প্রশাসনিক ব্যবস্থা (জনকল্যাণ বিভাগ, Administrative System)

রাষ্ট্র পরিচালনা ও জনগণের স্বার্থসংক্রান্ত কার্যাবলী বিভিন্ন অফিস, বিভাগ এবং প্রশাসনের মাধ্যমে পরিচালিত হয় – যাদের কাজ হল জনগণের স্বার্থসংক্রান্ত বিষয়াবলী ও রাষ্ট্রীয় কর্মকান্ডের সুব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করা। প্রত্যেক অফিসের (মাসলাহা) প্রধান হিসেবে একজন মহাব্যবস্থাপক, প্রত্যেক বিভাগ (দায়রাহ্) ও প্রশাসনের (ইদারা) প্রধান হিসেবে একজন পরিচালক এর পরিচালনার দায়িত্বে থাকবেন। এই পরিচালকগণ পেশাগতভাবে তাদের অফিস, বিভাগ ও প্রশাসনের মহাপরিচালকের কাছে এবং আইন ও সাধারণ নিয়মনীতি পালনের ক্ষেত্রে ওয়ালী বা আমীলের কাছে জবাবদিহি করতে বাধ্য থাকবেন।

রাসূলুল্লাহ্ (সা) সাধারণত প্রশাসন পরিচালনা ও জনগণের বিষয়াদি দেখভাল করতেন এবং প্রশাসনে কর্মরত সচিবদেরও তিনি (সা) নিয়োগ দিতেন। এভাবেই, রাসূলুল্লাহ্ (সা) মদীনার লোকদের দেখাশোনার দায়িত্ব নেন, তাদের বিভিন্ন সমস্যার সমাধান করেন, তাদের মধ্যকার বিভিন্ন সম্পর্ক নির্ধারণ করেন, তাদের সকল প্রয়োজন নিশ্চিত করেন এবং তাদের জন্য যথোপযুক্ত বিষয়ে নির্দেশনা দিতেন। এসবই ছিল প্রশাসনিক বিষয় যা তাদের জীবনের বিভিন্ন জটিলতা বা সমস্যা দূর করে জীবনকে করেছিল সহজ।   

শিক্ষাক্ষেত্রে, রাসূলুল্লাহ্ (সা) দশজন মুসলিম শিশুকে শিক্ষা দেওয়াকে কাফের বন্দীদের জন্য মুক্তিপণ হিসেবে ধার্য করেছিলেন, যেখানে মুক্তিপণ গণীমতের মালের বিনিময়ে দেয়া হত যা মুসলিমদের সম্পদ হিসাবে গণ্য হত। এভাবেই তিনি (সা) মুসলিমদের শিক্ষা লাভের ব্যাপারটি নিশ্চিত করেছিলেন।   

স্বাস্থ্য ক্ষেত্র উন্নয়নের জন্য তিনি (সা) তাঁর নিজের জন্য উপহার হিসেবে প্রাপ্ত একজন ডাক্তারকে মুসলিমদের সেবার কাজে নিয়োজিত করেছিলেন। বস্তুতঃ রাসূল (সা) তাঁর নিজের জন্য প্রাপ্ত উপহারটি নিজে ব্যবহার না করে কিংবা নিজে গ্রহণ না করে জনসেবার জন্য নিয়োজিত করার ঘটনা থেকে প্রমাণিত হয় যে, স্বাস্থ্যসেবা মুসলিমদের স্বার্থ সংশ্লিষ্ট একটি কাজ।   

কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে, রাসূলুল্লাহ্ (সা) এক ব্যক্তিকে ভিক্ষা করার বদলে আগে একটি জামা ও পরে একটি কুঠার ক্রয় করার নির্দেশ দিলেন। তারপর সেই কুঠার দিয়ে বন থেকে কাঠ কেটে তিনি (সা) তাকে বাজারে বিক্রির নির্দেশ দিয়েছিলেন। কারণ, ভিক্ষার ক্ষেত্রে ভিক্ষুককে কেউ ভিক্ষা দিতেও পারে আবার প্রত্যাখানও করতে পারে। এভাবে রাসূল (সা) কর্তৃক লোকটির কর্মসংস্থানের ঘটনা প্রমাণ করে যে, কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করাও মুসলিমদের স্বার্থ সংশ্লিষ্ট একটি কাজ। তিরমিযী সমর্থিত আহমাদ বর্ণিত একটি হাদীসে উল্লেখ আছে যে, 

‘আনসারদের মধ্য হতে এক ব্যক্তি নবী (সা) এর কাছে আসলো এবং তাঁর কাছে সাদাকা চাইলো। রাসূলুল্লাহ্ (সা) তাকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘তোমার ঘরে কি কিছুই নেই?’ লোকটি বললো,‘আছে।’ তিনি (সা) বললেন, ‘ওগুলো আমার কাছে নিয়ে আসো।’ লোকটি রাসূল (সা) এর কথা অনুসারে কাজ করলো। রাসূলুল্লাহ্ (সা) এগুলো হাতে নিয়ে বললেন, ‘এ দু’টিকে কে খরিদ করবে?’ একজন লোক বললো, ‘দুই দিরহামের বিনিময়ে আমি এগুলো ক্রয় করতে চাই।’ তিনি (সা) জিনিসগুলো তাকে দিলেন এবং বিনিময়ে দিরহাম দু’খানা নিলেন এবং দিরহাম দুটো আনসারীকে দিয়ে বললেন, ‘একটি দিরহাম পরিবারের জন্য খরচ কর এবং আরেকটি দিয়ে কুঠার খরিদ করে আমার কাছে নিয়ে এস।’ লোকটি তাই করল। রাসূলুল্লাহ্ (সা) তাকে বললেন, ‘যাও কুঠার দিয়ে বন থেকে কাঠ সংগ্রহ কর ও বিক্রয় কর; আর পনের দিনের আগে আমার সাথে দেখা করো না।’ লোকটি এ কথা মেনে নিল এবং পরবর্তীতে দশ দিরহাম নিয়ে ফেরত এল।’
(সূনানে আবু দাউদ, হাদীস নং-১৬৪১)

আল বুখারী থেকে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ্ (সা) বলেছেন, 

‘মানুষের কাছে ভিক্ষা করার চাইতে তোমাদের জন্য একটি রশি দিয়ে জ্বালানী কাঠ বেঁধে পিঠে বয়ে নিয়ে বাজারে বিক্রি করে তার মুখ (সম্মান) রক্ষা করা শ্রেয়তর; কারণ মানুষ তাকে ভিক্ষা দিতেও পারে আবার প্রত্যাখ্যানও করতে পারে।’
(সহীহ্ বুখারী, হাদীস নং-২০৭৫)

রাস্তাঘাট নির্মাণের ক্ষেত্রে, রাসূল (সা) তাঁর সময়ে বিবাদের আশঙ্কার ক্ষেত্রে রাস্তার প্রশস্ততা সাত হাত করবার নির্দেশ দিয়েছিলেন। আবু হুরাইরার সূত্রে আল বুখারী বর্ণনা করেছেন যে, 

‘বিবাদের আশঙ্কার ক্ষেত্রে রাসূলুল্লাহ্ (সা) এর সিদ্ধান্ত ছিল রাস্তার প্রশস্ততা হবে সাত হাত।’
(সহীহ্ বুখারী, হাদীস নং২৪৭৩)

আর মুসলিমে বর্ণিত 

‘যদি রাস্তার ব্যাপারে বিবাদ হয় তাহলে তোমরা এর প্রশস্ততা সাত হাত করো।’

তখনকার প্রশাসনের পক্ষ থেকে এ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়েছিল। শাফীঈ’র মতানুযায়ী, প্রয়োজনে রাস্তার প্রশস্ততা এর থেকে বেশী করাও অনুমোদিত। 

রাসূলুল্লাহ্ (সা) রাস্তার উপর দখল প্রতিষ্ঠা বা আগ্রাসন থেকে নিবৃত্ত থাকার নির্দেশ দিয়েছেন। তাবারানী (আল জামী’) আল সগীরে বর্ণনা করেছেন যে: 

যে ব্যক্তি মুসলিমদের রাস্তা থেকে এক হাত পরিমাণ জায়গা নিল, কিয়ামতের দিন আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা তাকে সাত জমীনের মাটি দ্বারা আবদ্ধ করবেন।’ 

সেচকাজের ক্ষেত্রে বলা যায় যে, আল যুবায়ের তার জমির উপর দিয়ে যাওয়া একটি জলধারার পানি দিয়ে সেচকার্য নিয়ে একজন আনসারের সাথে দ্বন্দে জড়িয়ে পড়েন। রাসূলুল্লাহ্ (সা) তাঁকে বলেন,   

‘হে যুবায়ের, সেচকার্যের পর তোমার প্রতিবেশীকে পানি ছেড়ে দাও।’
(মুসলিমের বর্ণিত এ হাদীসটির ব্যাপারে ঐকমত্য আছে) 

এভাবেই রাসূল (সা) মুসলিমদের প্রতিটি বিষয় দেখাশুনা করতেন এবং কোন প্রকার জটিলতা ব্যতীত সহজ সরল ভাবে তাদের সমস্যাসমূহ সমাধান করতেন। এ সমস্ত কার্য পরিচালনার জন্য তিনি (সা) কিছু কিছু সাহাবীদের (রা) সাহায্য নিতেন, এবং এভাবেই তিনি (সা) জনগণের বিষয়সমূহ দেখাশুনার বিষয়টিকে খলীফার তত্ত¡াবধানের অধীন একটি প্রতিষ্ঠানে পরিণত করেন; কিংবা, কোন কোন ক্ষেত্রে তিনি (সা) এ বিষয়সমূহ দেখাশুনা করার জন্য যোগ্য পরিচালক নিয়োগ করেন। এজন্যই আমরা খলীফার গুরুভার লাঘব করার জন্য এটিকে একটি প্রতিষ্ঠানে পরিণত করার সিদ্ধান্ত নিয়েছি, বিশেষ করে, বর্তমানে যখন জনগণ সম্পর্কিত বিষয়সমূহ বহুগুণে বৃদ্ধি পেয়েছে এবং শাখাপ্রশাখা বিস্তার করেছে। সুতরাং, জনগণের বিষয়সমূহ দেখাশুনা করার জন্য একটি প্রতিষ্ঠান (জনকল্যাণ বিভাগ) থাকবে, যার দায়িত্বভার একজন যোগ্য পরিচালকের হাতে ন্যস্ত করা হবে, এবং এমন উপায় উপকরণ ও পদ্ধতিতে তা পরিচালনা করা হবে যা রাষ্ট্রে বসবাসরত নাগরিকদের জীবনকে সহজতর করে।   

এ ব্যবস্থাটি বিভিন্ন প্রশাসন, বিভাগ ও পরিষদের দ্বারা গঠিত হবে। প্রশাসন হল রাষ্ট্রের যে কোন কর্মকান্ড সম্পর্কিত সার্বিক পরিচালনা, যেমন: নাগরিকত্ব, যাতায়াত, মুদ্রা, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কৃষি, কর্মসংস্থান, রাস্তাঘাট এবং অন্যান্য বিভিন্ন বিষয় সম্পর্কিত। এই প্রশাসন তার নিজস্ব কর্মকান্ড এবং এর অধীনস্থ বিভাগ ও পরিষদ সমূহের পরিচালনার দায়িত্ব পালন করবে। প্রতিটি বিভাগ আবার তার নিজস্ব কর্মকান্ড এবং এ বিভাগের নিয়ন্ত্রণাধীন পরিষদের পরিচালনা করবে। পরিষদগুলো আবার তাদের নিজস্ব কর্মকান্ড এবং এর অধীনস্থ প্রতিটি শাখা ও বিভাগ পরিচালনা করবে। 

বস্তুতঃ এই প্রশাসন, বিভাগ ও পরিষদ প্রতিষ্ঠা করার মূল লক্ষ্য হল রাষ্ট্রীয় কর্মকান্ড সুষ্ঠভাবে সম্পাদন করা এবং সেইসাথে, জনস্বার্থ সম্পর্কিত বিষয়সমূহ দেখাশুনা করা।

এছাড়া, এইসব প্রশাসন, বিভাগ ও পরিষদগুলোর সুষ্ঠ পরিচালনা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে অবশ্যই এদের জন্য পরিচালক নিযুক্ত করতে হবে। প্রতিটি প্রশাসনে একজন মহাব্যবস্থাপক নিয়োগ করা হবে, যিনি সরাসরি এর দায়িত্বে থাকবেন এবং এর অধীনস্থ সকল বিভাগ ও পরিষদের কর্মকান্ড তদারকী করবেন। আবার, প্রত্যেক বিভাগ ও পরিষদে একজন পরিচালক নিয়োগ করা হবে, যিনি সরাসরি এর দায়িত্বে থাকবেন এবং সংশ্লিষ্ট সকল শাখা ও বিভাগসমূহের কর্মকান্ড পর্যবেক্ষণ করবেন।

প্রশাসনিক ব্যবস্থা প্রশাসন পরিচালনার একটি বিশেষ পদ্ধতি, এটি শাসনকার্য সম্পর্কিত নয়

প্রশাসনিক ব্যবস্থা হল কোন কাজ সম্পাদনের পন্থা (style) এবং মাধ্যম (means)। সুতরাং, এর জন্য সুনির্দিষ্ট কোন শারী’আহ্ দলিলের প্রয়োজন নেই। এজন্য, প্রশাসনের উৎস বা মূলকে নির্দেশ করে এমন সাধারণ দলিল-প্রমাণই যথেষ্ট। সুতরাং, এটা বলা ভুল হবে যে, এই পন্থা বা মাধ্যমগুলো মানুষের কাজ, যার প্রতিটির জন্য শারী’আহ্ দলিলের প্রয়োজন। কারণ, এই বিষয় সম্পর্কিত কর্মকান্ডগুলোর মূল সাধারণ দলিলের মাধ্যমে প্রমাণিত। সুতরাং, এই মূল থেকে উৎসারিত সকল শাখাপ্রশাখা এর মধ্যে অন্তর্ভূক্ত, যতক্ষণ পর্যন্ত না এর শাখাপ্রশাখার ব্যাপারে কোন সুনির্দিষ্ট দলিল থাকে। সেক্ষেত্রে, এ নির্দিষ্ট বিষয়ে শারী’আহ্ দলিলের অনুসরণ করতে হবে। যেমন: আল্লাহ্ তা’আলা বলেন,   

‘এবং তোমরা যাকাত আদায় কর।’
[সূরা মুয্যাম্মিল: ২০]

যা মূলতঃ যাকাতের ব্যাপারে একটি সাধারণ দলিল। এরপর, এ কাজের শাখাপ্রশাখার ব্যাপারেও দলিল এসেছে। যেমন: নিসাবের পরিমাণ, যাকাত সংগ্রহকারী ব্যক্তিদের বিষয়ে এবং কোন ধরনের মানুষের কাছ থেকে যাকাত আদায় করা হবে ইত্যাদি। এই সমস্ত কর্মকান্ডই ‘তোমরা যাকাত আদায় কর’ এ আয়াত থেকে উৎসারিত হয়েছে। 

কিন্তু, যাকাত সংগ্রহকারী ব্যক্তিবর্গ কোন উপায়ে যাকাত সংগ্রহ করবেন এ ব্যাপারে কোন দলিল পাওয়া যায়নি। যেমন: তারা কি পায়ে হেঁটে সংগ্রহ করবে, না কোন বাহনে চড়ে করবে? তারা কি এ কাজে তাদের সাহায্য করার জন্য কোন কর্মচারী নিযুক্ত করবে? তারা কি কোন রেকর্ড অনুযায়ী তা সংগ্রহ করবে? তারা কি এ কাজের জন্য কোন কার্যালয় প্রতিষ্ঠিত করবে, যেখানে তারা সকলে একত্রিত হবে? তারা কি কোন গুদামঘর তৈরি করবে যেখানে তারা তাদের সংগৃহীত মালামাল জমা করবে? এ স্থাপনাসমূহ কি মাটির নীচে হবে, নাকি শস্য রাখবার ঘরের মতই হবে? নগদ যাকাত কি ব্যাগে নাকি তহবিলে জমা দিতে হবে? বস্তুতঃ এ সমস্ত কাজ ‘এবং তোমরা যাকাত আদায় কর’ এই আয়াত থেকে উৎসারিত এবং এ আয়াতের নির্দেশাধীন কাজ।

সুতরাং, এ সকল কাজই যাকাত আদায়ের সাধারণ দলিল-প্রমাণের আওতাধীন। কারণ, এ সকল কাজের জন্য কোন সুনির্দিষ্ট দলিল-প্রমাণ পাওয়া যায়নি। এছাড়া, এ কাজগুলো আসলে উপায় বা পন্থার সাথে সম্পর্কিত। সুতরাং, কোন কাজ করার উপায় বা পন্থা হচ্ছে সে কাজের অধীনস্থ একটি বিষয়। এ কারণেই কোন কাজের উপায় বা পন্থা নির্ধারণের জন্য কোন নির্দিষ্ট দলিল-প্রমাণের প্রয়োজন হয় না। কারণ, মূল কাজটির ক্ষেত্রে প্রাপ্ত দলিলই এ বিষয়ের দলিল হিসাবে যথেষ্ট হয়।  

সুতরাং, প্রশাসনিক পন্থা বা মাধ্যম যে কোন ব্যবস্থা থেকে গ্রহণ করা যেতে পারে, যদি না কোন সুনির্দিষ্ট শারী’আহ্ দলিলের দ্বারা ঐ বিশেষ পন্থা বা মাধ্যম গ্রহণ করা নিষিদ্ধ বলে প্রমাণিত হয়। এ ধরনের পরিস্থিতি ছাড়া, প্রশাসনিক প্রতিষ্ঠানকে সুষ্ঠ ও সুন্দরভাবে পরিচালনা এবং জনগণের বিষয়সমূহ দেখাশুনা করার জন্য যে কোন পন্থা বা উপায়ে প্রশাসন পরিচালনা করা যায়। এর কারণ হল, প্রশাসন পরিচালনার পন্থা বা উপায় কোন শারী’আহ্ বিধান নয় যার জন্য শারী’আহ্ দলিল প্রয়োজন। এ কারণে, উমর (রা) তাঁর সেনাসদস্য ও নাগরিকদের নামের তালিকা করার প্রয়োজনে দিওয়ান নিযুক্ত করেছিলেন যেন রাষ্ট্রীয় বা গণমালিকানাধীন সম্পদভূক্ত অর্থ থেকে তাদের জন্য বরাদ্দকৃত মজুরী বা বেতনভাতা সুষ্ঠভাবে বিতরণ করা যায়।      

আল হারিস ইবনু নুফায়েলের বরাত দিয়ে ’আবিদ ইবনে ইয়াহিয়া বর্ণনা করেছেন যে, উমর মুসলিমদের সাথে দিওয়ান এর তালিকার ব্যাপারে পরামর্শ করেন। তখন আলী (রা) তাঁকে পরামর্শ দিয়ে বলেন যে, ‘প্রতি বছরের সংগৃহীত সম্পদ না রেখে সবই আপনি বন্টন করে দিন।’ উসমান ইবনে আফফান বলেন, ‘আমি দেখছি যে বড় আকারের সম্পদ জনগণের মাঝে বন্টিত হয়। যারা পেল আর যারা পেল না এদের কোন তালিকা না করা হলে আমার ভয় হয় পরিস্থিতি আওতার বাইরে চলে যাবে।’ এ বিষয়ে আল ওয়ালিদ ইবনু হিশাম ইবনে আল মুগীরা বলেন, ‘আমি আল-শামে ছিলাম এবং লক্ষ্য করেছি যে, সেখানকার বাদশাহ্গণ সৈন্য সংগ্রহের সময় দিওয়ান ব্যবস্থার প্রচলন করেছিল। সুতরাং, আপনি এটার প্রচলন করছেন না কেন?’ তখন উমর তাঁর উপদেশ গ্রহণ করেন এবং কুরাইশ যুবক আকীল ইবনে আবি তালিব, মাখরামা ইবনে নুফায়েল এবং যুবায়ের ইবনে মাতাম’কে ডেকে পাঠান এবং নির্দেশ দেন যে, ‘প্রত্যেক বাড়িতে বাড়িতে গিয়ে জনসংখ্যার তালিকা প্রস্তুত কর।’ 

যখন ইসলাম ইরাকে পৌঁছাল, তখন তহবিল সংগ্রহ ও বেতনভাতা পরিশোধের জন্য দিওয়ান পূর্বের মতই অব্যাহত থাকে। আল-শামের দিওয়ান ছিল ল্যাটিন ভাষায়, কারণ এটি রোমান সাম্রাজ্যের অংশ ছিল; আর, বাগদাদের দিওয়ান ছিল ফারসী ভাষায়, কারণ এটি পারস্য সাম্রাজ্যের অংশ ছিল। খলীফা আব্দুল মালিক ইবন মারওয়ানের সময় আল-শামের দিওয়ান আরবী ভাষায় রূপান্তর করা হয় (৮১ হিজরীতে)। জনগণের স্বার্থরক্ষার নিমিত্তে প্রয়োজন অনুসারে বেশকিছু দিওয়ান চালু করা হয়। সেনাসদস্যদের অর্ন্তভূক্তি ও বরাদ্দকৃত মজ্ঞুরীর প্রয়োজনে সেনাবাহিনীতে দিওয়ানের প্রচলন করা হয় এবং  বিভিন্ন ধরনের ফি ও লেনদেনের দাবি দাওয়ার তালিকা সংরক্ষরণের আরও কিছু দিওয়ানের প্রচলন করা হয়। আরেকটি দিওয়ানের সূচনা করা হয় প্রত্যেক ওয়ালী ও আমীলের নিয়োগ ও পদচ্যুতির তালিকা সংরক্ষণের জন্য। বাইতুল মালের আয় ও ব্যয়ের হিসাব সংরক্ষণের জন্যও দিওয়ানের প্রচলন হয়। দিওয়ানের প্রচলণ হয়েছিল প্রয়োজনের তাগিদে এবং সময়ের আবর্তে এর পন্থায় অনেক পরিবর্তন ও পরিবর্ধন হয়েছে। কারণ, এগুলো হল পন্থা বা মাধ্যম, যা প্রয়োজনের তাগিদে এবং সময়ের সাথে সাথে পরিবর্তন করা অনুমোদিত। 

প্রতিটি দিওয়ানে অন্যান্য কর্মচারীসহ একজন প্রধান নিয়োগ করা হত। কখনো কখনো দিওয়ানের প্রধানকে তার অধীনস্থ কর্মচারী নিয়োগের ক্ষমতা প্রদান করা হত; আবার, কখনো বা তার জন্য তা নিয়োগ করে দেয়া হত। 

এভাবে, প্রশাসনিক কাজ পরিচালনার জন্য প্রয়োজনানুসারে এবং যে পন্থা বা উপায় উক্ত কাজকে সুষ্ঠভাবে পরিচালনা করতে সহায়তা করবে, সে অনুযায়ী দিওয়ান প্রতিষ্ঠা করা যেতে পারে; এবং এক্ষেত্রে বিভিন্ন এলাকা, বা উলাই’য়াহ্ ভেদে বিভিন্ন রকম পন্থা ও উপায় অনুসরণ করা অনুমোদিত।  

সরকারী কর্মচারীদের দায়িত্ব সম্পর্কে বলা যায় যে, একদিকে তারা রাষ্ট্রের বেতনভূক্ত কর্মচারী এবং অন্যদিকে, একইসাথে তারা রাষ্ট্রের নাগরিক। সুতরাং, পেশাগত দিক থেকে তারা তাদের নিজ নিজ বিভাগ বা পরিষদের ব্যবস্থাপকদের কাছে জবাবদিহিতা করতে বাধ্য; আবার, নাগরিক হিসাবে তারা শাসকের কাছে, অর্থাৎ, খলীফা, তার সহকারীবৃন্দ বা ওয়ালীদের কাছেও জবাবদিহিতার ব্যাপারে দায়বদ্ধ। এজন্য তাদের শারী’আহ্ বিধিবিধান এবং প্রশাসনিক নিয়মনীতি সবই মেনে চলতে হবে।

প্রশাসনিক নীতি 

প্রশাসনিক নীতির ভিত্তি হল ব্যবস্থার সহজীকরণ, কাজের গতিশীলতা নিশ্চিত করা এবং প্রশাসকদেও যোগ্যতা নিশ্চিত করা। জনগণের স্বার্থ নিশ্চিত করার স্বাভাবিক প্রক্রিয়ার ভিত্তিতেই এ নীতি গ্রহণ করা হয়েছে। কারণ, যদি কোন ব্যক্তির কর্মসংস্থান বা চাকুরীর প্রয়োজন হয়, তবে তার এ প্রয়োজন যথাসম্ভব দ্রুততার সাথে ও দক্ষ প্রক্রিয়ায় পূরণ করতে হবে। আল্লাহ্’র রাসূল (সা) বলেছেন: 

‘অবশ্যই আল্লাহ্ সবকিছু নিখুঁতভাবে সম্পাদনের নির্দেশ দিয়েছেন; যখন তুমি হত্যা কর, তখন তা সুন্দরভাবে কর এবং যখন জবাই কর তখনও তা সুন্দরভাবে কর।’
(এ হাদীসটি সাদ্দাদ বিন আওসের সূত্রে সহীহ্ মুসলিম বর্ণনা করেছেন, হাদীস নং-১৯৫৫)

সুতরাং, নিখুঁত, পূর্ণাঙ্গ বা সঠিকভাবে কার্যসম্পাদন করা শারী’আহ্ কর্তৃক নির্দেশিত। আর, এ যোগ্যতা অর্জন করতে হলে প্রশাসনকে তিনটি বিষয়ের প্রতি লক্ষ্য রাখতে হবে: 

প্রথমত: প্রশাসনিক ব্যবস্থাকে সহজ-সরল করতে হবে, যেন তা যে কোন প্রক্রিয়াকে দ্রুতগতিসম্পন্ন করে মানুষের জীবনযাত্রাকে সহজতর করে; বিপরীতক্রমে, প্রশাসনিক জটিলতা মানুষের জীবনকে দূর্বিসহ করে। 

দ্বিতীয়ত: লেনদেনের প্রক্রিয়াকে দ্রুতগতিসম্পন্ন করতে হবে, যেন তা জনগণকে অহেতুক বিলম্বজনিত হয়রানি থেকে রক্ষা করে।

তৃতীয়ত: কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের দক্ষতা ও যোগ্যতা নিশ্চিত করতে হবে; কারণ, তাদের যোগ্যতা ও দক্ষতার উপরই নির্ভর করবে কাজের পূর্ণাঙ্গতা ও ফলাফল।

রাষ্ট্রীয় বিভাগে কাজের যোগ্যতা

যে কোন ব্যক্তি, যারা রাষ্ট্রের নাগরিক ও যোগ্য, হোক সে নারী কিংবা পুরুষ, মুসলিম কিংবা অমুসলিম, প্রশাসনের যে কোন বিভাগের পরিচালক বা কর্মচারী হিসাবে নিযুক্ত হতে পারে। 

এ নীতিটি ইজারা বা অর্থের বিনিময়ে নিযুক্ত করা সংশ্লিষ্ট বিধিবিধানের ভিত্তিতে গৃহীত হয়েছে, যেখানে নারী বা পুরুষ, মুসলিম বা অমুসলিম যে কাউকে অর্থের বিনিময়ে নিযুক্ত করা অনুমোদিত। এর কারণ হল ইজারা’র জন্য প্রাপ্ত দলিলপ্রমাণ সার্বজনীন। আল্লাহ্ তা’আলা বলেন: 

‘যদি তারা তোমাদের সন্তানদেরকে স্তন্যদান করে, তবে তাদেরকে প্রাপ্য পারিশ্রমিক দেবে’
[সূরা ত্বালাক: ৬]

এটি হল সার্বজনীন দলিল। 

আবু হুরাইরা থেকে বুখারী বর্ণনা করেছেন যে, রাসূলুল্লাহ্ (সা) বলেছেন,

“আল্লাহ্ বলেছেন, ‘আমি হাশরের ময়দানে তিন ধরনের ব্যক্তিকে কঠিন জবাবদিহিতার মুখোমুখি করব… এবং সে ব্যক্তি যে কাউকে কাজে নিয়োগ দিল, তার কাছ থেকে কাজ আদায় করে নিল কিন্তু, তাকে পারিশ্রমিক দিল না।’
(সহীহ্ বুখারী, হাদীস নং-২২৭)

এই দলিলটিও সার্বজনীন। এছাড়া, আল্লাহ্’র রাসূল (সা) স্বয়ং বনু আল-দীল গোত্রের এক অমুসলিম ব্যক্তিকে রাষ্ট্রের বেতনভূক্ত কর্মচারী হিসাবে নিযুক্ত করেছিলেন, যা প্রমাণ করে যে, মুসলিম নাগরিকের মতো রাষ্ট্রের একজন অমুসলিম নাগরিককেও প্রশাসনে নিযুক্ত করা অনুমোদিত। এছাড়া, এ বিষয়ে দলিলের সার্বজনীনতা প্রমাণ করে যে, পুরুষের মতো একজন নারীকেও এ সমস্ত কাজের জন্য নিয়োগ করা অনুমোদিত। সুতরাং, নারীকে সরকারী কোন বিভাগের পরিচালক বা কর্মচারী যে কোন পদে নিয়োগ দেয়া যেমন অনুমোদিত; তেমনিভাবে, একজন অমুসলিম নাগরিককেও পরিচালক বা কর্মচারী যে কোন পদে নিযুক্ত করা অনুমোদিত। কারণ, এরা সকলেই রাষ্ট্রের বেতনভূক্ত কর্মচারী (শাসক নন) এবং কর্মচারী নিযুক্ত করার সাধারণ দলিল-প্রমাণই এক্ষেত্রে যথেষ্ট।  

বিচার বিভাগ

বাইতুল মাল

Leave a Reply