বর্ণবাদী ও সাম্রাজ্যবাদী পুঁজিবাদ: আদর্শিক দৈন্যতায় ভারাক্রান্ত বিশ্ব…বিকল্প কী?

২৫শে মে২০২০যুক্তরাষ্ট্রের মিনিয়াপোলিসে ৪৬ বছর বয়সী কৃষ্ণাঙ্গ জর্জ ফ্লয়েডকে শ্বাসরোধ করে হত্যা করে শ্বেতাঙ্গ পুলিশ কর্মকর্তা ডেরেক চাওভিন। ভাইরাল হওয়া একটি ভিডিও ক্লিপে দেখা যায় যে ফ্লয়েডকে গাড়ি থেকে বের করে কোন কারণ ছাড়াই এই পুলিশ অফিসার রাস্তার উপরে তার ঘাড়ে হাঁটু দিয়ে চেপে ধরে রাখে। এমন অবস্থায় ফ্লয়েড বারবার সেই পুলিশ অফিসারকে বলতে থাকেন যে তিনি নিঃশ্বাস নিতে পারছেন না। কিন্তু সেই পুলিশ অফিসার হাঁটু সরিয়ে না নেয়ায় আস্তে আস্তে তিনি নিস্তেজ হয়ে পড়েন। এরপর দেখা যায় যেএকটি এ্যাম্বুলেন্স এসে রাস্তায় নিস্তেজ হয়ে পড়ে থাকা ফ্লয়েডকে তুলে নেয়এবং পরবর্তীতে জানা যায় যে তিনি মারা গেছেন। এই ঘটনার চারদিন পর ২৯শে মে মিনিয়াপলিসে কৃষ্ণাঙ্গ আমেরিকানগণ বিক্ষোভ শুরু করেন এবং ক্রমান্বয়ে তাদের সাথে শ্বেতাঙ্গসহ মিশ্র বর্ণের মানুষেরা যুক্ত হয়ে দেশটির বৃহত্তর জনগোষ্ঠী বর্ণবাদী আচরণের বিরুদ্ধে প্রতিবাদে গর্জে ওঠে। এর ঢেউ লাগে ইউরোপের বিভিন্ন দেশেওযেখানে জনগণকে বর্ণবাদের বিরুদ্ধেস্লোগানে স্লোগানে ফুঁসে উঠতে দেখা গেছে। এমনকি আমরা যুদ্ধবাজ জুনিয়র বুশসহ সাবেক আমেরিকান প্রেসিডেন্টদেরও নিন্দা জ্ঞাপন করতেদেখছিযদিওবা তাদের সময়ও কৃষ্ণাঙ্গরা বিভিন্ন নিপীড়নের শিকার হয়েছেন। যে পুলিশ এই ঘটনা ঘটিয়েছে সেই পুলিশ বাহিনীর অন্য সদস্যরাও হাঁটু গেড়ে প্রতীকী প্রতিবাদের মাধ্যমে এ হত্যাকান্ডের নিন্দা জানিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের আদালত বলেছে যে এই কেসটি এমনভাবে সাজানো হবে যাতে অপরাধী পুলিশ কর্মকর্তার দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির মাধ্যমে এমন বর্ণবাদী আচরণ চিরতরে নির্মূল হয়।

জর্জ হত্যার প্রতিবাদে উত্তাল হয়ে ওঠা বিক্ষোভ দমনে যুক্তরাষ্ট্রের ২২টি অঙ্গরাজ্যের ৪০টি শহরে কারফিউ জারি করা হয়েছে এবং বিভিন্ন অঙ্গরাজ্যে এখন পর্যন্ত শত শত মানুষ গ্রেফতারের খবর পাওয়া গেছে। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প বিক্ষোভ নিয়ন্ত্রণে প্রতিনিয়ত হুমকি দিয়ে যাচ্ছেন। দিবেনইতোকারণ তিনিও তো একজন বর্ণবাদীযা বিভিন্ন সময়ে তার মন্তব্যের মাধ্যমে পরিষ্কারভাবে ফুটে উঠেছে। ২০১৮ সালের ১১ই জানুয়ারি তারিখে অভিবাসন নীতি নিয়ে কথা বলতে গিয়ে তিনি হাইতিহন্ডুরাসসহ কিছু আফ্রিকান দেশকে “শিট হোল”-এর সঙ্গে তুলনা করেছেন!! যুগ যুগ ধরে চলে আসা এমন বর্ণবাদী আচরণের কারণে ১৯৬৩ সালে তৎকালীন আমেরিকার প্রেসিডেন্ট জন এফ কেনেডি হত্যার পর কৃষ্ণাঙ্গ নেতা মার্টিন লুথার কিং তার স্ত্রীকে উদ্দেশ্য করে বলেছিলেন যে: আমিও এরকম হত্যাকান্ডের শিকার হবকারণ আমেরিকার সমাজ হচ্ছে একটি অসুস্থ সমাজ।

প্রথমে “বর্ণবাদ কী”-সেবিষয়ে একটু আলোকপাত করা যাক। এটি এমন একটি মতবাদ যাতে বিশ্বাস করা হয় যে কোন গোষ্ঠী অন্য গোষ্ঠীর চেয়ে নির্দিষ্ট কিছু বৈশিষ্ট্যের কারনে উঁচু বা নিচু স্তরেরকিংবা তাদের উপর তারা কর্তৃত্ব করার অধিকারীবা তুলনামূলকভাবে বেশি যোগ্য। বর্ণবাদী আচরন ও বৈষম্য কখনো গায়ের চামড়ার রঙের ভিত্তিতে করা হয় – অর্থাৎ: সাদা বা কালোকখনো করা হয় গোত্র কিংবা ধর্মীয় পরিচয়ের ভিত্তিতেআবার কখনোবা করা হয় ভিন্ন আঞ্চলিকতার কারনে। কিছু উদাহরনের মাধ্যমে আমরা বিষয়টি সম্পর্কে পরিষ্কার ধারনা পেতে পারি:শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে বিশ্বে চলমান শ্বেতাঙ্গ ও কৃষ্ণাঙ্গদের মধ্যে যে বর্ণবাদী আচরণ পরিলক্ষিত হচ্ছে তার সর্বশেষ উদাহরণ হলো জর্জ ফ্লয়েড হত্যাকান্ড। এমনকি বর্ণবাদের বিরুদ্ধে সারা জীবন সংগ্রাম করে আসা দক্ষিণ আফ্রিকার কৃষ্ণাঙ্গ নেতা নেলসন মেন্ডেলা জেল থেকে বেরিয়ে আসার পর সেদেশের রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে ২৫ বছর অতিবাহিত করার পরেও গণমাধ্যমে বলা হয়েছে যে এখনও সেখানে বর্ণবাদ প্রকট। কোথায় নেই বর্ণবাদহোক সেটা অধিকার আদায়ে কিংবা ন্যায় বিচারের ক্ষেত্রেক্রিকেট বা ফুটবল দুনিয়ায়বা সিনেমা পাড়ায়। ওয়েস্ট ইন্ডিয়ান ক্রিকেটার ক্রিস গেইল তার দল ও আইসিসির বিরুদ্ধে বর্ণবাদের অভিযোগ তুলেছেন। ফুটবল স্ট্রাইকার লুকাকু বলেছেন যে তিনি যখন গোল করেন তখন তিনি হিরো হিসেবে মর্যাদা পান আর দল হেরে গেলে তিনি হয়ে যান একজন ঘৃণিত কঙ্গো বংশোদ্ভূত কৃষ্ণাঙ্গ!! ২০১৮ সালের বিশ্বকাপ জয়ী ফুটবলার এমবাপ্পেকেও আলজেরিয়ার নিগ্রো বলে গালি দেয়া হয়যখন দল বা ক্লাব ফুটবলে তার অবদান কম হয়। পশ্চিমা দুনিয়ায় কৃষ্ণাঙ্গ অভিনেতা-অভিনেত্রীদের নিগৃহীত হওয়ার খবর আমরা প্রায়ই গণমাধ্যমে পাই। এই করোনা মহামারীর সময়েও দারিদ্র ও বৈষম্যের কারণে কৃষ্ণাঙ্গদের অনেকেরই যাদের স্বাস্থ্য বীমা নেই তারা চিকিৎসা পাচ্ছে নাবরং বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে তাদেরকে সংক্রমণের ঝুঁকির মধ্যেও জোরপূর্বক কাজ করতে বাধ্য করা হচ্ছে।

ধর্মজাত বা গোত্রের ভিত্তিতে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বৈষম্যপূর্ণ আচরণ পরিলক্ষিত হয়ভারতে উচু বা নিচু জাতের ভিত্তিতে ব্রাহ্মণ (পুরোহিত জাতীয় লোক) বা ক্ষত্রিয়দের (শাসক প্রশাসক ও যোদ্ধা) মাধ্যমে দলিতদের উপর বিভিন্ন ধরনের নিপীড়নের খবর প্রায়শঃই গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়। ২০১৪ সালে জার্মান বিশ্বকাপজয়ী ফুটবলার মেসুত ওজিল অভিযোগ করেছিলেন যে২০১৮ সালে দল হেরে যাওয়াতে তাকে তুর্কি মুসলিম বলে গালি দেয়া হয়!! এছাড়াও আমরা দেখি যে নাইন-ইলেভেনের পরে সমগ্র বিশ্বে পরিকল্পিতভাবে মুসলিমদের বিরুদ্ধে যে বর্ণবাদী আচরণ উসকে দেয়া হয়েছিল তার অন্যতম ফলাফল হচ্ছে নিউজিল্যান্ডের ক্রাইস্টচার্চে টেরেন্ট ব্রেন্টন নামক এক বর্ণবাদী কর্তৃক জুমু‘আর নামাজের সময়ে ৫০ জন মুসলিমকে গুলি করে হত্যা। গত ২৮শে এপ্রিল ইসরাইলী পুলিশ কর্তৃক একজন প্রতিবন্ধী ফিলিস্তিনি যুবককে গুলি করে হত্যার ঘটনা এসবের ধারাবাহিকতা মাত্র। ভারতের মুসলিমগণও এই ধরনের আচরণ থেকে রেহাই পায়নিযেখানে প্রতিনিয়ত বিভিন্ন ধরনের গুজব সৃষ্টি করে মুসলিমদেরকে নির্বিচারে হত্যা করা হয়। এছাড়াও মায়ানমারে রোহিঙ্গা মুসলিমদেরকে বৌদ্ধদের দ্বারা বর্ণনাতীত নিপীড়নের শিকার হয়ে দেশছেড়ে পালিয়ে আসতে হয়। এগুলো ছাড়াও পশ্চিমা বিশ্বসহ প্রায় প্রতিটি দেশেই মৌলিক অধিকার হরণসহ কর্মক্ষেত্রে মুসলিমদের সাথে বর্ণবাদী আচরণের অভিযোগ খুবই মামূলি বিষয়।

গত ৬ই মার্চ নিউইয়র্ক সিটিতে ভিন্ন আঞ্চলিকতার কারনে ডানপন্থীদের দ্বারা বর্ণবাদের একটি ঘটনা ঘটতে দেখা গেছেভিডিও ফুটেজ এসেছেযে সাবওয়ে ট্রেনে এক ব্যক্তির সাথে অন্য এক ব্যক্তি তর্ক করছে এবং এশিয়ান-আমেরিকান ওই ব্যক্তির উপরে এয়ার ফ্রেশনার স্প্রে করে দেয়া হয়েছে। সাম্প্রতিক সময়ে লন্ডনে জনাথন মক নামের এক সিঙ্গাপুরী তরুণকে বর্ণবাদী আক্রমণের শিকার হতে হয়েছেলন্ডনের অক্সফোর্ড স্ট্রীট দিয়ে হাঁটার সময় ৩ বা ৪ জনের একটি দল তাকে বলে যেআমরা আমাদের দেশে করোনা ভাইরাস চাইনাএবং তাকে কিল-ঘুষি মেরে মারাত্মকভাবে আহত করেকারণ সে একজন এশিয়ান। এরকম হাজারো ঘটনা প্রতিনিয়ত ঘটে চলেছে যা বলে শেষ করা যাবে না।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জর্জ ফ্লয়েড হত্যাকান্ডসহ সাম্প্রতিক ঘটনাপ্রবাহ বর্তমান সমাজগুলোতে বিদ্যমান জাতিগত বৈষম্য ও বিভাজনকে তুলে ধরেছে। যদিও মানুষ বর্ণবাদের বিরুদ্ধে সরবতথাপি যে পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় তার বসবাস সেখানেই নিহিত রয়েছে এমন বৈষম্যের বীজ। আমেরিকা ধনী এবং সম্পদশালী রাষ্ট্র হলেও পুঁজিবাদী আদর্শের অন্তর্নিহিত দুর্বলতা বা দৈন্যতার কারনে তাদের সমাজে আজ প্রতিনিয়ত সংঘর্ষউত্তেজনা ও রক্তপাতের মতো ঘটনা অহরহ ঘটছে। আর এই অন্তর্নিহিত আদর্শিক দুর্বলতাগুলোর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে সুবিচারের অভাবসম্পদের অসম বন্টনবর্ণবাদ এবং জাতিগত বৈষম্য। আর কেবল কালোরাই নয়বরং শেতাঙ্গ-অশেতাঙ্গ থেকে শুরু করে ন্যূনতম সম্পদের মালিক সমাজের বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর সকলেই এগুলোর শিকার। এজন্যই তারা আজ “নো জাস্টিসনো পিস” স্লোগানে রাজপথ মুখরিত করে তুলেছেযা আসলেই বাস্তব সত্য। পুঁজিবাদী আদর্শ বৈশ্বিকভাবে সমাজে যথাযথ ও ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে এবং সম্পদের সুষম বন্টনের মাধ্যমে গণমানুষের চাহিদা পূরণে ব্যর্থ হয়েছে। সর্বোপরি যেকোন ধরনের বৈষম্য দূর করে সমাজে জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সুশাসন নিশ্চিতের সক্ষমতার মাপকাঠিতেও এই পুঁজিবাদী আদর্শ ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে এবং এর আদর্শিক দৈন্যতার কারনে সমগ্র বিশ্ব কে আজ ভয়াবহ মূল্য চুকাতে হচ্ছে। অতএববিশ্বজগতের সৃষ্টিকর্তা মহান আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়া তা‘আলা কর্তৃক প্রদত্ত ত্রুটিমুক্ত আদর্শ “ইসলাম” কিভাবে মানবজাতিকে সকল ধরনের বৈষম্যবর্ণবাদের অভিশাপ এবং দুঃখ-দুর্দশা থেকে মুক্তি দিতে পারে সেবিষয়ে যাওয়ার আগে “জাতীয়তাবাদ কী” এবং ঐতিহাসিক দৃষ্টিকোন থেকে মুসলিম বিশ্বে এর প্রভাব কি সেবিষয়ে আসুন কিছু ধারনা পাওয়ার চেষ্টা করি।

জাতীয়তাবাদ হচ্ছে এমন একটি বন্ধন যা লোকদের মধ্যে পারিবারিক বা গোত্রীয় সম্পর্কের উপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠে। আধিপত্য অর্জনের মনোভাব থেকেই এটি উদ্ভূত হয়। এটি পরিবার থেকে এর শুরু হয় যেখানে একজন সদস্য পরিবারের অন্য সদস্যের উপর কর্তৃত্ব করতে চায়। পরিবারের উপর কর্তৃত্ব পাওয়ার পর সে যে কমিউনিটিতে বসবাস করে তাদের উপর কর্তৃত্ব অর্জনের চেষ্টা করে। পরবর্তীতে তারা একে অপরের সাথে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় লিপ্ত হয় যাতে করে সার্বিক কর্তৃত্ব কুক্ষিগত করার সাথে সাথে সবধরনের সুযোগ-সুবিধা ও সম্মান-প্রতিপত্তি অর্জন করতে সক্ষম হয়। ইসলামের বাণী আসার আগে আরব উপদ্বীপ বিভিন্ন গোত্রীয় ধারায় বিভক্ত ছিল এবং তৎকালীন আরব সমাজে জাতীয়তাবাদী ওদেশপ্রেমের বন্ধন বিদ্যমান ছিল। একই বাড়িতে বসবাসকারী লোকেরা একটি পরিবার গঠন করেছিল। একটি পরিবার থেকে বংশ তৈরী হয়েছিল এবং পরবর্তীতে বিভিন্ন গোত্রে বিভক্ত হয়েছিল। প্রতিটি গোত্রের নিজস্ব নিয়ম-কানুন ও বিধি-বিধান ছিল যার দ্বারা লোকেরা শাসিত হতো। সমস্ত ক্রিয়া-কলাপ এই কাঠামোর মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল এবং যে কেউ এই সীমা ছাড়িয়ে গেলে তাকে তাদের শাস্তির সম্মুখীন হতে হতো। গোত্রের প্রতিদৃঢ় আনুগত্যের কারণে আন্তঃগোত্রীয় প্রতিদ্বন্দ্বিতা থেকে তুচ্ছ বিষয়ে যুদ্ধ শুরু হয়ে যেত। যেমন: মদীনার আওস ও খাজরাজ গোত্র উটের রশি নিয়ে ৮ বছর যুদ্ধ করেছিল!

বহু শতাব্দী ধরে বিদ্যমান আরব সমাজের গোত্রীয় কাঠামো ইসলামের আগমনের ফলে নির্মূল হয়েছিল। ইসলামী আক্বীদার ভিত্তিতে গঠিত আদর্শিক বন্ধন মুসলিমদের মধ্যে প্রায় চৌদ্দশ বছর যাবৎ সুদৃঢ়ভাবে অব্যাহত ছিল। বর্ণগোত্রভাষা নির্বিশেষে সকল মানুষকে ইসলাম ঐক্যবদ্ধ করেছিল। এ বন্ধন ইসলামী রাষ্ট্রের শক্তি ছিল। ক্রুসেডে মুসলিমদের পরাজিত করতে ব্যর্থ হয়ে ব্রিটেন ও ফ্রান্স জাতীয়তাবাদের বিষাক্ত মতবাদ দ্বারা মুসলিমদেরকে পৃথক করার দিকে নজর দেয়। উসমানীয় খিলাফতের সময় পশ্চিমা মিশনারীরা মুসলিমদের বিভক্ত করার জন্য বিভিন্ন ধরনের পদক্ষেপ গ্রহণ করে প্রথমে ব্যর্থ হলেও পরবর্তীতে তারা আরব ও তুর্কি জাতীয়তাবাদের ভিত্তিতে বিভিন্ন সংগঠন প্রতিষ্ঠা করে। ১৮৫৭ সালে মিশনারীরা সিরিয়ান বিজ্ঞান সংঘ এবং ১৮৭৫ সালে বৈরুতে গুপ্তসংঘ প্রতিষ্ঠা করতে সফল হয়। এসব সংগঠন আরব জাতীয়তাবাদকে ধারণ করে প্রাক-ইসলামী সংস্কৃতিকে মেনে নিতে উসমানীয় খিলাফতকে চাপ দেয় এবং তুর্কিদেরকে আরবদের কাছ থেকে খিলাফতকে চুরি করার অভিযোগে অভিযুক্ত করে। এভাবে মুসলিম উম্মাহ্’র মধ্যে আরব জাতীয়তাবাদের প্রচলন করা হয়। বিংশ শতাব্দীর শুরুতে জাতীয়তাবাদের জ্বর ইসলামী রাষ্ট্রের প্রতিটি কোণে ছড়িয়ে পড়ে। যখন উপনিবেশবাদীরা ইসলামী রাষ্ট্রের বিভিন্ন অংশ জাতিরাষ্ট্রের ভিত্তিতে দখল করে নিল তখন রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক শোষণের প্রতিক্রিয়া হিসেবে মুসলিমদের ভিতরে দেশপ্রেমের জন্ম দেয়া হয়। এ সময় ইসলামী রাষ্ট্র ধ্বংস হয়ে যাওয়ার কারণে মুসলিমদের মধ্যে আক্বীদাগত বন্ধন নষ্ট হয়ে যায়এবং তারা বর্ণগোত্র ও ভৌগলিক অবস্থানের ভিতরে আবদ্ধ হয়ে পড়ে।

খিলাফত রাষ্ট্র ধ্বংস হওয়ার পরে মুসলিম উম্মাহ্’র মধ্যে কাফিরদের দ্বারা প্রোথিত জাতীয়তাবাদের বিষাক্ত বীজ সময়ের পরিক্রমায় বিষবৃক্ষে পরিনত হয়। আমরা বিভিন্ন সময়ে দেখেছি যে ভিন্ন ভিন্ন অঞ্চলে বসবাসরত মুসলিমদের মধ্যে জাতিগতগোত্রীয় বা বর্ণগত উত্তেজনা সৃষ্টি হচ্ছে। বর্তমান পুঁজিবাদী শাসকেরা নিজেদের নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখার জন্য জাতীয়তাবাদের সবক দেয় এবং তারা মুসলিমদেরকে জাতিগোত্রবর্ণ ওভৌগলিক অবস্থানের মধ্যে আবদ্ধ করে রাখতে কিছু উপাদান ব্যবহার করেযেমন: পশ্চিমা পরাশক্তিদের দালাল শাসকদের স্বার্থের দ্বন্দ্বে কিংবাখেলাধূলায় মুসলিম দেশগুলো যখন একে অপরের প্রতিপক্ষ হয় তখন এক মুসলিম অন্য মুসলিমের বিরুদ্ধে বিভিন্ন ধরনের মন্তব্যের মাধ্যমে পরষ্পরের বিরুদ্ধে বিষোদগার করেতখন তাদের পরিচয় হয়ে দাঁড়ায় সৌদি মুসলিম বা ইরানি মুসলিম বা ইয়েমেনি মুসলিমবাংলাদেশি মুসলিম বা পাকিস্তানি মুসলিমমিশরীয় মুসলিম বা নাইজেরিয়ান মুসলিম। আর এই ভিন্ন ভিন্ন জাতি পরিচয়ের অজুহাতে সৌদি আরবমিশরতুরস্কইরান সক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও ফিলিস্তিনের মুসলিমদেরকে রক্ষার জন্য ইসরাইল অভিমুখে তাদের শক্তিশালী সামরিক বাহিনীকে মার্চ করার নির্দেশদেয় নাপাকিস্তান ও আফগানিস্তানের সেনাবাহিনী কাশ্মিরীদেরকে ভারতীয় মুশরিকদের কবল থেকে উদ্ধারের জন্য ব্যারাক থেকে বের হয় নাবাংলাদেশমালয়েশিয়া বা ইন্দোনেশিয়ার সেনাবাহিনী মায়ানমারের রোহিঙ্গা মুসলিমদের সাহায্যে এগিয়ে আসে না!! কারন কিএগুলো হচ্ছে এসব দেশের আভ্যন্তরীণ সমস্যা এবং কৃত্রিমভাবে সৃষ্ট জাতি-রাষ্ট্রের সীমানার পবিত্রতা যেকোন মূল্যে অক্ষুন্ন রাখতে হবেনাউজুবিল্লাহ্।

আসুনএখন আমরা আলোচনা করে দেখি যে ইসলাম কিভাবে জাতীয়তাবাদ কিংবা বর্ণবাদের মতো বৈষম্য সৃষ্টিকারী চিন্তার মূলোৎপাটন করবে?

আল্লাহ্ রাব্বুল আলামিন জাতীয়তাবাদগোত্রবাদবর্ণবাদের মতো কুফর ধ্যান-ধারনার পরিবর্তে ইসলামের সুমহান আদর্শের প্রতি আনুগত্যের নির্দেশ দিয়েছেন। আল্লাহ্ (সুবহানাহু ওয়া তা‘আলা) মুসলিমদের মধ্যে বন্ধন হিসেবে ইসলামী আক্বীদাকে ভিত্তি হিসেবে নেয়ার তাগিদ দিয়েছেনতিনি (সুবহানাহু ওয়া তা‘আলা) বলেন: “হে যারা ঈমান এনেছ! তোমরা অন্তরঙ্গরূপে গ্রহণ করবে না তোমাদের পিতা ও তোমাদের ভাইদেরযদি তারা কুফরীকে প্রিয় মনে করে ঈমানের তুলনায়” (সূরা আত-তাওবা: ২৩)। মদিনায় নব প্রতিষ্ঠিত ইসলামী রাষ্ট্রে এক অমুসলিম যুবক কবিতা আবৃত্তির মাধ্যমে আওস ও খাজরাজ গোত্রকে বু‘আছ অভিযানের কথা স্মরণ করিয়ে দেয় তাদের মধ্যে পুরনো আবেগকে জাগিয়ে তোলে। ফলশ্রুতিতে সেখানে অস্ত্রের ঝনঝনানি শুরু হয়ে গেল। যখন রাসূল (সা)-এর কাছে এই সংবাদ পৌঁছাল তখন তিনি (সা) ছুটে এসে পরিস্থিতি অবলোকন করে বললেন: “হে মুসলিমগণ! আল্লাহকে স্মরণ করো,আল্লাহ্কে স্মরণ করো। আল্লাহ্ যখন তোমাদেরকে ইসলামে এনেছেনএর দ্বারা সম্মানিত করেছেনপৌত্তলিকতা থেকে দূরে সরিয়েছেনতখন আমি তোমাদের সাথে উপস্থিত থাকা অবস্থায় তোমরা কি ওদের মতো কাজ করবেইসলাম তো তোমাদের একে অপরকে বন্ধু বানিয়েছে”। আওস ও খাজরাজ গোত্র এ কথা শুনে কেঁদে ফেলল এবং একে-অপরকে মুসলিম ভাই হিসেবে জড়িয়ে ধরল। আল্লাহ্ (সুবহানাহু ওয়া তা‘আলা) বলেন: “আর স্মরণ কর আল্লাহ্’র সেই অনুগ্রহ যা তোমাদের উপর করা হয়েছেতোমরা ছিলে পরস্পর শত্রুআল্লাহ্ তোমাদের হৃদয়ে মহব্বত সৃষ্টি করেছেনফলে তাঁর অনুগ্রহে তোমরা পরস্পর ভাই-ভাই হয়ে গেলে। তোমরা ছিলে এক অগ্নিকুন্ডের কিনারেআল্লাহ্ তা থেকে তোমাদের রক্ষা করুন” (সূরা আল ইমরান: ১০৩)। তাই মুসলিমদের মধ্যে সম্পর্ক তৈরি হয়েছিল ইসলামী আক্বীদার উপর ভিত্তি করে। পারিবারিক পটভূমি বা বর্ণগোত্র নির্বিশেষে সবার প্রতি একই আচরণ করা হয়েছিল। যে কেউ  শাহাদাঘোষণা করেছে সে স্পষ্টতই মুসলিম উম্মাহ্’র অংশ হয়ে গেছে। রাসূলুলাহ্ (সা:) আসাবিয়াহ্ তথা জাতীয়তাবাদকে নিষিদ্ধ করেছেনতিনি বলেছেন: “সে আমার উম্মত নয় যে জাতীয়তাবাদের কথা বলেজাতীয়তাবাদের পক্ষে লড়াই করেবা এর জন্য মৃত্যুবরণ করে” (আবু দাউদ)।

ভাইয়েরা আমার! পশ্চিমা দেশসমূহে শ্বেতাঙ্গরা স্লোগান দেয়: “হোয়াইট ইজ রাইটকিল দা ব্ল্যাক বাস্টার্ডস”। তাদের স্লোগানেই তাদের মনোভাব প্রকাশ পায়। আজ থেকে ৪২ বছর আগে লন্ডনে খুন হন বাংলাদেশি যুবক আলতাব আলীযাকে গণমাধ্যম বলা হয়েছে “বাংলাদেশের জর্জ”আর এই আলতাব আলীর মৃত্যুবার্ষিকীতে বাংলাদেশিরা স্লোগান দিয়েছে: “সাদাকালো জোট বাঁধোবর্ণ ঘৃণা নির্মূল করো”। অথচবর্ণ ঘৃণা নির্মূলতো হয়ইনি বরং দিনকে দিন বৃদ্ধি পাচ্ছেভারতের পুলিশও আমেরিকার পুলিশের  মত হাঁটু দিয়ে চেপে ধরে মুসলিমদেরক নির্যাতন করছে। এই অবস্থার পরিবর্তন ততক্ষন পর্যন্ত আমরা দেখব নাযতক্ষণ না আমরা রাসূলুল্লাহ্ (সা) ইসলামী রাষ্ট্রব্যবস্থার যে মডেল দিয়ে গেছেন সেই ব্যবস্থায়ফেরত যেতে পারি। সেই ব্যবস্থায় হাবশী কৃষ্ণাঙ্গ বেলাল (রা) ইসলামের প্রথম মুয়াজ্জিন হওয়ার গৌরব অর্জন করেছেন। হিজরী অষ্টম সনেঅর্থাৎ ৬৩০ খ্রিস্টাব্দে যখন মক্কা বিজয় হয়তখন রাসুল (সা:) কুরাইশদের পরাজিত করে মক্কা নগরীতে শাসক হিসেবে প্রবেশ করে প্রবিত্র কাবা ঘরের  দরজার সামনে দাঁড়িয়ে তিনি (সা) প্রথমে জানতে চাইলেন – বেলাল কোথায়বেলালকে আমার কাছে নিয়ে আসো। কাবা’রদরজার সন্মুখে দাঁড়িয়ে তিনি (সা:) যখন বেলাল (রা:)-এর জন্য অপেক্ষা করছিলেন তিনি (সা:) বললেন, “আল্লাহ্র কসমআমি আজও সেই দিনগুলো স্মরণ করি যখন তারা এই কাবা’র সামনে বেলালকে নির্যাতন করত”। বেলাল (রা:) হাজির হলেন। রাসুল (সাঃ) তাকে বললেন, “বেলাল ভিতরে প্রবেশ কর। আজ একমাত্র তুমি আমার সাথে কাবা’র ভিতরে নামাজে শরীক হবে”। নামাজ শেষে রাসুল (সা) বেলাল (রা) বললেন, “কাবা’র উপর উঠে দাঁড়াও”। বেলাল (রা) চেষ্টা করে ব্যর্থ হলেন উচ্চ কাবা ঘরের উপড় উঠে দাঁড়াতে। নবীজি (সা) দেখলেন আশেপাশে কে আছে তাকে সাহায্য করার জন্য। আর তিনি (সা) পেয়ে গেলেন হযরত আবু বকর (রা) ও হযরত ওমর (রা)-কে। নবীজির নির্দেশে তারাদুজনই বেলাল (রাঃ) কে সাহায্য করতে এগিয়ে এলেন। হযরত বেলাল (রা) তার ডান পা হযরত ওমর (রা) এবং তার বাম পা হযরত আবু বকর (রাঃ) এর কাঁধে রেখে প্রবিত্র কাবা ঘরের উপড়ে উঠে দাঁড়ালেন। রাসুল (সা) বললেন, “ও বেলালআল্লাহর কসম তিনি ছাড়া আর কোন মাবুদ নাই। আল্লাহ্’র সুবহানাহু ওয়া তা’আলার কাছে এই কাবা ঘরের মর্যাদা সুমহান আর তোমার সম্মান তার কাছে আজ এর চেয়ে অধিক মর্যাদাপূর্ণ।” বেলাল (রা) তখন কাবা ঘরের উপর থেকে আযানের মাধ্যমে উপস্থিত ১০ হাজার বীর যোদ্ধাদেরকে তাওহীদের মহান বাণী শোনালেনযাদের মধ্যে আরব ও কুরাইশদের সন্মানিত নেতাগণ ছিলেন এবং ইসলামের মহান সাহাবাগনও (রা) ছিলেন। ইসলাম এভাবে একজন সামান্য ক্রীতদাসকেও সম্মানিত করেছিল।

এই প্রেক্ষিতে আরেকটি ঘটনা আপনাদের সামনে আমি তুলে ধরতে চাইমুসলিম বাহিনী ৬৪১ খ্রিস্টাব্দে ব্যাবিলন দুর্গ (আজকে যেটি কপটিক কায়রো নামে পরিচিত অঞ্চল) অবরোধ করেছিলযেখানে মিশরীয় শাসক আল-মুকাওকিসকে আটক করা হয়েছিল। জেনারেল আমর ইবনে আল-আস (রা) আল-মুকাওকিসের সাথে কথা বলার জন্য উবাদাহ বিন আস-সামিত (রা)-এর নেতৃত্বে দশ জন ব্যক্তির একটি প্রতিনিধি দল পাঠিয়েছিলেন। উবাদাহ বিন আস-সামিত (রা) কালো ছিলেন এবং প্রতিনিধি দলটি যখন নৌকায় করে আল-মুকাওকিসের উদ্দেশ্যে যাত্রার পরে তার জায়গায় প্রবেশ করলতখন উবাদাহ (রা) সামনের দিকে এগিয়ে গেলেন এবং আল-মুকাওকিস তার কৃষ্ণ বর্ণের কারণে আতঙ্কিত হয়ে পড়েন। তিনি বলেছিলেন, “এই কালো মানুষটিকে আমার কাছ থেকে দূরে নিয়ে যান এবং অন্য কেউ এসে আমার সাথে কথা বলুন”! বাকিরাবললেন: “এই কৃষ্ণাঙ্গ ব্যক্তি জ্ঞান ও প্রজ্ঞায় আমাদের মধ্যে সেরা। তিনি আমাদের নেতা এবং আমাদের মধ্যে সর্বোত্তমএবং তাকে আমাদের উপরে নিযুক্ত করা হয়েছে। আমরা সকলেই তার মতামতের গুরুত্ব দেই এবং আমাদের নেতা তাকে আমাদের উপরে নিযুক্ত করেছেন এবং তাঁর বিরুদ্ধে না যাওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন”। আল-মুকাওকিস প্রতিনিধিদলকে বলেছিলেন: “আপনারা কিভাবে এই কালো মানুষটিকে আপনাদের মধ্যেসেরা হিসেবে গ্রহণ করতে পারেনবরং সে আপনাদের মধ্যে সবচেয়ে কম মর্যাদাসম্পন্ন হওয়া উচিত”। তারা বলল: “নাযদিও আপনি দেখতে পাচ্ছেন যে তিনি কালোতথাপি তিনি আমাদের মধ্যে মর্যাদার দিক থেকে সেরাআমাদের মধ্যে অন্যতম এবং বুদ্ধিমান। কালো বর্ণ আমাদের মধ্যে খারাপ কিছু নয়”। আল-মুকাওকিস তখন উবাদাহ বিন আস-সামিত (রা)-কে বললেন: “হে কালো মানুষএগিয়ে আসুন এবং আমার সাথে মৃদুভাষায় কথা বলুনকারণ আপনার কালো বর্ণ আমাকে শঙ্কিত করেএবং আপনি কড়া কথা বললে তা আমাকে আরও শঙ্কিত করবে। উবাদাহ বিন আস-সামিত (রা) এগিয়ে গিয়ে বললেন: “আপনি যা বলেছেন তা আমি শুনেছি। আমার যে সঙ্গীদের আমি রেখে এসেছি তাদের মধ্যে এমন এক হাজার পুরুষ রয়েছেন যারা সকলেই আমার মতো কালোএমনকি আমার চেয়েও কালো এবং দেখতে আরও ভয়ানক। আপনি যদি তাদেরকেদেখেন তবে আপনি আরও শঙ্কিত হয়ে পড়বেন। আমার যৌবন চলে গেছেতবুও আমি ভয় করব না যদি আমার শত্রুদের মধ্য হতে একশতলোক একসাথে আমার মুখোমুখি হতে চায়এবং আমার সহচরদের ক্ষেত্রেও এটি সত্যকারণ আমাদের আশা ও আমাদের আকাঙ্খা হচ্ছে কেবল আল্লাহ্’র জন্যতাঁর সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য জিহাদে সংগ্রাম করা”।

ইসলামী জীবন ব্যবস্থার সাথে পশ্চিমা জীবন ব্যবস্থার কি অসাধারণ বৈপরীত্য! ইসলাম মানব জাতিকে মুক্ত করেছে মানুষের গায়ের রংমুখের ভাষাজন্মের স্থানের ভিত্তিতে মূল্যায়ন করার মত অসুস্থতা থেকে। ইসলাম শিখিয়েছে কিভাবে মানুষের মন থেকে বর্ণবাদকে উপড়ে ফেলে সাম্যের ও ভ্রাতৃত্বের বন্ধনে পরস্পরকে আবদ্ধ করতে হয়। অন্যদিকে পশিমা জীবনাদর্শ শ্বেতবর্ণের খ্রিস্টান ও শ্বেতবর্ণের নাস্তিক ব্যতীত সকলেই দ্বিতীয়শ্রেণির নাগরিক বা অর্ধ-মানব বলে গণ্য করে। তার বহিঃপ্রকাশ কেবলমাত্র তাদের শোষণমূলক পররাষ্ট্রনীতিতেই নয়বরং আজ তাদের নিজেদের ভূমিতেও পরিলক্ষিত হচ্ছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে জর্জ ফ্লয়েড নামক একজন কৃষ্ণাঙ্গের হত্যা থেকে উদ্ভূত আমেরিকাসহ পশিমা বিশ্বে চলমান বর্ণবাদ বিরোধী বিক্ষোভ ও দাঙ্গার মধ্য দিয়ে মৃতপ্রায় পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় ন্যায়বিচার কতটুক পাওয়া যাবে তা নিয়ে সংশয় আছে। তবে এটা নিশ্চিত করে বলা যায় যেযতক্ষণ না এই পশ্চিমা অপব্যবস্থার অপসরণ হবে এবং ইসলামী আদর্শের ভিত্তিতে মানুষ তাদের দৃষ্টিভঙ্গি ও মূল্যবোধকে শুধরেনেবেবর্ণবাদকে নির্মূল করা সম্ভব হবে না। মানব জাতি আজ বর্ণবাদ ও জাতীয়তাবাদের যে ভয়াল সমস্যার সন্মুখিন তার সমাধান নিহিত রয়েছে রাসুল (সা)-এর দেখানো ইসলামী রাষ্ট্রব্যবস্থায়। একমাত্র খিলাফত রাষ্ট্রই পারে সমাজে ইসলামী জীবন ব্যবস্থা বাস্তবায়ন করে বর্ণবাদের বিষবৃক্ষকে সমূলে উপড়ে ফেলতে।

ভাইয়েরাচলুন আমরা এমন এক আদর্শিক শাসন ব্যবস্থার দিকে ফিরে যাই যেখানে জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সবাই শান্তিতে বসবাস করবে। বিনা কারণে জর্জদের প্রাণ দিতে হবে নাযত্ন নেয়া হবে বেলালদেরঅমুসলিমরা হবে খিলাফত রাষ্ট্রের সম্মানিত নাগরিক এবং তারা সবসময় নিরাপদ ও মর্যাদাপূর্ণ জীবন যাপন করবেনাগরিক নিরাপত্তা ও সামাজিক সুবিধা লাভের জন্য তাদের সাথে চুক্তি থাকবে। বর্তমান পুঁজিবাদী ব্যবস্থার সংখ্যালঘু নামের কোন অমর্যাদাকর উপলব্ধি তাদের থাকবে নাসকল মুসলিম তাদের সাথে সৎ ও বন্ধুত্বপূর্ণ প্রতিবেশীসুলভ আচরণ করতে বাধ্যথাকবে। কারণআল্লাহ্’র রাসূল (সা) বলেছেন: “যে ব্যক্তি চুক্তিবদ্ধ অমুসলিমের ক্ষতি করল সে যেন আমাকে ক্ষতিগ্রস্থ করল” (আবু দাউদ)। খিলাফতের ইতিহাসে এধরনের অনেক অবিস্মরণীয় ঘটনা ঘটেছেযার মধ্য থেকে দু’টি উদাহরণ আমি বিশেষভাবে উল্লেখ করতে চাই। একটি হচ্ছে সপ্তম শতাব্দীর ঘটনা: একজন ইহুদি নাগরিক খলিফা আলী (রাঃ)-এর তলোয়ারের ঢাল চুরি করলে বিষয়টি বিচারালয়ে উত্থাপিত হয়। তখন কাজীঅর্থাৎ বিচারক তার পক্ষে সাক্ষী উপস্থিত করতে বললে তিনি তার পুত্রকে সাক্ষী হিসেবে হাজির করেন। বিচারক মামলাটি এই বলে খারিজ করে দেয় যে কোন পিতার পক্ষে পুত্রের সাক্ষী গ্রহণযোগ্য নয়। ন্যায় বিচারের এই চমৎকারিত্ব দেখে ওই ইহুদি দারুণভাবে অভিভূত হইয়া চুরির কথা স্বীকার করে নিজেই মুসলিম হয়ে যান। আরেকটি ঘটনা হচ্ছে: ১৫ শতাব্দীতে ইহুদিদেরকে যখন স্পেন থেকে বের করে দেওয়া হয় তখন ওই ইহুদীরা আশ্রয়স্থল খুঁজে পায় ইসলামী খিলাফতের ছায়াতলে। নাগরিক হিসেবে তারা স্বাস্থ্যসেবামেটাল ওয়ার্কিং ইত্যাদি খাতে সরকারকে প্রচুর সহযোগিতা করেছিল। তাদের ছিল অসামান্য মেধাকর্মদক্ষতা ও বিদেশী জ্ঞানতাদের এই অবদানের স্বীকৃতি দিয়ে তদানীন্তন উসমানী সুলতান দ্বিতীয় বায়েজিদ একটি বিখ্যাত উক্তি করেছিলেন: “তোমরা কি করে স্প্যানিশ রাজা ফার্দিনান্দকে বুদ্ধিমান বলযে নিজের নাগরিকদেরবের করে দিয়ে নিজেকে করেছে গরীবআর আমাকে করেছে ধনী”। পরিশেষে রাসূল (সা)-এর একটি উক্তি স্মরণ করে শেষ করছিতিনি বলেছেন: “কোন অনারবের উপর আরবের মর্যাদা নেইকোন আরবের উপর অনারবের মর্যাদা নেইকৃষ্ণাঙ্গের উপর মর্যাদা নেই সাদারসাদার উপর কৃষ্ণাঙ্গের মর্যাদা নেইমর্যাদা কেবল তাক্বওয়ার ভিত্তিতে নির্ধারিত হয়” (মুসনাদে আহমদ)।

অতএবআসুন আমরা মানবতার সামনে হুমকি হয়ে দাঁড়ানো এই বর্ণবাদ ও জাতীয়তাবাদের আশ্রয়স্থল পুঁজিবাদী জীবনাদর্শ পরিত্যাগ করে ইসলামী আদর্শের বন্ধনে আবদ্ধ হই। যেভাবে রাসুল বলে গেছেন: “একজন হাবশি ক্রীতদাসও যদি তোমাদের শাসক নির্বাচিত হয়যার মাথা কিসমিসের মততবুও তোমরা তাকে মান্য করবে”। আলহামদুলিল্লাহি রাব্বিল আলামিন।

Print Friendly, PDF & Email

Leave a Reply