মুত্তাকীন

হে ঈমানদারগণ! তোমাদের উপর রোজা ফরয করা হয়েছে, যেরূপ ফরজ করা হয়েছিল তোমাদের পূর্ববর্তী লোকদের উপর, যেন তোমরা পরহেযগারী অর্জন করতে পার।” [আল-বাক্বারাহ্: ১৮৩]

নিশ্চয়ই প্রত্যেক মুসলিমের লক্ষ্য হওয়া উচিত মুত্তাকী হওয়া, কারণ মুত্তাকীগণ হচ্ছেন সেসব ব্যক্তি যাদেরকে আল্লাহ্ (সুবহানাহু ওয়া তা’আলা) ভালবাসেন এবং যাদেরকে তিনি (সুবহানাহু ওয়া তা’আলা) সহায়তা, করুণা, ক্ষমা, বিশাল পুরস্কার এবং জান্নাতের পাশাপাশি ক্ষয়-ক্ষতি থেকে রক্ষা ও উত্তম কাজে সাহায্য করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন।

আল্লাহ্ (সুবহানাহু ওয়া তা’আলা) বলেন:

কিন্তু হ্যাঁ, যে কেউ তার অঙ্গীকার পালন করে এবং আল্লাহ্কে ভয় করে – নিশ্চয়ই তখন, আল্লাহ্ তাদেরকে ভালোবাসেন যারা মুত্তাকী।” [আল-ইমরান: ৭৬]

একদা উমর ইবনে আল খাত্তাব (রা) উবাই ইবনে কাব (রা)-কে জিজ্ঞেস করলেন: “আপনি তাক্বওয়াকে কিভাবে বর্ণনা করবেন?” উবাই (রা) বললেন: “আপনি কি কখনো দীর্ঘ, ঢোলা ও মাটিতে লুটানো বস্ত্র পরিধান করে একটি কণ্টকাকীর্ণ পথের মধ্য দিয়ে হেঁটে গেছেন?” উমর (রা) উত্তরে বললেন: ‘হ্যাঁ’। উবাই (রা) তখন জিজ্ঞেস করলেন: “সে সময়ে আপনি কি করেছিলেন?” উমর(রা) বললেন: “আমি আমার চারপাশে আঁটসাট করে পোশাকটিকে পেঁচিয়ে নিয়েছিলাম যাতে সেটা কাঁটার সাথে লেগে না যায়, কিংবা কাঁটার আঘাতে ছিন্নভিন্ন না হয়, এবং এরপর আমি সতর্কভাবে আমার রাস্তা খুঁজে নিয়েছিলাম”। উবাই (রা) বললেন: ‘এটাই তাক্বওয়া’।

আলী (রা) রাতের অন্ধকারে তার দাঁড়ি আঁকড়ে ধরতেন এবং বলতেন: “হে পঙ্কিল দুনিয়া! তুমি কি আমাকে মোহাবিষ্ট করতে চাও? যাও এবং অন্য কাউকে মোহাচ্ছন্ন করার চেষ্টা করো। আমি তোমার মালিক হওয়ার ইচ্ছা রাখি না এবং তোমাকে পেতে চাই না। আমি তোমাকে তিনবার তালাক দিয়েছি, যা প্রত্যাহারের অযোগ্য। তুমি আমাকে যে আনন্দময় জীবনের হাতছানি দাও তা খুবই স্বল্পসময়ের”।

ইবনে উমর কর্তৃক বর্ণিত আছে যে: আমি রাসূলুল্লাহ্ (সা)-কে বলতে শুনেছি: “বনী ইসরাইলের কিফাল তার খারাপ কাজের পাপকে ভয় করত না। একদিন একজন মহিলা আসে এবং কিফাল তার সাথে যৌন সম্পর্ক স্থাপনের জন্য ৬০ দিনার প্রদান করে। যখন সে মহিলাটির দিকে অগ্রসর হয় তখন সে কাঁপতে থাকে এবং কাঁদতে শুরু করে। তখন কিফাল জিজ্ঞেস করে: তুমি কাঁদছো কেন? সে উত্তরে বলে: এটা এমন কিছু যা আমি আগে কখনো করিনি। এটি শুধুমাত্র আমার প্রয়োজন যা আমাকে একাজ করতে বাধ্য করছে। কিফাল বলল: তুমি এরকম করছ কারণ তুমি আল্লাহকে ভয় করো! অতএব আল্লাহকে আমার আরও অধিক ভয় করা উচিত। টাকাটা নাও এবং যাও, আল্লাহ্’র কসম আমি আর কখনো আল্লাহকে অমান্য করবো না। সে রাতে কিফাল মারা যায় এবং তার দরজায় লিখিত পাওয়া যায় যে: ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ্ কিফালকে ক্ষমা করেছেন’, আর লোকেরা এটা জেনে অবাক হয়ে যায়”। আত-তিরমিজি এই হাদীসটিকে বর্ণনা করেছেন এবং হাসান হিসেবে শ্রেণীভুক্ত করেছেন। আল-হাকিম এটাকে সহীহ্ হিসেবে শ্রেণীভূক্ত করেছেন এবং আয-যাহাবী এতে সম্মতি প্রদান করেছেন। ইবনে হিব্বান তার সাহীহ্ এবং আল-বাইহাকী তার শু‘আব গ্রন্থে হাদীসটি উদ্ধৃত করেছেন। আল্লাহ্ (সুবহানাহু ওয়া তা’আলা) বলেন:

ওহে যারা ঈমান এনেছ! আল্লাহ্’কে ভয় করো, আর প্রত্যেকেই ভেবে দেখুক কী সে প্রেরণ করছে আগামীকালের জন্য – এবং আল্লাহ্’কে ভয় করো। নিঃসন্দেহ তোমরা যা করছ আল্লাহ্ সে-সন্বন্ধে পূর্ণ-ওয়াকিবহাল।” [আল-হাশর: ১৮]

আল-হাসান আল-বসরী বলেছেন: “তাক্বওয়াবান ব্যক্তি (আল-মুত্তাকিন) হলেন তারাই যারা আল্লাহ্ যা নিষেধ করেছেন তা থেকে বিরত থাকে এবং যা আদেশ করেছেন তার উপর আমল করে”।

খলিফা ওমর ইবনে আবদুল আজিজ বলেন: “তাক্বওয়া মানে কেবল দিনে রোজা রাখা এবং রাতে ইবাদত করা নয়, কিংবা এ দু’য়ের মধ্যে সংমিশ্রন করা নয়, বরং তাক্বওয়া হলো আল্লাহ্ যা হারাম করেছেন তা পরিত্যাগ করা এবং যা ফরজ করেছেন তা আদায় করা। একজন ব্যক্তি এই কাজ করলে আল্লাহ্ তাকে উত্তম প্রতিফল দান করবেন”।

অতএব, মুত্তাকীন হলেন সেসব ব্যক্তি যারা সকল কাজ ও জীবনের সকল ক্ষেত্রে – আধ্যাত্মিক, নৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক – আল্লাহ্কে মান্য করে। সুতরাং:

– তাক্বওয়াবান ব্যক্তি কেবল নামাজ পড়ে ও রোজাই রাখে না, বরং স্ত্রী বা স্বামী, সন্তান, পিতা-মাতা এবং আত্মীয়দের প্রতি সদয় আচরণ করে এবং ইসলামের আঙ্গিকে তাদের প্রত্যেকের অধিকার আদায় করে।

– তিনি তাক্বওয়াবান ব্যক্তি নন যিনি কেবল কি’য়ামে দাঁড়ান, কুর‘আন তেলাওয়াত করেন, জিকির ও নফল নামাজ আদায় করেন, বরং যিনি এগুলোর পাশাপাশি ইসলামের মূল্যবোধ ও বিপরীত লিঙ্গের সাথে তাদের পারস্পরিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে ইসলামী সামাজিক বিধানসমূহ মেনে চলেন তিনিই তাক্বওয়াবান।

যার তাক্বওয়া রয়েছে সে কেবল সাদাকাই দেয় না, বরং ইসলামের হুকুম অনুযায়ী সে তার ব্যবসা-বাণিজ্য ও আর্থিক লেনদেনসমূহ পরিচালনা করে, রিবা বা সুদ থেকে দূরে থাকে এবং ইসলামী অর্থনৈতিক চুক্তি ও আইন মেনে চলে।

তাক্বওয়াবান ব্যক্তি কেবল তাদেরকেই জবাবদিহি করে না যারা নামাজ পড়ে না, রোজা রাখে না বা পর্দা করে না, বরং তারা মুসলিম শাসকদেরকে জবাবদিহি করার বাধ্যবাধকতা পূরণের জন্য সোচ্চার হয় এবং তাদের দুর্নীতির বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ায়।

এবং, তাক্বওয়াবান ব্যক্তি সিরিয়া, ফিলিস্তিন, মায়ানমার এবং অন্যত্র আমাদের উম্মাহ’র বিরুদ্ধে পরিচালিত গণহত্যার বিরুদ্ধে নীরব থেকে কেবল জায়নামাজে বা মসজিদে অবস্থান করে না, বরং এধরনের নৃশংসতার বিরুদ্ধে কথা বলে এবং অত্যাচারের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ায়।

মুসলিমদের জন্য সাহাবাগণ (রা) হচ্ছেন অনুসরণীয় ব্যক্তিবর্গ, কারণ তাদের উপর আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়া তা‘আলা সন্তুষ্ট এবং তারা মুত্তাকীদের অন্তর্ভুক্ত।

যখন রাসুলুল্লাহ্ (সা) ইয়েমেনে নতুন মুসলিমদের শিক্ষা দেয়ার জন্য শিক্ষক খুঁজছিলেন তখন তিনি মু‘য়াজ ইবনে জাবাল (রা)-কে তাদের আমির নিযুক্ত করেন এবং তাকে এই প্রশ্নসমূহ জিজ্ঞাসা করেন: “তুমি কিভাবে রায় দেবে বা কোন বিবাদের নিষ্পত্তি করবে?” উত্তরে মু‘য়াজ বলেন,“আমি আল্লাহ্’র কিতাব দিয়ে তাদের শাসন করবো।” তারপর তিনি (সা) বলেন, “যদি এ ব্যাপারে সেখানে কিছু না পাও তবে কি করবে?” তখন মু‘য়াজ বলেন, “তাহলে আমি রাসূলের সুন্নাহ্’র মধ্যে তা খুঁজবো।” এটা শুনে রাসূল (সা) তাকে বলেন, “যদি সেখানেও না পাও তবে কি করবে?” উত্তরে মু‘য়াজ বলেন, “তাহলে আমার জ্ঞান অনুযায়ী বিচারিক যুক্তি (ইজতিহাদ) অনুযায়ী রায় দিব।” একথা শুনে আল্লাহ্’র রাসূল (সা) অত্যন্ত খুশি হন এবং বলেন, “প্রশংসা সেই আল্লাহ্’র যিনি তাঁর রাসূলের বার্তাবাহককে এমন জ্ঞান দিয়েছেন যা আল্লাহ্ ও তাঁর রাসূল ভালবাসেন।”

সুতরাং, সাহাবীদের (রা) মতো মুত্তাকী হওয়ার জন্য আমাদেরকেও আল্লাহ্ (আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা)-কে ভয় করতে হবে, জীবনের সকল ক্ষেত্রে হারাম এবং হালালকে অনুসরণ করতে হবে এবং আমাদের মধ্যকার বিবদমান বিষয়সমূহ ইসলামী শারী‘আহ্ অনুসারে ফয়সালা করতে হবে। আল্লাহ্ (সুবহানাহু ওয়া তা‘আলা) বলেন:

নিশ্চয়ই! যারা তাদের পালনকর্তাকে না দেখে ভয় করে, তাদের জন্যে রয়েছে ক্ষমা ও মহাপুরস্কার।” [আল-মূলক: ১২]

Leave a Reply