মদীনার প্রান্তসীমায় অবস্থিত ইহুদী গোত্রগুলোর সাথে চুক্তি সম্পন্ন হবার পর রাসূল (সা) যখন বুঝলেন যে, মদীনার নবগঠিত ইসলামী সমাজ দৃঢ় ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত হয়েছে তখন তিনি জিহাদের জন্য প্রস্তুতি নিতে শুরু করলেন। কারণ, দ্বীন ইসলামের আহবানকে সমস্ত পৃথিবীব্যাপী ছড়িয়ে দিয়ে কুফর নিয়ন্ত্রিত ভূমিকে ইসলামের পতাকাতলে নিয়ে আসা ইসলামী রাষ্ট্রের অন্যতম দায়িত্ব। আর ইসলামের আহবানকে ছড়িয়ে দেবার এ কাজটি কোন ভাবেই মিশনারীদের কাজের সাথে তুলনীয় নয়। বরং, ইসলামী রাষ্ট্রের দায়িত্ব হলো মানুষকে ইসলামের দিকে আহবান করা, তাদেরকে ইসলামী ধ্যান-ধারণা ও হুকুম-আহকাম শিক্ষা দেয়া ও সমাজের মানুষকে এ আলোকে গড়ে তোলা এবং সর্বোপরি সমাজ ও রাষ্ট্রে দ্বীন ইসলাম বাস্তবায়নের পথে যে কোন ধরনের বস্তুগত বাঁধা অপসারণ করতে প্রয়োজনীয় বস্তুগত পদক্ষেপ গ্রহন করা।
বস্তুতঃ মক্কার কুরাইশরা সবসময়ই দ্বীন ইসলাম প্রচারের পথে সর্বাত্মক বস্তুগত বাঁধা তৈরী করেছে, যে কারণে এ বাঁধা অপসারনে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহন করা এমনিতেই জরুরী ছিলো। এ চিন্তা মাথায় রেখে এবং একই সাথে মদীনায় সীমানা অতিক্রম করে ইসলামের আহবানকে সর্বত্র ছড়িয়ে দেয়ার লক্ষ্যে রাসূল (সা) তাঁর সৈনাবাহিনী প্রস্তুত করতে শুরু করলেন। এ উদ্দেশ্যে তিনি (সা) কুরাইশদেরকে চ্যালেঞ্জ করে বিশেষ উদ্দেশ্যে কিছু বাহিনী প্রেরণ করেন যা একই সাথে মদীনার মুনাফিক, ইহুদী ও মদীনার বাইরের ইহুদী গোত্রগুলোকেও সর্তক সংকেত প্রদান করেছিলো। তিনি চারমাসে মদীনার বাইরে তিনটি সৈন্যদল পাঠান।
তিনি (সা) হামযাহ (রা) এর নেতৃত্বে মুহাজিরদের মধ্য হতে ত্রিশজনের একটি দলকে আল-’ইশয়ের নিকটবর্তী অঞ্চলে পাঠান, এ অভিযানে আনসারদের মধ্য থেকে কেউ অংশগ্রহন করেনি। হামযাহ (রা) তাঁর দলবলসহ সমুদ্র তীরে আবু জাহল ইবন হিশাম ও তার তিনশত সহযাত্রীর মুখোমুখি হলে যুদ্ধাবস্থার সৃষ্টি হয়, কিন্তু মাযদি ইবন ’আমর আল-জুহানি উভয় পক্ষকে যুদ্ধ ব্যতীতই আলাদা করে দেন। এরপর রাসূল (সা) মুহাজিরদের মধ্য হতে ষাট জন অশ্বারোহীকে মুহাম্মদ ইবন ’উবাইদা ইবন আল-হারিছাহর নেতৃত্বে অভিযানে পাঠান। এ অভিযানেও আনসারদের মধ্য হতে কেউ ছিলো না। মুহাম্মদ ইবন ’উবাইদা (রা) রাবিগাহর উপত্যকায় আবু সুফিয়ানের মুখোমুখি হন। আবু সুফিয়ান এ সময় দুশোরও বেশী অশ্বারোহী বাহিনীর নেতৃত্ব দিচ্ছিল। এ অভিযানও শেষ পর্যন্ত যুদ্ধ পর্যন্ত গড়ায়নি, শুধুমাত্র সা’দ ইবন আবি ওয়াক্কাস ঐদিন শত্রুপক্ষকে উদ্দেশ্য করে একটি তীর নিক্ষেপ করেছিলেন। এছাড়া, আল্লাহর রাসূল (সা) সা’দ ইবন আবি ওয়াক্কাসের নেতৃত্বে বিশজন অশ্বারোহীকে মক্কার দিকে প্রেরণ করেছিলেন, কিন্তু তারাও কোনরকম যুদ্ধ ব্যতীতই ফিরে আসেন।
এ অভিযানগুলো মূলতঃ মদীনায় যুদ্ধের একটি আবহ তৈরী করেছিলো এবং রাসূল (সা) এর পরিকল্পিত একের পর এক এই অভিযানগুলো মক্কার কুরাইশদেরকেও যথেষ্ট পরিমাণে শঙ্কিত করেছিলো। কিন্তু, রাসূল (সা) শুধু তাঁর দলবলকে অভিযানে প্রেরণ করেই থেমে থাকেননি বরং, পরবর্তীতে তিনি (সা) নিজেও কুরাইশদের বিরুদ্ধে অভিযানে অংশগ্রহন করেন। মদীনাতে রাসূল (সা) এর হিজরতের এক বছর পর তিনি (সা) কুরাইশ এবং বনু দামরাহ গোত্রকে অতর্কিত আক্রমণের উদ্দেশ্যে ওয়াদ্দান পর্যন্ত পৌঁছে যান। এ অভিযানে তিনি (সা) কুরাইশদের মুখোমুখি না হলেও বনু দামরাহ গোত্র আল্লাহর রাসুলের সাথে শান্তিচুক্তি করে। এরপর আল্লাহর রাসূল (সা) মদীনার আনসার ও মুহাজিরদের সমন্বয়ে গঠিত দুইশত যোদ্ধা সহ অভিযানে বের হন এবং রাদওয়ার নিকটবর্তী বুয়াত নামক স্থানে পৌঁছান। এ অভিযানের উদ্দেশ্য ছিলো উমাইয়া ইবনে খালফের নেতৃত্বে প্রায় আড়াই হাজার উট এবং একশত যোদ্ধার সম্বন্বয়ে গঠিত পৌত্তলিকদের বাণিজ্য কাফেলাকে ধাওয়া করা। কিন্তু, এ বাণিজ্য
কাফেলাটি প্রচলিত পথ না ধরে অন্য পথ ধরে যাত্রা করায় আল্লাহর রাসূল (সা) পৌত্তলিকদের এ দলটিকে ধরতে ব্যর্থ হন। বুয়াত অভিযানের তিন মাস পর রাসূল (সা) আবু সালামাহ ইবন ’আবদ আল-আসাদকে মদীনার দায়িত্বে রেখে দু’শোর বেশি মুসলিম সহ আবারও অভিযানে বের হন। তিনি (সা) তাঁর দলবল সহ ইয়ানবু উপত্যকার আল-উশাইরাহ নামক স্থানে পৌঁছান। এ স্থানে তিনি (সা) জমাদিউল আউয়াল মাসে পৌঁছান এবং জমাদিউস সানির কিছুদিন পর্যন্ত এখানে অবস্থান করেন। এ স্থানে তিনি কুরাইশ নেতা আবু সুফিয়ানের বাণিজ্য কাফেলাকে ধাওয়া করার জন্য অবস্থান গ্রহন করেন। কিন্তু, এবারও তিনি (সা) তাঁর লক্ষ্য অর্জনে ব্যর্থ হন। কিন্তু, এ অভিযান একেবারে ব্যর্থ হয়নি, কারণ এই অভিযানে তিনি (সা) বনু মুদলাজ এবং তাদের মিত্র বনু দামরাহর সাথে শান্তিচুক্তি সম্পাদন করেন।
এরপর আল্লাহর রাসূল (সা) মদীনায় ফিরে আসার মাত্র দশদিনের মধ্যে কারজ ইবন জাবির আল ফাহরি নামে এক পৌত্তলিক মদীনার চারনভূমি আক্রমণ করে। আল্লাহর রাসূল (সা) সাহাবীদের সঙ্গে নিয়ে তার খোঁজে বের হন। কারজ ইবন জাবির ছিলো কুরাইশদের মিত্র পক্ষের লোক। আল্লাহর রাসূল (সা) বদরের নিকটবর্তী সাফওয়ান উপত্যকা পর্যন্ত কারজ ইবন জাবিরকে ধাওয়া করেন। কিন্তু, কারজ ইবন জাবির পালিয়ে যেতে সক্ষম হয়। এটা ছিলো বদর প্রান্তরে মুসলিমদের প্রথম আক্রমণ।
এভাবেই আল্লাহর রাসূল (সা) তাঁর গঠিত সৈন্যবাহিনীকে সমস্ত আরব ব-দ্বীপ অঞ্চলের বিভিন্ন স্থানে অভিযানে পাঠিয়ে কুরাইশদের প্রকাশ্যে চ্যালেঞ্জ করতে শুরু করেন। যদিও এ সকল অভিযানে প্রকৃতপক্ষে কোন যুদ্ধ সংগঠিত হয়নি কিন্তু, তারপরেও এ সব ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অভিযান থেকে অর্জিত প্রাপ্তি পরবর্তী সময়ের বড় বড় যুদ্ধের পথকে মসৃণ করেছিলো। কারণ, এ সমস্ত অভিযানে মুসলিমদের যে সামরিক প্রশিক্ষণ হয় তা মূলতঃ তাদের যুদ্ধের ময়দানের জন্যই প্রস্তুত করে। এছাড়া, মুসলিমদের ছোট ছোট এ সমস্ত অভিযান মদীনার মুনাফিক ও ইহুদী গোত্রগুলোর মেরুদন্ডে আতঙ্কের স্রোত প্রবাহিত করে, যা তাদের মুসলিমদের বিরুদ্ধে কোন ধরনের ঝামেলা তৈরী করার চিন্তা থেকে বিরত রাখে। কুরাইশদের উদ্দেশ্যে আল্লাহর রাসূল (সা) এর এ প্রকাশ্য চ্যালেঞ্জ যেমন একদিকে পৌত্তলিকদের মনোবল ভেঙ্গে দিয়েছিলো আবার অন্যদিকে মুসলিমরা মানসিকভাবে প্রচন্ড আত্মবিশ্বাসের সাথে উজ্জীবিত হয়েছিলো। এছাড়া, রাসূল (সা) মদীনা এবং লোহিত সাগর তীরের মধ্যবর্তী অঞ্চলে বসবাসকৃত বিভিন্ন গোত্র যেমন, বনু দামরাহ, বনু মুদলাজ এবং আরও অনেক গোত্রের সাথে মিত্রতার চুক্তি করে কুরাইশদের সিরিয়াগামী বাণিজ্য কাফেলার পথে অনেক বাঁধাবিপত্তিরও সৃষ্টি করেন।