ভয় (খাউফ)

বেঁচে থাকার প্রবৃত্তির একটি বহিপ্রকাশ হল ভয়। এটি মানুষের স্বভাবজাত। বাহ্যিক প্রণোদনা ছাড়া ভয় প্রকাশ পায় না। এ প্রণোদনাটি হতে পারে বাস্তবিক অথবা ভয়ের সাথে সর্ম্পকযুক্ত কোন চিন্তা। বাস্তবিক প্রণোদনার একটি উদাহরণ হল পাগলা কুকুর এবং চিন্তা বা কল্পনার সাথে বিজড়িত প্রণোদনা হল ভূতের ভয়-যার কোন বাস্তব ভিত্তি নেই।

ভয়ের কারণে অধপতিত ব্যক্তি ও দূর্বল জাতি অপমানিত হয় এবং পিছিয়ে থাকে। যদি কোন ব্যক্তির উপর ভয় প্রাধান্য বিস্তার করে তবে তার জীবনের সুখ থাকে না, তার মানসিক বিকার ঘটে, হিতাহিত জ্ঞান লোপ পায়, স্মৃতিশক্তি ক্ষীণ হয়ে যায়, সে মহৎ গুনাবলী বিবর্জিত হয় এবং ভাল মন্দ সনাক্ত করার যোগ্যতা হারিয়ে ফেলে।

সবচেয়ে নিকৃষ্ট ধরনের ভয় হল চিন্তা বা কল্পনা থেকে উদ্ভুত। এটি দূর্বল মনেই উদয় হয়। শিশুদের মত অবিকশিত মনে এরূপ হতে পারে অথবা বাস্তবতার সাথে সর্ম্পকযুক্ত করার মত যথাযথ তথ্য না থাকায় কোন ব্যক্তির মধ্যে এরকম ভয়ের উদ্রেক হতে পারে । অশিক্ষিত অথবা জীবনযাপনের পদ্ধতির কারণে, বোকা লোকের কম বুদ্ধিমত্তাসম্পন্ন মস্তিষ্ক বা একেবারেই প্রতিবন্ধী হওয়ায় তথ্যের ঘাটতি থাকতে পারে। এ ধরনের লোকের ভয় দূর করার উপায় হল তাদের সাথে ভয়ের বিষয়ে গভীর কোন আলোচনা দেয়া অথবা এ বিষয়ের সাথে সত্যিকারের বাস্তবতাকে তার বোধগম্যতার মধ্যে নিয়ে আসা।

কল্পনার চেয়ে কম নিকৃষ্ট ধরনের ভয় আসে ভুল বিবেচনাবোধ থেকে। একজন মানুষ এমন কোন কিছুকে ভীতিকর ভাবতে পারে যা আসলে তা নয়। সে একটি ঘুমন্ত কুকুরকে সেই পাগলা কুকুর ভাবতে পারে যেরকম একটি পাগলা কুকুর সে আগে দেখেছে। সুতরাং সে রাস্তা পার হতে ভয় পেতে পারে এবং সেটি থেকে পালাতে চেষ্টা করে। এরকম কারও বিষয়টি নিয়ে চিন্তা করা দরকার। হতে পারে এটি একটি পোষা কুকুর এবং এখন ঘুমিয়ে আছে ও লোকটির উপস্থিতি বুঝতে পারছে না। এই ধরনের ভয় বেশি কাজ করে কোন জায়গায় একটি প্রবন্ধ লেখা বা বক্তব্য দেয়ার ক্ষেত্রে অথবা কোন শাসক বা প্রভাবশালী ব্যক্তির সাথে আলোচনা করার ক্ষেত্রে। সঠিক বিবেচাবোধ না থাকায় ক্ষতির ভয় থেকে একজন ব্যক্তি লেখা, আলোচনা ও বক্তব্য দেয়া থেকে বিরত থাকে।

আর এক ধরনের ভয় ক্রিয়া করে যা একটি কাজ করা অথবা না করার পরিণাম সর্ম্পকিত তুলনামূলক চিন্তা থেকে উদ্ভুত হয়। অথচ একাজটি করলেও ক্ষতি হবে এবং না করলেও ক্ষতি হবে। যেমন: একজন জালিম শাসকের জুলুমের ভয় যা কোন ব্যক্তি অথবা উম্মাহ’র ক্ষতিসাধন করতে পারে। এটি একটি সৈন্যের যুদ্ধের ময়দানে মারা যাওয়ার ভয় যা পুরো সৈন্যবাহিনী অথবা সৈন্যবাহিনীর সদস্য হিসেবে একজনের উপর ধ্বংস ও অপমান ডেকে আনতে পারে। আকীদার কারণে জেলে যাওয়ার ভয় তাকে আকীদা থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলে। আকীদা থেকে বিচ্ছিন্নতা জেলে যাওয়ার চেয়েও গর্হিত কাজ। এই ধরনের ভয় উম্মাহ’র জন্য জেলে যাওয়া বা বিনাশ হয়ে যাওয়ার চেয়েও ভয়ানক।

তবে কিছু কিছু ক্ষেত্রে ভয় কেবল উপকারীই নয়, বরং অপরিহার্য। আল্লাহ (সুবহানাহু ওয়া তা’আলা) এবং তার শাস্তিকে ভয় করা বাধ্যতামূলক ও অপরিহার্য এবং এটি সুরক্ষাদানকারী ও নির্দেশনামূলক। সুতরাং অন্তরে আল্লাহ’র ভয়কে জাগ্রত করা, কুফর অথবা গুনাহের কারণে আল্লাহ শাস্তি প্রদানের ক্ষেত্রে কতটা কঠোর তা বর্ণণা করা অপরিহার্য ও অত্যাবশ্যকীয়।

একমাত্র আমাকেই ভয় কর।” [সূরা আল-বাক্বারা: ৪১]

আমি ছাড়া কাউকে ভয় করো না।” [সূরা আল-বাক্বারা: ৪০]

নিশ্চয়ই শয়তান শুধুমাত্র তার বন্ধুগণ হতে তোমাদেরকে ভয় প্রদর্শন করে; কিন্তু যদি তোমরা বিশ্বাসী হও তবে তাদেরকে ভয় করো না এবং আমাকেই ভয় করো।” [সূরা আলি ইমরান: ১৭৫]

অতএব তাদেরকে ভয় করো না বরং আমাকে ভয় করো।” [সূরা আল-মা’য়িদাহ্: ৩]

হে মানব সমাজ! তোমরা তোমাদের পালনকর্তাকে ভয় করো।” [সূরা আন-নিসা: ১]

যারা ঈমানদার, তারা এমন যে, যখন আল্লাহ্’র নাম নেয়া হয় তখন তাদের অন্তর ভীত হয়ে পড়ে।” [সূরা আল-আনফাল: ২]

এবং যারা বজায় রাখে ঐ সম্পর্ক, যা বজায় রাখতে আল্লাহ্ আদেশ দিয়েছেন এবং স্বীয় পালনকর্তাকে ভয় করে এবং কঠোর হিসাবের আশঙ্কা রাখে।” [সূরা রাদ: ২১]

এটা ঐ ব্যক্তি পায়, যে আমার সামনে দন্ডায়মান হওয়াকে এবং আমার আযাবের ওয়াদাকে ভয় করে।” [সূরা ইব্রাহীম: ১৪]

যে ব্যক্তি তার পালনকর্তার সামনে দন্ডায়মান হওয়ার ভয় রাখে, তার জন্যে রয়েছে দু’টি উদ্যান (অর্থাৎ, জান্নাতে)।” [সূরা আর-রহমান: ৪৬]

তোমাদের কি হল, (যে তোমরা আল্লাহ্-কে (তাঁর শাস্তি) ভয় করছো না, এবং) (আল্লাহ্-এর কাছ থেকে) মানমর্যাদা পাওয়ার মোটেই আশা পোষণ করো না?” [সূরা নুহ: ১৩  

এর অর্থ হলো তোমাদের কি হলো যে তোমরা আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা-এর শ্রেষ্ঠত্বকে ভয় করছো না।

সুন্নাহ্-এর দলিলের ক্ষেত্রে বলা যায়, কিছু হাদীসের সরাসরি শব্দ প্রয়োগ (মানতূক) এবং কিছু হাদীসের অন্তর্নিহিত অর্থ (মাফহূম) থেকে আল্লাহ্-কে ভয় করা ফরয হওয়ার বিষয়টি নির্দেশ করে:

আবু হুরায়রা (রা) বর্ণনা করেছেন যে, আমি রাসূলুল্লাহ্ (সা) বলতে শুনেছি: 

“শেষ বিচারের দিন সাত শ্রেণীর লোক আল্লাহ্-এর আরশের নীচে ছায়া পাবে যেদিন তাঁর (সুবহানাহু ওয়া তা’আলা) আরশের ছায়া ছাড়া আর কোন ছায়া থাকবে না। তাঁরা হলেন: একজন ন্যায়বিচারক শাসক, একজন যুবক যে আল্লাহ্-এর ইবাদতের মধ্যে বেড়ে উঠেছে, একজন ব্যক্তি যার হৃদয় মসজিদের সাথে সংযুক্ত, দুইজন ব্যক্তি যারা কেবলমাত্র আল্লাহ্-এর ওয়াস্তে একে অপরকে ভালবাসে-যারা একত্রিত হয় একমাত্র আল্লাহ্-এর কারণে এবং পরস্পর বিচ্ছিন্নও হয় একমাত্র আল্লাহ্-এর কারণে, যাকে কোন অভিজাত পরিবারের সুন্দরী রমণী অবৈধ যৌন সম্পর্কের জন্য আহ্বান জানায় এবং তখন সে বলে, ‘আমি আল্লাহ্-কে ভয় পাই’, একজন লোক যে গোপনে এমনভাবে দান করে যে, সে ডানহাতে দান করলে তার বাম হাত তা জানতে পারে না এবং সে ব্যক্তি যিনি একাকী গোপনে আল্লাহ্-কে স্মরণ করেন এবং অতঃপর তার চোখ অশ্রুতে ভরে উঠে।”

আনাস (রা) বর্ণনা করেছেন যে, রাসূলুল্লাহ্ (সা) বলেছেন: 

“আমি যা জানি যদি তোমরা তা জানতে তবে তোমরা হাসতে কম এবং কাঁদতে বেশি।” [মুত্তাফাকুন আলাইহি] 

আদী বিন হাতিম (রা) বর্ণনা করেছেন যে, রাসূলুল্লাহ্ (সা) বলেছেন:

“বিচার দিবসে তোমাদের কারোই তার এবং আল্লাহ্-এর মাঝে কোন মধ্যস্থতাকারী থাকবে না, সে তার ডানদিকে তাকাবে এবং সে যা অর্জন করেছে তা ছাড়া আর কিছুই দেখতে পাবে না, এবং অতঃপর সে তার বামদিকে তাকাবে এবং সে যা অর্জন করেছে তা ছাড়া আর কিছুই দেখতে পাবে না। অতঃপর সে তার সামনে তাকাবে এবং আগুন ছাড়া কিছুই দেখতে পাবে না। এবং সুতরাং, তোমাদের প্রত্যেকেই তার নিজেকে জাহান্নামের আগুন থেকে বাচানো উচিত, এমনকি একটি খেজুরের অর্ধাংশ (দান)-এর বিনিময়ে হলেও।” [মুত্তাফিকুন আলাইহি]

আয়েশা (রা) কর্তৃক বর্ণিত, যিনি বলেছেন যে তিনি রাসূলুল্লাহ্ (সা)-কে বলতে শুনেছেন:

“লোকেরা খালি পায়ে, নগ্ন ও খৎনাবিহীন অবস্থায় হাশরের ময়দানে একত্রিত হবে।” ‘আয়েশা (রা) বললেন, “হে আল্লাহ্’র রাসূল! পুরুষ এবং মহিলাগণ কি একে অপরেরর দিকে তাকাবে?” প্রত্যুত্তরে তিনি (সা) বললেন, “পরিস্থিতি তাদের জন্য এতটাই ভয়াবহ হবে যে তারা এতে মনযোগ দেয়ার কোন সুযোগই পাবে না।” [মুত্তাফাকুন আলাইহি]

নু’মান বিন আল-বাশী’র (রা) থেকে বর্ণিত আছে যে, তিনি রাসূলুল্লাহ্ (সা)-কে বলতে শুনেছেন যে: 

“বিচারের দিন যে ব্যক্তি দোযখের অধিবাসীদের মধ্যে সবচেয়ে কম কষ্ট পাবে, তার পা দুটিকে জ্বলন্ত অঙ্গারের নীচে স্হাপন করা হবে এবং এতে করে তার মগজ ফুটতে থাকবে।” 

ইবনে উমর (রা) হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ্ (সা) বলেন: 

“দুনিয়ার সব মানুষ তার প্রভূর সামনে এমন অবস্থায় দাঁড়াবে যে, তখন প্রত্যেকে তার ঘামে কানের মধ্যখান পর্যন্ত ডুবে যাবে।” [মুত্তাফাকুন আলাইহি] 

আবু হুরায়রা (রা) বর্ণনা করেন যে, রাসূলুল্লাহ্ (সা) বলেন: 

“শেষবিচারের দিন মানুষ এমন অঝোরে ঘামতে থাকবে যে তাদের ঘামে ভৃ-পৃষ্ঠে সত্তর হাত গভীরতা তৈরি হবে, এবং তাদের কান অবদি ডুবে যাওয়া পর্যন্ত তা থামবে না।” [মুত্তাফাকুন আলাইহি] 

আবু হুরায়রা (রা) হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ্ (সা) বলেন: 

“ঈমানদারগণ যদি জানতো যে আল্লাহ্ কী ধরণের শাস্তি মজুদ করে রেখেছেন, তাহলে তাদের কেউ আর জান্নাতের আশা পোষণ করতো না। এবং কাফিররা যদি জানতো আল্লাহ্’র হাতে কত ধরনের রহমত রয়েছে, তাহলে তারা জান্নাতে প্রবেশের আশা কখনও ত্যাগ করতো না।” [মুসলিম]

আবু হুরায়রা (রা)-এর বরাত দিয়ে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ্ (সা) বলেন যে, তাঁর রব বলেন: 

আমার ইজ্জতের কসম, আমি আমার বান্দার জন্য দু’বারের জন্য ভয় এবং দু’বারের জন্য সুরক্ষা বয়ে আনবো না। যদি সে দুনিয়াতে আমাকে ভয় করে, তাহলে বিচার দিবসে আমি তাকে সুরক্ষা দিবো। আর দুনিয়াতে সে যদি (আমার ভয়ের ব্যাপারে) নিজেকে সুরক্ষিত মনে করে, তাহলে আখিরাতে আমি তার জন্য ভয়ের কারণ হবো।

এটি ইবনে হিব্বান তাঁর সহীহতে উল্লেখ করেন। 

বর্ণিত আছে যে, ইবনে আব্বাস (রা) বলেন:

“যখন আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা তাঁর রাসূল (সা)-এর উপর নিম্নোক্ত আয়াতটি নাযিল করেন: 

হে ঈমানদারগণ! তোমরা নিজেদেরকে এবং তোমাদের পরিবার-পরিজনকে সেই অগ্নি থেকে রক্ষা করো, যার ইন্ধন হবে মানুষ এবং পাথর।’’ [সূরা আত-তাহরীম:৬]; একদা রাসূল (সা) সাহাবীগণদের সামনে আয়াতটি তিলাওয়াত করেন, তখন আয়াতটি শুনে এক যুবক অজ্ঞান হয়ে গেলো। রাসূল (সা) বালকটির হৃদপিন্ডের উপর হাত রাখলেন এবং তখনও তার স্পন্দন পেলেন, এবং বালকটিকে বললেন: হে যুবক, বল: লা’ ইলা’হা ইল্লাল্লাহ্। যুবকটিও পুনরাবৃত্তি করলো: লা’ ইলা’হা ইল্লাল্লাহ্, রাসূলুল্লাহ্ (সা) তাকে জান্নাতের সুসংবাদ দিলেন। সাহাবীগণ জিজ্ঞেস করলেন: এটা কি আমাদের মধ্য হতে তার জন্য, হে আল্লাহ্’র রাসূল (সা)? জবাবে রাসূল (সা) বললেন: তোমরা কি আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা’র এ আয়াতটি শুনতে পাওনি: “এটা ঐ ব্যক্তি পায়, যে আমার সামনে (বিচার দিবসে অথবা আমার শাস্তির ভয়ে) দন্ডায়মান হওয়াকে ভয় করে এবং আমার আযাবের ওয়াদাকেও ভয় করে।” [সূরা ইব্রাহীম: ১৪]; ইহা আল-হাকিম হতে বর্ণিত এবং তিনি একে যাচাই করেছেন।

অমূলক ভয়কে দূর করার আর একটি উপায় হল ইসলামিক আক্বীদার অংশ ‘ভাগ্যের ভাল এবং মন্দ’ বিষয়টি সঠিকভাবে অনুধাবন করা। আমাদের রিযক ও আজল বা আয়ুষ্কাল পূবনিধারিত। আল্লাহ’র রাস্তায় করা কোন কাজ রিযক বা আয়ুষ্কালকে কমাবে না। এ ব্যাপারে রাসূলুল্লাহ (সা) বলেন,  

“মানুষের ভয় যেন তোমাদেরকে হক্ কথা বলা হতে বিরত না রাখে যখন তা তোমাদের নিকট স্পষ্ট হয়; সত্য বলা এবং সৎকর্ম করা কখনই মৃত্যুকে ত্বরান্বিত করে না এবং রিজিককেও সংকুচিত করে না।” [আহমদ, ইবনে হিব্বান, ইবনে মাজাহ্]

জালিম শাসক বা মানুষের ভয় যাতে আমাদের হক্ব কথা বলা থেকে বিরত না রাখে।

বুখারী এবং মুসলিম শরীফের হাদীসে আবু সায়ীদ (রা) থেকে বণিত আছে, রাসূলুল্লাহ (সা) বলেন,

মানুষের ভয় যাতে তোমাদের মুনকারের বিরুদ্ধে কথা বলার ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা না হয় যখন তা (মুনকার) শুন অথবা দেখ।

আবু সায়ীদ (রা)-এর বরাত দিয়ে ইবনে মাজাহ উল্লেখ করে যে, রাসূলুল্লাহ (সা) বলেন,

‘‘তোমাদের কেউ যাতে নিজেকে অপমান না কর।’ তারা (রা) বললেন, ‘ইয়া রাসূলুল্লাহ, কীভাবে একজন তার নিজেকে অপমান করে?’ তিনি (সা) বললেন, ‘সে এমন একজন পাপী ব্যক্তিকে দেখল যার বিষয়ে আল্লাহ’র বক্তব্য থাকা সত্ত্বেও তাকে তা জানাল না।’ এরকম ব্যক্তিকে আল্লাহ বলবেন, ‘কী তোমাকে এটি বলা থেকে বিরত রেখেছিল?’ সে বলবে, ‘লোকের ভয়।’ অতপর আল্লাহ বলবেন, ‘আস, আস আমার দিকে, ভয়ের সবচেয়ে বড় হক্বদার তো আমিই ছিলাম।’’  

আল্লাহ’র রাস্তায় ইসলামের জন্য কাজ করলেই কেবল মানুষ মারা যায় না, বিপদের সম্মুখীন হয় না-তা বুদ্ধিবৃত্তিকভাবে চিন্তা করলেই বুঝা যায়। বাংলাদেশে কেবলমাত্র সড়ক দূঘটনায় বছরে প্রায় সাড়ে সাতহাজার লোক মারা যায়, পরিবেশ দূষণজনিত কারণে বছরে প্রায় বিশ হাজার লোক মারা যায়, প্রায় দেড় লক্ষ লোক প্রতি বছর ক্যান্সারে মারা যায়। এছাড়াও রয়েছে দূঘটনাজতি মৃত্যু-রানা প্লাজা, নিমতলী, তাজরীন গামেন্টস, চকবাজার ট্রাজেডী। বাংলাদেশের জেলে দুই তৃতীয়াংশ বন্দী বিনা বিচারে আটক রয়েছে। এতসব মৃত্যু, দূঘটনা, জেল কী ইসলাম প্রতিপালন করার কারণে হচ্ছে? পঙ্গু হাসপাতালে কয়জন রোগী ইসলাম পালন করে হয়েছে? ঢাকা মেডিকেল, বারডেম বা পিজির মগের লাশসমূহ কী ইসলাম পালন করে হয়েছে? আজমপুর গোরস্তানসহ দেশের সব গোরস্তানের কয়টি লাশ বছরে দাফন হয়েছে যারা আল্লাহ’র কাজ করতে গিয়ে নিহত হয়েছে?

আমাদেরকে আল্লাহ’র ক্রোধকে ভয় করতে হবে। সৎ কাজের আদেশ ও অসৎ কাজে নিষেধের ক্ষেত্রে জালিম শাসককে ভয় পেলে চলবে না।

আর তোমার পরওয়ারদেগার যখন কোন পাপপূর্ণ জনপদকে পাকড়াও করেন, তখন এমনিভাবেই করে থাকেন। নিশ্চয়ই তাঁর পাকড়াও অত্যন্ত যন্ত্রনাদায়ক, কঠিন। নিশ্চয়ই ইহার মধ্যে নিদর্শন রয়েছে এমন প্রতিটি ব্যক্তির জন্য যে আখিরাতের আযাবকে ভয় করে। উহা এমন একটি দিন, যেদিন সমস্ত মানব সম্প্রদায়কে একসাথে সমবেত করা হবে, সেদিনটি হলো সকলের হাযিরের দিন। আর আমি ওটা শুধু সামান্য কালের জন্যে বিলম্বিত রেখেছি। যখন সেই দিন আসবে তখন কোন ব্যক্তি আল্লাহ্’র অনুমতি ছাড়া কথাও বলতে পারবে না। অনন্তর তাদের মধ্যে কতক তো দূর্ভাগা হবে এবং কতক হবে ভাগ্যবান। অতএব, যারা দূর্ভাগা হবে তারা তো দোযখে এই অবস্হায় থাকবে যে, তাতে তাদের চীৎকার ও আর্তনাদ হতে থাকবে।” [সূরা হুদ: ১০২-১০৬]

আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা তাঁর (শাস্তি) সমপর্কে তোমাদের সতর্ক করেছেন।” [সূরা আলি ইমরান: ২৮]

হে মানব সম্প্রদায়! তোমাদের পালনকর্তাকে ভয় কর। নিশ্চয়ই কিয়ামতের প্রকম্পন একটি ভয়ংকর ব্যাপার। যেদিন তোমরা তা প্রত্যক্ষ করবে, সেদিন প্রত্যেক স্তন্যধাত্রী তার দুধের শিশুকে বিসমৃত হবে এবং প্রত্যেক গর্ভবতী তার গর্ভপাত করবে এবং মানুষকে তুমি দেখবে মাতাল; অথচ তারা মাতাল নয় বস্তুত: আল্লাহ্’র আযাব অত্যন্ত কঠিন।” [সূরা আল-হাজ্জ্ব: ১-২]  

“সেদিন মানুষ পলায়ন করবে তার ভ্রাতার কাছ থেকে, তার মাতা, তার পিতা, তার পত্নী ও তার সন্তানদের কাছ থেকে। সেদিন প্রত্যেকেরই নিজের এক চিন্তা থাকবে, যা তাকে ব্যতিব্যস্ত করে রাখবে।” [সূরা আবাসা: ৩৪-৩৭]

রাসূলুল্লাহ্ (সা:) বলেন,

‘‘এক শহরের অধিবাসীদের উপর আলাহ্ তাআলা শাস্তি প্রদান করেন। তাদের মধ্যে আঠার হাজার লোক এমন ছিল যাদের আমল ছিল নবীদের আমলের সমতুল্য।’ জিজ্ঞেস করা হলো, ‘ইয়া রাসূলুল্লাহ (সা:)! কেন তবে তাদের উপর শাস্তি এসেছিল?’ রাসূলুলাহ্ (আ:) বললেন, ‘এই কারণে যে, (বাকীদের পাপকাজ করতে দেখেও) তারা আল্লাহ্’র উদ্দেশ্য বাকীদের উপর ক্রুদ্ধ হতো না এবং তাদেরকে (পাপকাজ থেকে) বারণ করতো না।’’

রাসূলুল্লাহ(সা:) বলেন,

“সেই সত্তার শপথ যার হাতে আমার জীবন, তোমাদেরকে অবশ্যই সৎকাজের আদেশ এবং অসৎকাজের নিষেধ করতে হবে, না হলে অবশ্যই আল্লাহ নিজের পক্ষ থেকে তোমাদের উপর শাস্তি পাঠাবেন, অতঃপর তোমরা তাঁর কাছে প্রার্থনা করবে কিন্তু তোমাদের ডাকে সাড়া দেয়া হবে না।” [তিরমিযি]

রাসূলুলাহ্ (সা:) বলেন,

“তোমরা অবশ্যই সৎকাজের আদেশ দেবে ও অন্যায় কাজে বাধা দেবে এবং লোকদের কল্যাণময় কাজের জন্য উদ্বুদ্ধ করব। অন্যথায় আল্লাহ কোনো আযাবের মাধ্যমে তোমাদের ধ্বংস করে দেবেন কিংবা তোমাদের মধ্য থেকে খারাপ লোকদেরকে তোমাদের উপর শাসনকর্তা নিযুক্ত করে দেবেন। এসময় তোমাদের মধ্যকার ভালো লোকেরা আল্লাহ্’র কাছে দোয়া করবে, কিন্তু তা কবুল হবে না।” [মুসনাদে আহমদ]

হযরত আবু বকর (রা) বলেন, আমি রাসূলুলাহ্ (সা:) কে বলতে শুনেছি:

“মানুষ যখন কোনো অসৎকাজ দেখে আর তারা সেটাকে পরিবর্তন করে না, তাহলে আল্লাহ তাদেরকে ব্যাপকভাবে তাঁর আযাবে ছেয়ে ফেলবেন।” [ইবনে মাজাহ]

রাসূলুলাহ্ (সা:) বলেন,

“নিশ্চয়ই আল্লাহ আজ্জা ওয়া জাল বিশেষ কোনো ব্যক্তির পাপাচারের জন্য জনসাধারণকে শাস্তি দেন না। কিন্তু যখন তারা (জনসাধারণ) তাদের সামনে মুনকার (অসৎকাজ) হতে দেখে এবং তা প্রতিহত করে না, যদিও তাদের তা প্রতিহত করার ক্ষমতা রয়েছে। তারা যদি এরূপ করে তখন আল্লাহ্ ব্যক্তিবিশেষ ও জনসাধারণ উভয়কেই শাস্তি দেন।” [আহমদ]

এক্ষেত্রে আমাদের সালফে সালেহীনদের পদাঙ্ক অনুসরণ করতে হবে। ইমাম আবু হানিফা (র), আহমাদ ইবনে হাম্বল (র) হক্ব কথা বলতে গিয়ে শাসকের নিযাতনের স্বীকার হওয়া সত্বেও তারা তাতে অটল ছিলেন। আমরা নামাজসহ অন্যান্য ইবাদতে তাদের মাযহাব অনুসরণ করি। এইসব সালেহীনগণ শাসককে নয়, মানুষকে নয়, একমাত্র আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’আলাকে ভয় করে দ্বীনের উপর ইস্তিকামাত ছিলেন।

নিশ্চয় মানুষ অত্যন্ত কম জানে, আল্লাহ সবচেয়ে ভাল জানেন।

Leave a Reply