বাংলাদেশ কি গরিব নাকি গরিব করে রাখা হয়েছে?

বিগত প্রায় পঞ্চাশ বছর ধরে বাংলাদেশ শব্দটি উচ্চারিত হলেই হতদরিদ্র, অপুষ্ট, প্রাকৃতিক দূর্যোগে পর্যুদস্ত একটি জনপদের চিত্র মানুষের চোখে ভেসে উঠে। সচেতন লোকমাত্রই জানে, বহির্বিশ্বে বাংলাদেশীদের ‘মিসকীন’ নামে ডাকা হয়। যদিও বর্তমান সরকারের সময়ে হঠাৎ করে বাংলাদেশ ‘মধ্যম আয়ের দেশ’ এ রূপান্তরিত হয়েছে বলে ব্যাপক প্রচারণা শুরু করা হয়। বাংলাদেশের সাধারণ জনগণ অবশ্য তৃতীয় বিশ্বের হতদরিদ্র বাংলাদেশ ও ‘মধ্যম আয়ের দেশ’ এর মধ্যে কোন পার্থক্য খুঁজে পায় না। ‘মধ্যম আয়ের দেশ’ তকমাটির সাথে সরকার কিছু পরিসংখ্যানের কথা বলছে। সেগুলো হল: মাথাপিছু আয়, দৃঢ় জিডিপি, বিভিন্ন সামাজিক সূচক (স্বাক্ষরতার হার, সামাজিক নিরাপত্তা বলয়ের আওতাধীন জনগণ, বাল্যবিবাহ, চিকিৎসা সুবিধার আওতাধীন জনগণ ইত্যাদি) প্রভৃতি। এসবক্ষেত্রে সত্যিকার অর্থে বাংলাদেশের উন্নয়ন হয়েছে কিনা এটি প্রশ্নবিদ্ধ। কারণ মানুষকে ধোঁকা দেয়ার জন্য পরিসংখ্যান একটি ভাল উপায় এবং এসব উপাত্ত অর্জনের প্রক্রিয়ার উপরও অনেক কিছু নির্ভর করে। তাছাড়া পরিসংখ্যানের ক্ষেত্রে আমাদের শাসকদের বিশ্বাস করার কোন সঙ্গত কারণ নেই। কারণ বর্তমান ব্যবস্থায় যুতসই শাসক জনগণকে ধোঁকা দেয়ার ক্ষেত্রে দক্ষ হবে-এটাই স্বাভাবিক ও নিয়ম। 

দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পর উপনিবেশবাদী রাষ্ট্র ব্রিটেন, ফ্রান্স, জার্মানী, ইটালী, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র প্রত্যক্ষ উপনিবেশ থেকে পরোক্ষ উপনিবেশবাদ বা নব্য উপনিবেশবাদে প্রবেশ করে। নব্য উপনিবেশবাদে উপনিবেশবাদী রাষ্ট্রসমূহ প্রত্যক্ষভাবে শাসন না করলেও একজন দালাল শাসক দ্বারা ঐ দেশের জনগণকে পরোক্ষভাবে শাসন, শোষন করে। সে পুতুল শাসক কাফের উপনিবেশবাদীদের শাসন ও অর্থনৈতিক ব্যবস্থা বাস্তবায়ন করে, আই এম এফ ও বিশ্বব্যাংকের প্রেসক্রিপশন অনুযায়ী শোষণমূলক অর্থনীতিকে ঢেলে সাজায়, উপনিবেশবাদী বহুজাতিক কোম্পানীগুলোর হাতে দেশের গণমালিকানাধীন সম্পদ (খনিজ সম্পদ, বিদ্যুৎ) তুলে দেয়। বিনিময়ে  উপনিবেশবাদী রাষ্ট্র ঐ দালাল শাসককে ক্ষমতায় টিকে থাকার গ্যারান্টি প্রদান করে। বাংলাদেশও এর ব্যতিক্রম নয়। বাংলাদেশের গ্যাস ও কয়লার মালিকানা এ দেশের জনগণের হলেও উপনিবেশবাদী বিভিন্ন বহুজাতিক কোম্পানীর (শেভরণ, ইউনোকল, কনকো ফিলিপস, এশিয়া এনার্জি, গ্যাসপ্রম, নাইকো প্রভৃতি) কাছে বিভিন্ন সরকার মালিকানার সত্ত্ব বিক্রি করে এবং পরবর্তীতে উচ্চ আর্ন্তজাতিক মূল্যে সেগুলো জনগণের কাছে বিক্রি করে। এভাবে জনগণের কষ্টার্জিত অর্থ উপনিবেশবাদী রাষ্ট্রের কাছে চলে যায় এবং জনগণকে দারিদ্রের দুষ্ট চক্রে আবদ্ধ রাখা হয়। 

মোদ্দাকথা, উপনিবেশবাদী রাষ্ট্র মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপ এবং তাদের ঘৃণিত জীবনব্যবস্থা পুঁজিবাদের বাস্তবায়নের কারণে বাংলাদেশের অমিত সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও আজকে গরীব হয়ে আছে। 

অমিত সম্ভাবনার এক দেশ-বাংলাদেশ। একটি নেতৃত্বশীল রাষ্ট্রে পরিণত হওয়ার জন্য সব যোগ্যতাই বাংলাদেশের রয়েছে। বাংলাদেশের অধিকাংশ ভূমিই সমতল ও উর্বর। দীর্ঘদিন যাবত ক্রমহ্রাসমান উর্বর কৃষিজমি ক্রমবর্ধমান জনগনের খাদ্য চাহিদা যথাযথভাবে পূরণ করে আসছে । এখানকার প্রায় সব লোক এক ভাষাতেই কথা বলার কারণে তথ্য আদান প্রদান এবং ঐক্য ও সংহতি বজায় রাখা খুবই সহজ । বাংলাদেশের গ্যাস, কয়লা, ইউরেনিয়ামের মজুদ জনগণের জ্বালানী চাহিদা পূরণের জন্য যথেষ্ট। বাংলাদেশের রোদ, নদী, বিশাল সৈকতের বাতাস থেকেও শক্তি উৎপাদন সম্ভব। আমাদের রয়েছে দীর্ঘতম সমুদ্রসৈকত-যাও খনিজ সম্পদে পরিপূর্ণ। আমাদের সামুদ্রিক জল সীমানাও খনিজ থেকে শুরু করে বিভিন্ন সম্পদে সমৃদ্ধ। তিন দিকে ঘিরে থাকা পাহাড়ের সারি ও দক্ষিণ দিকে থাকা অসভীর সমুদ্র সৈকত বাংলাদেশকে সামরিকভাবে ‘ডিফেন্ডারস হেভেন’ এ পরিণত করেছে। তাছাড়া ভূ-রাজনৈতিকভাবেও বাংলাদেশের অবস্থান ভারত ও চীনের মাঝামাঝি। বাংলাদেশের জনগনের বড় একটি অংশ তরুণ-যাদেরকে সহজেই জনসম্পদের পরিণত করা সম্ভব। বাংলাদেশের জনগণ পরিশ্রমী, মেধাবী ও সৃজনশীল। খনিজ অনুসন্ধান, উত্তোলন, ণির্মাণ শিল্প, বস্ত্রশিল্প ও জাহাজ নির্মাণ শিল্পে বাংলাদেশের অভিজ্ঞতা অত্যন্ত মূল্যবান। এতসব আর্শীবাদ থাকা সত্ত্বেও দূরদর্শী আদর্শিক নেতৃত্বের অভাবে বাংলাদেশকে একটি নেতৃত্বশীল রাষ্ট্রে পরিণত করা সম্ভব হচ্ছে না। 

বাংলাদেশের শাসন, অর্থনীতি ও বিচারব্যবস্থা উপনিবেশবাদী শক্তি দ্বারা আরোপিত। বাংলাদেশের মানুষের বিশ্বাস ইসলাম থেকে এসেছে কিন্তু জীবন পরিচালনার সব ব্যবস্থা ইসলাম ব্যতিত অন্য কোন কিছু থেকে এসেছে। সেকারণে বিশ্বাস ও ব্যবস্থার বৈপরীত্যের মধ্যে বাংলাদেশ এগুতে পারছে না। বাংলাদেশকে যদি রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিকভাবে একটি পরাশক্তিতে পরিণত করতে চাই তাহলে ইসলামি মৌলিক বিশ্বাসের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ ব্যবস্থা লাগবে। আর এরকম ব্যবস্থাই হল খিলাফত ব্যবস্থা। একমাত্র খিলাফত ব্যবস্থাই বাংলাদেশকে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক দাসত্ব থেকে মুক্ত করে একটি নেতৃত্বশীল রাষ্ট্রে পরিণত করতে পারে। 

Print Friendly, PDF & Email

Leave a Reply