ভারতীয় পানি আগ্রাসনের এক নতুন অধ্যায়

খবর: ভারত ধারাবাহিকভাবে আন্তঃনদী সংযোগ প্রকল্প বাস্তবায়নের দিকে এগুচ্ছে। সমগ্র প্রকল্পের আওতায় ৩৮টি নদ-নদীর মধ্যে আন্তঃসংযোগ ঘটানো হবে। এতে ৩০টি সংযোগ রক্ষাকারী খাল ও ৩৪টি বাঁধ নির্মাণের পরিকল্পনা আছে। ভারতের ভিতর দিয়ে আসা ৫৪টি নদীর মধ্যে ভারত ইতিমধ্যে বাঁধ দিয়েছে।

এই প্রকল্পের মূল বিষয়টি হচ্ছে, উত্তর-পূর্ব ভারতের ব্রহ্মপুত্র ও উত্তর ভারতের গঙ্গার পানি সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হবে সুদূর দক্ষিণাত্যে এবং পশ্চিমে রাজস্থানে। গঙ্গা ও ব্রহ্মপুত্র এই দুই বড় নদী ও তাদের বিভিন্ন শাখা-প্রশাখা খাল দ্বারা সংযোগ করে এদিককার পানি ওদিকে নেয়ার এক বিশালকার প্রকল্প হচ্ছে নদী সংযোগ প্রকল্প। এই ভাবে ৩৭টি নদীকে ৩০টি খাল দ্বারা সংযোগ করা হবে। খালগুলোর মোট দৈর্ঘ্য হবে ১২ হাজার কিলোমিটার। গড়ে একেকটি খাল চারশ কিলোমিটার লম্বা। খালগুলো হবে ৫০ থেকে ১০০ মিটার চওড়া। গভীরতা ছয় মিটার। অর্থাৎ একেকটি খাল যেন একেকটা নদী। বলাই বাহুল্য, এতে বিপুল পরিমাণ কৃষি জমি ধ্বংস হবে।

ব্রহ্মপুত্র থেকে প্রথমে তিস্তা ও পরে তিস্তা থেকে ফারাক্কা বাধের উজানে পানি আনা হবে। এখানে ভুলেও ভাবার সুযোগ নেই যে, ফারাক্কা বাধের উজানের অতিরিক্ত পানির ছিটেফোটা বাংলাদেশে প্রবেশ করবে। বরং ফারাক্কা পয়েন্ট থেকে খাল কেটে উড়িষ্যার সুবর্ণ রেখা ও মহা নদীর সাথে সংযোগ করা হবে। ভারতের আন্তঃনদী সংযোগ প্রকল্পের আরেকটি অংশ হলো একটি সংযোগ খালের মাধ্যমে সাবরমতি নদীর পানি দক্ষিণ ভারতে নিয়ে যাওয়া হবে।

এই প্রকল্পে খাল খননের পাশাপাশি পানি ধরে রাখার ব্যবস্থা করা হবে এবং সেই পানিকে কোথাও কোথাও নদী প্রবাহের প্রাকৃতিক গতির বিপরীত দিকে জোর করে প্রবাহিত করা হবে। এ জন্য বিভিন্ন স্থানে বাধ, ব্যারাজ ও জলাধার নির্মাণ করা হবে। তাছাড়া জলবিদ্যুৎ কেন্দ্রও করা হবে।

এক কথায় এই প্রকল্প বাংলাদেশকে পানিশূন্য ও মরু অঞ্চলে পরিণত করবে।

আঞ্চলিক আধিপত্য বিস্তারে ভারত বহু আগে থেকেই শোষণ চালিয়ে আসছে। সাংস্কৃতিক, অর্থৈনৈতিক এবং রাজনৈতিক আগ্রাসনের ধারাবাহিকতা চলে আসছে বছরের পর বছর ধরে। নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্য থেকে শুরু করে বিদ্যুৎ এবং এমনকি নদীও ভারত হস্তগত করে চলেছে।

এই আন্তঃনদী প্রকল্পের ফলে বাংলাদেশের সম্ভাব্য ক্ষতি নিম্নে উল্লেখ করা হলো,

১। ভারত উজানে গঙ্গা, ব্রহ্মপুত্র, তিস্তা, ধরলা, দুধ কুমার, করতোয়া ও মহানন্দা থেকে পানি প্রত্যাহার করলে এই সকল নদী এবং শাখা নদী অর্থাৎ বাংলাদেশের অধিকাংশ নদী শুকিয়ে যাবে। নদীমাতৃক বাংলাদেশের ভূ-প্রকৃতিই বদলে যাবে। শস্য শ্যামলা বাংলাদেশ মরু প্রান্তরে পরিণত হওয়ার আশংকা আছে।

২। নদীতে যতোটুকু ক্ষীণ ধারায় প্রবাহিত পানি থাকবে দিনে দু’বার জোয়ারে, তা সমুদ্রের জোয়ারের পানিকে বাধা দিতে পারবে না। ফলে জোয়ারের লবণাক্ত পানি উত্তরের দিকে উঠে আসবে, এমনকি সিলেট পর্যন্তও আসবে। এতে মিষ্টি পানির অভাব দেখা দেবে। চাষের ও খাবারের পানির অভাব ঘটবে। এতেও মরু প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত হবে। মিষ্টি পানির মাছও মারা যাবে। মৎস্যজীবীরা বেকার হবে। মাছে-ভাতে বাঙ্গালির পরিচয় মুছে যাবে।

৩। ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নেমে যাবে। রিচার্জ হবে না। তাতেও মরু প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত হবে।

৪। যেটুকু ভূগর্ভস্থ পানি পাওয়া যাবে নলকূপের মাধ্যমে, তাতেও আর্সেনিকের পরিমাণ খুব বেশি হবে। ফলে খাবার অযোগ্য হয়ে উঠবে।

৫। নদীবাহিত পলি দ্বারা যে নতুন ভূখণ্ড তৈরি হচ্ছে (বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চল এই ভাবেই গঠিত হয়েছিল প্রাগৈতিহাসিক যুগে), সেই ভূমি গঠন বন্ধ হবে। এক কথায় সবুজ বাংলাদেশ মরুদেশে পরিণত হবে।

৬। নদী পথ সঙ্কুচিত হবে। ইতোমধ্যেই প্রধানত ফারাক্কা বাধ ও তিস্তার উজানে বাধের কারণে ১৯৭১ সাল থেকে ২০১৩ সালের মধ্যে নৌপথ ২৪ হাজার কিলোমিটার থেকে ২৪শতে (অর্থাৎ দশমাংশে) নেমে এসেছে।

একটা কথা বলা হয় যে, বাংলাদেশে নাকি পানির অপচয় হয়। প্রচুর পরিমাণ পানি বঙ্গোপসাগরে গিয়ে পড়ে। যারা এমন কথা বলেন, তারা চরম অজ্ঞতাই প্রকাশ করেন। কারণ নদীতে প্রচুর পানি থাকলেই নদী প্রবাহের জোর থাকবে, যা সাগরের জোয়ারের নোনা পানিকে উপরে উঠে আসতে বাধা দেয়। ইতোমধ্যেই ফারাক্কা বাধের কারণে দক্ষিণ বাংলায় জোয়ারের পানি অনেক বেশি ভেতরে প্রবেশ করছে। লবণাক্ততা বৃদ্ধি পাচ্ছে। চাষের জমি নষ্ট হচ্ছে। যদি কোনোভাবে ভারতের নদী সংযোগ প্রকল্প বাস্তবায়িত হয়, তাহলে সমুদ্রের লবণাক্ত পানি সিলেট পর্যন্ত চলে আসবে। বাংলাদেশে এই প্রকল্পের অন্যান্য আরও ক্ষতিকর দিক আছে।

ভারতের এমন ঔদ্ধত্যতা কোন নতুন ইস্যু নয়, বরং আমেরিকা-বৃটেনের সবুজ সংকেতের আধারে একের পর এক আগ্রাসন চালিয়ে যাচ্ছে। বাংলাদেশকে একটি পঙ্গু এবং এর উপর কর্তৃত্ব নেওয়ার লক্ষ্যে এইসকল আগ্রাসন সে নিত্যদিনই চালায়। বিডিআর হত্যাকাণ্ড থেকে শুরু করে সীমান্তে হত্যা, এবং দেশের অভ্যন্তরে মাদক চালানের মত ঘৃণ্য অপরাধ সে করে আসছে নির্বিঘ্নেই।

অন্যদিকে এদেশের শাসকগোষ্ঠী ভারতেরই এসকল আগ্রাসনে নিশ্চুপে সমর্থন দিয়ে যাচ্ছে আর জনগণকে উপহার দিচ্ছে “শেখ রাসেল আন্তর্জাতিক ফুটবল ম্যাচ” অথবা বিপিএল। ভারত যখন এদেশের আমাদের রক্ত নিয়ে খেলছে, নির্বোধ শাসকগোষ্ঠী তখন স্কাইপে বসে খেলা দেখে।

মুসলিমদের উপর এইসকল জুলুমের অবসানের একটিই উপায়; তা হলো ইসলামের দিকে প্রত্যাবর্তন। ইসলামী শাসনব্যবস্থা তথা খিলাফত রাষ্ট্রে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা প্রদত্ত জীবন ব্যবস্থা বাস্তবায়ন নিশ্চিত করে। রাসূল (সা) প্রতিষ্ঠা পরবর্তী ১৯২৪ সাল পর্যন্ত এই ব্যবস্থা বলবৎ ছিল এবং পৃথিবীকে দেখিয়েছে অন্ধকার থেকে আলোতে আসার পথ।

খিলাফত এমন এক অনন্য শাসনব্যবস্থা, যা সুনিশ্চিতরূপে এর জনগণের নিরাপত্তা নিশ্চত করে আর এর অসংখ্য উদাহরণ আমরা ইতিহাসের পাতায় খুঁজে পাবো।

অল্প কিছুকাল পূর্বেও, ১৭৮৫ সালে আজকের সুপার পাওয়ার আমেরিকা তৎকালীন সুপার পাওয়ার খিলাফতের জলসীমানায় প্রবেশ করলে, খিলাফতের নৌবাহিনী তা আটক করে। এবং এই প্রেক্ষিতে ১৭৮৬ সালে ফ্রান্সে তৎকালীন আমেরিকার দূত থমাস জেফারসন ও জন এডামস (ব্রিটেনে তৎকালীন আমেরিকান দূত) লন্ডনে খিলাফতের দূত আবদুর রহমানের সাথে শান্তি চুক্তির লক্ষ্যে বৈঠক কর। এবং পরবর্তীতে খিলাফতের সাথে আমেরিকা BARBARY TREATY করতে বাধ্য হয়।

অথচ আজকে সেই খিলাফত শাসন ব্যবস্থার অভাবে আমেরিকা-বৃটেন ও তাদের দোসর ভারত মুসলিমদের জীবন-সম্পদ নিয়ে খেলছে। আর মুসলিম ভূমিসমূহের যালিম শাসকেরা এদের পা-চাটা দালালে পরিণত হয়েছে।

বাংলাদেশে আজ সেই খিলাফত শাসনব্যবস্থার প্রয়োজন যা এদেশের জনগণকে মুক্তি দিবে আমেরিকা-ভারতের যুলুমে রচিত গণতান্ত্রিক অন্ধকার কুয়া থেকে এবং রাসূল(সা) এর ভবিষ্যৎবাণী অনুসারে আবারো উদিত হবে ইসলামের সূর্য।

আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা বলেন:

তোমাদের মধ্যে যারা ঈমান আনে এবং নেক কাজ করে, তাদের সাথে আল্লাহ তায়ালা ওয়াদা করেছেন, তিনি জমিনে তাদের অবশ্যই খিলাফত দান করবেন- যেমনিভাবে তিনি তাদের আগের লোকদের খিলাফত দান করেছিলেন”। (আন-নূরঃ ৫৫)

রাসূল (সা) বলেন: “...এরপর আবারো আসবে নবুয়্যতের আদলের খিলাফত” (মুসনাদে আহমদ)

Print Friendly, PDF & Email

Leave a Reply