জ্ঞানের অপরিহার্যতা

এখানে এটা সবার কাছে স্পষ্ট যে, জ্ঞান এবং সমসাময়িক মারুফ ও মুনকার সর্ম্পকে ওলেমাদের পরিষ্কার ধারণা প্রদান, লোকদের মারুফ সম্পাদন ও মুনকার বর্জনের জন্য অনুপ্রাণিত করা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ।  

আলেমগন হল সে ব্যক্তিবর্গ যারা অন্যদের জন্য প্রয়োজনীয় জ্ঞান অর্জন করে। তাদের ব্যক্তিগত ইবাদতের সাথে সংশ্লিষ্ট জ্ঞানার্জন করা তাদের জন্য ফরয। এর অতিরিক্ত হিসেবে উম্মাহর উপর অর্পিত বাধ্যবাধকতা সর্ম্পকেও তারা জ্ঞান লাভ করে। সুতরাং জ্ঞানার্জন একটি সামষ্টিক বাধ্যবাধকতা এবং উলেমাগন উম্মাহর পক্ষ থেকে তা সম্পাদন করেন ও এর জন্য তারা যথার্থ পুরষ্কার অর্জন করবেন। এই জ্ঞানার্জন করবার পরও তারা তাদের উপর অর্পিত দায়িত্ব থেকে মাহরুম হতে পারবেন না। অন্যদের মত তাদেরও ব্যক্তি পর্যায়ের ইবাদত সমূহ সম্পাদন করতে হবে। এ দায়িত্বের একটি হল খিলাফত প্রতিষ্ঠার জন্য কাজ করা। যদি কেউ উত্তরাধিকার আইনের উপরে একজন বিশেষষ্ণ হন বা একজন তাফসীরকারক হন অথবা তালাক বা বিয়ের উপর শরঈ নীতিমালার উপরে একজন বিচারক হওয়া সত্তে¡ও তার উপর অর্পিত শরঈ ব্যক্তিগত দায়িত্ব ও পুরো উম্মাহর সাথে সংশ্লিষ্ট সামষ্টিক দায়িত্ব থেকে পরিত্রাণ পাবেন না। কারণ আলেমগন এ উম্মাহর অংশ এবং তাদের কাছে কোন কিছু পৌছার অর্থ হল তা পুরো উম্মাহর কাছে পৌছে যাওয়া। কিন্তু অত্যন্ত পরিতাপের সাথে আজকে আমরা লক্ষ্য করছি যে, আলেমগন শরঈ এ দায়িত্ব (খিলাফত প্রতিষ্ঠা) পালনে অপারগতা প্রকাশ করছেন। এর জন্য তারা অবশ্যই আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা এবং উম্মাহর কাছে জিজ্ঞাসিত হবেন।

জ্ঞান হল আনুগত্য ও উপাসনার জন্য। জ্ঞান হল এমন জিনিস যা মানুষকে ত্বাকওয়া বা আল্লাহভীতির দিকে পরিচালিত করে।

’আল্লাহর বান্দাদের মধ্যে জ্ঞানীরাই কেবল তাঁকে ভয় করে।’ (সূরা ফাতির: ২৮)

ইতিহাসে উলেমাদের আমরা সবকিছুর আগে খুঁজে পাই-হোক সেটা সালাত, জিহাদ, দাওয়াত পরিবহন, শাসকদের জবাবদিহী করা, কুফর ও স্রষ্টাবিহীন চিন্তাকে চ্যালেঞ্জ করার ক্ষেত্রে। লোকদের সঠিক চিন্তায় উদ্ধুদ্ধ করা ও সে অনুযায়ী কার্যসম্পাদনের ক্ষেত্রে আমরা তাদের অগ্রদূত হিসেবে দেখতে পাই।

এটা কারও ভাবা ঠিক হবে না যে, ইসলামে উলেমাদের আনুষ্ঠানিক কোন অবস্থান আছে-যা ধর্মীয় পদবি বা অন্য কোন স্বতন্ত্র পদবি। অথবা তাদের জ্ঞানের কারণে লোকদের নির্দেশ দেয় এবং তারা তা মেনে নেয়। বরং তারা অন্য সাধারণ মুসলিমদের মতই। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’আলার বর্ণণায় তারা এমনভাবে এসেছেন যেভাবে রাসূলুল্লাহ (সা) ও সাহাবীগন অর্ন্তভুক্ত হয়েছিলেন।

শরীয়া ওলেমা ও জ্ঞানের বাধ্যবাধকতা সত্য উপলদ্ধি ও পালনের নিমিত্তে সুনিশ্চিত করেছে। শরীয়ার জন্য তারা হলেন মাধ্যম। তাদের মাধ্যমে মুসলিম তার উপর প্রভূর অধিকার সম্বন্ধে অবগত হয়। তাদের উপস্থিতি হল একটি সামষ্টিক বাধ্যবাধকতা। যদি তাদের উপস্থিতি না থাকে তাহলে পুরো উম্মাহ গুনাহগার হবে। কারণ এ অবস্থায় পুরো উম্মাহ জাহেলিয়াতের মধ্যে পতিত হবে। ফলে ইজতিহাদ হল একটি সামষ্টিক বাধ্যবাধকতা। সুতরাং এরকম একটি সময় কোনক্রমেই থাকা উচিত নয় যখন কোন মুজতাহিদ নেই। আর না হয় পুরো উম্মাহ গোনাহগার হবে।

আগ্রহের দিক থেকে উম্মাহর স্বাভাবিক প্রবণতা হল উলেমাদের মতামতকে গ্রহণ করা বা গুরুত্ব প্রদান করা। একারণে উলেমাদের কোন ধরনের প্রলোভনে সাড়া দেয়া ঠিক হবে না-পদ বা অবস্থান চাওয়া, সঠিক জ্ঞান না থাকা সত্তেও কোন বিষয়ে ফতওয়া প্রদান করা, নফসের বশবর্তী হয়ে বা শাসককে সন্তুষ্ট করবার জন্য শরীয়াকে অসত্যভাবে উপস্থাপন করা সমীচীন নয়। যেহেতু শরীয়ার জ্ঞান হল মারুফ, সেহেতু এক্ষেত্রে মুনকার হল রিয়া (প্রদর্শনেচ্ছা), নেতৃত্বের মনোবাঞ্চা এবং সস্তা সুবিধা খোজা। সেকারণে আজকের দিনে শাসকের স্বার্থ সিদ্ধির জন্য উলেমাদের ক্রীড়ানক হিসেবে রাজনৈতিক দুরভিসন্ধি পূরণের জন্য ব্যবহার করা হচ্ছে। একারণে এদের জন্য টাকা ছিটানো হয়, সম্মানিত ইসলামি পন্ডিত হিসেবে পদবী দেয়া হয়। তখন তারা লোকদের জন্য নজীর বা বিশিষ্ট মুফতী হয়ে যান-যাদের কাছে লোকেরা বিভিন্ন বিষয়ের সমাধানের জন্য আসেন। সেকারণে তারা এমন ফতওয়া প্রদান করে যাতে শাসক সন্তুষ্ট হয় এবং আল্লাহর ক্রোধের উদ্রেক করে। শরীয়াকে তারা শাসকের আওতাধীন ও ইচ্ছাধীন করে দেয়। সেকারণে যদি দেখা যায় শাসকগন সুদকে জায়েয ঘোষণা করে, ওলেমাগনও এটাকে জায়েয বলে এবং এর জন্য বাণীকে বিকৃত করবার প্রয়োজন হলে তাই করে ও যেরকম চায় সেরকমভাবে দলিলাদি উপস্থাপন করে। যদি শাসকগন কোন কারণে কাফির রাষ্ট্রের সহায়তা চায় তাহলেও উলেমাগন তাতেও সায় দেয়। যদি শাসকগন ইহুদীদের সাথে শান্তি চায় তারা সেটাতেও সম্মতি প্রদান করে। তারা হল আজ্ঞাবহ ইসলামী পন্ডিত-যাদের সাবধান করতে হবে। উম্মাহকে তাদের কর্মকান্ডসমূহ দ্ব্যর্থহীনভাবে প্রত্যাখান করতে হবে এবং শরীয়াকে বিকিয়ে দিয়ে তাদের প্রতি আনুগত্য অব্যাহত রাখা যাবে না। এই ধরনের লোক যারা নিকৃষ্ট শাসকদের প্রতি সহায়তার হস্ত প্রসারিত করে, তাদের সর্ম্পকে রাসূলুল্লাহ (সা) বলেছেন:

‘আমার উম্মাহর ব্যাপারে যে জিনিসটি সবচেয়ে বেশী ভয় করি তা হল মুনাফেক আলেম ব্যক্তি।’ (মুসনাদে আহমাদ)

এসব লোকদের প্রকাশ্যে অভিযুক্ত করতে হবে-যাতে অন্যরা তাদের মিথ্যে ফতওয়ার স্বীকার না হয়। এরা তারাই যারা আখিরাতের বিনিময়ে দুনিয়ার জীবনকে ক্রয় করে নিয়েছে।

যখন মুসলিম সৎ কাজের আদেশ প্রদান ও পালন এবং মুনকার পরিত্যাগের আদেশ প্রদান ও বিরত থাকার মাধ্যমে এইসব কার্যাবলী সম্পাদন করে তখন তার ব্যক্তিগত জীবন ভাল হয়। তখন একজন মুসলিম নিজস্ব কলেবরে যেমনি আনুগত্যশীল হয় তেমনি অন্যদেরও এ ব্যাপারে উপদেশ প্রদান করে, একইভাবে সে যখন তার ব্যবসা ও আশেপাশের লোকদের সাথে আল্লাহর প্রতি আনুগত্যশীল আচরণ করে তখন দ্বীনের একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক ঠিকভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়। আমরা আগেও বলেছি, দ্বীনের প্রধান লক্ষ্য হল আনুগত্য প্রকাশ করা, সৎ কাজ ও মুনকার বর্জন ও সমাজের কোন দিক যাতে আল্লাহর হুকুম ব্যতিরেকে না চলে-হোক সেটা ব্যক্তি বা সামষ্টিক পর্যায়ের। সমাজ কেবলমাত্র কিছু ব্যক্তির সমষ্টি নয়, বরং এই ব্যক্তিবর্গ একত্রিত হয়েছে কিছু বিশ্বাসের ভিত্তিতে-যা থেকে জীবনের সবক্ষেত্রের জন্য একটি ব্যবস্থা উদ্ভুত হয়। যদি ব্যক্তিগত দিকটি অর্জিত হয় তাহলে কেবলমাত্র একটি দিক অর্জিত হয়। কিন্তু তারপরেও আরও অনেক দিক রয়ে যায় যে ব্যাপারে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’আলার শরণাপন্ন হতে হয়। এসব ব্যক্তিকে খলীফার দ্বারা শাসিত হতে হবে যিনি বাস্তবতায় ইসলামকে প্রতিষ্ঠিত করবেন। খলিফা তলোয়ারের দ্বারা এ বাস্তবতা প্রতিস্থাপন করবেন যখন মুসলিমরা এই বাস্তবতায় আল্লাহর ভয়ে স্বেচ্ছায় আওতায় আসবে না। ‘আল্লাহ অবশ্যই শাসক দ্বারা সংযত রাখবেন যা কোরআন দ্বারা সংযত রাখা সম্ভব হয়নি।’ শরীয়া ইসলামী বিশ্বাসকে প্রতিষ্ঠিত ও বিস্তৃত করা বাধ্যতামূলক করে দিয়েছে এবং আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা ইসলামী রাষ্ট্রকে এর পদ্ধতি হিসেবে সুনির্দিষ্ট করে দিয়েছেন। এ বিষয়টি শরীয়াহ স্পষ্টভাবে আমাদের সামনে তুলে ধরেছে এবং বাস্তবায়নের পদ্ধতিও উল্লেখ করেছে। ইসলামী রাষ্ট্রকে এই বিশ্বাস সংরক্ষণ, প্রসার ও বাস্তবায়নের দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। যেমন: জিহাদ যা ইসলামের সর্বোচ্চ চূড়ার ব্যাপারে ইসলাম রাষ্ট্রকে দায়িত্ব দিয়েছে এবং জিহাদের মাধ্যমে দাওয়াত করতে নির্দেশ দিয়েছে। কত সুন্দরই না লাগে যখন ইমাম গাজ্জালী (র) বলেন, ‘অবশ্যই কোরআন এবং সুলতান জমজের মত। কুরআন হল ভিত্তি, সুলতান হল এর রক্ষক। যার কোন ভিত্তি নেই, তা খুব ধ্রুত নিঃশেষ হয়ে যায়; আর যার কোন রক্ষক নেই তা ধ্রুত হারিয়ে যায়।’

Leave a Reply