রমযান: পরিপূর্ণভাবে ইসলামে প্রবেশ করে সর্বোত্তম চরিত্রের অধিকারী হোন

রহমতের মাস রমযান শুরু হয়েছে, যে মাসে জান্নাতের দরজাসমূহ খুলে দেয়া হয়, জাহান্নামের দরজা বন্ধ থাকে এবং শয়তানকে শৃঙ্খলিত করা হয়। আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা মুসলিমদের জন্য রমযান মাসকে করুণা ও ইবাদতের মাস হিসেবে নির্ধারিত করে অন্যান্য মাসের উপরে এটিকে প্রাধান্য দিয়েছেন। আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা-এর পক্ষ থেকে এটা আমাদের জন্য একটি বিশেষ রহমত যে তিনি আমাদেরকে এই রমযানে জীবিত থাকার সুযোগ দিয়েছেন। যেহেতু এই মাসে আল্লাহ্’র সন্তুষ্টি অর্জনের উদ্দেশ্যে ভালো কাজ করার প্রতি আমাদের আগ্রহ বেশি থাকে এবং আমাদের অন্তর ইবাদতের প্রতি অধিক মনোনিবেশ করে, সেহেতু আসুন আমরা নিজেদেরকে প্রশ্ন করি যে, পরিপূর্ণভাবে ইসলামে প্রবেশের মাধ্যমে আল্লাহ্’র নৈকট্য লাভের জন্য আমরা কতটা সচেষ্ট হয়েছি, যা আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা আমাদের জন্য ফরয করেছেন। তিনি (সুবহানাহু ওয়া তা‘আলা) বলেন:

يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا ادْخُلُوا فِي السِّلْمِ كَافَّةً وَلَا تَتَّبِعُوا خُطُوَاتِ الشَّيْطَانِ إِنَّهُ لَكُمْ عَدُوٌّ مُّبِينٌ

“হে ঈমানদারগণ! তোমরা পরিপূর্ণভাবে ইসলামে প্রবেশ কর এবং শয়তানের পদাঙ্ক অনুসরণ করো না। নিশ্চিতরূপে সে তোমাদের প্রকাশ্য শত্রু।” [সূরা আল-বাক্বারা: ২০৮]

আমরা জানি যে, মহিমান্বিত এই মাসে কুর’আন নাযিল করা হয়েছে, যেখানে আমাদের জীবনের প্রতিটি দিকের জন্য নির্দেশনা বিদ্যমান – আধ্যাত্মিকতা, নৈতিকতা, পোশাক-পরিচ্ছদ, নারী-পুরুষের সম্পর্কের ধরণ, পারিবারিক জীবন, বিয়ে, আর্থিক বিষয়াদি, অপরাধ-অভিযোগের ফয়সালা, রাষ্ট্রে শাসনকার্য পরিচালনা, শাস্তি প্রদান এবং অন্য রাষ্ট্রের সাথে সম্পর্কের ধরণসহ সমস্ত বিষয়ে – এবং, এই কুর’আন ব্যক্তি, উম্মাহ্ এবং মানবতার জন্য একটি সুস্পষ্ট পথনির্দেশ – যাতে আমরা এটাকে প্রতিটি ফয়সালায়, পছন্দ-অপছন্দে, সিদ্ধান্তে, আইনে, এবং প্রতিটি কাজে কোনরূপ ব্যতিক্রম ছাড়া সত্য ও মিথ্যার মধ্যে পার্থক্য নিরূপণের মাপকাঠি হিসেবে ব্যবহার করতে পারি। কারণ, আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়া তা‘আলা বলেন:

شَهۡرُ رَمَضَانَ الَّذِىۡٓ اُنۡزِلَ فِيۡهِ الۡقُرۡاٰنُ هُدًى لِّلنَّاسِ وَ بَيِّنٰتٍ مِّنَ الۡهُدٰى وَالۡفُرۡقَانِۚ

“রমযান মাসে কুর‘আন নাযিল করা হয়েছে যা মানুষের জন্য হেদায়াত, সৎপথের স্পষ্ট নিদর্শন, এবং সত্য-মিথ্যার পার্থক্যকারী।” [সূরা আল-বাক্বারা: ১৮৫]

অতএব, এই মাসে যখন আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা শয়তানকে শৃঙ্খলিত করে রেখেছেন, তখন কুর’আনের শিক্ষাগুলিকে আমাদের জীবনে বাস্তবায়নের মাধ্যমে ইসলামের পরিপূর্ণ অনুসরণ আরম্ভ করার এটাই কি আদর্শ সময় নয়? কুর’আনের শিক্ষা কি শুধুমাত্র রমযানের জন্য কিছু ব্যক্তিগত ইবাদতের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখা উচিত, নাকি আমাদের সমাজে শান্তি ও ন্যায়-বিচার প্রতিষ্ঠার জন্য চূড়ান্ত নির্দেশনা হিসেবে ব্যবহার করা উচিত?

এটা প্রশংসনীয় যে, এই মাসে সাওম (রোজা) পালনের বাধ্যবাধকতা সম্পর্কে আমরা অত্যন্ত সচেতন, কিন্তু সমাজে সুদমুক্ত লেনদেন ও ব্যবসা-বাণিজ্য নিশ্চিতের মত অন্যান্য ফরয সম্পর্কে আমাদের অবস্থান কি?

وَاَحَلَّ اللّٰهُ الۡبَيۡعَ وَحَرَّمَ الرِّبٰو

“অথচ আল্লাহ্ ক্রয়-বিক্রয় বৈধ করেছেন এবং সুদকে হারাম করেছেন।” [সূরা আল-বাক্বারা: ২৭৫]

আপনাদেরকে আবার মনে করিয়ে দিতে চাই যে, কুর’আন মানবজাতির জন্য পথ-নির্দেশ এবং আমাদের জীবনের প্রতিটি দিকের জন্য সুস্পষ্ট নির্দেশনা – ব্যক্তিগত ইবাদত থেকে শুরু করে রাষ্ট্রীয় বিষয়াদি পর্যন্ত। এমনকি ইসলাম আমাদের জীবনসঙ্গী নির্বাচিত করার ক্ষেত্রেও দিক-নির্দেশনা প্রদান করে, রাসূলুল্লাহ্ (সা) বলেছেন,

تُنْكَحُ الْمَرْأَةُ لِأَرْبَعٍ : لِمَالِهَا ، وَلِحَسَبِهَا ، وَلِجَمَالِهَا ، وَلِدِينِهَا ، فَاظْفَرْ بِذَاتِ الدِّينِ تَرِبَتْ يَدَاك

“একজন নারীকে চারটি জিনিসের জন্য বিয়ে করা যেতে পারে, তার সম্পদ, তার বংশধর, তার সৌন্দর্য, এবং তার দ্বীন। এমন একজনকে সন্ধান করো যে দ্বীনদার সম্পন্ন, তোমার হাত ধুলোয় ধুসরিত হোক (অর্থাৎ, যাতে তুমি কল্যাণ লাভ করতে পার)”।

আমাদেও দ্বীনদার ও তাক্বওয়াবান পূর্বসূরীরা আন্তরিকতার সাথে আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়া তা‘আলা ও তাঁর রাসূলের (সা) এর আদেশ বাস্তবায়ন করার ক্ষেত্রে উদগ্রীব ছিলেন। খলিফা উমর (রা) একজন দুধ বিক্রেতার মেয়ের তাক্বওয়ার বিষয়ে এতটাই বিমুগ্ধ হয়েছিলেন যে, তিনি তার পুত্র আসিম-এর সাথে সেই মেয়ের বিয়ে দিয়েছিলেন। আসলাম-এর পিতামহ হতে ইবনে যাঈদ বর্ণনা করেছেন যে, তিনি বলেছেন: “যখন মদিনাতে উমর (রা) রাত্রিকালীন পরিভ্রমনে বের হতেন, তখন আমি একবার তার সাথে গিয়েছিলাম, আল্লাহ্ তার উপর সন্তুষ্ট হোন। তিনি ক্লান্ত বোধ করছিলেন, তাই তিনি একটি দেয়ালে হেলান দেন এবং শুনতে পান যে, একজন মহিলা তার মেয়েকে দুধ বিক্রি করার আগে দুধের সাথে পানি মেশাতে বলছে। মেয়েটি তাকে বলছিল যে, মু’মিনদের নেতা উমর এটা নিষেধ করেছেন। কিন্তু, তার মা তাকে এটা বলে জোর করলো যে, সে এমন এক জায়গায় রয়েছে যেখানে উমর ও তার উপ-পরিদর্শক তাকে দেখতে পাবে না। যাহোক, মেয়েটির বলল: আমি আল্লাহ্’র নামে শপথ করছি যে, আমি এমন কাজ করব না যার ফলে তাকে প্রকাশ্যে মান্য করা হবে এবং গোপনে অমান্য করা হবে। এরপর সে বলল: আমার বিবেক আমার খলিফা। তুমি খলিফা ও তার কর্মকর্তাদের হাত থেকে পালাতে পারো, কিন্তু কিভাবে আমরা আল্লাহ্ ও আমাদের বিবেকের হাত থেকে মুক্তি পাবো..?” সেই মেয়ে এবং আসিমের সংসারে একজন কন্যা সন্তানের জন্ম হয় যিনি পরবর্তীতে মহান খলিফা ওমর বিন আব্দুল আজিজের মা হন।

এভাবেই আমাদের তাক্বওয়াবান পূর্বসূরীরা তাদের জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে কুর‘আন ও আল্লাহ্’র শারী’আহ্ বাস্তবায়নের মাধ্যমে উচ্চতর মর্যাদার অধিকারী হয়েছিলেন। বিবাহের ক্ষেত্রে কুর’আনের মানদ-ের ভিত্তিতে আপাতদৃষ্টিতে একটি সহজ-সরল সিদ্ধান্তের ফলে খলিফা ওমর বিন আব্দুল আজিজ-এর মত সন্তানের জন্ম হয়েছে। অতএব, শুধু কল্পনা করুন যে, সমাজের সকল ক্ষেত্রে কুর‘আনের অন্যান্য মানদ-সমূহ বাস্তবায়িত হলে কি ধরনের সমাজ প্রতিষ্ঠা হবে। আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা আরবদের মত পশ্চাদপসরণ জাতিকে সভ্যতার সর্বোচ্চ শিখরে উন্নীত করেছেন, কারণ তারা আল্লাহ্’র কিতাব বাস্তবায়ন করেছিল, অথচ আমরা এখন ক্রমাগত কুর’আনের সামগ্রিকতা থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার কারণে জাতি হিসেবে ক্রমাগত অবনমিত হচ্ছি। রাসূলুল্লাহ্ (সা) বলেছেন:  

إِنَّ اللَّهَ يَرْفَعُ بِهَذَا الْكِتَابِ أَقْوَامًا ، وَيَضَعُ بِهِ آخَرِينَ

“আল্লাহ্ এই গ্রন্থের মাধ্যমে কিছু জাতিকে উন্নত করবেন এবং অন্যদেরকে অধঃপতিত করবেন” [সহীহ্ মুসলিম]।

আমাদের প্রাণপ্রিয় রাসুলের (সা) একটি হাদিস স্মরণ করে আমি আমার এই বক্তব্যটি শেষ করছি:

وَالْقُرْآنُ حُجَّةٌ لَكَ أَوْ عَلَيْكَ

“এবং এই কুর‘আন হয় আপনার পক্ষে প্রমাণ, কিংবা আপনার বিপক্ষে প্রমাণ”। (সহীহ্ মুসলিম)

সুতরাং এই মাসে আমাদের এটাই প্রথম লক্ষ্য হওয়া উচিত যে, কুর‘আনের সাথে আমাদের সম্পর্ককে সত্যিকারভাবে উপলব্ধি করা এবং মুসলিম হিসেবে আমাদের জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে এটাকে মানদ- হিসেবে স্থির করা। সুতরাং এই রমযান মাসে, কিংবা তারপরে এই কিতাবের যে আয়াতসমূহ আমরা তেলাওয়াত করি তা হয় আমাদের স্বপক্ষে প্রমাণ, বা আমাদের বিপক্ষে প্রমাণ- আমরা কি এর মাধ্যমে জীবন পরিচালনা করি, বা এই দুনিয়াতে এটা বাস্তবায়নের জন্য কাজ করি? নাকি আমরা এটাকে অবহেলা করি এবং আমাদের জন্য যা সহজ কেবল তাই পছন্দ করি?

Print Friendly, PDF & Email

Leave a Reply