তারকা বিভ্রম আর দ্বৈতচারিতা

আজকাল চারদিকে তারকার ছড়াছড়ি। এখন চাইলেই খুব সহজে যে কেউ তারকা বনে যেতে পারে। রূপালী পর্দার তারকা, ক্রীড়াতারকা, রিয়েলিটি শো তারকা, সঙ্গীত তারকা। কেননা মানুষের স্বেচ্ছাচারিতা, গড্ডালিকা প্রবাহে গা ভাসানো, হুজুগ আর অন্ধ অনুকরন আজ ব্যবসার আসল মূলধন। আর এসব নিপতিত বৈশিষ্ঠ্য কেবল এটাই জানান দেয়, মানুষের চিন্তা-চেতনা আর বিবেকবোধ লোপ পেয়েছে আর তারা তাদের চিন্তাশীলতা আর মননকে বন্ধক দিয়েছে মিডিয়ার কাছে। ছোট্ট একটা উদাহরন দেই, যা আমি প্রায় সময়ই দেই। সমকামিতা: আজ থেকে এক দশক আগেও পশ্চিমা কিছু কুকুর ব্যতীত অধিকাংশ মানুষের কাছেই তা ছিলো ঘৃন্য এক কাজ। অথচ মিডিয়ার জঘন্য মিথ্যাচারিতা আর প্রতারনার ধারাবাহিক ফলস্বরূপ আজ অধিকাংশ মানুষই এই ধরনের আচরন যা পশুদের মধ্যে নেই তাকে মানবাধিকার বলে শোরগোল ফেলে দিচ্ছে। অর্থ্যাৎ পশুবৃত্তিকেও ছাড়িয়ে গেছে মানবাধিকারের সংজ্ঞা।

আরো সহজ করে দেই। টারজান এক জনপ্রিয় টিভি চরিত্র। যে জঙ্গলের মাঝখানে বসবাস করে অথচ তার মুখমন্ডল অসম্ভব রকমের মসৃণ। এবার ভাবুন কোথায় বন্ধক রেখেছেন আপনার চিন্তাশক্তিকে? অবসাদগ্রস্থতা বলে একটা ব্যাপার আছে; আপনাকে এটা গ্রাস করেনি তো? জেগে জেগে ঘুমানো ব্যক্তিকে জাগানো কি যায়!

আরো বলি, শুনুন। মুসলিম সেই ব্যক্তি যে ইসলাম পালন করে। অর্থ্যাৎ যে ব্যক্তি নিজের স্বাধীন ইচ্ছাকে আত্মসমর্পন আর সঁপে দিয়েছে বিশ্বপ্রতিপালকের কাছে নিষ্ঠা আর বাধ্যবাধকতায়; শান্তি অর্জনের নিমিত্তে। এর বিপরীতার্থক কোন শব্দ হলো সন্ত্রাসবাদ। অথচ এই বিপরীত বৈশিষ্ট্যমন্ডিত দুইটি বিষয়কে সমার্থক বানানোর মতো অসম্ভব কাজটুকুও মিডিয়া করে ফেললো; বন্ধকী মস্তিষ্কের কল্যানে। এটাকে ইংরেজীতে বলে Oxymoron; অর্থ্যাৎ বিপরীতার্থক বৈশিষ্ট্য সম্বলিত ধাঁধাঁ। যেমন-স্থল বৈমানিক [Ground Pilot ]। সত্যিই হাস্যকর।

আজ তরুণরা “Assassin’s Creed” গেমসে মত্ত থাকলে ও জানে না “Islamic Creed” সম্পর্কে। তারা “Call of Duty” খেললেও সাড়া দেয় না “Call of Duty”- সলাতে। তারা ট্রয়ের কাল্পনিক ক্ষয়িঞ্চু চরিত্র একিলিস [Achilles] কে চিনলেও চিনে না সত্যিকারের তারকা মাসজিদে আল-আকসা বিজয়ী সালাহদীন আইয়ুবীকে। তারা টোয়াইলাইট [Twilight] দ্বারা মোহগ্রস্থ থাকলে ও Towards Light তাদের পদযুগল এগোয় না। তারা আভ্যাটারে [Avatar] এ মন্ত্রমুগ্ধ; পরকালে বিশ্বাস তাদের কাছে সেকেলে। প্রবৃত্তির ডাকে আর টানে তারা সাড়া দেয় Nike এর স্লোগান এর মতো “Just do it” অথচ ফজরের সলাতে তারাই “Never did it”। খুব বেশী pacy life, খুব বেশী rush, খুব বেশী events আর happening তাদের জীবন। অথচ বড় বেশী অন্তঃশূণ্য তাদের অন্তরাত্মা; ঢুকরে কাঁদে সঙ্গোপনে। তারপরও তারা pretend করে iron-man হওয়ার; তাদের thyroid ইনজেকশানে বাড়ানো মাংসপেশীর প্রদর্শনীতে, Hardy’s এর নতুন cool t-shirt এ, Levis এর ছেড়া জিন্সে। আত্ম-প্রতারণা আর আত্ম-বিদ্রুপ কার সাথে হচ্ছে?

আর ক্রীড়াসক্তির কথা কি বলবো? লা লিগা মেসি-রোনালদোর দ্বৈরথতো দ্বীনদার ভাইদেরও ছেড়ে কথা বলে না। টেনিসে ফেদেরার-নাদাল, ক্রিকেটে শচীন-লারা, ফর্মুলা ওয়ানে শুমাখার পেরিয়ে নতুন কেউ, স্প্রিন্টে বোল্ট, NBA তে জর্ডান কিংবা গলফে উডসদের নিয়ে বড় বেশী মত্ত। বাংলাদেশের জাতীয় ক্রিকেট দল নিয়ে বাড়াবাড়ি তো আর কম হয় না। এসকল তারকাদের অধিকাংশেরই চারিত্রিক দোষে দুষ্ট আর তাদের হামবড়া ভাবের কথা নাই বললাম। কেবল বিনোদিত হওয়ার জন্যই বিলিয়ন বিলিয়ন ডলারের খরচ করা হচ্ছে। অথচ কেবল আফ্রিকার দিকে তাকাইলে আমাদের আমুদে ভাব কেটে যাওয়ার কথা। এ সকল খেলোয়াড়রা যতটা না তাদের ক্রীড়াশৈলীর জন্য তার চেয়ে বেশী এনডোর্সমেন্ট, বিপনন, পন্যের দূত কিংবা নারীঘটিত কারনে সংবাদশিরোনাম হন। আর তা গিলার জন্য রয়েছে; একপাল উৎসুক ভেঁড়ার পালসদৃশ তরুণগোষ্ঠী।

সঙ্গীত-তারকাদের দুর্দশার কথা না বলে কেবল যদি তাদের মধ্যে আত্মহত্যাকারীদের তালিকা করা হয় তা অনেক দীর্ঘ হবে। এটা কেবল সঙ্গীততারকা নয় রূপালীপর্দার তথাকথিত তারকারাও এই মিছিলে পিছিয়ে নেই। সঙ্গীতের নামে কপটতা, অপরের দুঃখের ফিরিস্তি, আত্ম-গরিমা আর হতাশার বিকিকিনি কেবল সাময়িক মোহ তৈরী করে; যা জীবনের প্রকৃত উদ্দেশ্যকে ভুলিয়ে রাখে। আমরা এমন এক Big Brother Society তে বসবাস করি যেখানে অন্যের জীবনের দুর্দশা আনন্দ হিসেবে বিকানো হয়; রিয়েলটি শো নামক ধোঁকায়।

এসব তারকাদেরকে আর তাদের গুরুদের আপাতঃ দৃষ্টিতে দেখলে মনে হয় তাদের জীবনের সবকিছুই তারা নিয়ন্ত্রণ করছে [as though they are dictating their terms of life]। তারা তাকদীরের উপর প্রবল হওয়ার প্রচেষ্টা করে। বস্তুতঃ তাদেরকে দেয়া হয়েছে অবকাশ আর তাদের সীমালঙ্গনকে তাদের কাছে করা হয়েছে সুশোভিত। আর তাদের সংকীর্ণ জীবনাচরণের কথা নাই বললাম। তাই তাদেরকে দেখে ধোঁকায় নিমজ্জিত হওয়া বোকামি আর মূর্খতা ছাড়া কিছুই নয়।

আর হাদীসের ভাষ্য অনুযায়ী, যারা যাকে ভালবাসবে কিয়ামাহ্’র দিন তাদের সাথে উত্থিত হবে। তাই আমি কাকে ভালবাসছি তা দেখতে হবে। মুসলিম তরুণদের এই ভালবাসার সবচেয়ে বেশী হকদার রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ও তার সাহাবীগণ। অথচ আজ তরুণসমাজ আদর্শ শূণ্যতায় ভুগছে।

আর এই অনর্থক মোহগ্রস্থতাকে যারা জীবনের উপজীব্য ভাবে তাদের জন্য এই সতর্কবাণী:

“তোমরা কি ধারণা কর যে, আমি তোমাদেরকে অনর্থক সৃষ্টি করেছি এবং তোমরা আমার কাছে ফিরে আসবে না? [সুরা মুমিনুন:১১৫]”

সায়্যিদ মাহমূদ গজনবী

Print Friendly, PDF & Email

Leave a Reply