ইউক্রেন যুদ্ধের ক্লান্তি

ফেব্রুয়ারি ২০২৩ সালে ইউক্রেন যুদ্ধ তার প্রথম বছর পূর্ণ করেছে এবং ২০২৪ সালের ফেব্রুয়ারিতে এর দু বছর পূর্ণ হবে। রাশিয়ার রাষ্ট্রপতি ভ্লাদিমির পুতিন আক্রমণের নির্দেশ দেওয়ার পরবর্তী কয়েক সপ্তাহে বাইডেন প্রশাসন ইউক্রেনকে আত্মরক্ষার জন্য গভীরভাবে জমে থাকা ক্ষোভের সদ্ব্যবহার করতে প্রয়োজনীয় সামরিক সহায়তা দিয়েছিল। সিরিয়ায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পদক্ষেপের মতো, ইউক্রেন সংঘাতেও মার্কিন পদক্ষেপে ইউক্রেনের যুদ্ধক্ষেত্রে বিজয়ের আকাঙ্ক্ষা খুব কমই ছিল। আর এর মধ্যেই ওয়াশিংটনের রাজনীতিতে আরও মেরুকরণ ঘটতে থাকে।

যুদ্ধে আমেরিকান সম্পৃক্ততার প্রথম অংশটি ছিল ইউক্রেনকে সাহায্য-সহযোগিতা সরবরাহ নিশ্চিত করা এবং একই সাথে রাশিয়ার উপর যাতে বড় ধরনের আর্থিক ব্যয় আরোপিত হয়।  যখন রাশিয়ার ব্লিটজক্রেগ (সংক্ষিপ্ত ও দ্রুত আক্রমণ) ব্যর্থ হল তখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দ্বিতীয় পর্যায়ের পরিকল্পনা শুরু হয় যা ইউক্রেনকে একটি পাল্টা আক্রমণের জন্য প্রস্তুত করছিল যার ফলে রাশিয়া ইউক্রেনকে কিছু ভূখণ্ড ফিরিয়ে দিবে এবং অবশেষে শক্তিশালী  অবস্থান থেকে সে রাশিয়াকে আপসের প্রস্তাব দিবে। কিন্তু আমেরিকার যুদ্ধ প্রচেষ্টার এই অংশে বড় ধরনের ধাক্কা লেগেছে। ইউক্রেন তার ২০২৩ এর পাল্টা আক্রমণে যে লক্ষ্যগুলি নির্ধারণ করেছিল তা অর্জন করতে সংগ্রাম করে যাচ্ছে, যার লক্ষ্য ছিল রাশিয়ান ফ্রন্টকে ডনবাস থেকে ক্রিমিয়া পর্যন্ত বিভক্ত করে রাশিয়ার প্রতিরক্ষা ভেদ করে তা ব্ল্যাক সি পর্যন্ত নিয়ে যাওয়া। আক্রমণের ৫ মাস পরে, ইউক্রেনে শীত শুরু হওয়ার সাথে সাথে রাশিয়ার প্রতিরক্ষা ভেদ করতে সে ব্যর্থ হয়েছিল।

মার্কিন সামরিক সহায়তা একটি পরিচিত প্যাটার্ন অনুসরণ করেছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ইউক্রেনকে পদাতিক অস্ত্র দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল এবং এটি যুদ্ধের শুরুর দিকে হওয়ায় তাতে সামান্যই বিরোধিতা ছিল। ইউক্রেন তখন আর্টিলারি সিস্টেমের জন্য বলেছিল, তবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যুদ্ধ প্রসারিত করবে কিনা এবং ইউরোপীয় মহাদেশকে আরো অস্থিতিশীল করা ঠিক হবে কিনা তা নিয়ে বিতর্ক শুরু হয়েছিল। অবশেষে, অনেক বিতর্কের পর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং অন্যান্য ইউরোপীয় দেশগুলি ইউক্রেনকে আর্টিলারি সিস্টেম সরবরাহ করে। ইউক্রেন তখন বলেছিল যে, রাশিয়ান বাহিনীর বিরুদ্ধে আরও অগ্রসর হওয়ার জন্য তাদের ট্যাঙ্ক দরকার এবং তখন কে তাদের ট্যাংক সরবরাহ করবে তা নিয়ে আরেকটি বিতর্ক শুরু হয়েছিল। ইউক্রেন আব্রামস ট্যাঙ্ক চেয়েছিল, কিন্তু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তার ইউরোপীয় মিত্রদের ইউক্রেনে ট্যাঙ্ক স্থানান্তর করার জন্য চাপ দেয় যেহেতু সেগুলো ইউরোপীয় মহাদেশে রয়েছে। অনেক বিতর্ক ও মিডিয়া সার্কাসের পরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ট্যাঙ্ক সরবরাহ করতে সম্মত হয়েছিল, কিন্তু কোনো নির্দিষ্ট সময়সীমা প্রদান করা হয়নি বা কোন স্টক থেকে ইউক্রেনকে তা সরবরাহ করা হবে তাও বলা হয়নি। ইউক্রেনের কর্মকর্তারা তখন বলেছিলেন যে, তাদের সেনাদের কভার দেওয়ার জন্য যুদ্ধবিমান দরকার। এবার আবার বিতর্ক শুরু হয় যে, কে এসব সরবরাহ করবে এবং কোথা থেকে তা আসবে? মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র F-16 এর ইউরোপীয় স্টক ইউক্রেনে স্থানান্তর করার ব্যাপারে সম্মত হয়, এই প্রচেষ্টার জন্য মার্কিন যুক্তরাজ্য ও ইউরোপে ইউক্রেনীয় পাইলটদের প্রশিক্ষণ শিবির স্থাপন করা হয়। ইউক্রেন তখন বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার প্রয়োজন দেখায় এবং আবারও অনেক ধুমধাম করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র একটি ‘প্যাট্রিয়ট ব্যাটারি’ সরবরাহ করে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ধীরে ধীরে ইউক্রেনকে অস্ত্র সরবরাহ করছে এবং তারপরে পরিমাণ সীমিত করে রাখছে যার অর্থ ইউক্রেন রাশিয়াকে যে একটি গুরুতর সামরিক আঘাত দেবে এমনটি কখনই ঘটবে না।

যুদ্ধের অর্থনৈতিক দিক বিবেচনা করলে দেখা যাচ্ছে যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমারা রাশিয়াকে ইতিহাসের সবচেয়ে বেশি নিষেধাজ্ঞার দেশ বানিয়েছে। ইউরোপ কার্যত রাশিয়া থেকে জ্বালানী আমদানি বন্ধ করে দেয় এবং মার্কিন নেতৃত্বে পশ্চিমারা রাশিয়াকে বিশ্ব থেকে বিচ্ছিন্ন করতে কাজ করে। নিষেধাজ্ঞাগুলি কেবল তখনই কার্যকর হয় যখন প্রত্যেকে তা প্রয়োগ করে। যদিও ইউরোপ তার জ্বালানী আমদানি কমিয়েছে, রাশিয়া ভারত, চীন ও তুরস্ককে তার জ্বালানী কিনতে এবং কার্যকরভাবে ইউরোপীয় বাজার প্রতিস্থাপন করতে খুবই আগ্রহী রূপে পেয়েছে। এই মুহূর্তে রাশিয়া অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞার দিকটি অনুভব করছে না কারণ ২০১৪ সাল থেকেই সে তার ‘রাশিয়ান দুর্গ’ কৌশলের অংশ হিসেবে এমন কোনো ঘটনার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিল। মার্কিন ট্রেজারি ও স্টেট ডিপার্টমেন্টের ২০২৩ সালের সেপ্টেম্বরে রাশিয়া নিষেধাজ্ঞাগুলি এড়াতে ব্যবহার করা ১৫০ জন ব্যক্তি ও সংস্থার উপর আরো  জরিমানা করার ঘোষণার মাধ্যমে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র রাশিয়ার উপর তার স্ক্রু আরো শক্ত করছে।

২০২৩ সালের অক্টোবরে ফিলিস্তিনে যুদ্ধ শুরু হওয়ার সাথে সাথে আমেরিকার নজর মধ্যপ্রাচ্যের যুদ্ধের দিকে চলে যায় এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ইউক্রেনকে রাশিয়ার সাথে শান্তি আলোচনা শুরু করার জন্য চাপ দিতে শুরু করে। এটি একটি বড় ইউ-টার্ন বিশেষ করে যেহেতু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র রাশিয়ার সাথে আলোচনা করতে পূর্বে অস্বীকার করেছে এবং ইউক্রেনও যাতে কখনই রাশিয়ার সাথে আলোচনা না করে তার জন্য তাকে বাধ্য করেছে। ৪ নভেম্বর ২০২৩-এ ইউরোপীয় কমিশনের প্রেসিডেন্ট উরসুলা ভন ডার লেয়েনের সাথে একটি যৌথ সংবাদ সম্মেলনের সময়, রাষ্ট্রপতি ভলোদিমির জেলেনস্কি স্বীকার করেন যে রাশিয়ার বিরুদ্ধে তার দেশের যুদ্ধ নিয়ে পশ্চিমে ছিল ক্রমবর্ধমান ক্লান্তি এবং “এটি পরিষ্কার যে মধ্যপ্রাচ্যের যুদ্ধ.. …আন্তর্জাতিক মনোযোগ তাদের দিক থেকে সরিয়ে অন্যদিকে নিয়ে গিয়েছে।” এই স্বীকারোক্তি ইউক্রেনীয় জেনারেলের বক্তব্যের এক সপ্তাহ পর এলো যেখানে তিনি স্বীকার করেন যে, যুদ্ধ একটি অচলাবস্থায় রূপ নিয়েছে। রাশিয়ার প্রধান দাবি সর্বদাই ছিল ‘ইউক্রেনীয় নিরপেক্ষতা’। কিন্তু যুদ্ধের অগ্রগতির সাথে সাথে রাশিয়া খেরসন, জাপোরিঝিয়া, দোনেৎস্ক ও লুহানস্ককে দখল করে নিয়েছে এবং এখন বলছে যে কোনো শান্তি চুক্তির জন্য অবশ্যই এই অঞ্চলগুলোকে রাশিয়ার অঞ্চল হিসাবে স্বীকৃতি দিতে হবে।

২০২৪ নির্বাচনের বছর হওয়ায় বাইডেন প্রশাসন ঘরোয়া বিষয়গুলিতে মনোনিবেশ করবে। তবে ২০২৪ সালে একমাত্র চলক হচ্ছে যদি রাশিয়া তার নিজস্ব একটি পাল্টা আক্রমণ শুরু করার জন্য তার সংঘবদ্ধ সৈন্যদের ব্যবহার করার সিদ্ধান্ত নেয়।

Taken from “Strategic Estimate 2024” by Adnan Khan

Print Friendly, PDF & Email

Leave a Reply