ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কথা বলে যখন ব্রিটিশরা ভারতে আসে তখন জনগণ প্রথমে খুশিই হয়েছিল। কারণ ইংরেজরা হয়তো এখানে বিনিয়োগ করে এদেশের উন্নয়নই করবে!! কিন্তু জনগণ পরে স্বচক্ষে ইংরেজদের ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির বিনিয়োগের অন্তরালে সেসময়ের সুপার পাওয়ার উসমানী খিলাফত [অটোমান] রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ভারত জয়ের নীল নকশা দেখতে পায়। পরবর্তীতে এই ইংরেজরাই প্রায় ১৫০ বছর সরাসরি ভারত উপমহাদেশ শাসন করে, এমনকি এখনো এদেশের শাসকদের এজেন্ট বানিয়ে তারা আগের মতই শাসন করে যাচ্ছে।
আমেরিকার টিকফা চুক্তি ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির উদ্দেশ্যের চাইতে কি ব্যাতিক্রম কিছু??? আসুন দেখি ……
সবশেষ হাসিনার কেবিনেটে পাশ হওয়া টিকফা চুক্তির মূল কথাগুলো এরকম:
[১] চুক্তির শর্ত মোতাবেক বাংলাদেশের বাজার উন্মুক্ত করে দিতে হবে এবং সেবা খাতের ঢালাও বেসরকারিকরণ করতে হবে ।
[২] যুক্তরাষ্ট্রের বহুজাতিক কোম্পানির বাণিজ্য ও বিনিয়োগের জন্য বাংলাদেশের বাজার উন্মুক্ত করে দিতে হবে এবং বিদ্যমান শুল্ক ও অশুল্ক বাধাসমূহ দূর করতে বাংলাদেশ বাধ্য থাকবে ।
[৩] বেসরকারি খাতের বিকাশকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিতে হবে, (মানে সরকারকে জিরো করে আনার বুদ্ধি)।
[৪] দুই দেশের কর্মকর্তাদের সমন্বয়ে গঠিত বাণিজ্য ও বিনিয়োগ কমিশন প্রাইভেট সেক্টরের বিকাশের জন্য প্রয়োজনীয় কাজ করবে ।
[৫] যুক্তরাষ্ট্র ভবিষ্যতে শুধু সেবা খাতেই বাংলাদেশে বিনিয়োগ করবে [ তারা কোনো পণ্য এদেশে উৎপাদন করবে না / সোজা কথা সার্ভিস দিয়ে পয়সা নেয়া ]।
[৬] বাংলাদেশের দেশীয় শিল্প বা প্রতিষ্ঠানকে সুবিধা প্রদানকারী বাণিজ্য সংক্রান্ত অভ্যন্তরীণ সংরক্ষণ নীতি বাতিল করতে হবে [অর্থাৎ শিল্পখাত চরম প্রতিযোগিতার মুখে পড়বে] ।
[৭] যুক্তরাষ্ট্রের বিনিয়োগকারীদের অর্জিত মুনাফা বা পুঁজির উপর কোনো কর আরোপ করা যাবে না ।
[৮] বিনিয়োগের বিশেষ সুরক্ষা দিতে হবে এবং বিনিয়োগ প্রত্যাহার করে নেয়া হলে তার ক্ষতিপূরণ দিতে হবে ।
[৯] দেশের জ্বালানি গ্যাস বিদ্যুৎ বন্দর টেলিযোগাযোগ শিক্ষা স্বাস্থ্য পরিবহন ইত্যাদি খাতে মার্কিন কোম্পানিগুলোকে বাণিজ্যের জন্য উন্মুক্ত করে দিতে হবে ।
[১০] কৃষিপণ্যের বাজার উন্মুক্ত করতে হবে এবং কৃষি থেকে ভর্তুকি প্রত্যাহার করতে হবে ।
[১১] চুক্তি অনুযায়ী মেধাস্বত্ব আইনের কঠোর বাস্তবায়ন নিশ্চিত করবে বাংলাদেশ ।
টিকফা চুক্তিতে এ কথা আছে যে, দুই পক্ষের মধ্যে কারো বাণিজ্য ও বিনিয়োগের সুরক্ষা নিশ্চিত করতে যদি কোনো এক পক্ষ ব্যর্থ হয় তাহলে অপরপক্ষ তাকে ‘সহযোগিতা’ দিবে। স্পষ্টতই চুক্তির এই ধারাতে বাণিজ্যের পাশাপাশি ‘বিনিয়োগের সুরক্ষার’ বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। বিনিয়োগ ও তার সুরক্ষার বিষয়টি প্রায় সর্বাংশে যুক্তরাষ্ট্রের বিষয়। যুক্তরাষ্ট্রে বা অন্য কোনো দেশে বিনিয়োগ করার শক্তি বা ক্ষমতা বাংলাদেশের তেমন নেই। কিন্তু বাংলাদেশে ও সারাবিশ্বে যুক্তরাষ্ট্র একটি প্রধান বিনিয়োগকারী দেশ। চুক্তির বিধান অনুসারে যুক্তরাষ্ট্রের সেই বিনিয়োগ সুরক্ষার দায়িত্ব বাংলাদেশের। বাংলাদেশ যদি সে কাজে অপারগতা প্রদর্শন করে তাহলে যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশকে যুক্তরাষ্ট্রের বিনিয়োগ সুরক্ষার কাজে ‘সহযোগিতা’ দিবে। এই ‘সহযোগিতার’ স্বরূপ কি হতে পারে? ধরা যাক, বাংলাদেশের সমুদ্রসীমায় তেল-গ্যাস অনুসন্ধান ও উত্তোলনের জন্য যুক্তরাষ্ট্রের কোনো কোম্পানির পিএসসি’র মাধ্যমে বিনিয়োগ করলে সেই বিনিয়োগের সুরক্ষা করা বাংলাদেশের কর্তব্য হয়ে উঠবে। এক্ষেত্রে বিষয়টি বাংলাদেশের সমুদ্রসীমার সামরিক নিরাপত্তার প্রশ্নের সাথে সম্পৃক্ত তা যুক্তরাষ্ট্রের জন্য বাংলাদেশের সামুদ্রিক নিরাপত্তার সক্ষমতা বাড়ানোর কাজে ‘সহযোগিতা’ দেয়ার ‘সুযোগ’ খুলে দিবে। চুক্তির এই বিষয়ের সাথে আমরা যদি বঙ্গোপসাগরে মার্কিন নৌ উপস্থিতি, নৌঘাঁটি স্থাপন, বাংলাদেশের অরক্ষিত সমুদ্রসীমা রক্ষার কাজে সহযোগিতা ইত্যাদি বিষয়ে আগ্রহ সম্পর্কে একদিকে জোরালো মার্কিনী বক্তৃতা-বিবৃতি এবং অন্যদিকে সমুদ্রে তেল-গ্যাস উত্তোলনের জন্য মার্কিন তেল কোম্পানিগুলো কর্তৃক পিএসসি চুক্তির মাধ্যমে বিভিন্ন ব্লক ইজারা নিয়ে নেয়ার কথা একসাথে হিসেবে নেই তাহলে কারো পক্ষেই মার্কিন উদ্দেশ্য সম্পর্কে দুয়ে দুয়ে চারের অঙ্ক মিলিয়ে নিতে অসুবিধা হওয়ার কথা নয়।
বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রের বিশ্ব রাজনৈতিক-সামরিক স্ট্র্যাটেজির প্রধান দিক নির্দেশ হলো- ‘চীনকে নিয়ন্ত্রনে রেখে তাকে নিবৃত করা’ (containing the influence of china)। এজন্য এশীয়-প্রশান্ত মহাসাগরীয় এলাকাকে সে তার আন্তর্জাতিক তত্পরতার প্রধান কেন্দ্রে পরিণত করেছে এবং এখানেই তার বিদেশে অবস্থানরত নৌসেনার বেশিরভাগ মোতায়েন করেছে। বাংলাদেশকে এই স্ট্র্যাটেজিতে আরো শক্ত করে আটকে ফেলাটা যুক্তরাষ্ট্রের একটি গুরুত্বপূর্ণ লক্ষ্য। বাংলাদেশকে যুক্তরাষ্ট্রের কথিত ‘সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে গ্লোবাল যুদ্ধের’ আঞ্চলিক সহযোগী করাটাও তার আরেকটি উদ্দেশ্য। এসব ভূ-রাজনৈতিক ইস্যুতে বাংলাদেশকে নিজেদের পরিকল্পনায় আরো নিবিড় ও কাঠামোগতভাবে অন্তর্ভুক্ত করার জন্যই ‘টিকফা’ স্বাক্ষরে যুক্তরাষ্ট্রের এরূপ মরিয়া প্রয়াস। এমনিতেই যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে অনেক গোপন সামরিক চুক্তি রয়েছে। এসবের সাথে ‘টিকফা’ স্বাক্ষরিত হলে বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব ও সাথে সাথে তার নিরাপত্তা গুরুতরভাবে ক্ষুণ্ন হবে।
‘টিকফা’ বা ‘টিফা’ হচ্ছে একটি ঘুমন্ত বাঘ। উন্নত দেশের সঙ্গে অনুন্নত দেশের মধ্যে চুক্তিগুলো মূলত করা হয় গরিব দেশের ভাগ্য উন্নয়নের জন্য। তবে ভাগ্যের বদল হয় না। দক্ষিণ এশিয়ার শ্রীলঙ্কা ও পাকিস্তানের সঙ্গে এবং বিশ্বের অন্যান্য ৭২টি দেশের সঙ্গে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এ ‘টিকফা’ বা ‘টিফা’ চুক্তি করেছে। তাতে তারা খুব বেশি লাভবান হয়েছেন বলে তথ্য পাওয়া যায় না। ‘টিকফা’ বা ‘টিফা’ সম্পর্কে সরকারের বক্তব্যে আপাতদৃষ্টিতে বাণিজ্য ও বিনিয়োগের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকলেও এর সঙ্গে বাংলাদেশের রাজনীতি, অর্থনীতি, নিরাপত্তা ব্যবস্থা এবং আঞ্চলিক বাণিজ্য ও পররাষ্ট্রনীতিসহ অনেক বিষয় জড়িত। এ ধরনের চুক্তি করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক কৌশলের অংশ হওয়া যে কোনো বিচারেই ক্ষতিকর। এতে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে বাংলাদেশকে মার্কিনিদের স্বার্থরক্ষার জন্যই কাজ করতে হবে।
ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি প্রথম এদেশে আসে বাণিজ্য করতে, পরে তারা নিজেদের বাণিজ্যিক কেন্দ্রগুলো পর্তুগিজ ও অন্যান্য দস্যুর কাছ থেকে রক্ষার জন্য ভারতে ঘাটির নামে দুর্গ বানায়। পরে তারা নিজেদের সম্পত্তি রক্ষার জন্য নিজ দেশের সেনাবাহিনীও ভারতে আনতে থাকে। পরে একসময় সেই সেনাবাহিনীই এক এক করে ভারতের সকল অঞ্চল মুসলিম শাসকদের কাছ থেকে জয় করে নেয়। আর মুসলিমরা তখন নিজ আদর্শ থেকে দূরে সরে যাওয়ায় খুবই দুর্বল হয়ে উঠে, যার সুযোগ ইংরেজরা গ্রহন করে।
টিকফা চুক্তি ফলে এদেশের বাণিজ্যের উপর অ্যামেরিকার নিয়ন্ত্রণ বেড়ে যাবে, তখন ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির মত অ্যামেরিকাও নিজ বাণিজ্য রক্ষার জন্য এদেশে সেনাবাহিনী নিয়ে আসবে। আর যে দেশে অ্যামেরিকা সেনাবাহিনী নিয়ে উপস্থিত হয়েছে সেদেশের অবস্থা সম্পর্কে কারই খারাপ ধারণা নেই। ইরাক, আফগান দেখলে তা আরও পরিস্কার হবে। চিন্তা করেন আপনার বাসার সামনে দিয়ে অ্যামেরিকার সৈন্য হেটে যাচ্ছে আর আপনার বাসায় আপনার স্ত্রী ও মেয়েরা খুব ভাল আছে!!!! …… এ কি আদৌ সম্ভব????!!!!
আজকে পৃথিবীতে এমন অবস্থা নেই যে কোন দেশ জয় করে সেখানে কলোনি করে সরাসরি গভর্নর দিয়ে চালানো যাবে, যেমনটা ব্রিটিশরা করত। এখন সময় অ্যামেরিকার, কারণ তারা এখন সুপার পাওয়ার। তারা সরাসরি কোন দেশ জয় করে গভর্নর দিয়ে চালায় না। তারা সে দেশে নিজেদের পছন্দের এজেন্ট বসায় যারা তাদের সকল ইচ্ছা অনিচ্ছা পুরন করবে। যেমন এদেশের দুই নেত্রীর কেউ না কেউ প্রতিবার ক্ষমতায় আসে কোন নেত্রীকে জনগণ ঘৃণা করলে আরেক জনকে অ্যামেরিকা ক্ষমতায় আনে। এদের কাউকে ভাল না লাগলে ডক্টর ইউনুস জাতীয় কাউকে ক্ষমতায় আনবে, যার পাবলিক সাপোর্ট ও অ্যামেরিকার এজেন্টশীপ দুইটাই আছে।
এখানে জনগনের সাপোর্ট পাওয়ার জন্য কিছু কিছু এজেন্ট অনেক সময় অ্যামেরিকার বিরুদ্ধে ক্যাম্পেইন করে। এতে অ্যামেরিকা খুবই খুশি হয় সে এজেন্টের প্রতি, কারণ এতে জনগণ বুঝতে পারবে না যে সেই নেতাও অ্যামেরিকার এজেন্ট, কারণ সে তো অ্যামেরিকাকে বকে অথবা অ্যামেরিকার বিরুদ্ধে কথা বলে। যেমন, পাকিস্তানের ইমরান খান, নওয়াজ শরীফ, ইরানের আহমাদে নিজাদ ইত্যাদি।
মুলত পৃথিবীর সবস্থানে যেহেতু অ্যামেরিকার আদর্শ গনতন্ত্র ও পুঁজিবাদ প্রতিষ্ঠিত, সেহেতু যেকোন শাসককে ক্ষমতায় যেতে হলে অ্যামেরিকার আদর্শ প্রতিষ্ঠা ও অ্যামেরিকাকে সকল প্রকার সহযোগিতা করার প্রতিশ্রুতি দিয়েই ক্ষমতায় যেতে হবে। তাই বর্তমান প্রচলিত ও প্রতিষ্ঠিত আদর্শে যারা ক্ষমতা চায় তারা সবাই কোন না কোন ভাবে অ্যামেরিকার এজেন্ট, হোক সে ইসলাম পন্থী অথবা সমাজতন্ত্রী।
সুতরাং আজ এদেশের সকল জনগণকে পূর্বের ভুলকে না ভুলে এতটুকু হলেও উপলব্ধি করা উচিত যে তারা যখন এই গনতান্ত্রিক আদর্শকে প্রতিষ্ঠিত করার প্রতিশ্রুতিবদ্ধ কোন প্রার্থীকে ভোট দেয় তারা আর কাউকে নয় একজন স্বঘোষিত সাম্রাজ্যবাদী অ্যামেরিকার এজেন্টকে ভোট দেয়, যে কিনা এদেশের সাধারন জনগনের কাছ থেকে ছিনিয়ে নিয়ে অ্যামেরিকার খাদ্য, বস্ত্র ও বাসস্থানের জোগান দেয়।
এতএব, এই ক্রান্তি কালে মানুষের পূর্বের ইতিহাসকে স্মরন করে শুধুমাত্র একটি কাজই করা উচিৎ আর তা হল সেই ৬২২-১৯২৪ সাল পর্যন্ত প্রায় ১৩০০ বছর গৌরবের সাথে পৃথিবীর বুকে একচ্ছত্রভাবে টিকে থাকা ইসলামিক শাসন খিলাফত ব্যাবস্থাকে ফিরিয়ে আনা। আর এ কাজে যারা নিয়োজিত তাদের সক্রিয় ভাবে সহযোগিতা করা। কারণ এটি সেই বাবস্থা যা সরাসরি সৃষ্টিকর্তা প্রদত্ত যা মানব জীবনের একমাত্র জীবনবাবস্থা। তবে তারা এ সহযোগিতা করুক আর না করুক খিলাফত আবারো পৃথিবীতে আসবে এটা রাসুল (সা) এর ভবিষ্যৎবানী যা কখনো ভুল হবার নয়……..
“তোমাদের মধ্যে নবুয়ত থাকবে যতক্ষণ আল্লাহ ইচ্ছা করেন, তারপর আল্লাহ তার সমাপ্তি ঘটাবেন। তারপর প্রতিষ্ঠিত হবে নবুয়তের আদলে খিলাফত। তা তোমাদের মধ্যে থাকবে যতক্ষণ আল্লাহ ইচ্ছা করেন, অতঃপর তিনি তারও সমাপ্তি ঘটাবেন। তারপর আসবে যন্ত্রণাদায়ক বংশের শাসন, তা থাকবে যতক্ষণ আল্লাহ ইচ্ছা করেন। এক সময় আল্লাহর ইচ্ছায় এরও অবসান ঘটবে। তারপর প্রতিষ্ঠিত হবে জুলুমের শাসন এবং তা তোমাদের উপর থাকবে যতক্ষণ আল্লাহ ইচ্ছা করেন। তারপর তিনি তা অপসারন করবেন।
“তারপর আবার ফিরে আসবে খিলাফত – নবুয়্যতের আদলে।” (মুসনাদে আহমদ, খণ্ড ৪, পৃষ্ঠা -২৭৩, হাদিস নং-১৮৫৯৬ )
রাশেদুল ইসলাম