উপনিবেশবাদ বা সাম্রাজ্যবাদ পুঁজিবাদের স্বাভাবিক পরিণতি। ইউরোপে খ্রীস্টান ধর্মযাজক, শাসকশ্রেণী এবং নির্যাতিত সাধারণ জনগণ ও বুদ্ধিজীবী শ্রেণীর মধ্যে শতকের পর শতক ধরে সংঘটিত রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের পর তারা জীবন থেকে ধর্মকে পৃথকীকরণের প্রতিক্রিয়াশীল সিদ্ধান্ত- ধর্মনিরপেক্ষতায় উপনীত হয়। এটি ছিল ইউরোপীয়দের পূর্ণজাগরণ। এ পূর্ণজাগরণ ইউরোপীয়দের একটি চিন্তার (অর্থাৎ ধর্মনিরপেক্ষতা) ভিত্তিতে গড়ে উঠা পুঁজিবাদী ব্যবস্থার মাধ্যমে বস্তুগত উন্নয়নের দিকে এগিয়ে নিয়ে যায়। যার ফলশ্রুতিতে শিল্প বিপ্লব আসে। কাঁচামাল, পুজি, জ্বালানী ও বাজারের জন্য ইউরোপের পুঁজিবাদী রাষ্ট্রসূহ এশিয়া, আফ্রিকা, অস্ট্রেলিয়া, ল্যাটিন আমেরিকার রাষ্ট্রসমূহে প্রত্যক্ষ উপনিবেশ স্থাপন করে। এক্ষেত্রে সবচেয়ে সফল ছিল ব্রিটেন। তার পরের সারিতেই ছিল ফ্রান্স, স্পেন, পর্তুগাল।
ব্রিটিশদের সর্ম্পকে বলা হয় তারা তাদের মগজের শেষটুকু দিয়ে চেষ্টা করে। যে কারণে তারা অন্যদের চেয়ে একটু বেশীই সফল। শক্তিশালী নৌবাহিনী, ধূর্ত রাজনৈতিক কূটকৌশল, সুদূরপ্রসারী আদর্শিক চিন্তাকে ব্যবহার করে বিশাল উপনিবেশ গড়ে তুলেছিল ব্রিটিশরা। তারা যেখানে গিয়েছে সেখানে কেবল ভূমিকে দখল করেনি, সে ভূমির মানুষের মগজকেও দখল করেছে। এর জন্য শিক্ষাব্যবস্থা তথা কালচারের মাধ্যমে মানুষের চিন্তাপ্রক্রিয়ায় পরিবর্তন নিয়ে এসেছে। তাদের মত চিন্তা করতে, জীবনকে দেখতে শিখিয়েছে। যেখানে তারা গিয়েছে সেখানে ব্রিটিশ শিক্ষাব্যবস্থা, বিচারব্যবস্থা, শাসনব্যবস্থা, নিপীড়নমূলক পুঁজিবাদী অর্থনীতি বাস্তবায়ন করেছে। এতে করে সবচেয়ে বেশী ক্ষতি হয় মুসলিম বিশ্বের। কারণ মুসলিমদের রয়েছে নিজস্ব আক্বীদা, শাসনব্যবস্থা, সমাজব্যবস্থা, অর্থনীতি, বিচারব্যবস্থা-যা কাফির ব্রিটিশদের চেয়ে সম্পূর্ণরূপে পৃথক।
দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পর অর্থনৈতিক ও সামরিক সক্ষমতা হ্রাস পাওয়ায় ব্রিটিশদের জন্য প্রত্যক্ষ উপনিবেশ বজায় রাখা অসম্ভব হয়ে পড়েছিল। কিন্তু দীর্ঘদিন তাদের শিক্ষাব্যবস্থা, বিচারব্যবস্থা, শাসনব্যবস্থা, নিপীড়নমূলক পুঁজিবাদী অর্থনীতি বাস্তবায়নের ফলে উপনিবেশবাদকে তারা নতুন রূপ দিতে সক্ষম হয়েছিল। এই নতুন রূপের উপনিবেশবাদের নাম হল নব্য উপনিবেশবাদ বা নিও কলোনিয়ালিজম। এখানে ব্রিটিশরা প্রত্যক্ষভাবে কোন ভূমিতে শাসনে না থাকলেও তাদেরই পছন্দনীয় ঐ ভূমির কাউকে শাসক হিসেবে নিয়োগ দেয়। ফলে জনগণের মধ্যে স্বাধীন সার্বভৌমত্বের একধরনের নকল অনুভূতি বিরাজ করতে থাকে-যদিও এ অনুভূতিই শেষ কথা। বাস্তবে এ রাষ্ট্রসমূহ স্বাধীন বা সার্বভৌম নয়। এই দালাল শাসক ঐ ভূমিতে ব্রিটিশদের স্বার্থ রক্ষা করে এবং ব্রিটিশরা এর বিনিময়ে ঐ শাসককে ক্ষমতার থাকার নিশ্চয়তা প্রদান করে। এই শাসক এক নায়ক স্বৈরাচার হতে পারে, আবার গণতান্ত্রিকও হতে পারে। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পর বিশ্ব রাজনীতিতে পরাশক্তি হিসেবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আর্বিভূত হয়। তারা মুসলিম এবং অমুসলিম বিশ্বে নব্য উপনিবেশবাদের এ ধারাকে অব্যাহত রাখে।
মুসলিম বিশ্বে দ্বিদলীয় গণতন্ত্র প্রত্যক্ষ উপনিবেশকালীন সময়ে উপনিবেশবাদী ব্রিটিশদের শেখানো রাজনৈতিক কালচারের ফলাফল। ব্রিটিশরা নিশ্চিত করতে চেয়েছিল তারা চলে যাওয়ার পর কমনওয়েলথভুক্ত দেশগুলো তাদের দেখানো রাজনৈতিক ধারার মধ্যেই থাকে। এর প্রমাণ পাওয়া যায় ভারতীয় কংগ্রেস পার্টির প্রতিষ্ঠার ইতিহাস থেকে-যার প্রতিষ্ঠাতা কোন ভারতীয় নয়, বরং একজন ব্রিটিশ শিক্ষাবিদ- এলান অক্টোভিয়ান হিউম। ব্রিটিশ ওয়েস্ট মিনিস্টার ধারার রাজনীতিতে দুইটি বড় রাজনৈতিক দল থাকে যারা পালাক্রমে জনগণকে শাসন করে। একই চিত্র আমরা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেও দেখতে পাই। এ দু’টি দলের মধ্যে একটি থাকে দেশপ্রেমিক ঘরানার এবং অন্যটি জাতীয়তাবাদী ঘরানার। মুসলিম বিশ্বে এদের কোনটি আমেরিকান ব্লকের আবার কোনটি ব্রিটিশ ব্লকের। বাংলাদেশ, পাকিস্তান, তুরষ্ক, তিউনেশিয়া, ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়ার রাজনৈতিক সংস্কৃতি এরকমই।
১. আদর্শিক হওয়ায় দ্বিদলীয় রাজনীতি আমেরিকা, ব্রিটেনের জনগণকে বিভক্ত না করলেও গণতন্ত্র মুসলিম বিশ্বে আরোপিত ব্যবস্থা হওয়ায় জনগণকে বিভক্ত করে। বিধায় রাষ্ট্রের মধ্যে নৈরাজ্য ও বিশৃংখলা দেখা দেয়। জনগণ ও রাজনৈতিক দলের বিভক্তি উপনিবেশবাদীদের খবরদারি ও দরকষাকষির মোক্ষম সুযোগ এনে দেয়। এভাবে মুসলিম বিশ্বে কাফের উপনিবেশিক শক্তিসমূহের আধিপত্য ও প্রভাব আরও বৃদ্ধি পায়।
২. পুঁজিবাদ বাস্তবায়নের ফলে সাধারণ জনগণ জুলুমের মধ্যে থাকে এবং ক্ষোভ দানা বাধতে থাকে। কয়েক বছর পর পর নির্বাচনের মাধ্যমে নতুন নতুন চেহারা নিয়ে এসে সেই ক্ষোভ প্রশমনের ব্যবস্থা করা হয়। জনগন নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণ ও ভোট প্রদানের মাধ্যমে নতুন কাউকে নিয়ে এসে পুরাতন জালিমকে প্রতিস্থাপন করে ক্ষোভকে প্রশমিত করে।
৩. গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় মিডিয়া কিছুটা স্বাধীনতা ভোগ করে এবং জনগণ সভা সমাবেশ করার অধিকার পায়। এভাবেও ক্ষোভ কিছুটা প্রশমিত হয়। তবে উপনিবেশবাদীদের পছন্দনীয় শাসকের পক্ষে জনগমত তৈরির ও জনগনের সাথে প্রতারণার জন্যও মিডিয়াকে ব্যবহার করা হয়।
কিন্তু একই ব্যবস্থা অব্যাহত থাকায় নতুন মুখও কিছুদিনের মধ্যে জালিম হয়ে উঠে। গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় পশ্চিমা উপনিবেশিকদের পছন্দমত শাসক না আসলে সেসব দেশে তারা পছন্দনীয় এক নায়ককে বেছে নেয়। যেমনটি ঘটেছে মিশরে। সেখানে আমেরিকা জনপ্রিয় শাসক মুরসীকে সেনাপ্রধান ফাত্তাহ আল সিসির মত একনায়ক দ্বারা প্রতিস্থাপন করেছে। এতে গণতন্ত্র ধর্ষিত হলেও উপনিবেশবাদীদের কোন ক্ষতি নেই। মধ্যপ্রাচ্যের অধিকাংশ স্বৈরশাসক আমেরিকা ব্রিটেনের প্রত্যক্ষ মদদে পরিচালিত হয়। গণতন্ত্র রপ্তানি করতে আমেরিকা ইরাক আফগানিস্তানকে চরদখলের মত জবরদখল করলেও মধ্যপ্রাচ্যের স্বৈরশাসকদের নিয়ে তাদের কোন সংকোচ বোধ বা অ্যালার্জি নেই। এ থেকে বুঝা যায়, মুসলিম বিশ্বে গণতন্ত্র নিয়ে আমেরিকা ব্রিটেন যতটা না চিন্তিত, তার চেয়ে বেশী চিন্তিত ও উদ্বিগ্ন সেসব দেশে যে কোন প্রকারে নব্য উপনিবেশবাদ বজায় রাখার ক্ষেত্রে। কারণ নব্য উপনিবেশবাদের মাধ্যমে ধূর্ততার সাথে পশ্চিমা উপনিবেশবাদীরা মুসলিম বিশ্বের জনগণ ও সম্পদের উপর কর্তৃত্ব, খবরদারি ও আধিপত্য বিস্তার করতে পারে। আর মুসলিম বিশ্বে গণতন্ত্র এক্ষেত্রে একটি মোক্ষম হাতিয়ার।