন্য তিনি আমীর নিযুক্ত হয়েছেন সেসব বিষয়ে তার আনুগত্য করা বাধ্যতামূলক। আমীরের নির্দেশ মতো দলটিকে চলতে হবে যাতে সামষ্টিক কাজের একটি শরীয়তসম্মত পরিণতি অর্জন করা যায়।

— যেহেতু মুসলিমদের উপরে আল্লাহ এমন অনেক দায়িত্ব ফরয করেছেন যেগুলো কেবলমাত্র খলিফাই সম্পাদন করতে পারেন সেহেতু এসব ফরয আদায়ের জন্য একজন খলিফা নিযুক্ত করা অপরিহার্য। আবার যেহেতু কোনো দল ছাড়া খলিফার নিয়োগ ও খিলাফত প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব না, সেহেতু এমন একটি দল যার উদ্দেশ্য হবে খলিফা ও খিলাফত প্রতিষ্ঠা তার অস্তিত্ব অপরিহার্য। কারণ শরীয়াহ’র একটি মৌলিক নীতিমালা হচ্ছে:

“কোনো ওয়াজিব পালন করতে যা প্রয়োজন তা নিজেও ওয়াজিব।”

আলোচনা থেকে এটি স্পষ্ট হলো যে নির্দিষ্ট শর’ঈ উদ্দেশ্যের সঙ্গে দলটির অস্তিত্ব অবিচ্ছেদ্যভাবে জড়িত। অতএব নিছক ইসলামের দাওয়াত বহন করে অথবা কেবল বার্তাবহনের জন্যই তা বহন করে এমনকোনো দলের কথা বলা হয় নি। বরং দল প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্য হবে ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত করার মাধ্যমে মুসলিমদের জীবনে ইসলাম প্রতিষ্ঠা করা। কারণ ব্যক্তিগত ও সামষ্টিক পর্যায়ের সমস্ত ইসলামী হুকুম বাস্তবায়নের শরঈ পদ্ধতি হচ্ছে ইসলামী রাষ্ট্র। অতএব এমন একটি দলের অস্তিত্ব অপরিহার্য যা তার প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্য পূরণ করবে।

যতক্ষণ পর্যন্ত দলটি তার প্রয়োজনীয় দায়িত্বগুলো পূরণ করতে সক্ষম না হচ্ছে ততক্ষণ পর্যন্ত তাকে নিচের বিষয়গুলো অবশ্যই মেনে চলতে হবে:

— দায়িত্ব সম্পাদনের জন্য প্রয়োজনীয় চিন্তা, শরঈ হুকুম ও মতামত দলটিকে গ্রহণ করতে হবে এবং কথা, কাজ ও চিন্তায় সেগুলোর অনুসরণ করতে হবে। এসব বিষয় গ্রহণ করার উদ্দেশ্য হচ্ছে দলের ঐক্য রক্ষা করা। যদি প্রতিষ্ঠিত দলটির সদস্যগণ ভিন্ন ভিন্ন চিন্তা ও ইজতিহাদ গ্রহণ করে তাহলে দলটি ভাঙনের মুখে পড়বে এবং তা খণ্ড-বিখণ্ড হয়ে যাবে যদিও তারা সাধারণভাবে নিজেদের উদ্দেশ্য ও ইসলামের ব্যাপারে একমত থাকে। এমনকি এসব খণ্ডদলের ভিতরে আরো অনেক উপদল তৈরি হবে। ফলে তখন ফরয দায়িত্ব প্রতিষ্ঠার জন্য অন্যদের নিকট দাওয়াত পৌঁছানোর পরিবর্তে তারা নিজেদের মধ্যে দাওয়াতের সূচনা করবে। তারা একে অন্যের সঙ্গে তর্ক-বিতর্কে লিপ্ত হবে এবং প্রত্যেকটা উপখণ্ডই চাইবে তাদের চিন্তা পুরো দলের নেতৃত্ব দিক। এজন্য নির্দিষ্ট চিন্তা গ্রহণ এবং এর বৈধতা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। দলের ঐক্য বজায় রাখা শরীয়াহ’র দৃষ্টিতে একটি প্রয়োজনীয় বিষয়। এক্ষেত্রে দায়িত্ব পালনের জন্য প্রয়োজনীয় সমস্ত চিন্তা গ্রহণ এবং সেগুলো মেনে চলতে শাবাবদেরকে বাধ্য করা ছাড়া অন্যকিছুর মাধ্যমে দলের ঐক্য বজায় রাখা সম্ভব না। সুতরাং ‘কোনো ওয়াজিব পালন করতে যা প্রয়োজন তা নিজেও ওয়াজিব’ এই নীতির আলোকে প্রয়োজনীয় বিষয়সমূহকে গ্রহণ করতে হবে।

দলটি তার দায়িত্ব সম্পাদনের জন্য যেসব প্রয়োজনীয় চিন্তা, হুকুম ও মতামত গ্রহণ করে সেগুলো যতক্ষণ পর্যন্ত শরীয়তসম্মত হয় এবং যতক্ষণ পর্যন্ত দলের উপরে শাবাবদের আস্থা থাকে ততক্ষণ পর্যন্ত বিভিন্ন কাজের চিন্তাসমূহ মেনে নেওয়ার জন্য শাবাবদের বাধ্য করা একটি বৈধ বিষয়, কারণ মুসলিমদের জন্য এই বিষয়টি বৈধ যে, সে নিজের মতামত ত্যাগ করে অন্যের মত অনুযায়ী কাজ করতে পারবে। এজন্যই উসমান বিন আফফান (রা) এই শর্তে খলিফা হিসেবে বাইয়াত নিয়েছিলেন যে তিনি নিজস্ব ইজতিহাদ পরিত্যাগ করবেন এবং আবু বকর ও উমর (রা)-এর ইজতিহাদ গ্রহণ করবেন যদিও সেগুলো তার ইজতিহাদের সঙ্গে না মিলে। এই বিষয়টি সাহাবীগণ (রা) মেনে নিয়েছিলেন এবং তাঁরা তাঁকে বাইয়াত দিয়েছিলেন। তবে এই বিষয়টি ফরয নয় বরং মুবাহ, যা আলী (রা) এর ঘটনাটি দ্বারা প্রমাণিত। কারণ তিনি আবু বকর (রা) ও উমর (রা)-এর ইজতিহাদ গ্রহণের বিনিময়ে নিজের ইজতিহাদ পরিত্যাগ করতে রাজি না হওয়া সত্ত্বেও কোনো একজন সাহাবীও এতে আপত্তি করেননি। এছাড়া আশ—শাবী কর্তৃক সহীহ সনদে বর্ণিত আছে যে, আবু মুসা (রা) আলী (রা)-এর মতের জন্য নিজের মত, যাইদ (রা) উবাই বিন কাব (রা)-এর মতের জন্য নিজের মত এবং আবদুল্লাহ (রা) উমর (রা)-এর মতের জন্য নিজের মত পরিত্যাগ করতেন। একটি হাদীসে বর্ণিত আছে যে আবু বকর (রা) এবং উমর (রা) নিজেদের মত পরিত্যাগ করতেন আলী (রা)-এর মতের জন্য। এ থেকে বুঝা যাচ্ছে যে , অন্যকোনো মুজতাহিদের প্রতি আস্থার কারণে তার মত গ্রহণ করে নিজের মত পরিত্যাগ করা কোনো মুজতাহিদের জন্য অনুমোদিত। দলের শাবাবদেরকে অবশ্যই এই দুটো ধারণা মেনে চলতে হবে এবং বুদ্ধিবৃত্তিক ও আবেগগত দিক থেকে একটি দেহের মতো আচরণ করতে হবে।  

— দলের কর্মকাণ্ড পরিচালনা করার জন্য যেভাবে সে প্রয়োজনীয় শরঈ হুকুম গ্রহণ করে, সেগুলোকে সম্পাদন করার জন্য ঠিক তেমনিভাবে অবশ্যই তাকে ধরন (style)সম্পর্কিত হুকুমও নির্ধারণ করতে হবে। ধরন (style) বলতে সেই উপায়কে বোঝানো হচ্ছে যার মাধ্যমে শর’ঈ হুকুম বাস্তবায়িত হয়। এটি একটি হুকুম যা এমন কোনো মৌলিক হুকুমের সঙ্গে সম্পর্কিত যার স্বপক্ষে দলীল বিদ্যমান। উদাহরণস্বরূপ, রাসূল (সা)-এর অনুসরণে দলের শাবাবদের চিন্তা-চেতনাকে খুব ভালোভাবে গড়ে তুলতে হবে। এটি হচ্ছে একটি শর’ঈ হুকুম যা অবশ্যই মেনে চলতে হবে। কিন্তু কোন উপায়ে? কীভাবে এই শরঈ হুকুম বাস্তবায়িত হবে? একটি নির্দিষ্ট ধরনের সাহায্যে এই শরঈ হুকুম পালন করতে হবে। এক্ষেত্রে হালাকাহ (পাঠচক্র) অথবা উশার (পরিবার) প্রভৃতি হতে পারে প্রয়োজনীয় ধরন (style)।

অতএব, যুক্তিসম্মত উপায়ে ধরন (style) নির্ধারণ করতে হবে যাতে এর সাহায্যে সর্বোত্তম উপায়ে শরঈ হুকুম বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয়। মূলনীতি অনুযায়ী এই হুকুমটি হচ্ছে মুবাহ। শরীয়াহ আদেশ করেছে শর’ঈ হুকুমটির ব্যাপারে কিন্তু তা বাস্তবায়নের ধরনটি (style) ছেড়ে দিয়েছে মুসলিমদের উপরে।

কোনো একটি হুকুমের জন্য যেহেতু বিভিন্ন ধরন (style) রয়েছে সেহেতু একটি নির্দিষ্ট ধরন (style) গ্রহণ করতে এবং দলটি শাবাবদেরকে সে অনুযায়ী পরিচালিত করবে । অতএব দলটিকে একটি ধরন গ্রহণ করতে হবে যার মাধ্যমে সে শর’ঈ হুকুম বাস্তবায়ন করবে। এক্ষেত্রে মূল কাজটি যে পর্যায়ের হুকুম, ধরনটির (style) হুকুমও তাই হবে। অন্যভাবে বলা যায়, শরঈ হুকুমটি যে পর্যায়ের বাধ্যবাধকতা ধরনটিও (style) সে পর্যায়ের বাধ্যবাধকতা।

যখন দলটি উত্তমরুপে বিকশিত চিন্তা-চেতনা (culture) গড়ে তোলার জন্য হালাকাহকে একটি ধরন (style) হিসেবে গ্রহণ করবে, তখন অবশ্যই একে একটি বাধ্যবাধকতা হিসেবে গ্রহণ করতে হবে। ধরনটিকে (style) গ্রহণ করার সময় দলটিকে অবশ্যই এর উদ্দেশ্যের দিকে নজর দিতে হবে যা হচ্ছে উত্তমপন্থায় বিকাশক্রিয়াকে (culture) গড়ে তোলা। অতএব, ধরন হিসেবে হালাকাহকে গ্রহণ করলে এর উদ্দেশ্য পূরণের জন্য প্রয়োজনীয় সমস্ত বিষয়ই গ্রহণ করতে হবে। উদাহরণস্বরূপ, হালাকাহতে কত লোক থাকবে তা হালাকাহ’র উদ্দেশ্যের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ হতে হবে। যদি লোকসংখ্যা বেশি হয় তাহলে উত্তমভাবে চিন্তা—চেতনা গড়ে তোলার প্রক্রিয়া ক্ষতিগ্রস্ত হবে। যদি লোকসংখ্যা কম হয় তাহলে অনেক বেশি হালাকাহ হয়ে যাওয়ার ফলে তা উদ্দেশ্যের জন্য বোঝা এবং বাধাস্বরূপ হবে। কোনোরকম সংখ্যাধিক্য বা অপর্যাপ্ততা না রেখে লোকসংখ্যা এমনভাবে নির্ধারণ করতে হবে যাতে তা চিন্তাভাবনা গঠন প্রক্রিয়ার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ হয়। সুতরাং লোকসংখ্যা নির্ধারণের বিষয়টি যুক্তিসম্মত সিদ্ধান্তের উপর নির্ভরশীল। অনুরূপভাবে হালাকাহ’র সময়কাল এমন হতে হবে যাতে চিন্তাগুলোকে সঠিকভাবে বোঝার জন্য ছাত্ররা নিজেদের মনোযোগ ধরে রাখতে পারে, অন্যথায় বোঝার বিষয়টি অপর্যাপ্ত থেকে যাবে। সময় খুব সংক্ষিপ্ত হলে চিন্তাগুলোকে পুরোপুরি উপস্থাপন করা সম্ভব হবেনা। কতদিন পরপর হালাকাহ নিতে হবে? এটা কি প্রতিদিনই হবে, সপ্তাহে একবার হবে নাকি দুসপ্তাহে একবার হবে ? দাওয়াতের ব্যবহারিক বিষয়ের পথে যেন হালাকাহ বাধা না হয়ে দাঁড়ায়। শাবাব যেন দাওয়াত বাদ দিয়ে কেবল শিক্ষাসংক্রান্ত বিষয়ের মধ্যে ব্যস্ত না হয়ে পড়ে। শরঈ হুকুম বাস্তবায়নের জন্য এভাবে উপযুক্ত ধরন বেছে নিতে হবে যাতে সেগুলো শরঈ হুকুম বাস্তবায়নের সঙ্গে পুরোপুরি সামঞ্জস্যপূর্ণ থাকে। ধরনের ব্যাপারে যে বিষয়গুলো এখানে বলা হলো সেগুলো উপকরণের বেলায়ও অনেকটাই প্রযোজ্য। কাজের চাহিদা অনুযায়ী আমীর চাইলে ধরন ও উপকরণ পরিবর্তন করতে পারেন। 

— দলটি যেহেতু বিশাল বিস্তৃত ভূখণ্ডে কার্যক্রম পরিচালনা করবে এবং অনেকগুলো দেশে পৌঁছাবে সেহেতু এর কর্মকাণ্ডের পরিধির দাবি অনুযায়ী একটি প্রশাসনিক ব্যবস্থার প্রয়োজন, যার মাধ্যমে দলটি দাওয়াত পরিচালনা করবে এবং কাজের সমস্ত উদ্দেশ্যকে বাস্তবায়ন করবে। এই প্রশাসনিক ব্যবস্থাটি দাওয়াতের আন্দোলনকে সংগঠিত ও নিয়ন্ত্রিত করবে। এটি শাবাবদেরকে গড়ে তোলার বিষয়টি দেখাশোনা করবে এবং উদ্দেশ্য বাস্তবায়নের জন্য একটি সাধারণ ক্ষেত্র প্রস্তুত করবে। এটি বুদ্ধিবৃত্তিক ও রাজনৈতিক আন্দোলনকে সংগঠিত করবে। উম্মাহ্র কাছে দলটি এমন একটি সত্তা হিসেবে আবির্ভূত হবে যা তার দায়িত্ব পালনের জন্য প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। অতএব, একটি সুসংগঠিত কাঠামোর প্রয়োজন অপরিহার্য যা তার উদ্দেশ্য বাস্তবায়নের জন্য সর্বোচ্চ প্রচেষ্টা গ্রহণ করবে। ফলে কাজের অগ্রগতিকে সে পর্যবেক্ষণ করবে এবং অর্জিত সাফল্যকে ধরে রাখবে।

অতএব দলটিকে একটি প্রশাসনিক ব্যবস্থা অথবা একটি সুসংগঠিত কাঠামো প্রতিষ্ঠিত করতে হবে যা সফলতার সঙ্গে দাওয়াত পরিচালনার মাধ্যমে উদ্দেশ্য বাস্তবায়নে তাকে সাহায্য করবে।

দলটিকে কিছু প্রশাসনিক নিয়মকানুন গ্রহণ করতে হবে যার মাধ্যমে দলের সদস্যবৃন্দকে এবং দল কতৃর্ক পরিচালিত আন্দোলনকে সংগঠিত করা যাবে। এতে আমীরের ক্ষমতা, সে কীভাবে দল পরিচালনা করবে এবং কীভাবে নির্বাচিত হবে সেসব বিষয় নির্ধারিত থাকবে। বিভিন্ন এলাকা এবং প্রদেশের দায়িত্বশীলদেরকে কে বা কারা নিয়োগ দিবে এবং তাদের ক্ষমতা কতটুকু থাকবে-এ বিষয়গুলো এতে বর্ণিত থাকতে হবে। নির্দিষ্ট নিয়মকানুন হিযবের সমস্ত কাজের প্রশাসনিক বিষয়কে সংগঠিত করবে এবং সংশ্লিষ্ট প্রত্যেকের চূড়ান্ত ক্ষমতাকে নির্ধারিত করবে।

কাজের সঙ্গে সম্পর্কিত সমস্ত শর’ঈ হুকুম বাস্তবায়নের জন্য প্রয়োজনীয় ধরন ও উপকরণ সম্পর্কিত হুকুম থাকতে হবে এসব নিয়মকানুনের মধ্যে। গ্রহণকৃত প্রশাসনিক ব্যবস্থার আনুগত্য করা ততক্ষণ পর্যন্ত বাধ্যতামূলক যতক্ষণ পর্যন্ত আমীর এগুলোকে প্রয়োজনীয় বলে মনে করেন, কারণ আমীরের আনুগত্য করা ওয়াজিব।

— গ্রহণকৃত বিষয়ের আনুগত্য করতে প্রত্যেকেই বাধ্য। অতএব কেউ তা লঙ্ঘন করলে দল তার বিরুদ্ধে কি ব্যবস্থা নিবে? এই লঙ্ঘনের জন্য কি তাকে তিরস্কার করা হবে, নাকি কোনো প্রশাসনিক শাস্তি দেয়া হবে?

যারা গ্রহণকৃত হুকুম লঙ্ঘন করে অথবা নির্ধারিত শর’ঈ পথ থেকে বিচ্যুত হয় তাদের ব্যাপারে প্রশাসনিকভাবে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে দলটি বাধ্য। আমীরের অবাধ্যতার জন্য এ শাস্তিমূলক ব্যবস্থা বৈধ। শরঈ হুকুম অনুযায়ী যেহেতু আমীর থাকা বাধ্যতামূলক সেহেতু তার আনুগত্য করা বাধ্যতামূলক এবং যেসব দায়িত্বের জন্য সে আমীর হিসেবে নিযুক্ত হয়েছে সেসব ব্যাপারে তার অবাধ্য হওয়া নিষিদ্ধ ; অন্যথায় দলের আমীর থাকার কোনো মানে হয় না।

রাসূল (সা) বলেন; 

“যে ব্যক্তি আমার আনুগত্য করল সে যেন আল্লাহর আনুগত্য করল এবং যে আমাকে অমান্য করল সে যেন আল্লাহকে অমান্য করল। যে ব্যক্তি আমীরের আনুগত্য করল সে যেন আমার আনুগত্য করল এবং যে ব্যক্তি আমীরকে অমান্য করল সে যেন আমাকে অমান্য করল।”
[মুসলিম থেকে বর্ণিত]

আন্দোলনরত প্রত্যেক সদস্যই আমীরের প্রশাসনিক শাস্তির আওতাধীন থাকবে, এমনকি যদি সে একেবারে কনিষ্ঠ সদস্যও হয়। এসব শাস্তি দেয়া হবে গ্রহণকৃত বিষয়ের লঙ্ঘনের ফলে। গ্রহণকৃত শরঈ হুকুম অথবা ধরনকে যে লঙ্ঘন করে অথবা প্রশাসন বা প্রশাসনিক নিয়ম যে অমান্য করে অথবা নিজের ক্ষমতার সীমালঙ্ঘন করে তাকে অবশ্যই জবাবদিহি করতে হবে।

এভাবে বুদ্ধিবৃত্তিক কাঠামোর সঙ্গে একটি সুশৃঙ্খল সাংগঠনিক কাঠামো যুক্ত করতে হবে যা পদ্ধতির সঙ্গে সম্পর্কিত কর্মকাণ্ড ও হুকুমের চিন্তাগুলোকে যথাযথভাবে বাস্তবায়ন করবে। সাংগঠনিক বিষয়ের দিকে দৃষ্টিপাত না করার কারণে অনেক ইসলামী এবং অৈইসলামি সংগঠনকে আমরা ব্যর্থ হয়ে যেতে দেখেছি।

যদি গ্রহণ করার (adoption) বিষয়ের দিকে দলটি যথার্থ মনোযোগ দেয় না তাহলে দলের মধ্যে মহামারী আকারে মতানৈক্য ছড়িয়ে পড়বে, সে বিশৃঙ্খলভাবে অগ্রসর হবে এবং বৃত্তাবদ্ধ হয়ে পড়বে, দলের জবাবদিহিতা থাকবে না। এই বিষয়টি লক্ষ্য অর্জনের পথে দলের জন্য বাধা হয়ে দাঁড়াবে।  

যদি বৈধ এবং স্থির শর্তসাপেক্ষে দলের সদস্য এবং দায়িত্বশীল লোক নিয়োগ না করে বরং বিভিন্ন কারণ যেমন কার সঙ্গে কার সম্পর্ক আছে অথবা কার সামাজিক মর্যাদা ও শিক্ষাগত যোগ্যতা আছে তার উপরে ভিত্তি করে নিয়োগ দেওয়া হয় তাহলে স্বাভাবিকভাবেই দায়িত্বের বণ্টন হবে ত্রুটিপূর্ণ এবং সদস্যগণ বিশেষ অবস্থান পাওয়ার প্রতি আগ্রহী হয়ে উঠবে।

এট স্বাভাবিক যে, যদি একটি সাধারণ গঠনতান্ত্রিক নিয়ম না থাকে যা প্রত্যেক সদস্যের জন্য প্রযোজ্য, তাহলে জবাবদিহিতার ক্ষেত্রে বৈষম্যের সৃষ্টি হবে এবং সমতা ও নিরপেক্ষতা হারিয়ে যাবে। 

স্বাভাবিকভাবেই গ্রহণকৃত বিষয়ের বড় ধরনের লঙ্ঘন এবং ছোট ধরনের লঙ্ঘনের মধ্যে পার্থক্য রেখে যদি গঠনতন্ত্রে শাস্তির বিধান না থাকে , তাহলে কর্মকাণ্ড পরিচালনার ক্ষেত্রে অবাধ্যতা দেখা দিবে এবং ভুলের পরিমাণ বেড়ে যাবে।

অতএব, কার্যকরী আন্দোলনের জন্য সাংগঠনিক দিক এবং সঠিকভাবে দল গঠন প্রক্রিয়ার দিকে যথার্থ মনোযোগ দিতে হবে যাতে দাওয়াতের চিন্তাসমূহকে এবং শাবাবগণকে ঠিকভাবে সংগঠিত করা যায় এবং কার্যক্রম পরিচালনায় বেশি সুবিধা হয়। যে উদ্দেশ্যে দল প্রতিষ্ঠিত হয়েছে তার সঙ্গে দলের সাংগঠনিক কাঠামো পুরোপুরি সামঞ্জস্যপূর্ণ হতে হবে।

দলের সাংগঠনিক দিকটিকে গৌণ বিবেচনা করলে চলবেনা বরং এটি একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। দল যদি সুসংগঠিত না হয় এবং প্রয়োজনীয় নিয়মকানুন গ্রহণ না করে অথবা গ্রহণকৃত নিয়মকানুনগুলোকে বাধ্যতামূলক হিসেবে মেনে না নেয় তাহলে যে সাফল্য দল অর্জন করবে তা হারিয়ে যাওয়ার আশঙ্কা থাকবে।

উপরন্তু দলের কার্যক্রম পরিচালনার জন্য কিছু অর্থনৈতিক দায়িত্ব বহন করা দলটির জন্য বাধ্যতামূলক। কারণ কিছু শাবাবকে দলের প্রয়োজনীয় বিভিন্ন দায়িত্ব পালনের জন্য বিশেষভাবে নিয়োগ দিতে হবে যেগুলো পালন করতে গেলে পরিবহন খরচ, প্রিন্টিং খরচ অথবা দাওয়াতের প্রয়োজনে অন্যান্য খরচ লাগবে। এসব খরচ দলকে অর্থাৎ দলের শাবাবদেরকেই বহন করতে হবে। দাওয়াতের জন্য যে স্বয়ং নিজেকে উৎসর্গ করেছে তার জন্য এটা অধিকতর সহজ যে, এর চেয়ে কম গুরুত্বপূর্ণ বিষয় অর্থাৎ আর্থিক সহায়তা সে প্রদান করবে।

দলের বাইরে যাতে হাত প্রসারিত করতে না হয় সেদিকে দলকে দৃষ্টি রাখতে হবে চাই সে কোনো ব্যক্তির নিকট হোক বা দলের কোনো নিকট বা কোনো সরকারের নিকট। এভাবেই দলকে অগ্রসর হতে হবে। দাওয়াতের শত্রুরা অর্থের প্রয়োজনকে কাজে লাগিয়ে দলকে ব্যবহার করার চেষ্টা করতে পারে, এজন্য তারা প্রথমে আপাতঃ দৃষ্টিতে নির্দোষ আর্থিক সাহায্য দিতে শুরু করে। কিন্তু খুব দ্রুতই এই সাহায্যদান কোনো উদ্দেশ্য বাস্তবায়নের জন্য ব্যবহৃত হয়।

Leave a Reply