সরকার পুঁজিবাদী রাষ্ট্রসমূহের অনুকরণে “ভাইরাস অথবা ক্ষুধা”-এর মধ্যে যেকোন একটিকে বেছে নিতে জনগণকে বাধ্য করছে
একমাত্র খিলাফত রাষ্ট্র অর্থনীতি ও জনজীবনকে সচল রেখে মহামারী সংকট মোকাবেলা করতে সক্ষম
হে দেশবাসী, আমরা এমন একটি সময়ে মহিমান্বিত রমযান মাস প্রত্যক্ষ করছি, যখন আমরা ঈমানের দিকে সবচেয়ে শক্তিশালী অবস্থানে আছি এবং অনিশ্চয়তা ও উদ্বেগের দিক থেকেও চরম অবস্থানে আছি। মহিমান্বিত এই মাস সম্পর্কে আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা বলেন, “রমযান হচ্ছে সেই মাস যে মাসে কুর’আন নাযিল হয়েছে, মানবজাতির হিদায়াত ও পথনির্দেশ এবং সত্য-মিথ্যার পার্থক্যকারী হিসেবে।” [সূরা আল-বাক্বারাহ্ : ১৮৫]। এবং এই কুর’আন সম্পর্কে আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা বলেন, “নিশ্চয়ই আমি আপনার প্রতি সত্য কিতাব অবতীর্ণ করেছি, যাতে আপনি মানুষের মধ্যে শাসন করেন, যা আল্লাহ্ আপনাকে হৃদয়ঙ্গম করান। আপনি বিশ্বাসঘাতকদের পক্ষ থেকে বিতর্ককারী হবেন না।” [সূরা আন-নিসা : ১০৫]। আমরা প্রত্যক্ষ করছি, কিভাবে আল্লাহদ্রোহী ধর্মনিরপেক্ষ পুঁজিবাদী আদর্শের অনুসারী পশ্চিমা রাষ্ট্রসমূহ ও তাদের অনুসারী সরকারগুলো করোনাভাইরাসের বিস্তার ঠেকাতে শুধু ব্যর্থই হয়নি, বরং পৃথিবীর শত শত কোটি মানুষকে নজিরবিহীনভাবে গৃহবন্দি করে অর্থনীতি ও জনজীবনকে অচল করে দিয়েছে, এবং এই সংকটকে আরও ঘনীভূত করেছে। কুফর ধর্মনিরপেক্ষ আদর্শের অন্ধ অনুসারী এই সরকার আল্লাহ্ প্রদত্ত বিধান বাদ দিয়ে, করোনাভাইরাস (কোভিড-১৯) সংকট মোকাবেলার ক্ষেত্রেও পশ্চিমা পুঁজিবাদী রাষ্ট্রসমূহের নীতি অনুসরণ করেছে, যার ফলে বর্তমানে বাংলাদেশও করোনা সংকটে বিপর্যস্ত, এবং লকডাউনে ক্ষুধায় মৃত্যুবরণ অথবা ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ এই দুই বিকল্প ছাড়া এই সরকার আপনাদের সামনে কোন সমাধান অবশিষ্ট রাখে নাই। তাই, এই সঙ্কট থেকে আশু মুক্তির লক্ষ্যে, এই সংকটের মূল কারণ এই পুঁজিবাদী ব্যবস্থা এবং এই সংকট থেকে উত্তরণে আল্লাহ্ প্রদত্ত বিধান অর্থাৎ ইসলামী আদর্শের ভিত্তিতে সমাধান উপস্থাপন করছি। আমরা যদি ঈমানের ভিত্তিতে সঠিক পদক্ষেপ নিতে পারি তবে এই রমযান হবে আমাদের জন্য এক যুগান্তকারী পরিবর্তনের মাস, ইনশা’আল্লাহ্।
প্রথমত, এই ধর্মনিরপেক্ষ পুঁজিবাদী শাসকগোষ্ঠী বাণিজ্যিক, সংকীর্ণ রাজনৈতিক ও কৌশলগত স্বার্থকে নিজ দেশের জনগণের উপর প্রাধান্য দিয়েছে, তাই চীন যেমন ভাইরাসটির প্রাণঘাতি চরিত্র নিয়ে তথ্য গোপন করেছে, ঠিক তেমনি পুঁজিবাদী ইউরোপ, আমেরিকাও ভাইরাসটির বিস্তার রোধে চরম উদাসীনতা দেখিয়েছে। ফলে ভাইরাসটি তার উৎপত্তিস্থল চীনের উহান থেকে সমস্ত চীনে এবং আন্তর্জাতিক পর্যায়ে ছড়িয়ে পড়ে। বাংলাদেশের স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের একাধিক সতর্ক বার্তা সত্ত্বেও সরকার শুধুমাত্র তার মুজিববর্ষ উৎযাপন এবং চীন ও পশ্চিমা দেশসমূহের সাথে বাণিজ্যিক ও কূটনৈতিক সম্পর্ক নির্বিঘ্ন রাখতে বাংলাদেশে করোনাভাইরাস সনাক্তের বিষয়টি গোপন রাখে, এমনকি তা নিশ্চিত করতে গ্রেফতার ও ভয়-ভীতির পথ অবলম্বন করে। সরকার বিদেশ থেকে আগতদের মাধ্যমে সংক্রমণ ঠেকাতেও কোন কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করেনি।
দ্বিতীয়ত, যখন এই ধর্মনিরপেক্ষ শাসকগোষ্ঠী ও তাদের সহযোগী পুঁজিপতিশ্রেণী প্রত্যক্ষ করল ভাইরাসটি ধনী-গরীব পার্থক্য করে না, রাষ্ট্রপ্রধান, শীর্ষনেতৃবৃন্দ, ব্যবসায়ী, প্রভাবশালীরা আক্রান্ত হচ্ছে, এবং এতে প্রতিষেধকহীন অবস্থায় মৃত্যুবরণ করতে হয়। এই প্রেক্ষাপটে তারা অমানবিক লকডাউন কার্যকর করে, জনগণকে বলির পাঠা বানায়। সরকারও এর ব্যতিক্রম থাকেনি, গত ৮ মার্চ সরকারের পক্ষ থেকে প্রথম করোনা রোগী সনাক্তের ঘোষণার পর ২৩ মার্চ (২৬ মার্চ থেকে ৪ এপ্রিল পর্যন্ত) ছুটি ঘোষণার মাধ্যমে পরিকল্পিতভাবে লক্ষ লক্ষ মানুষকে শহর থেকে বের হয়ে যাওয়ার সুযোগ করে দেয়, যার ফলে সমস্ত দেশে সংক্রমণটি ছড়িয়ে পড়ে, এবং ভিআইপি হসপিটালের মাধ্যমে নিজেদের স্বাস্থ্য সুরক্ষা নিশ্চিত করে। দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে এখন এই ভাইরাসজনিত যেসব মৃত্যুর ঘটনা ঘটছে সেগুলো আড়াল করতে সরকারের হুমকি-ধামকির কারণে সংবাদ সংস্থাগুলি এসব মৃত্যুর নতুন নাম দিয়েছে “জ্বর-কাশিতে মৃত্যু”!
তৃতীয়ত, চাকুরীহীন মুহুর্তের মধ্যে বিশ্বের শত শত কোটি মানুষ কর্মহীন, চাকুরীহীন, ব্যবসাহীন হয়ে পড়ে। তখন বর্তমান সরকার পুঁজিপতিগোষ্ঠীর বিশ্বস্ত অভিভাবক হিসেবে আবির্ভূত হয়ে দুর্যোগকালীন অর্থনীতি পুনরুদ্ধারের নামে ৯৫ হাজার ৬১৯ কোটি টাকার (১১.২ বিলিয়ন ডলার যা জিডিপি’র প্রায় ৩.৩ শতাংশ) ‘বেইলআউট’ প্যাকেজ ঘোষণা করে। পুঁজিপতি ও বৃহৎ কর্পোরেশনগুলো যারা ইতিপূর্বে ব্যাংকের অর্থ লুট করেছে, তাদেরকে স্বল্প সুদে এই ঋণ সুবিধা প্রদান, যা কেবলই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, বা ই.ইউ-এর নীতিসমূহের অন্ধ অনুকরণ, অর্থাৎ সাধারণ মানুষকে দুর্দশার মধ্যে নিপতিত রেখে প্রথমেই পুঁজিপতিদের স্বার্থ ও মুনাফাকে সুরক্ষিত করা। এখন আবার সেই পুঁজিপতিদের ব্যবসার চাকা সচল রাখতে সরকার পোষাক কারখানাগুলো খুলে দিয়ে লক্ষ লক্ষ গার্মেন্টস শ্রমিকদেরকেই জ্বালানী হিসেবে ব্যবহার করতে যাচ্ছে।
চতুর্থত, লকডাউন কার্যকর করতে সরকার পক্ষ থেকে জনগণকে হুমকি দেয়া হচ্ছে, “ঘরে থাকবেন, না কবরে যাবেন এটা আপনার সিদ্ধান্ত, কিন্তু জনগণ দেখছে ঘরে থাকলে তাকে ক্ষুদার জ্বালায় মরতে হবে, কারণ তথাকথিত সরকারী ত্রাণ, লুটেরাদের ঘরেই ঢুকছে, তখন কাজ ও অন্নের খোঁজে নিরুপায় ও বাধ্য হয়ে বের হওয়া এই জনগণকেই ভাইরাসের সংক্রমণ ছড়ানোর জন্য দায়ী করা হচ্ছে, বলা হচ্ছে, জনগণ অকারণে রাস্তায় বের হচ্ছে, সামাজিক দূরত্ব মানছে না, ইত্যাদি।
সর্বোপরী, এই করোনাভাইরাস আমাদেরকে চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়েছে পশ্চিমা পুঁজিবাদী রাষ্ট্রসমূহ ও তাদের অনুসারী সরকারগুলো কতই না ভঙ্গুর! পশ্চিমারা এবং তাদের দালাল শাসকেরা তাদের অর্থনীতি ও সেবাখাতের দুর্বলতাকে করোনার দোহাই দিয়ে আড়াল করতে চাইছে। অথচ, প্রকৃতপক্ষে পুঁজিবাদের কৃত্রিম অর্থনীতি, যা পুঁজিবাজার, ইন্সুরেন্স, সুদ, ফটকাবাজারি, কালোবাজারি, ইত্যাদির উপর প্রতিষ্ঠিত, তা বিরাট কৃত্রিম অর্থনৈতিক বেলুন তৈরি করেছে। এই কাল্পনিক অর্থনীতিটি মাকড়শার জালের চেয়েও দুর্বল, করোনার মত একটি রোগ সমস্ত পুঁজিবাদী বিশ্বকে কাঁপিয়ে দিয়েছে, এর পতনের সূচনা করেছে। তাদের তথাকথিত উন্নয়ন চিন্তা আজ প্রশ্নবিদ্ধ, যেখানে জনগণের অন্যতম মৌলিক অধিকার চিকিৎসা সেবাকে গুরুত্ব দেয়ার চেয়ে বিশাল আকারের জিডিপি, তথাকথিত উন্নয়ন প্রকল্পকে গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীদের জন্য পিপিই, মাস্কের মত সামান্য সুরক্ষা সরঞ্জাম কিংবা রোগীদের জন্য পর্যাপ্ত আইসিইউ-ভেন্টিলেটর স্থাপন তাদের উন্নয়ন চিন্তায় স্থান পায়নি। ১৯২টি আইসিইউ বেড নিয়ে সমস্ত বাংলাদেশে কোভিড-১৯ মোকাবেলা করা হচ্ছে। [ঢাকা ট্রিবিউন, ২০ এপ্রিল, ২০২০]। ইউরোপ ও আমেরিকাতে স্বাস্থ্যকর্মীরা সুরক্ষা সরঞ্জামের অভাবে আন্দোলন করছে, সেখানে পর্যাপ্ত ভেন্টিলেটর ও আইসিইউ সাপোর্টের অভাবে ব্যাপক প্রাণহানী ঘটছে।
বিশ্বব্যাপী পুঁজিবাদের উপর মানুষ আস্থা হারিয়ে ফেলছে, মানুষ প্রশ্ন করছে পুঁজিবাদ আদৌ কি মানব সভ্যতার কল্যাণে সক্ষম, এমনকি পুঁজিবাদী রাষ্ট্রসমূহের জনগণেরও আস্থায় ফাটল ধরেছে, তারা প্রত্যক্ষ করছে, এই ব্যবস্থা তাদেরকে না ভাইরাস থেকে রক্ষা করতে পেরেছে, না খাদ্যের অভাব থেকে। তা সত্ত্বেও আল্লাহ্’র প্রতি অবাধ্য হাসিনা ও অন্যান্য মুসলিম শাসকেরা, সংকট কাটাতে ইসলামের সুস্পষ্ট দিক-নির্দেশনা বাদ দিয়ে অন্ধের মত সেই পুঁজিবাদী নীতিরই অনুসরণ করে লকডাউনের মাধ্যমে কোটি কোটি মানুষকে সীমাহীন ক্ষুধা, দারিদ্রতা ও চরম অনিশ্চয়তার মধ্যে নিক্ষেপ করেছে।
হে মুসলিমগণ! দিক-নির্দেশনা ক্ষুধা, দারিদ্রতা নিরসনে খিলাফত রাষ্ট্রের সুনির্দিষ্ট দিক নির্দেশনা রয়েছে এবং খলীফা সেসব নির্দেশনা পালনে বাধ্য। এটি কোন কর্পোরেট রাষ্ট্র নয় যে, এটি শুধুমাত্র ক্ষুদ্র পুঁজিপতিগোষ্ঠী ও কর্পোরেটদের স্বার্থ রক্ষা করবে, বরং এই খোদাভীরু রাষ্ট্র হচ্ছে মানবতার জন্য রাষ্ট্র, যা শুধু তার নাগরিকদেরই নয় বরং সমগ্র মানবজাতির জন্য রহমতপূর্ণ রাষ্ট্র। রাসূলুল্লাহ্ (সা:) বলেছেন: “নিশ্চয়ই খলীফা হচ্ছেন অভিভাবক এবং তিনি তার নাগরিকদের জন্য দায়িত্বশীল।” [বুখারী/মুসলিম]। খিলাফত রাষ্ট্র মানুষের ক্ষুধা কিংবা খাদ্যাভাবকে বর্তমান পুঁজিবাদী রাষ্ট্রের মত মিথ্যা প্রতিশ্রুতি, ধনীদের অনুদান অথবা ত্রাণের উপর ছেড়ে দেয় না, বরং খিলাফত রাষ্ট্র একেবারে ব্যক্তিপর্যায়ে ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে রাষ্ট্রের নাগরিকদের মৌলিক চাহিদা পূরণকে নিশ্চিত করতে তার শক্তি ও সম্পদকে ব্যবহার করে, যাতে সর্বাবস্থায় রাষ্ট্রের নাগরিকদের স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত হয় এবং খাদ্যাভাব দূর হয়। খিলাফতের বাস্তব অর্থনীতি পণ্যের উৎপাদন ও তার সেবা মানুষের নিকট পৌঁছে দেয়াকে কেন্দ্র করে পরিচালিত, এবং তা নিশ্চিত করার সরবরাহ লাইন হচ্ছে কারখানা, শ্রমিক, ক্ষুদ্রব্যবসা, স্বাস্থ্যখাত, অফিস ও প্রতিষ্ঠানসমূহ – কোন দুর্যোগে তা ভেঙ্গে পড়ে না। জাতীয় আয়ের অধিকাংশ অর্থ ঋণনির্ভর উন্নয়ন প্রকল্পের সুদ প্রদানে ব্যয় না হওয়ায়, স্বাভাবিক কিংবা সংকটকালীন উভয় অবস্থায় এই আয় রাষ্ট্রের নাগরিকদের প্রতি দায়িত্ব পালনে ব্যবহৃত হয়। প্রকৃতপক্ষে ইসলাম “রোগ কিংবা ক্ষুধা” দু’টির মধ্যে একটিকে বেছে নাও – জনগণকে এই পরিস্থিতির মুখোমুখি করে না, বরং খিলাফত রাষ্ট্র রোগ এবং ক্ষুধা দুটোকেই নির্মূল করে। রাসূলুল্লাহ্ (সা:) বলেছেন: “যে ব্যক্তি এমন অবস্থায় দিন শুরু করল যে তার পরিবার নিরাপদ ও সুস্থ; এবং তার নিকট দিন যাপনের প্রয়োজনীয় খাদ্য উপকরণ বিদ্যমান, সে যেন সমস্ত পৃথিবীকে তার হাতে পেল।”
হে মুসলিমগণ! পশ্চিমের ধর্মনিরপেক্ষ শাসকগোষ্ঠীর এই চরম ব্যর্থতার প্রেক্ষাপটে আমরা দেশের জনগণের উদ্দেশ্যে মহামারী মোকাবেলায় ইসলাম নির্দেশিত কতিপয় গুরুত্বপূর্ণ নীতি তুলে ধরছি:
সংক্রমিত রোগ ও মহামারীর মোকাবিলার ক্ষেত্রে আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা প্রদত্ত বিধান অনুযায়ী সঠিক পদক্ষেপ হচ্ছে: খিলাফত রাষ্ট্র শুরু থেকেই রোগটিকে পর্যবেক্ষণের মধ্যে রাখবে এবং রোগটিকে তার উৎপত্তিস্থলেই অবরূদ্ধ রাখতে সর্বোচ্চ প্রচেষ্টা ব্যয় করবে, এবং অন্য অঞ্চলের বাকি সুস্থ জনগণ কাজ ও উৎপাদন কর্মকান্ড অব্যাহত রাখবে। এই লক্ষ্য বাস্তবায়নে:
প্রথমত, খিলাফত রাষ্ট্র সংক্রমিত রোগটিকে তার উৎপত্তিস্থলেই আবদ্ধ রাখতে রাষ্ট্রীয়ভাবে পদক্ষেপ নিবে। ইমাম বুখারী কর্তৃক উসামা বিন যায়িদ হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ্ (সা:) বলেছেন: “তোমরা যদি কোন জায়গায় প্লেগের প্রাদুর্ভাব সম্পর্কে অবহিত হও, সেখানে গমন করো না; যদি এমন অঞ্চলে প্লেগের প্রাদুর্ভাব হয় যেখানে তুমি অবস্থান করছ, তবে সেখান থেকে পালিয়ে যেওনা।” অন্য আরেকটি বর্ণনায় মুসলিম শরীফে বর্ণিত আছে, রাসূলুল্লাহ্ (সা:) বলেছেন: “প্লেগ হচ্ছে একটি মহাবিপর্যয় যা বনী ইসরাইলদের উপর আপতিত হয়েছে, অথবা তোমাদের পূর্ববর্তীদের উপর প্রেরণ করা হয়েছে। যদি তোমরা কোন এলাকায় এর উপস্থিতি সম্পর্কে জানতে পাও, তবে সেখানে যেও না, এবং যদি এটি তোমাদের বসবাসরত এলাকায় হানা দেয়, তবে উক্ত স্থান ত্যাগ করো না, এটি হতে পালিয়ে যেও না।” চীন শুরুতে উহানকে কোয়ারেন্টাইন করেনি এবং ভাইরাস সম্পর্কে অবগত হওয়ার পরও ৪,৩০,০০০ জন চীন থেকে যুক্তরাষ্ট্রে ভ্রমন করেছে, যার মধ্যে উহান থেকে ভ্রমনকারীও রয়েছে। হাসিনা সরকারও মহামারীর কেন্দ্রবিন্দু উহানসহ আক্রান্ত ইউরোপের বিভিন্ন দেশের সাথে বিমান যোগাযোগ চালু রাখে।
দ্বিতীয়ত, সংক্রমিত রোগের ক্ষেত্রে ইসলামের নির্দেশনা হচ্ছে “তোমরা অসুস্থদের সুস্থদের সাথে রেখো না।” [বুখারী]। তাই অসুস্থদেরকে চিহ্নিত করে পৃথক করা হবে এবং বিনা খরচে তাদের চিকিৎসার ব্যবস্থা করা হবে। সংক্রমণের উপসর্গধারণকারীরা যাতে স্বেচ্ছায় কোয়ারেন্টাইনে থাকেন এজন্য তাদেরকে কুর’আন-সুন্নাহ্ দ্বারা উৎসাহিত করা হবে। অসুস্থদের সেবাদানকারী এবং চিকিৎসকদের জন্য সুরক্ষা সরঞ্জামের ব্যবস্থা করাতে হবে যাতে সংক্রমণটি কমিউনিটি পর্যায়ে না ছড়ায়। যার অভাবে বর্তমানে আমরা প্রত্যক্ষ করছি বাংলাদেশে মোট সংক্রমণের ১১ ভাগই চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মী। অন্যদিকে, সুস্থ ব্যক্তিগণ তাদের অর্থনৈতিক কর্মকান্ড ও সামাজিক জীবন অব্যাহত রাখবে। ফলে মহামারী সাধারণ মানুষের জীবনকে স্থবির ও অর্থনীতিকে পঙ্গু করে তুলবে না।
তৃতীয়ত, কোয়ারান্টাইনের ক্ষেত্রে ইসলামে নীতি পুঁজিবাদী নীতির বিপরীত, অর্থাৎ ইসলাম রোগকে কোয়ারান্টাইন করার উপর গুরুত্ব দেয়, মানুষকে কোয়ারান্টাইন করে না। ব্যাপক সেনিটাইজেশন ও জীবানুনাশক কার্যক্রম পরিচালনা করাসহ মাস্ক ও সুরক্ষা সরঞ্জাম পর্যাপ্ত সরবরাহ নিশ্চিত করা হবে, এবং এগুলো ব্যবহারে জনগণকে উদ্বুদ্ধ করা হবে। তাছাড়া সংক্রমণের নীরব বাহকদের মাধ্যমে যাতে রোগটি বিশাল জনগোষ্ঠীর মধ্যে ছড়িয়ে না পড়তে পারে, সে ব্যাপারেও ইসলামের সুস্পষ্ট দিকনির্দেশনা রয়েছে। যেহেতু নীরব বাহকরা সম্ভাব্য ক্ষতির কারণ, এবং রাসূলুল্লাহ্ (সা:) বলেছেন: “তোমরা ক্ষতি করো না, কিংবা ক্ষতির শিকারও হয়ো না।” [ইবনে মাজাহ্]। রাষ্ট্র ব্যাপক জনগোষ্ঠীকে টেস্টের আওতায় এনে দ্রুত সময়ের মধ্যে নীরব বাহকদের চিহ্নিত করবে।
চতুর্থত, খিলাফত রাষ্ট্রের সংবিধান অনুযায়ী স্বাস্থ্য সুরক্ষা নিশ্চিত করা খলীফা’র উপর দায়িত্ব। খিলাফত রাষ্ট্রকে অবশ্যই গবেষণা প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলতে হবে, যাতে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধির বিভিন্ন উপায় যেমন, পুষ্টি, ব্যায়াম কিংবা ঔষধ, হারবাল ও ভিটামিন সাপ্লিমেন্ট ইত্যাদি নিয়ে গবেষণা করা যায়। তাছাড়া মহামারী সংক্রান্ত রোগের ক্ষেত্রে, জনগণের মধ্যে সংক্রমিত হবার পর প্রাকৃতিকভাবে তৈরি হওয়া এন্টিবডির মাধ্যমে সুস্থ হয়ে উঠার ক্ষমতা, যা হ্যার্ড ইমিউনিটি (herd immunity) নামে পরিচিত, এর সম্ভাব্যতা যাচাইয়ে গবেষণা চালাবে। পাশাপাশি ভ্যাক্সিনের নিরাপত্তা ও কার্যকারীতা নিয়েও গবেষণা চালাবে। স্বাস্থ্যখাতকে কোনভাবে বর্তমান শাসকগোষ্ঠীর মত কাফির সাম্রাজ্যবাদীদের উপর নির্ভরশীল করা অথবা পুঁজিবাদী কোম্পানীর মুনাফা অর্জনের হাতিয়ার বানানো সম্পূর্ণ শারী’আহ্ পরিপন্থী।
পঞ্চমত, সাবধানতা মানে দায়িত্বহীনতা নয়, বর্তমান শাসকগোষ্ঠী সাবধানতার নামে দায়িত্বহীনতার শিক্ষা দিচ্ছে, লাশ দাফনে বাধা দেয়া, অসুস্থদের সাহায্যে এগিয়ে না আসা, ইত্যাদি যার কিছু বহিঃপ্রকাশ। খিলাফত রাষ্ট্র নিশ্চিত করবে যাতে জনগণ যথাযথ স্বাস্থ্যবিধি মেনে অসুস্থদের পাশে দাঁড়ায়, বিশেষ করে যাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা দুর্বল, যেমন, বয়স্ক ব্যক্তি কিংবা আগে থেকেই এ্যাজমা, ডায়বেটিকস, ফুসফুসের রোগে আক্রান্ত, তাদের যাতে বিশেষ যত্ন নেয়া হয়। রাষ্ট্র জনগণকে বার বার স্মরণ করাবে, সংক্রমিত রোগকে নয়, বরং আল্লাহ্’কে ভয় পেতে হবে, হায়াত-মউত-রিযিক শুধুমাত্র আল্লাহ্’র হাতে। আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা বলেন, “আপনি বলুন, আমাদের কাছে কিছুই পৌঁছবে না, কিন্তু যা আল্লাহ্ আমাদের জন্য পূর্বনির্ধারিত করেছেন; তিনি আমাদের কার্যনির্বাহক। আল্লাহ্’র উপরই মু’মিনদের ভরসা করা উচিত।” [সূরা আত-তওবা: ৫১]
সর্বোপরী, ইসলাম শুধুমাত্র মহামারীকালীন শারিরিক এবং আর্থিক ক্ষতিকেই কমিয়ে আনেনা, এর পাশাপাশি এই ধরনের মহামারীতে মৃত্যুকে মুসলিমরা কিভাবে দেখবে সে বিষয়ে দিকনির্দেশনা প্রদান করে। বুখারী কর্তৃক আয়েশা (রা) থেকে বর্ণিত, তিনি রাসূলুল্লাহ (সা)-কে প্লেগ সম্পর্কে জিজ্ঞেস করেন, এবং রাসূলুল্লাহ (সা:) তাকে (রা) বলেন, বলেন, যার উপর আল্লাহ্ ইচ্ছা করেন, কিন্তু আল্লাহ্ ঈমানদারদের জন্য এটিকে রহমত বানিয়েছেন, প্রত্যেক আল্লাহ্’র বান্দা, যিনি প্লেগের সম্মুখীন হয়েছেন কিন্তু ধৈর্য্যধারণ করে নির্দিষ্ট স্থানে অবস্থান করেছেন এটা জেনে যে, আল্লাহ্ কর্তৃক তার জন্য নির্ধারিত কিছু ছাড়া তার উপর অন্যকোন বিপদ আপতিত হবে না, তার জন্য শহীদের ন্যায় পুরস্কার রয়েছে।” সুতরাং, মুসলিমরা পশ্চিমা কাফিরদের ন্যায় ভয়ে এবং আতঙ্কে হতবিহ্বল না হয়ে বালা-মুসিবতে ধৈর্য্যধারণ করবে, আল্লাহ্’র পক্ষ থেকে পুরস্কারের আশা করবে, এবং আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা’র সাহায্য পেতে অব্যাহতভাবে দু’আ করবে যাতে তিনি এই বিপদ থেকে তাদেরকে উদ্ধার করেন।
এভাবে ইসলাম নিশ্চিত করে যাতে মহামারীটি সীমিত পরিসরে থাকে এবং বিস্তার লাভ করে সমগ্র দেশে না ছড়ায়, এবং পূর্ণ লকডাউনের মতো পরিস্থিতির উদ্ভব না হয়, যেমনটি আমরা আমেরিকাসহ বিভিন্ন পুঁজিবাদী রাষ্ট্রে প্রত্যক্ষ করছি। মুসলিমরা ইতিহাসে বহুবার একই রকম পরিস্থিতি অতিক্রম করেছে, হিজরী ৬ষ্ঠ শতকের মাঝামাঝি মুসলিমরা “আল-শাকফা” দ্বারা আক্রান্ত হয়, যা একধরনের ব্যাকটেরিয়া জনিত চামড়ার সংক্রমণ। মুসলিমরা ৮ম শতকের মাঝামাঝি পরীক্ষার সম্মুখীন হয়, যা দামেস্কের প্রলয়ংকারী প্লেগ নামে পরিচিত, কিন্তু এগুলোর কোন ক্ষেত্রেই মসজিদ, জুম্মা, তারাবী কিংবা জামাতে নামায বন্ধ করা হয়নি। এবং জনগণকেও তাদের গৃহের মধ্যে বন্দি করে রাখা হয়নি, কিন্তু অসুস্থদের আলাদা রাখা হয়েছে, এবং সুস্থরা মানব সভ্যতা বিনির্মাণে কাজ চালিয়ে গেছেন। তারা ইবাদতের উদ্দেশ্যে মসজিদে গিয়েছেন এবং অসুস্থদের সঠিক সেবা ও চিকিৎসা প্রদানের পাশাপাশি এই রোগের কবল থেকে মুক্তির জন্য মহান আল্লাহ্’র দরবারে ফরিয়াদ করেছেন।
হে মুসলিমগণ, এই সংক্রমণব্যাধি করোনা আপনাদেরকে অন্য যেকোন সময়ের তুলনায় আল্লাহ্’র দিকে ধাবিত করেছে। পশ্চিমা শাসকগোষ্ঠী ও তাদের অনুসারীরা আল্লাহ্’র পক্ষ থেকে প্রদত্ত এই বালা-মুসিবতকে বিভিন্ন ষড়যন্ত্র তত্ত্বের আবরণ দিতে চাইছে, যাতে আপনারা আল্লাহ্’র নৈকট্য অর্জন থেকে দূরে থাকেন, সুতরাং তাদের দ্বারা প্রতারিত হবেন না। যখন পুঁজিবাদী রাষ্ট্রসমূহ আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা’র এক অতিক্ষুদ্র সৃষ্টির নিকট বিপর্যস্ত, অথচ তা প্রত্যক্ষ করেও হাসিনার এই ধর্মনিরপেক্ষ শাসকেরা মানবজাতির তত্ত্বাবধানের জন্য অযোগ্য সেই কুফর পুঁজিবাদী আদর্শের দিকেই ছুটছে, ইঞ্চি-ইঞ্চি পদচিহ্নে সেটি অনুসরণ করছে, সেখানেই সমাধান ও প্রতিষেধক খুঁজছে। আবু সা’ঈদ (রা.) হতে বর্ণিত: তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ্ (সা:) বলেছেন: “তোমরা অবশ্যই তোমাদের পূর্ববর্তীদের পন্থা পুরোপুরি অনুসরণ করবে, প্রতি বিঘতে বিঘতে এবং প্রতি গজে গজে। এমনকি তারা যদি গো-সাপের গর্তেও ঢুকে, তবে তোমরাও তাতে ঢুকবে।” আমরা জিজ্ঞেস করলাম, “হে আল্লাহ্’র রাসূল! আপনি কি ইহুদী এবং খৃষ্টানদের কথা বলছেন?” তিনি (সা:) বললেন, “তবে আর কার কথা?” [বুখারী/মুসলিম]। এই ধর্মনিরপেক্ষ শাসকদের প্রতি আর কোন আশা বাকি নাই। প্রকৃতপক্ষে স্রষ্টাহীন এই পুঁজিবাদী আদর্শের অনুসারীরা বর্তমান এই সংকটসহ পৃথিবীব্যাপী ফিতনা-ফ্যাসাদ তৈরির জন্য দায়ী। আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা বলেন: “স্থলে ও জলে যে বিপর্যয় ছড়িয়ে পড়েছে তা মানুষের কৃতকর্মের ফল। আল্লাহ্ তাদেরকে তাদের কিছু কর্মের শাস্তি আস্বাদন করাতে চান, যাতে তারা (সঠিক পথে) ফিরে আসে।” [সূরা রূম : ৪১]। সুতরাং, মহিমান্বিত এই রমযান মাসে, কুর’আন নাযিলের এই মাসে, আসুন আমরা এই শপথ নিই যে, আমরা এই ধর্মনিরপেক্ষ পুঁজিবাদী শাসকগোষ্ঠীকে অপসারণের রাজনৈতিক সংগ্রামে অংশগ্রহণ করবো, আমরা বুঝে কিংবা না বুঝে, কিংবা ভয়ে কোন অবস্থাতেই এই ধর্মনিরপেক্ষ পুঁজিবাদী শাসনব্যবস্থা ও শাসকগোষ্ঠীকে অনুসরণ ও সমর্থন করবো না, এবং আল্লাহ্’র দ্বীনের পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন তথা খিলাফতে রাশিদাহ্ পুনঃপ্রতিষ্ঠার কাজে সর্বশক্তি দিয়ে আত্মনিয়োগ করবো, আল্লাহ্ প্রদত্ত যে রহমতপূর্ণ শাসনব্যবস্থাকে আমরা ৯৯ হিজরী বছর পূর্বে ২৮শে রজব ১৩৪২ হিজরীতে পৃথিবী থেকে হারিয়ে ফেলেছি।
রাসূলুল্লাহ্ (সা:) বলেছেন: “সুলতান (খলীফা) হচ্ছে জমিনে (পৃথিবীতে) আল্লাহ্’র ছায়া (রহমত)।” [দারাকুতনি]
রবিবার, ৩ রমযান, ১৪৪১ হিজরী
২৬ এপ্রিল, ২০২০ খ্রিষ্টাব্দ