আমরা যেই হাদীসের বইগুলো পড়ি সেগুলো ৩০০ হিজরি বা হিজরতের তিনশত বছর পর লেখা হয়েছে। এত বছর পর কি আসলেই রাসুল (সা) এর কথা ও কাজ নিখুঁতভাবে জানা ও লিপিবদ্ধ করা সম্ভব? হাদীসগুলো লেখা হয়েছে নবী (সা) এর মৃত্যুর পর, খুলাফায়ে রাশিদিনদের পর, উমাইয়া খেলাফতের পর এবং আব্বাসীয় খেলাফতের শুরুর দিকে। এর মধ্যে কত যুগ ও প্রজন্ম গত হয়েছে কিন্তু এরপরও কিছু লেখক ও গবেষকরা কিভাবে দাবি করতে পারে এগুলো রাসুল (সা) এর হাদীস? এটা কি বাস্তব সম্মত?
ইমাম বুখারি নাকি ছয় লক্ষ হাদীস সংগ্রহ করে এরপর বিচার বিশ্লেষণ করে সহীহ বুখারি রচনা করেছেন। এটা কি একজন ব্যক্তির পক্ষে কখনো সম্ভব যে সে ছয় লক্ষ হাদীস সংগ্রহ করতে পারবে? এত অল্প সময়ে এটা কীভাবে সম্ভব? আর সবচেয়ে বড় কথা হলো নবীজি (সা) কীভাবে ছয় লক্ষ হাদীস বর্ননা করবেন। এতো বিশাল সংখক হাদীসের সংখ্যাই বলে দিচ্ছে এর মধ্যে একটা বড় অংশ বানোয়াট। আসলে এই হাদীসের বইগুলোর উপর কোনোভাবেই আস্থা রাখা যায় না।
উপরের এই কথাগুলো যখন সাধারণ মুসলিম একজন শুনে তখন অনেক ক্ষেত্রেই তারা বিভ্রান্তিতে পড়ে যায়। আর এই কাজটাই করে যাচ্ছে কিছু ব্যক্তিরা যারা ইসলামি শরীয়তের ভিত্তি হিসাবে সুন্নাহকে মানতে চায় না। কিন্তু এই কথাটা একজন আম মুসলিমকে সরাসরি বলা সম্ভব না তাই তারা এইরকম চতুরতার আশ্রয় নিয়েছে। তারা জানে যদি হাদীসের বিশুদ্বতা নিয়ে সন্দেহ তৈরী করা যায় তাহলে স্বাভাবিকভাবেই যেকোনো ব্যক্তি সুন্নাহকে ত্যাগ করবে এবং শরীয়তে বেশিরভাগ হুকুম আহকাম অপ্রাসঙ্গিক হয়ে পড়বে। আসলে যারা হাদীস সম্পর্কে এই মিথ্যা সন্দেহ ছড়াচ্ছে তাদের অন্তর ব্যাধিগ্রস্ত। জীবনের সকল ক্ষেত্রে আল্লাহর হুকুমকে তারা মানতে নারাজ। ইসলামের হুকুম আহকাম তাদের জন্য বোঝা। কারণ তারা তাদের প্রবৃত্তির দাসত্ব করতেই পছন্দ করে, আল্লাহর হুদূদগুলো যেমন- চুরি করলে হাত কাটা, ব্যভিচার করলে পাথর নিক্ষেপ করে হত্যা করা, মুরতাদের মৃত্যুদণ্ড ইত্যাদি নিয়ে তারা হীনম্মন্যতায় ভোগে এবং পশ্চিমাদের পছন্দসই ইসলামের আধুনিক ভার্সন তৈরি করে নিজেকে তাদের কাছে গ্রহণযোগ্য করতে মরিয়া হয়ে থাকে। আর এই উদ্দেশ্য অর্জনের জন্য সুন্নাহকে কীভাবে বাদ দেওয়া যায় তা নিয়ে পরিকল্পনা করতে তারা ব্যস্ত।
আসলেই কি তিনশত হিজরির পূর্বে কোনো হাদীসের বই লেখা হয় নাই? ইমাম বুখারি সত্যি সত্যি ছয় লক্ষ হাদীস সংগ্রহ করেছিলেন? এটা সত্যি যে রাসুল (সা) এর মৃত্যুর পর হাদীসের সংখ্যা অস্বাভিকভাবে বেড়েছে কিন্তু মজার বিষয় হলো এটা খুবই স্বাভাবিক ঘটনা কিন্তু কীভাবে? আর হাদীস সংগ্রহের এই প্রক্রিয়া আসলে কতোটুকু নির্ভরযোগ্য? কীভাবে আমরা এতো বছর পরও এর উপর নির্ভর করে বিভিন্ন বিশ্লেষণ করতে পারি? এই সকল বিষয়ে নিয়ে আজকে আমি আলোচনা করবো যাতে করে শরীয়তের দ্বিতীয় উৎস হাদীস যে কতটা বিশুদ্ধ তা আমরা বুঝতে পারি।
এক্ষেত্রে সবার শুরুতে আমাদের হাদীস কীভাবে সংগ্রহ করা হয়ে থাকে তা নিয়ে আলোকপাত করতে হবে। একটি হাদীস সঠিক কিনা সেটা যাচাই করার প্রক্রিয়া সম্পর্কে আমাদের অবশ্যই ন্যূনতম ধারণা অর্জন করতে হবে। যে সকল ধাপ অতিক্রম করার পর একটা হাদীসকে গ্রহণ করা হয় তা হল:
১) সনদের ধারাবাহিকতা বা ইত্তিসাল আস সনদ (continuity of the chain)
২) বর্ণনাকারীর বিশ্বাসযোগ্যতা বা আদালাতুর রুউউয়াহ (Probity or trustworthiness of narrators)
৩) বর্ণনাকারী নির্ভুল ও সঠিক হওয়া বা দাব তার রুউউয়াহ (The precision and accuracy of narrators)
৪) হাদীসটি অন্য কোনো হাদীসের সাথে সাংঘর্ষিক হয় কিনা বা হাদীসটির মধ্যে কোনো লুক্কয়িত সমস্যা আছে কিনা সেটা খুঁজে বাহির করা। (The absence of shuzooz and al-‘illah)
এরপর হাদীসগুলোকে গ্রেডিং বা শ্রেণিতে ভাগ করা হয়। উপরের ধাপ গুলো ছাড়াও বিশুদ্ধ হাদীস নির্ণয়ে ত্রুটি এড়ানোর জন্য বা জালিয়াতি ও প্রতারণা সনাক্তকরণের জন্য আরো অসংখ্য কৌশলের অনুসরণ করা হয়। আমরা এখানে সংক্ষিপ্তভাবে প্রতিটি ধাপ নিয়ে আলোচনা করবো।
সনদের ধারাবাহিকতা বা ইত্তিসাল আস সনদ
সর্বপ্রথম একটি হাদীসের বর্ণনাকারীদের মধ্যে কোনো গ্যাপ বা ধারাবাহিকতার অভাব আছে কিনা তা দেখা হয়। এক্ষেত্রে সকল বর্ণনাকারীকে চিহ্নিত করা হয়। সকলের পরিচয় পাওয়া বাধ্যতামূলক। এছাড়াও বর্ণনাকারীদের জন্ম ও মৃত্যু তারিখ ও তাদের ভৌগলিক অবস্থান দিয়ে ক্রস ম্যাচ করা হয় যে আসলেই সে যার কাছ থেকে শুনেছে সেটা বাস্তবসম্মত কিনা। যদি দেখা যায় তাদের ভৌগলিক অবস্থান অনেক দূরবর্তী যে তাদের মধ্যে কখনো দেখা হওয়া সম্ভব না বা তারা একই প্রজন্মের না তাহলে সেটা সনদের ধারাবাহিকতাকে নষ্ট করে দেয়।
বর্ণনাকারীর বিশ্বাসযোগ্যতা বা আদালাতুর রুউউয়াহ
বর্ণনাকারীদের ধারাবাহিকতা নিশ্চিত হওয়ার পরের ধাপ হলো তাদের বিশ্বাসযোগ্যতার বিষয়ে নিশ্চিত হওয়া। আদিল হওয়ার শর্ত হচ্ছে যে, ব্যক্তি মিথ্যাবাদী হিসাবে পরিচিত না, হরহামেশা বা প্রকাশ্যে গুনাহ করতো না এবং অসভ্য বা অসম্মাননক আচার-আচরণ থেকে মুক্ত। এছাড়াও কোনো একজন বিশ্বাসযোগ্য ব্যক্তি অন্য আরেকজনকে আদিল হিসাবে নিশ্চায়ন করলে সেটাও গ্রহণযোগ্য হবে।
বর্ণনাকারী নির্ভুল ও সঠিক হওয়া বা দাবত আর রুউউয়াহ
মানুষ ভুল করতে পারে এটা স্বাভাবিক কিন্তু দাবিত হচ্ছে সেই ব্যক্তি যিনি সাধারণত ভুল করেন না। যিনি তার বলা প্রতিটি বক্তব্যের বিষয়ে অত্যন্ত সতর্ক থাকেন যেনো ভুল না হয়। এর পাশাপাশি অন্য বর্ণনাকরীদের বর্ণনার সাথে তার কথা মিলে কিনা সেটা দিয়েও নিশ্চিত হওয়া যায়। অনেকসময় কোনো একজন ভালো বর্ণনাকারী জীবনের পরবর্তী সময়ে তার সক্ষমতা হারাতে পারেন সেটাও সবসময় বিবেচনা করা হয়।
শাজ (অস্বাভাবিক বা ব্যতিক্রম) এবং ইল্লাহ (অনিয়ম) এর অনুপস্থিতি নিশ্চিত করা
কোনো একটি হাদীসকে শাজ বলে ধরা হয় যখন এর মতন ও সনদ অন্য আরেকটি হাদীস যা কিনা আরো বিশ্বাসযোগ্য বর্ণনাকারী দ্বারা বর্ণিত তার মতন ও সনদের সাথে সাংঘর্ষিক হয়। এর মাধ্যমে কোনো একটি ভুল বা জাল হাদীসকে চিহ্নিত করার পাশাপাশি বর্ননাকারীর বিশ্বাসযোগ্যতা ও নির্ভুলতাকেও পুনরায় যাচাই করা যায়।
হাদীসের মধ্যে ইলাল বা এমন ত্রুটি যা সহজে দেখা যায় সেটা খুঁজে বাহির করার কাজটি অত্যন্ত সূক্ষ্ম ও কঠিন যা কিনা একজন অভিজ্ঞ হাদীস বিশারদ করে থাকেন। হাদীসের মতন ও সনদ উভয়ের মধ্যেই এই ধরনের ত্রুটি থাকতে পারে যা একজন মুহাদ্দিস তার দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতা ও গবেষণার আলোকে করে থাকেন।
জালিয়াতি ও প্রতারণা সনাক্তকরণ
হাদীসের মতন ও সনদের মধ্যে জালিয়াতি বা মিথ্যার সংযোজন সনাক্তকরণের জন্য বিভিন্ন পদ্ধতির অনুসরণ করা হয়ে থাকে।
যেমন- সনদের ক্ষেত্রে অনেক সময় কোনো বর্ণনাকারী যদি স্বীকার করে যে, সে জালিয়াতি করেছে তাহলে তার নাম লিপিবদ্ধ করা হয় এবং তার দ্বারা বর্ণিত সকল হাদীস বাতিল করা হয়। কোনো বর্ণনাকারী যে স্কলারের কাছ থেকে হাদীসটি শুনেছে তার সাথে যদি সরাসরি দেখা না হয়ে থাকে বা সেই স্কলারের মৃত্যুর পর জন্ম গ্রহণকরে থাকে বা সেই এলাকায় যদি কখনো না গিয়ে থাকে যেখানে সে হাদীসটি শুনেছে সেটা জালিয়াতি বা মিথ্যাকে নির্দেশ করে। এর পাশাপাশি বর্ণনাকারীর জীবন যাপনকেও গবেষণা করে দেখা হয় যে তার এই ধরনের হাদীস বর্ণনার পেছনে কোনো বৈষয়িক স্বার্থ থাকতে পারে কিনা। এভাবে অসংখ্য জাল হাদীসকে সহজে চিহ্নিত করা হয়েছে।
একইভাবে হাদীসের মতন বা বর্ণনা নিয়েও এই রকম কৌশল প্রয়োগ করে ভুল বা মিথ্যাকে খুঁজে বাহির করা হয়। যেমন যে সকল হাদীসের সত্যতা নিয়ে আমরা সুনিশ্চিত সেগুলোর বর্ণনার ধরন এবং ভাষার গুণগত মান থেকে আমরা রাসূল (সা) কথার ভঙ্গিমা সম্পর্কে একটা স্পষ্ট ধারণা পাই যার সাথে আরেকটি হাদীসের ভাষাকে মিলিয়ে দেখা হয়। এভাবেও জাল হাদীস সনাক্ত করা হয়ে থাকে। এছাড়াও যে সকল বর্ণনা অর্থের দিক থেকে অতিরঞ্জিত বা বুদ্বিবৃত্তিকভাবে অসাড় সেগুলোকেও বাদ দেওয়া হয়ে থাকে। যে সকল বর্ণনা কুরআনের সাথে সাংঘর্ষিক সেগুলোকেও পরিত্যাগ করা হয়। এরপর কোনো একটি বর্ণনা যদি কোনো প্রতিষ্ঠিত ঐতিহাসিক সত্য এর বিপরীত হয়, বর্ণনার মধ্যে যদি গোত্রীয় দৃষ্টিভংগি বা পক্ষপাতমূলক দৃষ্টিভঙ্গির উপস্থিতি থাকে তবে তা বাদ দেওয়া হয়।
দ্বন্দ্বমূলক বা পরস্পর বিরোধী হাদীস সম্পর্কিত বিজ্ঞান বা মুখতালাফুল হাদীস (Science of Conflicting Hadeeth)
এটা খুবই স্বাভাবিক যে বর্ণনার দিক থেকে বিবেচনা করলে কিছু হাদীসকে পরস্পর বিরোধী মনে হতে পারে। এর বিভিন্ন কারণ হতে পারে। যেমন- একটি হাদীস এসেছে সাধারণ পরিস্থিতিকে উদ্দেশ্য করে আবার অন্যটি এসেছে কোনো একটি সুনির্দিষ্ট পরিস্থিতিকে উদ্দেশ্য করে অথবা মিসকোট বা ভুলজায়গায় উদ্ধৃতি করা হয়েছে অথবা নির্দেশটি পরবর্তীতে রহিত হয়ে গিয়েছে। সুতরাং, এই ধরনের দ্বন্দ্বমূলক মনে হওয়া হাদীসগুলোকে রিকনসাইল করার জন্য সুনির্দিষ্ট কিছু পদ্ধতির অনুসরণ করা বাধ্যতামূলক। যেকারণে মুখতালাফুল হাদীস শাস্ত্রের উৎপত্তি। এক্ষেত্রে তিনটি পদ্ধতিকে কাজে লাগানো হয়:
ক) জাম বা সমন্বয়সাধন – দুটি হাদীসের মধ্যে সমন্বয় করার চেষ্টা করা হয় এবং কোনোটাকেই বাদ দেওয়া হয় না।
খ) তারজিহ (যখন হাদীস দুটির কালানুক্রম অজানা থাকে) – অনেকভাবেই এটা করা হয় যার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে দুটি দ্বন্দ্বমূলক হাদীসের মধ্যে যেটা অন্য কোন বিশুদ্ধ হাদীস এর সাথে মিলে সেটাকে গ্রহণ করে অন্যটি বাদ দেওয়া।
গ) নাকশ বা রহিতকরণ (যখন হাদীস দুটির কালানুক্রম জানা থাকে) – দুটি হাদীসের মধ্যে যদি সমন্বয়সাধন সম্ভব না হয় কিন্তু তাদের কালানুক্রম আমাদের জানা আছে তাহলে আগের হাদীসটিকে রহিত হয়েছে ধরে নেওয়া হয়।
ঘ) উপরের তিন উপায়ে যদি সমাধান না হয় তাহলে পরস্পর বিরোধী দুটি হাদীসকে অস্তিত্বহীন ধরে নেওয়া হয়।
একটি হাদীসকে গ্রহণ করার আগে মুহাদ্দিসগণ এই রকম গভীর গবেষণা করে থাকলে আর এর ফলে আমরা সহিহ বুখারি, মুসলিম, সিহাহ সিত্তাহ এর মতো বিশুদ্ধ হাদীসের কিতাব পেয়েছি। কিন্তু এরপরও যারা সন্দেহ ছড়ায় তারা আম মুসলিমদের অজ্ঞানতার সুযোগ নিয়ে সহিহ বুখারিকে নিয়েও সন্দেহ তৈরি করার চেষ্টা করছে। তারা বলে ইমাম বুখারি দাবি করেছেন যে তিনি ছয় লক্ষ হাদীস সংগ্রহ করেছিলেন এবং এর এর মধ্য থেকে যাচাই বাছাই করে তিনি সহীহ বুখারি রচনা করেছেন। তারা বলে হাদীস সংগ্রহের যে কঠিন পদ্ধতি অনুসরণ করা হয় সে অনুসারে একজন ব্যক্তির পক্ষে ছয় লক্ষ হাদীস সংগ্রহ করা কখনো সম্ভব না। সুতরাং এগুলো বানোয়াট।
আসলে, ইমাম বুখারি কোথাও বলেননি যে তিনি নিজে ছয় লক্ষ হাদীস সংগ্রহ করেছিলেন বরং তার সময়ে ছয় লক্ষ হাদীস প্রচলিত ছিল। যার মধ্য থেকে তিনি হাদীসের বিভিন্ন বিশুদ্ধতার মাপকাঠি ব্যবহার করে অল্প কিছু হাদীস গ্রহণ করে সহিহ বুখারি রচনা করেছেন। কেন আমরা মনে করছি যে, ইমাম বুখারিকেই ছয় লক্ষ হাদীস নিজে থেকেই সংগ্রহ করতে হবে। এখানে একটা ভুল ধারণাছড়ানো হচ্ছে যে ইমাম বুখারির আগে কোনো হাদীস কিতাব ছিলো না বা হাদীস এর লিখিত সংকলন ছিল না। এগুলো সম্পূর্ণ মিথ্যা। বরং, সহিহহ বুখারির আগেই অনেক কিতাব লেখা হয়েছিল যা নিয়ে আমরা একটু পর বিস্তারিত আলাপ করবো।
আরেকটা কথা বলা হয়, ছয় লক্ষ হাদীসের যে বিশাল সংখ্যা সেটাই বলে দিচ্ছে বেশিরভাগ হাদীস বানোয়াট কারণ নবীজি (সা) এর তেইশ বছরে নবুয়্যতের জীবনে এত অল্প সময়ে এত বিপুল পরিমাণ হাদীসের সংখ্যা হওয়া বাস্তবসম্মত না। এখানেও তারা জেনে-শুনে চতুরতার আশ্রয় নিচ্ছে অথবা তারা এতটাই মূর্খ যে জানেই না কিভাবে হাদীসের সংখ্যা পরিমাপ করা হয়। হাদীসের সংখ্যা কিভাবে গণণা করা হয় সেটা বুঝলে আমাদের কাছে সব পরিষ্কার হয়ে যাবে। প্রথমত, বেশিরবভাগ হাদীসেরই বর্ণনাকারী শুধুমাত্র তিনটি প্রজন্মের মধ্যে সীমাবদ্ধ। অর্থাৎ, সাহাবি, তাবেঈ এবং তাবে-তাবেঈন। হতে পারে কোনো একটা চেইনে তাবেঈ তিনজন, তাবে-তাবেঈ চারজন কিন্তু দিনশেষে তিন প্রজন্মের মধ্যেই তা সীমাবদ্ধ। এখন, একজন সাহাবি থেকে একজন তাবেঈ শুনলেন আর তার থেকে আরেকজন তাবে-তাবেঈ জানলেন তাহলে এটা একটা ইউনিক হাদীস। এখন যদি ঐ একই সাহাবি থেকে সেই তাবেঈ জানলেন আর তার থেকে অন্য একজন তাবে তাবেঈ জানলেন তখন কিন্তু সেটাকে আরেকটা ইউনিক হাদীস হিসাবে কাউন্ট করা হবে। এভাবে হাদীসের ইসনাদের মধ্যে যত পরিবর্তন আসবে তত সংখ্যক আলাদা আলাদা হাদীস হিসাবে গণণা করা হবে যদিওবা তা একই সাহাবা থেকে একইরকম বর্ণনা সম্বলিত হাদীস। তার মানে হাদীসের টেক্সট এর অনন্য হওয়া দিয়ে হাদীস গণণা করা হয় না বরং প্রত্যেকটা ইউনিক চেইন বা সনদকে আলাদা একটা হাদীস হিসাবে ধরা হয়। তাহলে চিন্তা করেন একটা হাদীস একজন সাহাবি থেকে অসংখ্য আলাদা আলাদা বর্ণনাকারীর মাধ্যমে তিন প্রজন্মের পর কয়েকশতে পরিণত হতে পারে। আর এভাবেই এসে নবী (সা) এর অল্প কিছু হাদীস তাবে-তাবেঈনদের যুগে এসে লক্ষ লক্ষ হাদীসে পরিণত হয়েছে। সুতরাং, হাদীসের প্রকৃত সংখ্যা বাড়েনি বরং বর্ণনা বা ইসনাদের সংখ্যা বেড়েছে।
অতীতে আমাদের স্কলারগণ বলেছিলেন যে, সহিহ হাদীসের সংখ্যা চার হাজারের আশেপাশে হবে। যেটা খুবই বাস্তব সম্মত সংখ্যা। আধুনিক যুগেও এই বিষয়ে একটা চমৎকার গবেষণা হয়েছে যেখানেও দেখা গেছে ইউনিক হাদীসের সংখ্যা চার হাজারের কম। একজন বিখ্যাত গবেষক সালেহ আহমেদ শামি তার লেখা গ্রন্থ “ওয়াজিজ ফি আল সুন্নাহ আল নাবাউইয়্যাহ” গ্রন্থে এই বিষয়টা উপস্থাপন করেছেন। তিনি শুরুতে বর্তমান সময়ে গ্রহণযোগ্য সহিহ হাদীসের ১৪ টা বই এর সকল হাদীসকে একত্রিত করেন এবং এর মধ্য থেকে যে হাদীসগুলো পুনরাবৃত্তি হয়েছে সেগুলো বাদ দিয়ে শুধু একটিকে গণনা করেছেন। যেমন: কোনো একটি হাদীস একজন সাহাবি থেকে বর্ণিত হওয়ার পর যদি পরবর্তীতে অসংখ্য বর্ণনাকারী সংযোজনের কারণে অনেকগুলো আলদা সনদ বা চেইন লাভ করে সেক্ষেত্রে তিনি সেটাকে শুধুমাত্র একটা হাদীস হিসাবে গণনা করেছেন। কিন্তু একই রকম টেক্সট বা বর্ণনা সম্বলিত হাদীস যদি অন্য আরেকজন সাহাবির মাধ্যমে পাওয়া যায় তবে তাকে আরেকটা হাদীস হিসাবে গণনা করেছেন। ধরুন একই রকম মতন সম্বলিত একটা হাদীস তিন জন সাহাবা আলাদা আলদাভাবে বর্ণনা করেছেন তাহলে সেটা তিনটা হাদীস ধরা হয়েছিল। অর্থাৎ, এখানেও অল্প কিছু পুনরাবৃত্তিকে গ্রহণ করা হয়েছিল। এরপরও, ইউনিক হাদীসের সংখ্যা এসে দাঁড়ায় চার হাজারেরো কম। এটা খুবই বাস্তবসম্মত সংখ্যা যা সাহাবাদের মাধ্যমে হাদীস আকারে আমরা পেয়েছি।
রাসূল (সা) এর হাদীসগুলোই কুরআনের ব্যাখ্যা স্বরূপ এবং আমাদের জন্য বিস্তারিত দিক নির্দেশনা। তাইতো নবী (সা) এর সাহাবিগণ অক্লান্ত পরিশ্রম করেছেন যেনো হাদীসগুলো হারিয়ে না যায়। মূলত হাদীস সংরক্ষণের জন্য চার ধরনের প্রচেষ্টা আমরা দেখতে পাই- মুখস্থকরা, আলোচনা করা, আনুশীলন করা এবং লিপিবদ্ধ করা।
ক) মুখস্থ করা
সাহাবাগণ(রা) হাদীসগুলোকে তাদের অন্তরে গেঁথে রাখতেন। হাদীস অনুসারে জীবন যাপন করা এবং তা মুখস্থ করে মনে রাখার জন্য তারা সর্বোচ্চ সময় ব্যয় করতেন। তাদের মধ্যে একটা বড় অংশ বাসায় না থেকে মসজিদে থাকতেন যেন সরাসরি রাসূল (সা) – এর কথা শুনতে পান। আর সেই সময়ের আরবের অধিবাসীগণের স্মৃতিশক্তি ছিল অসাধারণ। তারা খুব সহজেই কবিতার কয়েকশত লাইন মুখস্থ করে ফেলতে পারতো আর এটা ছিল তাদের নিত্যদিনের চর্চা। কয়েক হাজার কবিতা মুখস্থ ছিল এরকম লোকও আমরা আরব সাহিত্যে খুঁজে পাই। তারা তাদের বংশ পরম্পরা সম্পর্কে বিস্তারিত জ্ঞান রাখতো। শুধু তাই না তাদের উট এবং ঘোড়াগুলো বংশানুক্রমও মনে রাখতো।
আরবরা তাদের স্মৃতিশক্তি নিয়ে অনেক গর্ব করতো এবং লেখার চেয়ে স্মৃতিশক্তির উপর বেশি আস্থা রাখতো। কবিতাকে লিপিবদ্ধ করে সংরক্ষণ করাকে তারা লজ্জাজনক মনে করতো এবং লিখলেও সেটা প্রকাশ করতো না কারণ এর মাধ্যমে তাদের স্মৃতিশক্তির দুর্বলতা প্রকাশ পেতো। আর সাহাবাগণ এই চর্চাকেই কাজে লাগিয়েছিলেন। হাদীস মুখস্থ করার জন্য তাদের উৎসাহ ও উদ্দীপনা ছিল তথাকথিত এইসব কবিতা ও সাহিত্য মুখস্থ করার চাইতে অনেক গুণ বেশি।
আবু হুরাইরা (রা) রাতকে তিনভাগে ভাগ করতেন। একভাগে ইবাদত করতেন, এক ভাগে ঘুমাতেন আর একভাগে হাদীস মুখস্থ করতেন। একদা, মদিনার গভর্নর আবু হুরাইরা (রা) এর স্মৃতিশক্তি পরীক্ষা করার জন্য উনাকে তার বাসায় দাওয়াত দিলেন এবং উনাকে কিছু হাদীস শুনাতে বললেন। একইসময় মারোয়ান তার পত্রলেখককে পর্দার আড়ালে নিযুক্ত করলেন হাদীসগুলো লিখে রাখার জন্য। এরপর এক বছর পর মারোয়ান আবু হুরাইরা (রা)-কে আবারো আসতে বললেন এবং সেই হাদীসগুলো শুনাতে বললেন। এরপর আগের হাদীসের সাথে মিলেয়ে দেখা গেলো আবু হুরাইরা (রা) হুবহু একই রকমভাবে বর্ণনা করেছেন।
হাদীস বিশেষজ্ঞগণ ‘আসমা উর রিজাল’ নামক শাস্ত্র গড়ে তুলেছিলেন যেখানে বিভিন্ন নির্ভরযোগ্য উপায়ে একজন বর্ণনাকারী স্মৃতিশক্তি পরীক্ষা করা হতো এবং স্মৃতিশক্তি উচ্চমানসম্পন্ন না হলে তারা হাদীস গ্রহণ করতেন না।
খ) পারস্পরিক আলোচনা
সাহাবাগণ (রা) নিজেদের মধ্যে হাদীসগুলো নিয়ে পারস্পরিক আলোচনা করতেন। তারা যখনি রাসূল (সা) এর কাছ থেকে নতুন কোনো কিছু শিখতেন তা তারা অন্যদের সাথে আলোচনা করতেন। ইসলামে জ্ঞান অর্জন করা এবং তা প্রচার করা বাধ্যতামুলক। এই চর্চাটি হাদীস সংরক্ষণে ব্যাপক ভুমিকা রেখেছে।
গ) বাস্তব অনুশীলন
রাসূল (সা) হাদীসগুলো শুধুমাত্র কোন তত্ত্ব বা দর্শন না বরং এগুলো আমাদের জীবনযাপানের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত বা বাস্তবজীবনে প্রয়োগের সাথে সম্পর্কিত। সুতরাং, সাহাবীগণ (রা) যাই শিখতেন সাথে সাথে তা হুবহু তাদের জীবনে প্রয়োগ করতেন। আর এইভাবে হাদীসগুলো বাস্তব জীবনে চর্চা বা অনুশীলনের মাধ্যমে সংরক্ষিত হয়েছে।
ঘ) লিপিবদ্ধকরণ
অনেক সাহাবী (রা) হাদীস লিখে রাখতেন এবং এর মাধ্যমে অনেক হাদীস সংরক্ষণ করা হয়েছে। এটা সত্য যে শুরুর দিকে রাসূল (সা) কোরআনের আয়াত ব্যতীত অন্য কিছু লিখে রাখতে নিষেধ করেছিলেন। যার কারণ ছিল, শুরুর দিকে সাহাবারা (রা) কোরআনের ভাষাশৈলির সাথে পুরোপুরি পরিচিত ছিলেন না আর সেই সময় কোরআন বই আকারেও ছিল না তাই এই সম্ভাবনা ছিল যে হাদীসগুলো লিখে রাখলে তা কুরআনের সাথে মিশ্রিত হয়ে যেতে পারে। কিন্তু পরবর্তীতে যখন সাহাবাগিণ (রা) কোরআনের ভাষাশৈলি সম্পর্কে পুরোপুরি ধারণা লাভ করলেন তখন আর হাদীস লিখে রাখলে তা মিশ্রিত হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকলো না। এমতাবস্থায় রাসূল (সা) তার সাহাবাদের নির্দেশ দিলেন হাদীস লিখে রাখার জন্য। এইজন্যই আমরা হাজার হাজার হাদীস লিখিত অবস্থায় পেয়েছি যা রাসুল (সা) ও চার খলিফার সময়েই লেখা হয়েছিল। সুতরাং, আমাদের মধ্যে যে ভুল ধারণা ছড়ানো হচ্ছে হাদীস সংকলন শুরু হয়েছিল তিনশত হিজরি সনের পরে তা পুরোপুরি মিথ্যা। লিখিত কিছু হাদীস সংকলনের উদাহারণ নিচে দেওয়া হলো:
- রাসূল (সা) এর নির্দেশ মোতাবেক একটি নথি লেখা হয়েছিল যেখানে যাকাত সম্পর্কিত শরিয়তের হুকুম আহকাম বিস্তারিতভাবে ছিলো। এর নাম দেওয়া হয়েছিল ”আল সাহিফাহ আল সাদাকাহ”। আব্দুল্লাহ ইবন উমার (রা) বলেন, “রাসূল (সা) এর নির্দেশে যাকাতের প্রতিলিপি লেখা হয়েছিল এবং তার(সা) এর ওফাতের পর তা গভর্নরদের কাছে পাঠানো হয়েছিল। তিনি (সা) এটা তার (সা) তলোয়ারের সাথে সংযুক্ত করেছিলেন। তিনি (সা) যখন মৃত্যু বরণ করেন এরপর আবু বকর (রা) আমৃত্যু এটা অনুসরণ করেন, এরপর উমর (রা) আমৃত্যু এটা অনুসরণ করেন…। (তিরমিযি)
- দশম হিজরিতে, মুসলিমরা যখন নাজরান বিজয় করে রাসুল (সা) তখন আমর ইবন হাজম (রা) কে ইয়েমেনের গভর্নর হিসাবে নিয়োগ করেন। সে সময় রাসুল (সা) উবাই ইবন কাব (রা) কে দিয়ে একটি বিস্তারিত প্রতিলিপি লেখান এবং আমর ইবন হাজম (রা) কে প্রেরণ করেন। এই প্রতিলিপিতে কিছু সাধারণ উপদেশ ছাড়াও পবিত্রতা, নামায, যাকাত, উশর, হাজ্জ, উমরাহ, জিহাদ, গনিমত, ট্যাক্স, রক্তপণ, প্রশাসন, শিক্ষা ইত্যাদি বিষয়ে শরীয়াহ হুকুম লেখা ছিল। হযরত আমর ইবন হাজম (রা) এই প্রতিলিপি অনুসারেই ইয়েমেনের শাসন কাজ পরিচালনা করতেন।
- আবু হুরাইরা (রা) সবচেয়ে বেশি হাদীস বর্ণনা করেছেন। ইসলাম গ্রহণেরর পর তিনি তার সম্পূর্ণজীবন এই হাদীস জানা ও সংরক্ষণের জন্য কাজ করে গেছেন। আবু হুরাইরা (রা) এর কাছে রাসুল (সা) হাদীস সম্বলিত অনেক বই ছিল শুধু তাই না উনার ছাত্ররা তার কাছ থেকে শিক্ষা লাভ করে অনেক বই তৈরি করেছিলেন।
- হযরত আনাম ইবন মালিক (রা) রাসূল (সা) এর সাথে দশ বছর ছিলেন। এই সময়ে তিনি বিশাল সংখ্যক হাদীস শুনেন এবং সেগুলো লিখে রাখেন।
- হযরত আলি (রা) এর কাছেও বিশাল সংখ্যক হাদীস লিখিত ছিল যা ইমাম বুখারি সহিহ বুখারিতে যা ছয়টি জায়গায় উল্লেখ করেছেন।
- রাসুল (সা) যখন মৃত্যু বরণ করেন তখন আব্দুল্লাহ ইবন আব্বাস (রা) অনেক ছোট ছিলেন। হাদীস সংরক্ষণের জন্য তিনি যেগুলো সরাসরি শুনেছেন সেগুলো লিখে রাখেন এবং অন্যান্য সাহাবিদের কাছে যেতেন ও জ্ঞান অর্জন করতেন আর সেগুলোও লিখে রাখেন। তার লেখা বই এর সংখ্যা এতো বেশি ছিলো যে সেগুলো বহন করতে একটা উটের প্রয়োজন হত। ইবন আব্বাস (রা) এর ছাত্ররাও সেই হাদীসের বই গুলো কপি করে অসংখ্য বই লিখেছেন।
- এছাড়াও পরবর্তী সময় প্রসিদ্ধ ইমামগণ বিভিন্ন ফিকহের বই লিখেন যা মধ্যে দলিল হিসাবে অসংখ্য হাদীস লেখা ছিল। ইমাম শাফেই ২০৫ হিজরি সনে ‘আল-উম্ম’ ও ‘আর-রিসালাহ’ নামক বই লিখেন যেখানে তিনি শত শত হাদীস উল্লেখ করেছেন। আর এর মধ্যেই ইমাম মালিক তার মুয়াত্তা লিখে ফেলেছেন যা বর্তমানে হাদীসের বই হিসাবে পরিচিত হলেও এটা মূলত ফিকহের বই।
সুতরাং, আমরা দেখতে পাচ্ছি স্বয়ং রাসুল (সা) এর সময় থেকে শুরু করে ইমাম বুখারি ও মুসলিমের আগমনের আগেই সব সময় লিখিতভাবে হাদীস সংকলনের প্রচলন ছিল। ইমাম বুখারি যেটা করেছেন সেটা হলো হাদীস গ্রহণ করার মাপকাঠিগুলোকে আরো নিখুঁত করেছেন এবং হাদীস সংগ্রহের একটি নিখুঁত প্রক্রিয়া তৈরি করেছেন যাতে করে করে বিশুদ্ধভাবে রাসুল (সা) এর হাদীসগুলো কেয়ামত পর্যন্ত সংরক্ষিত হয়।
এখানে আমরা অতি সংক্ষেপে হাদীস সংগ্রহ ও সংকলন ইত্যাদি বিষয়ে আলোচনা করেছি। এছাড়া হাদীস এর সত্যতা নিয়ে যে সন্দেহগুলো ছড়ানো হচ্ছে সেগুলো যে ভিত্তিহীন তা তুলে ধরেছি। আশা করি, এই বিষয়গুলো নিয়ে আমরা যদি নিষ্ঠার সাথে চিন্তা ভাবনা করি তাহলে আমাদের ঈমান আরো শক্তিশালী হবে এবং যাদের মধ্যে বিভ্রান্তি তৈরি হয়েছে তারা সঠিক পথে ফিরে আসতে পারবেন। আমিন।