মুনকারের অপসারন একটি ফরজ দায়িত্ব এবং একে প্রতিহত করার জন্য শক্তিপ্রয়োগ নির্ভর করে সামর্থ্যের উপরে।
শরীয়াহ কর্তৃক প্রত্যাখ্যাত এবং নিষিদ্ধ সমস্ত কাজই হচ্ছে মুনকার, যেমন কোন ফরয কাজে অবহেলা করা অথবা কোন হারাম কাজ সম্পাদন করা। মুনকারের অপসারন করা আল্লাহ্ কর্তৃক নির্ধারিত হুকুম শর’ঈ যা ব্যক্তিগত, দলগত, সাংগঠনিক, জাতিগত এবং রাষ্ট্রীয় সমস্ত পর্যায়ে সকল মুসলিমের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। আবু সাঈদ আল খুদরী থেকে মুসলিম শরীফে বর্ণিত আছে, “আমি রাসূল (সা) কে বলতে শুনেছি, ‘তোমাদের মধ্যে কেউ কোন মুনকার দেখে তাহলে সে যেন তার হাত দিয়ে তা পরিবর্তন করে দেয়, যদি সে তাতে সক্ষম না হয় তাহলে সে যেন মুখ দিয়ে তা সম্পাদন করে এবং যদি সে তাতেও সক্ষম না হয় তাহলে সে যেন তার অন্তর দিয়ে তা (প্রত্যাখ্যান) করে এবং এটাই হচ্ছে দূর্বলতম ঈমান”।
সৎ কাজের আদেশ এবং অসৎ কাজের নিষেধের জন্য নিজেদের মধ্য থেকে দল বা সংগঠন প্রতিষ্ঠা করা মুসলিমদের জন্য আল্লাহর তরফ থেকে একটি ফরয দায়িত্ব। আল্লাহ্ বলেন,
“তোমাদের মধ্য থেকে একটি দল বের হোক যারা মানুষকে কল্যাণের (খায়ের) দিকে ডাকবে সৎকাজের (মারুফ) আদেশ করবে এবং অসৎকাজের (মুনকার) নিষেধ করবে এবং তারাই হচ্ছে সফলকাম’’। [আলে-ইমরান: ১০৪]
এই জাতিকে আল্লাহ্ শ্রেষ্ঠ জাতির সম্মানে ভূষিত করেছেন যার উদ্ভব ঘটানো হয়েছে মানবজাতির কল্যাণে, যাতে সে সৎকাজের আদেশ করতে পারে, অসৎকাজে নিষেধ করতে পারে এবং আল্লাহর উপরে ঈমান আনতে পারে । তিনি বলেন,
“তোমরাই হলে শ্রেষ্ঠ জাতি যার উদ্ভব ঘটানো হয়েছে মানবজাতির কল্যাণে যাতে তোমরা সৎ কাজের আদেশ কর, অসৎ কাজের নিষেধ কর এবং আল্লাহর উপরে ঈমান আন’’। [আলে ইমরান: ১১০]
সৎ কাজের আদেশ এবং অসৎ কাজের নিষেধকে আল্লাহ মুমিন এবং মুনাফিকের মধ্যে পার্থক্যকারী সাব্যস্ত করেছেন। তিনি বলেন,
“মুনাফিক পুরুষ ও মুনাফিক নারী একে অপরের হতে, তারা অসৎ কাজের আদেশ করে এবং সৎ কাজে নিষেধ করে’’। [আত তাওবাহ: ৬৭]
তিনি আরো বলেন,
“মুমিন নর-নারী একে অন্যের আউলিয়া (সাহায্যকারী, রক্ষক, বন্ধু)। তারা সৎ কাজের আদেশ করে, অসৎ কাজের নিষেধ করে এবং তারা সালাত কায়েম করে”। [আত তাওবাহ: ৭১]
মুনকারের ব্যাপারে নীরব থাকা এবং তা নির্মূলের লক্ষ্যে কাজ না করার ব্যাপারে আল্লাহ মুসলিমদেরকে শাস্তির ভয় দেখিয়েছেন। হুযাইফা বিন আল ইয়ামান থেকে বর্ণিত যে রাসূল (সা) বলেছেন, “সেই সত্তার শপথ যার হাতে আমার জীবন, তোমরা অবশ্যই সৎ কাজের আদেশ করবে এবং অসৎ কাজের নিষেধ করবে, অন্যথায় আল্লাহ্ তোমাদেরকে শাস্তি দিবেন, তখন তোমরা তাঁর কাছে প্রার্থনা করবে (সাহায্য চাইবে) কিন্তু তিনি সাড়া দিবেন না ।হাইছাম থেকে আরো বর্ণিত আছে, তিনি বলেন, “আমি রাসূল (সা) কে বলতে শুনেছি, ‘কোন সম্প্রদায়ের মধ্য থেকে কিছু লোক যদি অন্যায় কাজ সংঘটিত করে এবং সেটা পরিবর্তন করার সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও তারা সেটা না করে তাহলে আল্লাহ্ তাদের সবার উপরে আযাব নাযিল করেন”।
আহমাদ থেকে বর্ণিত যে, রাসূল (সা) বলেছেন, “কিছু বিশেষ লোকের কৃতকর্মের জন্য আল্লাহ্ সমস্ত মানুষকে শাস্তি দেন না, যদি না তারা নিজেদের মধ্যে অপকর্ম সংঘটিত হতে দেখে এবং পরিবর্তন করার সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও তা না করে। যদি তারা এরূপ আচরণ করে তাহলে তিনি সেসব বিশেষ লোকের পাশাপাশি অন্যান্য সাধারণ মানুষকেও শাস্তি প্রদান করেন”।
অতএব কোন মুসলিম যদি তার সামনে কোন অপকর্ম সংঘটিত হতে দেখে – যেকোনো অপকর্ম- তাহলে তাতে নিষেধ করতে হবে এবং নিজ নিজ সামর্থ্য অনুসারে। আবু সাঈদ আল খুদরী কর্তৃক হাদীসে উল্লেখিত তিনটি পন্থার যেকোনো একটি অনুসারে একে পরিবর্তন করতে হবে, অন্যথায় সে গোনাহগার হবে ।
মুসলিমরা ইসলামী শাসনব্যবস্থার অধীনে থাকুক অথবা কুফর শাসনব্যবস্থার অধীনে, শাসক ইসলামী শাসনব্যবস্থা যথার্থরুপে বাস্তবায়ন করুক অথবা এর অপপ্রয়োগ করুক- সর্বাবস্থায়ই সৎকাজের আদেশ এবং অসৎকাজের নিষেধ মুসলিমদের উপর ফরয। সৎকাজের আদেশ এবং অসৎকাজে নিষেধের চর্চা রাসুল (সা) এর সময়ে ছিল, সাহাবাদের (রা) সময়ে ছিল, তাবিঈ এবং তাবি-তাবিঈগণের সময়েও ছিল এবং এটা কিয়ামতের আগ পর্যন্ত চলতে থাকবে । ব্যক্তি, দল বা রাষ্ট্র যে কারো দ্বারাই মুনকার সংঘটিত হতে পারে । রাষ্ট্র, ব্যক্তি এবং সংগঠন প্রত্যেকেরই দায়িত্ব হচ্ছে মুনকারকে নিষেধ করা এবং তা পরিবর্তন করা ।
ইসলামী রাষ্ট্রে মূলত শাসকই হচ্ছেন জনগণের বিষয়াদিকে শরীয়া আইন দ্বারা দেখাশোনা করার জন্য দায়িত্বশীল, অনুরূপভাবে কোন ব্যক্তি বা দল কর্তৃক সংঘটিত মুনকারকে শরীয়া দ্বারা নিষেধ করার জন্যও তিনি দায়িত্বশীল। রাসূল (সা) বলেন, “ইমাম হচ্ছে রাখাল (রক্ষক) এবং সে তার জনগণের জন্য দায়িত্বশীল”। আল্লাহ্ তাকে সবধরনের ফরয (আল্লাহ্ কর্তৃক নির্দিষ্ট দায়িত্ব সমূহ) পালনের জন্য ব্যক্তি দলের উপর শক্তিপ্রয়োগের ক্ষমতা দিয়েছেন। যদি এসব দায়িত্ব পালন করানোর জন্য তাদের উপর শক্তি প্রয়োগের প্রয়োজন দেখা দেয় তাহলে সেটা করতে তিনি বাধ্য। আল্লাহ্ তার উপরে এটাও বাধ্যতামূলক করেছেন যে তিনি নিষিদ্ধ কাজ বাস্তবায়ন করা থেকে লোকজনকে প্রতিরোধ করবেন। যদি এসব নিষিদ্ধ কাজ থেকে লোকজনকে সরিয়ে রাখতে তাদের উপর শক্তি প্রয়োগের প্রয়োজন দেখা দেয় তাহলে সেটা করতে তিনি বাধ্য । অতএব হাত অর্থাৎ শক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে মুনকারের পরিবর্তন এবং প্রতিরোধের জন্য মূলত রাষ্ট্রই হচ্ছে দায়িত্বশীল, কারণ ইসলামের প্রয়োগ এবং ইসলামী আইন মেনে চলতে বাধ্য করার জন্য শক্তি প্রয়োগ উভয়ের জন্য শরীয়াহ মোতাবেক রাষ্ট্র হচ্ছে দায়িত্বশীল ।
এবার আসা যাক ব্যক্তি কর্তৃক সংঘটিত কোন অপকর্মের ব্যাপারে, কোন ব্যক্তি যদি তার সামনে কোন অপকর্ম সংঘটিত হতে দেখে; যেমন কোন ব্যক্তি কর্তৃক মদ্যপান করা, চুরি করা, কাউকে হত্যার চেষ্টা করা অথবা কোন নারীর সাথে ব্যভিচার করা অথবা অন্য যেকোনো অপকর্ম তাহলে সেসব অপকর্মে নিষেধ করা এবং এগুলোকে পরিবর্তন ও নির্মূল করা তার জন্য একটি বাধ্যবাধকতা; এ কাজে ব্যর্থ হলে সে গোনাহগার হবে। নিজের হাত দ্বারা যদি সে অপকর্মকে নির্মূল করতে সক্ষম হয় অথবা এরূপ সম্ভাবনাও থাকে তাহলে পরিবর্তনের জন্য কাজ শুরু করা এবং তা নির্মূল করা তার জন্য একটি বাধ্যবাধকতা। এভাবেই সে কাউকে মদ্যপান করা অথবা চুরি করা অথবা কাউকে হত্যা করা অথবা কারো সাথে ব্যভিচার করা থেকে বিরত রাখবে। একে নিজের হাত দিয়ে সে প্রতিহত ও নির্মূল করবে কারণ এরূপ করতে সে সক্ষম এবং এর মাধ্যমে সে পালন করবে রাসূল (সা) এর হাদীস, “তোমাদের মধ্যে যদি কেউ কোনো অপকর্ম সংঘটিত হতে দেখ, সে যেন নিজের হাত দিয়ে তা পরিবর্তন করে দেয়”।
হাত অর্থাৎ শক্তিপ্রয়োগের বিষয়টি নির্ভর করে কোন অপকর্মকে পরিবর্তন করার প্রকৃত সামর্থ্যের উপর—এমনকি যদি অপকর্মটি হাত দ্বারা পরিবর্তন ও নির্মূলের সম্ভাবনাও পরিলক্ষিত হয় । যদি অপকর্ম নির্মূলের সামর্থ্য না থাকে তাহলে হাত ব্যবহারের প্রয়োজন নেই কারণ এক্ষেত্রে অপকর্ম পরিবর্তন ও নির্মূলের যে লক্ষ্য তা অর্জিত হবেনা। তার ক্ষেত্র হলো প্রকৃতপক্ষে অপকর্মটি পরিবর্তনের সামর্থ্য ।
আর এর প্রমাণ হচ্ছে অক্ষমতার ক্ষেত্রে হাদীসটিতে হুকুমের পরিবর্তন অর্থাৎ হাত দিয়ে নিষেধ করা এবং নির্মূল করার সামর্থ্য না থাকলে মুখ দিয়ে নিষেধ করার হুকুম; যেখানে বলা হচ্ছে “যদি সে তাতে সক্ষম না হয় তাহলে সে যেন মুখ দিয়ে তা নিষেধ করে।” মুখ দিয়ে নিষেধ করাকে অপকর্মের পরিবর্তন হিসেবে গণ্য করা যাবে না বরং এর মানে হচ্ছে অপকর্ম সম্পাদনকারীকে মৌখিকভাবে সতর্ক করা অর্থাৎ অপকর্ম সম্পাদনকে প্রত্যাখ্যান করা। যদি সে মৌখিকভাবে প্রত্যাখ্যান করতে না পারে তাহলে অন্তর দিয়ে অপকর্মটি ঘৃণা করতে হবে এবং সে কোনভাবে একে গ্রহণ করতে পারবেনা।
এতক্ষণ আলোচনা হলো ব্যক্তি এবং দল কর্তৃক সংঘটিত অপকর্মের ব্যাপারে, যেমন শাসক যদি অন্যায় আচরণ করে অথবা জনগণের সম্পদে অন্যায়ভাবে হস্তক্ষেপ করে অথবা কাউকে তার অধিকার থেকে বঞ্চিত করে অথবা জনগণের প্রতি দায়িত্ব পালনে অবহেলা করে অথবা রাষ্ট্রের প্রতি কর্তব্য পালনে শৈথিল্য প্রদর্শন করে অথবা ইসলামের কোনো হুকুমের সাথে ভিন্নমত পোষণ করে অথবা অন্য যেকোনো অপকর্ম করে তাহলে তাকে সঠিক পথে ফিরিয়ে আনা, তার অপকর্মকে প্রত্যাখ্যান করা এবং তা পরিবর্তন করা জাতি, সেনাবাহিনী, দল এবং ব্যক্তিগতভাবে সমস্ত মুসলিমের উপর একটি বাধ্যবাধকতা; তারা যদি এ ব্যাপারে নীরবতা অবলম্বন করা এবং অন্যায়ের প্রতিবাদ করা ও তা পরিবর্তনের জন্য কাজ করা থেকে বিরত থাকে তাহলে তারা গুনাহগার হবে।
শাসকের কিছু অপকর্মের ক্ষেত্রে অন্যায়ের প্রতিবাদ ও পরিবর্তন করার বিষয়টি মুখ দ্বারা সম্পাদন করতে হবে যেমনটি মুসলিম কর্তৃক উম্মে সালমা হতে বর্ণিত আছে যে, রাসূল (সা) বলেন, “তোমাদের কিছু নেতা (আমীর) আসবে, যাদের কিছু কাজ তোমরা সত্য বলে স্বীকার করবে এবং কিছু কাজ প্রত্যাখ্যান করবে। যারা (অন্যায়কে) ঘৃণা করবে তারা নিজেদেরকে (দায়িত্ব থেকে) মুক্ত করে নিবে এবং যে প্রত্যাখ্যান করবেI সে নিরাপদ, কিন্তু তাদের কি অবস্থা হবে যারা (অন্যায়কে) গ্রহণ করবে এবং অনুসরণ করবে?” আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ হতে আরো বর্ণিত আছে, রাসূল (সা) বলেন, “না, আল্লাহর কসম, তোমরা সৎকাজের আদেশ করবে এবং অসৎকাজে নিষেধ করবে এবং অত্যাচারীর হাত চেপে ধরবে এবং তাকে সঠিক পথে ফিরিয়ে আনতে ও তাতে স্থির রাখতে প্রকৃত অর্থেই শক্তি প্রয়োগ করবে, নাহলে আল্লাহ তোমাদের কিছু লোকের অন্তরের সাথে অন্যদের দ্বন্দ্ব সৃষ্টি করে দিবেন এবং তিনি তোমাদেরকে অভিশাপ দিবেন যেভাবে তাদেরকে দিয়েছিলেন।” অনূরূপভাবে, অত্যাচারী শাসকের সামনে সত্য কথা বলাকে রাসূল (সা) সর্বোত্তম জিহাদ সাব্যস্ত করেছেন। “কোনটি সর্বোত্তম জিহাদ?” এক লোকের এরূপ প্রশ্নের জবাবে রাসূল (সা) বলেন: “অত্যাচারী শাসকের সামনে একটি সত্য কথা বলা”।
শুধুমাত্র একটি ক্ষেত্র ছাড়া বাকি সমস্ত হাদীসেই শাসকের বিরুদ্ধে সশস্ত্র বিদ্রোহকে নিষেধ করা হয়েছে এবং এই ক্ষেত্রটি হচ্ছে এমন প্রকাশ্যে কুফরে লিপ্ত হওয়া যার ব্যাপারে আল্লাহ’র পক্ষ থেকে সন্দেহাতীত প্রমান বিদ্যমান; অর্থ্যাৎ যদি সে আল্লাহ’র ওহীজাত আইন পরিত্যাগ করে এবং প্রকাশ্যে কুফর আইন দ্বারা শাসন করে। আউফ বিন মালিক আল আশযায়ী থেকে বর্ণিত, “আমি রাসূল (সা)-কে বলতে শুনেছি, ‘তোমাদের শাসকদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ হচ্ছেন তারা যাদেরকে তোমরা ভালোবাস এবং তারা তোমাদেরকে ভালোবাসে এবং তারা তোমাদের জন্য দুয়া করে এবং তোমরা তাদের জন্য দুয়া কর। এবং তোমাদের শাসকদের মধ্যে নিকৃষ্ঠ হচ্ছে তারা যাদেরকে তোমরা ঘৃণা কর এবং তারা তোমাদেরকে ঘৃণা করে”।তিনি বর্ণনা করেন, “আমরা বললাম, হে আল্লাহর রাসূল, আমরা কি তখন তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করব না?’ তিনি বললেন, ‘না, যতক্ষণ তারা তোমাদের মাঝে সালাত কায়েম রাখে”। সালাত কায়েম রাখা বলতে এখানে বোঝানো হয়েছে ইসলামে শাসন কায়েম রাখা; অর্থাৎ অংশবিশেষকে উল্লেখের মাধ্যমে পুরো বিষয়টি উল্লেখ করার ভিত্তিতে বুঝানো হয়েছে শর’ঈ আহকাম পুরোপুরি বাস্তবায়ন করা।
উম্মে সালামা (রা) কর্তৃক বর্ণিত আছে রাসূল (সা) বলেন, “তোমাদের কিছু নেতা (আমীর) আসবে যাদের কিছু কাজ সত্য বলে স্বীকার করবে এবং কিছু কাজ প্রত্যাখান করে। যারা (অন্যায়কে) ঘৃণা করবে সে নিজেকে (দায়িত্ব থেকে) মুক্ত করে নিবে এবং যে প্রত্যাখান করবে সে নিরাপদ, কিন্তু তাদের কী হবে যারা (অন্যায়কে) গ্রহণ করবে এবং অনুসরণ করবে”। তারা বললেন, “আমরা কি তখন তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করব না?” তিনি বললেন, “না, যতক্ষণ তারা সালাত আদায় করে”। অর্থ্যাৎ ‘অংশবিশেষকে উল্লেখের মাধ্যমে পুরো বিষয়টি উল্লেখ করার ভিত্তিতে বুঝানো হয়েছে যতক্ষণ তার সালাতসহ সমস্ত শর’ঈ আহকাম বাস্তবায়ন করে। উবাদা বিন আস সামিত হতে বর্ণিত আছে, তিনি বলেন, “আমরা রাসূল (সা) এর কাছে কিছু বিষয়ে বাইয়াত (আনুগত্যের শপথ) দিলাম, কঠিন ও সহজ সমস্ত অবস্থায় (তাঁর প্রতি) শ্রবন ও আনুগত্য করার ব্যাপারে, নিজেদের পছন্দ-অপছন্দের ক্ষেত্রে (তাঁর আদেশকে) নিজেদের উপরে প্রাধান্য দেওয়ার ব্যাপারে এবং কতৃর্ত্বশীল লোকদের সাথে ততক্ষণ পর্যন্ত বিবাদে লিপ্ত না হওয়ার ব্যাপারে যতক্ষণ আমরা এমন প্রকাশ্য কুফর না দেখি যার ব্যাপারে সর্বশক্তিমান আল্লাহর তরফ থেকে প্রমাণ বিদ্যমাণ এবং (বাইয়াত দিলাম) আল্লাহর খাতিরে আমাদের সর্বদা সত্য কথা বলার ব্যাপারে”।
অতএব তিনি এই তিনটি হাদীস অনুযায়ী শাসকের বিরুদ্ধে সশস্ত্র বিদ্রোহ করা নিষিদ্ধ, যদি না সে আল্লাহর ওহী অনুযায়ী শাসন না করে অর্থাৎ শুধুমাত্র তখন যখন সে এমন প্রকাশ্য কুফর আইন দিয়ে শাসন করতে শুরু করে যার কুফর হওয়ার ব্যাপারে আল্লাহর তরফ থেকে সন্দেহাতীত প্রমাণ বিদ্যমান।
অতএব, যখন কোন মুসলিম শাসক আল্লাহর ওহী দিয়ে শাসন না করে বরং স্পষ্ট কুফর আইন দিয়ে শাসন করে তখন সমস্ত মুসলিম তার বিরুদ্ধে সশস্ত্র বিদ্রোহ করতে বাধ্য, যার মাধ্যমে তাকে কর্তৃত্ব থেকে অপসারণ করা যায় সেসব কুফর আইন যেগুলো দিয়ে সে শাসন করত সেগুলো অপসারন করা যায় এবং আল্লাহর নাযিলকৃত আইন গ্রহণ করে তা বাস্তবায়ন করা যায়। শাসকের বিরুদ্ধে সশস্ত্র বিদ্রোহের ব্যাপারটি একটি বাধ্যবাধকতা হিসেবে তখনই আরোপ হয় যখন শক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে তাকে এবং কুফর আইন সমূহকে অপসারণ করার সামর্থ্য থাকবে অথবা এরূপ সম্ভাবনা থাকবে কারণ মুনকারকে হাত তথা শক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে পরিবর্তন করার কাজটি নির্ভর করে প্রকৃতপক্ষে সেই সামর্থ উপরে যার মাধ্যমে মুনকারকে অপসারণ করা যায়। মুনকারকে হাত দিয়ে পরিবর্তন করার বাধ্যবাধকতা যে হাদীসটিতে এসেছে তার প্রয়োগ এবং কুফর আইন দিয়ে শাসনকারী শাসকের বিরুদ্ধে সশস্ত্র বিদ্রহের বাধ্যবাধকতা যে হাদীস দুটিতে এসেছে তারও প্রয়োগ নির্ভর করে প্রকৃত পক্ষে মুনকার ও স্পষ্ট কুফরকে পরিবর্তনের জন্য পর্যাপ্ত শক্তি প্রয়োগের সামর্থ্যের উপরে অথবা এরূপ সম্ভাবনার উপরে। কিন্তু মুনকার এবং কুফর আইনের পরিবর্তন ও অপসারণের মত পর্যাপ্ত শক্তি প্রয়োগের সামর্থ যদি না থাকে অথবা এরূপ সম্ভাবনা ও না থাকে তাহলে এ থেকে তখন বিরত থাকতে হবে কারণ তখন মুনকার ও কুফর আইন সমূহের প্রকৃত পরিবর্তন এবং অপসারণের সেই উদ্দেশ্য অর্জিত হবে না যার জন্য শরীয়াহ শক্তি প্রয়োগ বাধ্যতা মূলক করেছে । এরূপ পরিস্থিতিতে মুনকারকে নিষেধ করার দায়িত্বটি মুখ দিয়ে পালন করতে হবে, এবং পাশাপাশি সক্ষমতা অর্জনের জন্য অথবা এরূপ সম্ভাবনা সৃষ্টির জন্য শক্তি বৃদ্ধি প্রচেষ্টা জোরদার করতে হবে যাতে মুনকার এবং কুফর আইন সমূহকে প্রকৃত পক্ষে পরিবর্তন করা যায় এবং এরুপ পরিস্থিতিতেই শক্তি প্রয়োগ করতে হবে। পুরো জাতি যদি ঐক্যবদ্ধ হয় এবং এর সামরিক ক্ষমতা সম্পন্ন সেনাবাহিনী, প্রভাব শক্তি সম্পন্ন বৃহৎ গোত্র সমূহ ও এর সামরিক শক্তিসহ অথবা উম্মাহর মধ্যে প্রবল প্রভাব বিস্তারকারী রাজনৈতিক দল সমূহ – এদের যে কেউ যখন কুফর আইন-কানুন সমূহ দিয়ে শাসনকারী এবং ইসলামের বিধান-সমূহ পরিত্যাগকারী শাসককে অপসারণের সামর্থ অর্জন করে তাহলে সেক্ষেত্রে শাসকের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করতে সে শরীয়াহ অনুযায়ী বাধ্য, যাতে তাকে এবং কুফর আইন-কানুন সমুহকে অপসারন করা যায় এবং আল্লাহর নাযিলকৃত আইন-কানুন সমূহকে পুনঃস্থাপন করা যায়।
ইসলামের দশটি মৌলিক বিধানের মধ্যে এটি হচ্ছে একটি যাকে আমরা পেয়েছি আমাদের উপরে একটি দায়িত্ব হিসেবে, যাতে আমরা এই পথনির্দেশনা অনুসারে গণমানুষকে সচেতন করতে পারি। নিশ্চয় আল্লাহ তার বিষয়কে পূর্ণতা দান করবেন, যদিও অধিকাংশ মানুষই তা জানে না।
প্রবন্ধটি ১ জুলাই, ১৯৮৯ (২৮ জুল-কা’দা, ১৪০৯ হি) সালে আরবী ভাষায় প্রকাশিত একটি লেখার অনুবাদ হতে নেয়া হয়েছে
————————————————————————————————————————–
উপরের লেখাটির প্রতিক্রিয়ায় একই বছরে প্রকাশিত একটি প্রশ্নোত্তর নিম্নে দেয়া হলো:
প্রশ্নোত্তর: “মুনকার নিষেধ করা একটি দায়িত্ব এবং একে প্রতিহত করার জন্য শক্তি প্রয়োগ নির্ভর করে সামর্থ্যের উপর” লিফলেট সম্পর্কিত প্রশ্নের উত্তর
প্রিয় ভাইয়েরা,
আসসালামু আলাইকুম ওয়া রাহমাতুল্লাহি ওয়া বারাকাতাহু। “মুনকার নিষেধ করা একটি ফরজ দায়িত্ব এবং একে প্রতিহত করার জন্য শক্তি প্রয়োগ নির্ভর করে সামর্থ্যের উপরে” শিরোনামে প্রকাশিত লিফলেটটি অনেক প্রশ্ন ও জিজ্ঞাসার জন্ম দিয়েছে। বিভিন্ন রকম জিজ্ঞাসা ও সমালোচনার ভিতরে কিছু সমালোচনার বর্ণনা ছিল এরুপ – “হিজব” একটি পথভ্রষ্ট দল, অন্যকিছু সমালোচনার বিষয়বস্তু ছিল – হিজবের নীতিমালা ও কার্যপদ্ধতির আমূল পরিবর্তন এবং নতুন কর্মপদ্ধতির অবলম্বন। এসব প্রশ্ন জিজ্ঞাসা এবং সমালোচনা কোন একজন ব্যক্তি বা কোন একটি এলাকা থেকে আসেনি বরং এগুলো এসেছে অনেক লোকের কাছ থেকে এবং অনেক এলাকা থেকে।
প্রিয় ভাইয়েরা, আমি সততার সাথে বলছি এসব প্রশ্ন, জিজ্ঞাসা ও সমালোচনা ছিল উপশম দানকারী, প্রশান্তিদায়ক যা আত্মাকে পুলকিত করেছে এবং অন্তরকে আনন্দিত ও প্রশান্তিময় করেছে, কারণ এগুলো চিন্তা ও কাঠামোগত ঐক্যের ব্যাপারে প্রতিশ্রুতিকে প্রমাণিত করেছে এবং এতে শাবাবদের প্রচন্ড সততা, আন্তরিকতা এবং দলকে রক্ষার জন্য প্রবল আগ্রহের বিষয়টিই প্রমাণিত হয়েছে। এতে শাবাব ও নেতা হিসেবে আবশ্যকীয়ভাবে সেসব চিন্তার প্রতি আনুগত্যের বিষয়টি প্রমাণীত হয়েছে যেগুলোতে আমরা বিশ্বাস স্থাপন করেছি, যেগুলো আমরা গ্রহণ করেছি এবং যেগুলোর ভিত্তিতে আমরা নিজেদেরকে সংগঠিত করেছি এবং যেগুলো আমরা আল্লাহর কিতাব ও সুন্নাহ এবং এ দুটো দ্বারা অনুমোদিত অন্যান্য উৎস থেকে ইজতিহাদের মাধ্যমে বের করেছি। এ গুলোতে যে কোন পরিবর্তন বা পরিমার্জন শুধুমাত্র ওহীজাত প্রমাণের সাপেক্ষেই গ্রহণযোগ্য, অন্যথায় প্রত্যাখ্যাত-এটিও প্রমাণিত হয়েছে। আল্লাহর তরফ থেকে আমাদের ও সকলের প্রতি এটি একটি অনুগ্রহ যা চিন্তা ও কাঠামোগত ঐক্যকে নিরাপত্তা প্রদান করে এবং পথভ্রষ্ট হওয়া থেকে আমাদেরকে রক্ষা করে।
প্রিয় ভাইয়েরা, এবার আলোচনা করা যাক লিফলেটের বিষয়বস্তু নিয়ে, এটি প্রকাশ করার অনুপ্রেরণা ও উদ্দেশ্য নিয়ে এবং ব্যাখ্যা করা যাক যে এটি আমাদের গৃহীত চিন্তার সাথে সাংঘর্ষিক নয় বা তাতে কোন পরিবর্তন বা পরিমার্জনও করা হয়নি এই লিফলেটের মাধ্যমে।
কিছু আন্তরিক ইসলামী দলের সাথে আলোচনাকালে আমাদের কিছু শাবাব মুনকার নির্মূলের লক্ষ্যে শক্তি প্রয়োগের শর’ঈ হুকুম সম্পর্কে প্রশ্নের সম্মুখীন হয়েছিল এবং এই প্রশ্নটিই হচ্ছে আলোচ্য লিফলেট প্রকাশের অনুপ্রেরণা। তাদেরকে একটি জবাব প্রেরণ করা হয়েছে যার সাথে ইসলামী জীবনব্যবস্থার পুনরুত্থান ও খিলাফত প্রতিষ্ঠার কাজের সাথে পার্থক্য সূচিত করা হয়েছে, (অর্থাৎ) খিলাফত প্রতিষ্ঠার জন্য দলটিকে অবশ্যই রাসূল (সা) এর সীরাত অনুসরণ করতে হবে অর্থাৎ মক্কী জীবনের কর্মপদ্ধতি হতে মদীনায় ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পূর্ব পর্যন্ত তার (সা) অনুসরণে তিনটি ধাপের কার্যক্রম পরিচালনা করতে হবে। এরপর সৎকাজের আদেশ ও অসৎকাজের নিষেধ সম্পর্কে তাদের কাছে ব্যাখ্যা উপস্থাপন করা হয়। পরবর্তীতে মুনকারকে নিষেধের হুকুম সম্পর্কিত আলোচনাটি শাবাব ও গণমানুষের কাছে পৌছে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়।
শাবাবদের পক্ষ থেকে একই প্রশ্নের জবাব প্রদান এবং তারপর বাকি শাবাব ও জনগণের কাছে তা প্রেরণের উদ্দেশ্য ছিল মূলত এ বিষয়ের ব্যাখ্যা প্রদান যে, ইসলামী দলসমূহ শক্তি প্রয়োগের বিষয়টিকে যে ভাবে চিন্তা করে ও তা বাস্তবায়ন করে সেটা হাত দিয়ে মুনকার পরিবর্তন সম্পর্কিত হাদীস সমূহের সাথে এবং শাসক যখন স্পষ্ট কুফরে লিপ্ত হয় তখন তার বিরুদ্ধে বাধ্যতামূলক বিদ্রোহ সম্পর্কিত হাদীস সমূহের সাথে সাংঘর্ষিক। পাশাপাশি শাবাব পক্ষ যাতে এ ব্যাপারে ইসলামী দলসমূহের সাথে আলোচনা চালিয়ে যেতে পারে ও তাদেরকে অনুপ্রাণিত করতে পারে এবং সর্বোপরি কুফর আইনসমূহ অপসারণ করে ওহীজাত আইন পুনঃস্থাপনের দায়িত্ব পালনের জন্য উম্মাহকে অনুপ্রাণিত করতে পারে। অতএব এক্ষেত্রে উপরোক্ত লক্ষ্যগুলো অর্জন ব্যতীত অন্য কোন উদ্দেশ্য ছিল না।
অতএব দলের গৃহীত চিন্তা পরিত্যাগ করে নতুন কর্মপদ্ধতি গ্রহণ করা কোনভাবেই উদ্দেশ্য ছিলনা, এমনকি এরূপ চিন্তা কখনো মাথায় আসেনি।
আমাদের গ্রহণকৃত চিন্তার সাথে লিফলেটের বিষয়বস্তু সামঞ্জস্যতার ব্যাপারে ব্যাখ্যা নিম্নরূপ:
১. ব্যক্তি কর্তৃক সংঘটিত মুনকারের ব্যাপারে যখন লিফলেট এ আলোচনা করা হয়েছে, তখন বলা হয়েছে যে একে হাত দিয়ে পরিবর্তন করার দায়িত্ব হচ্ছে রাষ্ট্র ও ব্যাক্তির এবং একাজের জন্য দলের দায়িত্বের কথা বলা হয়নি, কারণ এ ব্যাপারে আমরা যা বুঝি সেটা হচ্ছে ব্যক্তি কর্তৃক সংঘটিত মুনকার নির্মূলের দায়িত্ব কোন দলের নয়।
আবার মুনকার সংঘটনকারী ব্যক্তিকে হাত দিয়ে প্রতিহত করার কথা যখন বলা হয়েছে, তখন সেটিও সুনির্দিষ্ট কিছু মুনকারের জন্য অনুমোদিত। অতএব চুরি করা, ব্যাভিচারে লিপ্ত হওয়া ও হত্যা করা প্রভৃতি যেহেতু মুসলিম ভূখন্ড সমূহে অনুমোদিত নয়, অতএব রাতের বেলায় কাউকে কোনো স্থানে চুরি করতে দেখলে অথবা কোন নারীর সাথে যেনার চেষ্টা করতে দেখলে অথবা কাউকে হত্যার প্রচেষ্টা করতে দেখলে, যে কোন মুসলিমের উপর একটি শর’ঈ দায়িত্ব যে সে একাজগুলো প্রতিহত করবে যদি সে এসব মুনকারকে হাত দিয়ে প্রতিহত করার সামর্থ্য রাখে। যদি সে এগুলো প্রতিহত না করে, তাহলে সে আল্লাহর চোখে গোনাহাগার হবে কারণ আল্লাহ কর্তৃক নির্ধারিত একটি দায়িত্ব সে পরিত্যাগ করেছে।
কিন্তু রাষ্ট্রের আইন দ্বারা অনুমোদিত মুনকার সমূহ, যেমন সমাজে নারীর অবাধ চলাফেরা প্রভৃতি ব্যক্তি কর্তৃক সংঘটিত হলেও এগুলোকে শাসক কর্তৃক সংঘটিত মুনকার হিসেবে বিবেচনা করতে হবে, কারণ এগুলো শাসক কর্তৃক বাস্তবায়িত আইন ও ব্যবস্থার কারণে উদ্ভুত। এসব মুনকার নির্মূলের উপায় হচ্ছে সেই ব্যবস্থাকে নির্মূল করে দেওয়া যা এগুলোকে অনুমোদন দেয়। ব্যক্তি কর্তৃক ব্যাংক ধ্বংস করে দেওয়া, ডিসকো গুঁড়িয়ে দেওয়া অথবা শরঈ পোশাক পরিধান না করে প্রকাশ্য চলাফেরায় নারীদেরকে বাধা দেওয়ার মাধ্যমে এসব মুনকার নির্মূল সম্ভব নয়।
প্রয়াত তাকী উদ্দিন আন নাবাহানী (রহ) এর সময়ে একটি প্রশ্নের জবাব (তারিখ অনুল্লেখিত) প্রদান করা হয়েছিল যাতে তিনি ব্যাখ্যা করেছিলেন যে সৎ কাজের আদেশ ও অসৎকাজের নিষেধ প্রত্যেক মুসলিমের উপর একটি ব্যক্তিগত দায়িত্ব এবং এটি কোন সামষ্টিক দায়িত্ব নয়; জবাবটি ছিল নিম্নরূপ:
সৎকাজের আদেশ ও অসৎকাজের নিষেধ প্রত্যেক মুসলিমের উপর একটি ব্যক্তিগত দায়িত্ব এবং এটি কোন সামষ্টিক দায়িত্ব নয়, কারণ এখানে সৎকাজের প্রকৃতি অনুযায়ী সমস্ত সৎকাজকেই বুঝানো হয়েছে এবং কোন সুনির্দিষ্ট সৎকাজ বা সুনির্দিষ্ট অসৎকাজকে বুঝানো হয়নি। যদি এই বাস্তবতাটি আমাদের কাছে স্পষ্ট হয়ে থাকে তাহলে আমরা বুঝতে পারব যে এরূপ দায়িত্ব পালনের কোনো শেষ নেই কারণ সর্বযুগে, সর্বত্র এর পুনরাবৃত্তি ঘটে চলেছে এবং হাদীসের বর্ণনা সে ব্যক্তির অপরাধ ব্যখ্যা করার জন্য এসেছে যে ব্যক্তি এগুলোকে অবজ্ঞা করল। রাসূল (সা) বলেন, “তোমাদের মধ্যে যদি কেউ কোন অপকর্ম হতে দেখে সে যেন তাঁর হাত দিয়ে তা পরিবর্তন (প্রতিহত) করে দেয়, যদি তাতে সক্ষম না হয় তাহলে সে যেন তাঁর মুখ দিয়ে তা পরিবর্তন করে দেয় আর যদি সে তাতেও অক্ষম হয় তাহলে সে যেন অন্তর দিয়ে পরিবর্তন (প্রত্যাখ্যান) করে এবং এটাই হচ্ছে সর্বনিম্ন স্তরের ঈমান”। অতএব হাদীসের বর্ণনা অনুযায়ী “তোমাদের মধ্যে যদি কেউ দেখে” অর্থাৎ যে দেখল এটি তাঁর উপরে একটি বাধ্যবাধকতা, এবং তিনি বলেছেন, “তোমাদের মধ্যে” অর্থাৎ তিনি এরূপ বলেননি “যদি তোমরা (দলবদ্ধভাবে) দেখ”। এবার সেই ব্যক্তির আলোচনায় আসা যাক যে সৎকাজের আদেশ করে এবং অসৎকাজের নিষেধ করে, যদি কোন ব্যক্তি কাউকে আদেশ ও নিষেধ করা সত্ত্বেও আদিষ্ট ব্যক্তি বিরত না হয়, তাহলে তাঁর সাথে পানাহার এবং চলাফেরা করা আদেশকারীর জন্য হারাম হয়ে যাবে যতক্ষণনা আদিষ্ট ব্যক্তি অপকর্ম থেকে বিরত হচ্ছে। কিন্তু এই বিষয়টি ইসলামী জীবনব্যবস্থার পুনর্বহালের কর্মীর (দাঈ’র) ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়, অতএব যদি সে কোন মুসলিমকে ইসলামী পুনর্বহালের জন্য কাজ করতে বলে এবং একটি সামষ্টিক দায়িত্ব হিসেবে সর্বোচ্চ সামর্থ্য অনুযায়ী যদি সে কাজ করতে অস্বীকৃতি জানায় তাহলে তাঁর সাথে পানাহার এবং চলাফেরা করতে দাঈ’র কোন সমস্যা নেই। কিন্তু ইসলামী জীবনব্যবস্থা পুনর্বহালের জন্য পরিচালিত কার্যক্রমের মধ্যে সুনির্দিষ্ট কিছু কাজ রয়েছে যা সৎকাজের আদেশ ও অসৎকাজের নিষেধের মধ্যে অন্তর্ভূক্ত রয়েছে যেগুলোর ক্ষেত্রে তাদের জন্য সেই নির্দিষ্ট শর’ঈ হুকুম বিদ্যমান। অতএব, জুলুম পরিত্যাগ না করা পর্যন্ত অত্যাচারীর হাত শক্তভাবে চেপে ধরে রাখা একটি ব্যক্তিগত দায়িত্ব; কিন্তু ইসলামী জীবনব্যবস্থা পুনর্বহালের জন্য কাজ করা একটি সামষ্টিক দায়িত্ব যদিও এর কিছু কাজ ব্যক্তিগত দায়িত্ব এবং দাওয়াত পৌছে দেওয়া সামষ্টিক দায়িত্ব।
২. লিফলেটে শাসক কর্তৃক সংঘটিত মুনকারের আলোচনা এসেছে তিনটি অনুচ্ছেদ, যার শুরু হয়েছিল এভাবে “এবং এগুলো ছিল ব্যক্তি বা দল কর্তৃক সংঘটিত মুনকার; কিন্তু শাসক কর্তৃক সংঘটিত মুনকার……” এবং চতুর্থ অনুচ্ছেদের আগ পর্যন্ত এ আলোচনা চলছিল যার শুরু হয়েছিল এভাবে, “এবং তাঁর সাথে বিদ্রোহ করার বাধ্যবাধকতা নির্ভর করে সামর্থ্যের উপরে” এই বর্ণনা “যুলুম করা সত্ত্বেও শাসকের প্রতি আনুগত্য করা মুসলিমদের জন্য একতী বাধ্যবাধকতা” শিরোনামে প্রকাশিত Dossier (পৃষ্ঠা ৬৫-৭০) এর বর্ণনার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ। বর্ণনার সামঞ্জস্যতার একটি উদাহরণ হিসেবে আমরা ৬৮ পৃষ্ঠার ২২ নং লাইনটি বিবেচনা করতে পারি, যেখানে বলা হচ্ছে, “হাদীসের অর্থগত নির্দেশনা অনুযায়ী তাঁর বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করা, যুদ্ধে লিপ্ত হওয়া এবং তাঁর কর্তৃত্বের বিরুদ্ধে বিবাদে জড়ানোর নির্দেশটি তখনই বৈধ যখন সে প্রকাশ্য কুফরে লিপ্ত হয়। দলীলের শব্দগত (মানতূক) নির্দেশনার মতো অর্থগত (মাফহূম) নির্দেশনাও সমানভাবেই বাধ্যবাধকতা অতএব এসব হাদীস হচ্ছে আমাদের নিকট প্রমাণ যে, আইনপ্রণেতার তরফ থেকে আমরা শাসকদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষনা করতে, যুদ্ধে লিপ্ত হতে এবং তাদের কর্তৃত্বের বিরুদ্ধে বিবাদে লিপ্ত হতে বাধ্য যদি প্রকাশ্য কুফর পরিলক্ষিত হয়।
লিফলেটের সর্বশেষ অনুচ্ছেদ যা থেকে দ্বিধাদ্বন্দ্বের সূত্রপাত তাঁর শুরু হলো এভাবে “এবং উম্মাহ যদি ঐক্যবদ্ধ হয় …প্রভৃতি” যদি এই বর্ণনাটি সঠিকভাবে পর্যালোচনা করা হয় তাহলে আর কোন দ্বিধাদ্বন্দ্ব থাকবে না। যখন দল সম্পর্কে আলোচনা করা হলো তখন তাঁর দায়িত্বের সীমারেখা টেনে দেওয়া হলো তিনটি বিষয়ে সামর্থ্য অর্জনের উপরে। প্রথমতঃ যদি সেনাবাহিনীর অভ্যন্তরে তাদের প্রবল প্রভাব বিদ্যমান থাকে দ্বিতীয়তঃ যদি বৃহৎ গোত্রসমূহের মধ্যে তাদের পর্যাপ্ত প্রভাব বিদ্যমান থাকে। তৃতীয়তঃ যদি উম্মাহর মধ্যে তাদের প্রবল প্রভাব বিদ্যমান থাকে। কোন দলের পক্ষে এই তিনটি বিষয় অর্জন করা কখনই সম্ভব না, যদি না তারা রাজনৈতিক সংগ্রামে অবর্তীণ হয় এবং নুসরাহ খোঁজ করা সহ তিনটি ধাপের ভিতরে দিয়ে অগ্রসর হয়; কারণ নুসরাহ খোঁজ ছাড়া সেনাবাহিনী এবং বৃহৎ গোত্রসমূহের মধ্যে প্রবল প্রভাব বিস্তার করা সম্ভবনা এবং দীর্ঘ রাজনৈতিক সংগ্রাম ব্যতীত উম্মাহর মধ্যে প্রবল প্রভাব বিস্তার সম্ভব না।
কুফর আইনকানুনসমূহের ধ্বংস এবং আল্লাহর নাযিলকৃত আইনকানুনসমূহকে পুনঃস্থাপনের লক্ষ্যে উম্মাহ ও বৃহৎ গোত্রসমূহ তখনই অগ্রযাত্রা করবে যখন তারা জনমত এবং গণজাগরণ প্রত্যক্ষ করবে। একইভাবে সেনাবাহিনী এবং বৃহৎ গোত্রসমূহের ক্ষেত্রে এই বিষয়টি প্রত্যক্ষ করা যাবেনা, যদিনা তারা এমন একটি রাজনৈতিক দলের নেতৃত্ব পরিচালিত হয় যারা রাজনৈতিক সংগ্রাম এবং রাজনৈতিক কর্মকান্ডের চর্চা করে।
প্রদত্ত ব্যাখ্যার আলোকে এটা স্পস্ট যে লিফলেটের বিষয়বস্তু এবং গ্রহণকৃত চিন্তার মধ্যে কোন বৈপরীত্য নেই। যাই হোক বাস্তবতা হলো ১৯৬৫ সাল থেকে আজ পর্যন্ত দল নুসরাহ দিতে সামর্থ্যবান ব্যক্তিবর্গের মাধ্যমেই শক্তি সংগ্রহের প্রচেষ্টায় লিপ্ত যাতে সে কুফর আইনসমূহের পরিবর্তন করতে পারে এবং আল্লাহর ওহীর শাসন প্রতিষ্ঠা করতে পারে; এবং এ কাজটি দল ব্যবস্থার ভিতরে থেকেই সম্পাদন করে বাইরে থেকে নয় যদিও সমস্ত মুসলিম ভূখন্ডসমূহকে এটা দারুল কুফর হিসেবে বিবেচনা করে দারুল ইসলাম হিসেবে নয়। অতএব দেখা যাচ্ছে এই বাস্তবতা ও অনেক প্রচেষ্টার ভিতর দিয়ে দল যা চর্চা করে এসেছে তাঁর সবকিছু ভুলে যাওয়া হয়েছে এসব প্রশ্ন জিজ্ঞাসা এবং সমালোচনা করার সময়ে ।
অতএব কুফর আইনসমুহের অপসারণ এবং আল্লাহর নাযিলকৃত আইনকানুন সমূহের পুনঃস্থাপনের লক্ষ্যে পর্যাপ্ত শক্তি অর্জনের যে বাধ্যবাধকতা, তা রাসূল (সা) এর কর্মপন্থা অনুসারে হিজব সম্পাদন করেছে নুসরাহ খোঁজার ভিতর দিয়ে, দল ও শাবাব এর মধ্যে সামরিক প্রশিক্ষণ দিয়ে অস্ত্রে সজ্জিত করার ভিতর দিয়ে নয়।
প্রিয় ভাইয়েরা, আপনাদের প্রশ্ন জিজ্ঞাসা ও সমালোচনার জবাব আমরা এই চিঠিতে ব্যাখ্যা করেছি। অতএব এটা স্পষ্ট হলো যে এর সাথে আমাদের গ্রহণকৃত চিন্তার কোন বিপরীত নেই এবং আমরা গ্রহণকৃত কর্মপদ্ধতিকে পরিত্যাগ করিনি এবং কোন নতুন পদ্ধতিও গ্রহণ করিনি।
আমরা দুআ করছি যাতে আল্লাহ তার পক্ষ হতে আমাদেরকে সাহায্য করেন, আমাদেরকে সর্বোত্তম পথে পরিচালিত করেন এবং বিভ্রান্তি ও বিচ্যুতি থেকে আমাদেরকে রক্ষা করেন, তার দ্বীনের ব্যাপারে যেন তিনি আমাদেরকে সাহায্য করেন এবং তার সাথে সাক্ষাৎলাভের আগ পর্যন্ত আমরা যেন তার দাওয়াত পৌঁছে দিতে পারি, আমাদের কোন কাজ যেন বৃথা না যায়, আমাদের আশা প্রত্যাশাগুলো যেন হতাশায় পর্যবসতি না হয় এবং আমরা যাতে ইখলাসের সাথে নিজেদের কার্যসম্পাদন করতে পারি এবং আমরা যেন দ্রুততার সাথে মুক্তির দিকে অগ্রসর হতে পারি এবং অদুর ভবিষ্যতে তার তরফ থেকে একটি মহান বিজয় দিয়ে সম্মানিত করার জন্য প্রার্থনা করি যার মাধ্যমে তিনি আমাদেরকে খিলাফত প্রতিষ্ঠিত করতে, ইসলামের পতাকা সুউচ্চে তুলে ধরতে এবং নাযিলকৃত শাসনব্যবস্থা পুনঃস্থাপন করতে সক্ষমতা দান করবেন। এই প্রত্যাশায় আমাদের দুআ শেষ করছি।
২৫ মুহাররম, ১৪১০
২৬ আগষ্ট, ১৯৮৯