বর্তমানে আমরা যে বিশ্বে বসবাস করছি সে বিশ্বে এমন কোনো রাষ্ট্র নেই যাকে ইসলামী রাষ্ট্র বলা যায়। কারণ ইসলামী রাষ্ট্র হওয়ার যে শর্ত বা বিষয়গুলো থাকা দরকার তা বর্তমান বিশ্বের রাষ্ট্রগুলোতে অনুপস্থিত। এ অবস্থায় আমরা যখন পুনর্জাগরণের মাধ্যমে খিলাফত পুনঃপ্রতিষ্ঠার কথা বলি তখন কিছু প্রশ্ন এসে যায়। যেমন – খিলাফত কী? খিলাফত প্রতিষ্ঠিত ছিল কিনা? খিলাফত কত বছর টিকে ছিল? ইত্যাদি।
এ পর্যায়ে প্রথমে আমি খিলাফত কী এবং ৬২২ খৃস্টাব্দে রাসূল (সা) মদিনায় যে ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, যা ঔপনিবেশবাদী শক্তি ইসলামী ভূমিগুলো দখল করার পূর্ব পর্যন্ত অর্থাৎ ১৯২৪ সালের ৩রা মার্চ পর্যন্ত প্রতিষ্ঠিত ছিল – খিলাফতের এই সুদীর্ঘ সময় আদৌ ইসলাম বাস্তবায়িত হয়েছিল কিনা, এ বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা করার চেষ্টা করব ইনশাআল্লাহ।
খিলাফত হচ্ছে ইসলামী আদর্শের ভিত্তিতে বাস্তবায়িত রাষ্ট্র ব্যবস্থার নাম। যে ব্যবস্থা পৃথিবীতে মানুষের তৈরি আইন বাস্তবায়িত না করে, আল্লাহর আইন বাস্তবায়িত এবং যে ব্যবস্থার মাধ্যমে ইসলামের দাওয়াত পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে নিয়ে যাওয়া হয়।
এছাড়া খিলাফত ব্যবস্থা সারা বিশ্বের মুসলিমদের ঐক্যবদ্ধ করে রাখে এবং সকল মানুষের মৌলিক চাহিদা ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করে।
দ্বিতীয় বিষয়টি হচ্ছে – খিলাফত কত বছর প্রতিষ্ঠিত অবস্থায় ছিল? এ বিষয়টি বুঝতে হলে আমাদেরকে প্রথমে জানতে হবে কোন বিষয়গুলো বিদ্যমান থাকলে আমরা বলতে পারব খিলাফত প্রতিষ্ঠিত ছিল। আর বিষয়গুলো হচ্ছে-
১. বিচার ব্যবস্থা ও
২. আহকাম শরীয়াহ-এর বাস্তবায়ন
অর্থাৎ আমরা যদি বুঝতে পারি রাষ্ট্রে বিদ্যমান সমস্যাগুলোর বিচার ইসলামী শরীয়াহ আনুসারে সম্পন্ন এবং শাসক ইসলামী নিয়মানুসারে শাসন করে থাকেন তখনই বুঝবো ইসলামী রাষ্ট্র তথা খিলাফত প্রতিষ্ঠিত ছিল। এখন আমি ১৯২৪ সালে খিলাফত ধ্বংস হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত বিচার ব্যবস্থা ও শাসন ব্যবস্থা যে ইসলামী ছিল এ বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করব:
১. বিচার ব্যবস্থা:
এক্ষেত্রে লক্ষ্য করা যায় যে, ১৯২৪ সালের পূর্ব পর্যন্ত বিচারকগণ একমাত্র শরীয়াহ্ দ্বারাই জনগণের মধ্যে বিদ্যমান বিবাদগুলো মীমাংসা করতেন। বিচার ব্যবস্থার বিচার প্রক্রিয়ায় শুধু যে মুসলমানরা উপকৃত হয়েছে তা না, অনেক অমুসলিমরাও উপকৃত হয়েছিল। যা তখনকার সময়ের বিভিন্ন ইসলামী বিশেষজ্ঞ ও আলেমদের লিখা ইতিহাসগ্রন্থগুলো থেকে জানা যায়। ইসলামী বিচার ব্যবস্থার সুফল দেখে অনেক অমুসলিমও ইসলামী শরীয়াহ নিয়ে গবেষণা করতেন। এর অন্যতম প্রমাণ হচ্ছে “আল মাজাল্লা”-র ধারাবহিক একজন লেখক ছিলেন অমুসলিম। যার নাম ছিল সেলিম আল বাজ। মূলত “আল মাজাল্লা” ছিল একটি ম্যাগাজিন যেটাতে ইসলামী আইন নিয়ে লেখা হত। তাছাড়া যে সকল ইসলামী ভূখণ্ড ঔপনিবেশবাদীদের দ্বারা দখল হয়েছিল তারপরও অই সব ভূখণ্ডে ইসলামী আইন দ্বারা বিচারকার্য সম্পন্ন করা হত, যা আজ পর্যন্ত বজায় আছে। যেমন_ বাংলাদেশে উত্তরাধিকার আইন, মধ্যপ্রাচ্যের কিছু দেশে ব্যভিচারের শাস্তি, চুরি করার শাস্তি ইত্যাদি । সুতরাং, আমরা বলতে পারি খিলাফত রাষ্ট্রের ইতিহাসে ইসলামী শরীয়াহ ভিত্তিক বিচার ব্যবস্থা চালু ছিল।
এ থেকেই প্রমাণিত হয় যে, সে সময় বিচার ব্যবস্থা অবশ্যই ইসলাম অনুযায়ী ছিল।
২. আহকাম শরীয়াহ-এর বাস্তবায়ন:
মূলত পাঁচটি ক্ষেত্রের মধ্য দিয়ে ইসলাম বাস্তবায়িত হয়েছিল। ক্ষেত্রগুলো হচ্ছে – ১. সামাজিক ২. অর্থনৈতিক ৩. শিক্ষা ৪. পররাষ্ট্রনীতি এবং ৫. শাসন ব্যবস্থা। নিচে এই ক্ষেত্রগুলোতে ইসলাম বাস্তবায়িত ছিল তার একটা সংক্ষিপ্ত বর্ণনা দেওয়ার চেষ্টা করব।
১) সামাজিক: সামাজিক অবস্থা এমন ছিল যে, ঔপনিবেশবাদীরা ইসলামী ভূখণ্ডগুলো দখল করে নিলেও অন্যান্য ক্ষেত্রের তুলনায় সামাজিক ক্ষেত্রে তারা তেমন কোনো প্রভাব ফেলতে পারে নি। যা আজ পর্যন্ত বিভিন্ন মুসলিম অধ্যুষিত দেশে লক্ষ করা যায়। এখনও শহর-বন্দর বা পল্লীগ্রামে আভ্যন্তরীণ ব্যাপারসমূহের মীমাংসা জনসাধারণ নিজেদের মধ্যেই রেখেছেন। তারা নিজেরাই নিজেদের মধ্যে আপোষ-নিষ্পত্তি এবং বিভিন্ন অনুষ্ঠানাদি পালন করে থাকেন। যেমন- বিয়ে-শাদির ক্ষেত্রে মুসলমানরা এখনও ইসলামী নিয়ম-কানুন পালন করে থাকে।
পরিবারের দেখাশুনার বিষয়টি এখনও সাধারনত পিতাই পালন করে থাকে। তাছাড়া মুসলিম অধ্যুষিত রাষ্ট্রগুলোতে মহিলাদের হিজাব পরার অভ্যাসটিও প্রমাণ করে সামাজিক ক্ষেত্রে ঔপনিবেশবাদীদের তেমন কোনো প্রভাব পড়েনি এবং সঙ্গে সঙ্গে এটাও প্রমাণ করে যে, নিশ্চয়ই ইসলামী রাষ্ট্র তথা খিলাফত রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত ছিল। অন্যথায় মুসলমানরা এই বিষয়গুলো কীভাবে পালন করছে।
২) অর্থনৈতিক: অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে দুটি বিষয়ের প্রতি লক্ষ্য রাখা হত। বিষয় দুটি হচ্ছে – রাজস্ব সংগ্রহ ও রাজস্ব ব্যয়। রাজস্ব সংগ্রহ মূলত ভূমির উপর আরোপিত খারাজ ও উশর, অমুসলিমদের থেকে জিজিয়া আদায়, গনীমত, ফাই ইত্যাদি।
এছাড়া বিত্তবান মুসলমানদের নিকট থেকে যাকাত আদায় করা হতো। যদিও যাকাতের অর্থ কোরআনে উল্লিখিত ৮টি খাত ছাড়া অন্য কোনো ব্যয়ের ক্ষেত্রে ব্যবহার করা হত না। ব্যয়ের ক্ষেত্রে রাজস্বের একটা বিরাট অংশ সামরিক বাহিনীর জন্য ব্যয় করা হতো। যুদ্ধাবস্থায় সৈন্যবাহিনীর প্রয়োজনীয় আহার্য, অন্যান্য দ্রব্যাদি, তাদের পরিবারবর্গকে নগদ অর্থ বা খাদ্যদ্রব্যাদি রাষ্ট্রীয় রাজস্ব আয় থেকে সরবরাহ করা হতো। তাছাড়া শহর-নগর, কেল্লা নির্মাণ ছাড়াও মাদ্রাসা, সরাইখানা, পুল, খাল, কুয়ো, মসজিদ ইত্যাদি নির্মাণেও রাজস্ব থেকে প্রাপ্ত অর্থ ব্যয় করা হতো। আবিষ্কারক, কারিগর, হাকিম, কবি, চিকিৎসক, সাহিত্যিক এবং শাস্ত্রবিদদেরকে বেতন-ভাতা দেয়া হতো। ফলে দেখা গেছে যে, বেশ কিছু খ্রিস্টান ও ইহুদী চিকিৎসক বাগদাদে অত্যন্ত বিত্তবানও প্রচুর প্রাচুর্যের অধিকারী হয়েছিল। এছাড়াও রাজস্ব আয়-ব্যয়ের মাধ্যমে কারিগর তৈরি, ঔষধ তৈরি করার জন্য উৎসাহ প্রদান করা হতো। রাজস্ব ব্যয়ের ক্ষেত্রে আরো একটি গুরত্বপূর্ণ বিষয় ছিল সেটা হচ্ছে – নাফাকাহ ব্যবস্থা (অর্থনৈতিক সহায়তা), যেখানে অসমর্থ, বিভিন্ন দিক থেকে অক্ষম, বিকলাঙ্গ এদেরকে সহায়তা এবং হজ্জ যাত্রাপথে দরিদ্র, দুঃস্থ ও ভ্রমণকারী পথিকদেরও সহায়তা করা হতো। অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে এরকম সুষ্ঠু নীতিমালার ফলে দেখা যেত যাকাত দেওয়ার মতো লোক খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। যেমন- খিলাফতের শেষের দিকের শাসনামলে আয়ারল্যান্ডে দুর্ভিক্ষ দেখা দিলে তৎকালীন খলীফা বৃটেনের রাণীর আপত্তি সত্ত্বেও তিনটি জাহাজ ভর্তি ত্রানসামগ্রী আয়ারল্যান্ডকে দিয়ে সহায়তা করেছিল। তবে কিছু সময় রাজস্ব সংগ্রহ ও ব্যয়ের ক্ষেত্রে কিছুটা অবহেলা দেখা গেছে। এর অর্থ এই নয় যে, খিলাফত ছিল না; বরং এর অর্থ হলো রাজস্ব সংগ্রহ ও ব্যয়ের ক্ষেত্রে কিছুটা অনিয়ম হয়েছিল, কিন্তু শরীয়াহ অনুপস্থিত ছিল না। যেমন: বর্তমান পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় সরকার মানুষ থেকে বিভিন্নরকম কর নির্ধারণ করলেও সঠিকভাবে আদায় করে না। এ অবস্থায় আমরা যদি বলি পুঁজিবাদী ব্যবস্থা নাই তাহলে তা অনুচিত হবে। যেহেতু কর সংগ্রহ ও বণ্টনের অনিয়মের ক্ষেত্রে আমরা বলি না পুঁজিবাদী ব্যবস্থা নাই, সেহেতু রাজস্ব সংগ্রহ ও করের ক্ষেত্রে অনিয়ম হলেও আমাদের বলা উচিত নয় যে খিলাফত ছিল না।
৩) শিক্ষা: শিক্ষা ক্ষেত্রে ইসলাম শিক্ষার পাঠ্যক্রম এমনভাবে তৈরি করেছিল যে, যাতে শিক্ষার্থীরা ইসলামী আক্বীদার সঙ্গে সাংঘর্ষিক কোনো সংস্কৃতি বহন করতে না পারে। শিক্ষার্থীদেরকে এমনভাবে শিক্ষা দান করা হতো যাতে তারা ইসলামী আক্বীদা সঠিকভাবে বুঝে ইসলামী জীবনাদর্শের মাধ্যমে রাষ্ট্রের উন্নতি করতে পারে। যদিও উসমানীয় শাসনামলে শেষের দিকে নতুন স্কুল শুরুর ব্যাপারে কিছু অবহেলা করা হয়েছিল। তারপরও ইসলাম বাস্তবায়িত থাকার কারণেই গোটা বিশ্ব শিক্ষা ক্ষেত্রে এক অতুলনীয় সাফল্য এসেছিল যার প্রমাণ কর্ডোভা, বাগদাদ, দামেস্ক-এর মতো বিশ্ববিদ্যালয়গুলো প্রতিষ্ঠা এবং এদের পাঠ্যক্রম থেকে বুঝা যায়। শিক্ষা ক্ষেত্রে সফলতার ফলে দেখা গেছে, কাফের-মুশরিকরাও উপর্যুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে পড়ালেখা করার স্বপ্ন দেখতো এবং করতো। যেমন- বর্তমানে হার্ভার্ড, অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ালেখা করা কিছু মানুষের কাছে স্বপ্নের মতো মনে হয়। যদিও তারা মুসলমান এবং জানে না পুঁজিবাদী ব্যবস্থার সুফল কিংবা কুফল। ঠিক তেমনি মন থেকে ইসলাম মেনে না নিলেও ইসলামী রাষ্ট্র ছিল তৎকালীন মুসলিম-অমুসলিম পন্ডিত ও শিক্ষার্থীদের প্রাণকেন্দ্র স্বরূপ। অতএব, উপরিউক্ত বিষয়গুলো থেকে বুঝা যায় ইসলাম অবশ্যই বাস্তবায়িত ছিল।
৪) পররাষ্ট্রনীতি: বর্তমানে একটি মুসলিম অধ্যুষিত দেশ চারপাশে শত্রু দ্বারা বেষ্টিত থাকা সত্ত্বেও বলা হয়- “Friendship to all, malice to none” অর্থাৎ ‘সকলের সঙ্গে বন্ধুত্ব, কারো সঙ্গে শত্রুতা নয়।’ কিন্তু এ ধরনের হাস্যকর পররাষ্ট্রনীতি খিলাফত রাষ্ট্রে ছিল না। বরং খিলাফত ব্যবস্থার পররাষ্ট্রনীতি হচ্ছে ইসলামের বাণী ও ন্যায়বিচার পৃথিবীতে অন্যান্য জাতির সামনে তুলে ধরা। শক্তিশালী নেতৃত্বও দূরদর্শী চিন্তার মাধ্যমে সর্বশ্রেষ্ঠ আদর্শ ইসলামকে পৃথিবীর বিভিন্ন রাষ্ট্রে নিয়ে যাওয়া ছিল পররাষ্ট্রনীতির অন্যতম কাজ। এই নীতির ভিত্তিতেই ইখতিয়ার উদ্দিন মোহাম্মদ বিন বখতিয়ার খিলজি ভারতবর্ষে ইসলামকে নিয়ে এসেছিল। পররাষ্ট্রনীতির সফল বাস্তবায়নের কারণেই দুটি পরাশক্তি পারস্য ও রোমান সাম্রাজ্যকে হারিয়ে মুসলমানরা বিশ্বের নেতৃত্ব নিজেদের হাতে তুলে নিয়েছিল।
৫) শাসন ব্যবস্থা: শাসন ব্যবস্থার ক্ষেত্রে খিলাফত রাষ্ট্র ব্যবস্থার ৮টি স্তম্ভ ছিল। এগুলো হচ্ছে – খলীফা, প্রতিনিধিত্বকারী সহকারী (মু’আউইন আত-তাফউইদ বা ওয়াযির), খলীফার নির্বাহী সহকারী (মু’আউইন আত-তানফীয), আমীরুল জিহাদ, গভর্নর, বিচারক মণ্ডলী, প্রশাসনিক বিভাগ ও পরামর্শ বা শুরা পরিষদ (মজলিস-আল-উম্মাহ)। এই কাঠামোটি ১৯২৪ সালের ৩রা মার্চ খিলাফত ধ্বংসের পূর্ব পর্যন্ত ছিল। যদিও ১৯১৮ থেকে ১৯২৪ সাল পর্যন্ত খলীফা পদটি শধুমাত্র ১টি পদ হিসেবে ছিল। কিন্তু ১৯১৮ সাল পর্যন্ত খলীফার হাতে ছিল সকল নির্বাহী ক্ষমতা। তাছাড়া খলীফা যেমন-গোটা মুসলিম জাহানের শাসক ছিলেন, তেমনি দুনিয়ার নেতা বলে বিবেচিত হতেন। এজন্য রাষ্ট্রে শাসন-শৃঙ্খলা বজায় রাখা ছিল খুবই সহজসাধ্য। গভর্নর, বিচারক, প্রশাসনিক বিভাগের লোকজন নিজেদের পদে আসীন ছিলেন এবং দায়িত্ব পালন করছিলেন, যদিও সাম্রাজ্যবাদী শক্তি ইসলামী বিভিন্ন ভূমি দখল করে নিয়েছিল। আমীরুল জিহাদের অন্যতম কাজ ছিল সৈন্যবাহিনীকে পরিচালনা করা, শত্রুর আক্রমণের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলা। তার নেতৃত্বে থাকার কারণে বিশ্বব্যাপী সেনাবাহিনী ছিল অত্যন্ত সুশৃঙ্খল ও দায়িত্বশীল। গভর্নরের কাজ ছিল জনগণের দেখাশোনা করা এবং রাজস্ব আদায় করে বায়তুল মালে অর্থাৎ রাষ্ট্রীয় কোষাগারে জমা রাখা। কাজী অর্থাৎ বিচারকের কাজ ছিল শরীয়তের দন্ডবিধি জারি করা, বিচার-মীমাংসাদি করা ইত্যাদি। খুলাফা আর-রাশিদীন এর পরের দিকে মজলিস-আল-উম্মাহ প্রতিষ্ঠানটির প্রতি তেমন গুরুত্ব দেয়া হয়নি। যদিও শুরা হচ্ছে জনগণের অধিকার। তবে খলীফাগণ গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার সমূহে পরামর্শ গ্রহণ করতেন। কিন্তু সে পরামর্শ গ্রহণের ক্ষেত্রে কোনো বাধ্যবাধকতা ছিল না। আবার বিনা তলবেও লোকে খলীফাকে পরামর্শ দান করতো এবং অনেক সময় সে পরামর্শ তাকে মঞ্জুর করতে হয়েছে। অতএব, খলীফা যদি পরামর্শ বা মতামত নেয়ার ব্যাপারে অবহেলা করেন, এর অর্থ এই নয় যে, তিনি খিলাফত কাঠামোকে এবং খিলাফত ব্যবস্থাকে অস্বীকার করেছেন। কারণ শুরা রাষ্ট্রীয় কাঠামোর সে রকম কোনো অংশ নয় যা না থাকলে খিলাফত ব্যবস্থা বিলুপ্ত হয়ে যায়। কাজেই এটা অবহেলা করলে খলীফা অবহেলাকারী হবেন কিন্তু ব্যবস্থা হিসেবে খিলাফত ব্যবস্থাই টিকে থাকবে। শুরা-র ক্ষেত্রে কিছুটা অবহেলার পরও দেখা গেছে মানুষের মৌলিক চাহিদাগুলো পূরণের মাধ্যমে এবং অন্যান্য ক্ষেত্রে সফলতার মাধ্যমে ব্যবস্থা হিসেবে খিলাফত ব্যবস্থাই প্রতিষ্ঠিত ছিল। খলীফার বায়’আত নেয়ার ব্যাপারে বায়’আত গ্রহণের পদ্ধতিতে কিছুটা অপপ্রয়োগ হয়েছিল। একজন খলীফা মৃত্যুর পূর্বে তার ছেলেকে যোগ্য মনে করে তার জন্য বায়’আত নিয়ে রাখতেন এবং তার মৃত্যুর পর বায়’আত পুনরায় নবায়ন করা হতো। তাই বলে এটা মনে করা উচিত না যে, রাজতন্ত্রের ন্যায় বংশানুক্রমিক শাসন ছিল। বরং খিলাফত শাসনামলের পুরো ইতিহাসে এমন কোনো ঘটনা ঘটেনি যে, বায়’আত ছাড়া কেউ খলীফা নির্বাচিত হয়েছেন। যেমন, বর্তমান ব্যবস্থার নির্বাচনে অনিয়ম বা কারচুপি হলেও সেটাকে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার নির্বাচনই বলি। তাছাড়া বর্তমানে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসেবে পরিচিত রাষ্ট্রের শাসকগণ কিছু পরিবার কেন্দ্রিক হওয়ার পরও সেসব রাষ্ট্রকে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র বলা হয়। তাই বায়’আতের কিছুটা অপপ্রয়োগের কারণে খিলাফত ছিল না, তা বলা অনুচিত হবে। এছাড়াও আমরা জানি খিলাফতের সময়ের কোনো আলেমই খিলাফত ব্যবস্থাকে অন্য কোনো নামে আখ্যায়িত করেননি বরং খিলাফত ব্যবস্থাই বলেছিলেন। সে সময়কালের আলেমদের মধ্যে অন্যতম একজন আলেম ছিলেন জালালুদ্দিন সুয়ূতি যিনি রাসূলুলস্নাহ (সা)-এর প্রায় ৯০০ বছর পরের একজন আলেম এবং যিনি তার সময় পর্যন্ত খলীফাদের ইতিহাস নিয়ে ‘তারিখুল খুলাফা’ নামক একটি গ্রন্থ রচনা যেখানে তিনি অসংখ্য খলীফাদের নিয়ে আলোচনা করেছেন।
তাই আমাদের বুঝা উচিত বায়’আতের ব্যাপারে সমস্যা হলেও মূলত ইসলাম অর্থাৎ খিলাফত ব্যবস্থাই বাস্তবায়িত ছিল। তাছাড়া ইসলাম যে বাস্তবায়িত ছিল তা ইসলামী বুদ্ধিবৃত্তিক নেতৃত্বের সফলতা থেকে বুঝা যায় – ইসলামী জীবনাদর্শ তখনকার অন্ধকারাচ্ছন্ন দুর্বল আরব জাতিকে উন্নত চিন্তাশক্তি সম্পন্ন বুদ্ধিমান জাতিতে পরিণত করেছিল। ফলে, তৎকালীন যুগে আরবদেরকে বিজয়ী জাতি এবং অন্যান্য জাতিকে বিজিত জাতি বলে বিবেচনা করা হতো। জনগণের মধ্যে ধর্মীয় প্রেরণা প্রবলভাবে থাকায় কুরআনুল করীম ও সুন্নতে রাসূল (সা) ছাড়া অন্য কোনো আইন মেনে চলার বিষয়টি তারা বিবেচনাও করতো না। যদিও মুসলমানদের মধ্যে কিছু আত্মকলহ ছিল, তারপরও মুসলমানরা আরব থেকে ইসলামকে বিশ্বের প্রান্তে প্রান্তে নেয়ার ফলে পারস্য, ইরাক, মিশর, সিরিয়া প্রভৃতি ভূমিগুলো নিজেদের অধীনে নিয়ে এসেছিল। বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর অভিন্ন ধর্ম, জাতীয়তা, ভাষা, সংস্কৃতি থাকলেও ইসলামী বুদ্ধিবৃত্তিক নেতৃত্বের ফলে এরা সকলে এক জাতি অর্থাৎ এক ইসলামী উম্মাহতে পরিণত হয়েছিল। বিভিন্ন ধরনের অত্যাচার, হত্যা, আক্বীদাকে কলুষিত করার চেষ্টা সত্ত্বেও আজো এসকল মানুষ মুসলিম রয়ে গেছে। তাছাড়া ইসলামী বুদ্ধিবৃত্তিক নেতৃত্বের ফলে মুসলমানরা বিজ্ঞান, সাহিত্য, সংস্কৃতি, ঐতিহ্য, চিকিৎসা প্রভৃতি ক্ষেত্রে অবিস্মরণীয় সাফল্য এনেছিল। খিলাফতের প্রথম দিকে আরবি ব্যাকরণের নাহুশাস্ত্রের প্রচলন শুরু হয়।
উপরিউক্ত বিষয়গুলো থেকে এটা স্পষ্ট যে, মুসলমানরা খিলাফত-এর মাধ্যমে ইসলাম বাস্তবায়িত করেছিল এবং তা ১৯২৪ সালে মুস্তফা কামাল পাশা (আল্লাহ তার উপর লানত করুক)-এর মাধ্যমে তুরস্কে ধ্বংস হয়েছিল। কাজেই আমরা বলতে পারি, যে শাসন ব্যবস্থা সারা বিশ্বে প্রায় দীর্ঘ ১৩০০ বছর শাসন করেছিল সেটাই একমাত্র বুদ্ধিবৃত্তিক নেতৃত্ব এবং পুনর্জাগরণের জন্য উপযুক্ত। কিন্তু বর্তমানে বুদ্ধিবৃত্তিক নেতৃত্বের অভাবের কারণে মুসলমানরা অধঃপতিত ও নির্যাতিত অবস্থায় আছে। অতএব, বর্তমানে আবার সময় এসেছে সেই খিলাফত ব্যবস্থার গুরুত্ব বুঝার এবং খিলাফত পুনঃপ্রতিষ্ঠার জন্য কাজ করার। কারণ রাসূল (সা) বলেছেন-
“যে ব্যক্তি এমন অবস্থায় মৃত্যুবরণ করে যে তার কাঁধে (কোনো খলীফার) বায়’আত (আনুগত্যের শপথ) নেই তবে তার মৃত্যু হচ্ছে জাহিলিয়্যাতের (জাহেলি যুগের) মৃত্যু।” [মুসলিম]
উক্ত হাদীসে জাহেলি যুগ বলতে ‘ইসলাম ছিল না’-এমন যুগকে বুঝানো হয়েছে। হাদীসটিতে খলীফার বায়’আত ছাড়া মৃত্যুবরণকে জাহেলি যুগ অর্থাৎ ইসলামবিহীন অবস্থায় মৃত্যুর সঙ্গে তুলনা করা হয়েছে। কিন্তু মুসলমান মাত্রই কেউই কখনোই চাইব না বা আশা করব না আমাদের মৃত্যু জাহেলি অবস্থায় মৃত্যুর মতো হোক। অথচ গত ৮০ বছরেরও বেশি সময় আমরা খলীফাবিহীন অবস্থায় আছি। শুধু তাই নয় খলীফা না থাকার কারণে কাফের মুশরিকরা আমাদের প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মদ (সা)-কে নিয়ে ব্যঙ্গ করার দুঃসাহস দেখাচ্ছে, আমাদের উম্মুল মুমিনীন হযরত আয়েশা (রা)-কে নিয়েও ব্যঙ্গাত্মক বই রচনা করছে, আমাদের পবিত্র কুরআনকে অবমাননা করার মতো এসকল ক্ষমার অযোগ্য অপরাধ করছে। কিন্তু আমরা জাতি খিলাফত দুর্বল অবস্থায় থাকার সময়েও (১৯০৩ সাল) তৎকালীন খলীফা (আবদুল হামিদ ২য়) জিহাদে আকবর ঘোষণা করায় বৃটেন সরকার রাসূল (সা)-কে নিয়ে নির্মিত নাটক বন্ধ করতে বাধ্য হয়েছিল। খলীফা মু’তাসিম বিল্লাহর খিলাফতকালে একজন রোমান সৈন্য একজন মুসলিম দাসীকে অপহরণ করার কারণে মু’তাসিম বিল্লাহ ওই অঞ্চল দখল করে নিয়েছিল। কিন্তু বর্তমানে সেই রকম খলীফা না থাকায় বিশ্বের প্রান্তে প্রান্তে কাফেররা মুসলিমদের হত্যা করছে, বাংলাদেশের মতো মুসলিম অধু্যষিত দেশে মুসলিম মেয়েদের পতিতাবৃত্তির মতো ঘৃণ্য কাজকে পেশা হিসেবে নিতে সুযোগ করে দেয়া হচ্ছে। সারা পৃথিবীকে নেতৃত্বদানকারী মুসলিম সভ্যতা আজ অধঃপতিত, লাঞ্চিত, অবহেলিত। এক সময় যে মুসলিম যুব সমাজ পৃথিবীকে আলো দেখিয়েছিল জ্ঞান-বিজ্ঞানে, সাহিত্যে, সংস্কৃতিতে আজ সেই মুসলিম যুব সমাজকে আখ্যায়িত করা হচ্ছে মোল্লা, জঙ্গী, মৌলবাদী, চরমপন্থী, উগ্রবাদী ইত্যাদি নানা রকম উপাধিতে।
কিন্তু সেই দিন আর বেশি দূরে নয় যখন মুসলিম উম্মাহ আবারো ফিরে পাবে হারানো গৌরব। আজ দিকে দিকে জেগে উঠছে মুসলমানরা। পূর্ব থেকে পশ্চিমে সর্বত্রই আজ সোচ্চার দাবি উঠছে শোষণ বঞ্চনামুক্ত একটি নতুন বিশ্বব্যবস্থার। আর মানুষের সার্বিক মুক্তির একমাত্র পথ হচ্ছে ইসলাম এবং একমাত্র খিলাফত রাষ্ট্র ব্যবস্থাই নিশ্চিত করতে পারে ইসলামের পরিপূর্ণ বাস্তবায়ন। বিশ্বব্যাপী আজ খিলাফত রাষ্ট্র ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার যে আন্দোলন জেগে ওঠছে সে থেকে স্পষ্টতই বুঝা যায় খিলাফত খুব সন্নিকটে। আমাদের প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মদ (সা) তাঁর হাদিসে আমাদের সুসংবাদ দিয়েছেন”………… অতঃপর পুনরায় ফিরে আসবে নবুয়্যতের আদলের খিলাফত” [মুসনাদে আহমদ]। খিলাফত রাষ্ট্র ব্যবস্থাকে ফিরিয়ে আনার মহান আন্দোলনে অংশগ্রহণ করা প্রতিটি মুসলমানের উপর একটি ফরয দায়িত্ব। আমরা যদি সঠিকভাবে ইসলাম নির্দেশিত পথে আমাদের দায়িত্বগুলো ঠিকমতো পালন করি আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’য়ালা আমাদেরকে শীঘ্রই খিলাফত দান করবেন যা মুসলিম উম্মাহকে আবারো পৃথিবীর শ্রেষ্ঠত্বের আসনে আসীন করবে। আল্লাহ সুবহানাহুতা’য়ালা পবিত্র কুরআনে ইরশাদ করেছেন-
তোমাদের মধ্যে যারা ঈমান আনে ও নেক কাজ করে, আল্লাহ তাদেরকে ওয়াদা দিয়েছেন যে, অবশ্যই তিনি তাদেরকে পৃথিবীতে নেতৃত্ব দান করবেন,যেমন তিনি নেতৃত্ব দান করেছিলেন তাদের পূর্ববর্তীগণকে এবং তিনি অবশ্যই সুদৃঢ় করবেন তাদের জন্য তাদের দ্বীনকে যা তিনি তাদের জন্য পছন্দ করেছেন এবং অবশ্যই তিনি তাদের ভয়-ভীতির পরে তা পরিবর্তিত করে দেবেন নিরাপত্তায়। তারা আমারই ইবাদত করবে, আমার সঙ্গে কোনো শরীক সাব্যস্ত করবে না। আর যারা এরপরও কুফরী করবে, তারাই তো ফাসেক। [সূরা আন-নূর: ৫৫]
আল্লাহ রাব্বুল আলামীন আমাদেরকে খিলাফত পুনঃপ্রতিষ্ঠা করার তৌফিক দান করুন – আমিন।
আবু সুমাইয়া
২৯ জুন ২০০৯