খিলাফত রাষ্ট্রের কাঠামো ও প্রতিষ্ঠানসমূহ সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনার আগে কিছু বিষয়ে আলোকপাত করা প্রয়োজন:
১. ইসলামে শাসনব্যবস্থা বলতে খিলাফত রাষ্ট্রব্যবস্থাকে বুঝায়, যা এ মহাবিশ্বের প্রতিপালক মহান আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা কর্তৃক নির্ধারিত এবং যেখানে রাষ্ট্রের প্রধান, খলীফা মুসলিমদের বাই’আত মাধ্যমে নিযুক্ত হয়ে থাকেন। এই বিষয়টির অকাট্য দলিল হচ্ছে আল্লাহ’র কিতাব, রাসূল (সা) এর সুন্নাহ্ এবং সাহাবাদের (রা.) ইজ্মা (ঐক্যমত)
আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা পবিত্র কুর’আনে বলেন:
“অতএব, আপনি আল্লাহ্ যা নাযিল করেছেন তা দিয়ে তাদের মাঝে শাসন করুন এবং আপনার কাছে যে মহান সত্য এসেছে, তা পরিত্যাগ করে তাদের প্রবৃত্তির অনুসরণ করবেন না।”
[সূরা আল-মায়িদাহ: ৪৮]
তিনি সুবহানাহু ওয়া তা’আলা আরও বলেন:
“অতএব, আপনি আল্লাহ্ যা নাযিল করেছেন তা দিয়ে তাদের মাঝে শাসন করুন, আর তাদের প্রবৃত্তির অনুসরণ করবেন না এবং তাদের ব্যাপারে সতর্ক থাকুন; যেন তারা আপনার নিকট আল্লাহ’র প্রেরিত কোন বিধান থেকে আপনাকে বিচ্যুত করতে না পারে।”
[সূরা আল-মায়িদাহ: ৪৯]
রাসূল (সা) এর প্রতি আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা প্রদত্ত শাসন সংক্রান্ত এই নির্দেশনা তাঁর উম্মাহ্’র প্রতিও সমভাবে প্রযোজ্য। এর অর্থ হল উম্মাহ্কে অবশ্যই রাসূল (সা) এর পরে এমন একজন শাসক নিযুক্ত করতে হবে যিনি আল্লাহ’র কিতাব অনুযায়ী শাসনকার্য পরিচালনা করবেন। উসূল-উল-ফিকহ্ (Islamic Jurisprudence) এর নীতি অনুসারে এই আদেশের ভাষা অকাট্য (Decisive) যা থেকে বোঝা যায় যে, নির্দেশটি অবশ্য পালনীয় অর্থাৎ ফরয।
রাসূল (সা) এর পর”আল্লাহ’র আইন দ্বারা মুসলিমদের শাসনকার্য পরিচালনার জন্য যাকে নিয়োগ করা হবে তিনিই খলীফা। একইভাবে সেই শাসন পদ্ধতির নাম হল খিলাফত। এছাড়া, এ ব্যাপারে আরও যে দলিল-প্রমাণ উপস্থাপন করা যায় তা হল, ইসলামী শারী’আহ্ অনুযায়ী আইনী শাস্তির বিধি-বিধান (হুদুদ) এবং অন্যান্য শারী’আহ্ আইন (আহ্কাম) বাস্তবায়ন করা মুসলিমদের জন্য ফরয। আর এটা সর্বজনবিদিত যে, একজন শাসক ছাড়া হুকুম-আহকাম বা শাস্তির বিধিবিধান কোনকিছুই বাস্তবায়ন করা সম্ভব নয়। হুকুম শারী’আহ্ ’র মূলনীতি অনুযায়ী কোন ফরয বাস্তবায়নের পূর্বশর্ত সমূহ যেহেত ফরয, সেহেতু ইসলামী আইন বাস্তবায়ন কবার ব্যাপারে কর্তৃত্বশীল একজন শাসক নিযুক্ত করাও ফরয। এক্ষেত্রে, শাসক হলেন খলীফা এবং শাসন ব্যবস্থাটির নাম হল খিলাফত।
সুন্নাহ্ ভিত্তিক দলিল-প্রমাণের দিকে আমরা আলোকপাত করলে দেখতে পাই, আব্দুল্লাহ্ বিন উমর (রা.) বলেছেন, “আমি রাসূল (সা) কে বলতে শুনেছি,
“যে আনুগত্যের শপথ (বাই’আত) থেকে তার হাত ফিরিয়ে নেয়, কিয়ামতের দিন আল্লাহ্ তার সাথে এমনভাবে সাক্ষাৎ করবেন যে, ঐ ব্যক্তির পক্ষে কোন দলিল থাকবে না এবং যে ব্যক্তি এমন অবস্থায় মৃত্যুবরণ করবে যে, যখন তার কাঁধে কোন আনুগত্যের শপথ নেই, তবে তার মৃত্যু হবে জাহেলি যুগের মৃত্যু।”
(সহীহ্ মুসলিম, হাদীস নং-১৮৫১)
রাসূল (সা) প্রত্যেক মুসলিমের উপর বাই’আত শপথকে বাধ্যতামূলক করে দিয়েছেন। যে বাই’আত (আনুগত্যের শপথ) ছাড়া মৃত্যুবরণ করে তিনি (সা) তার মৃত্যুকে ইসলামপূর্ব অজ্ঞানতার (জাহেলিয়াতের) যুগের মৃত্যু হিসাবে বর্ণনা করেছেন। রাসূল (সা) এর পরে কেবলমাত্র খলীফাকেই বাই’আ দেয়া যায়। যেহেতু হাদীসটি প্রত্যেক মুসলিমের কাঁধে বাই’আত শপথ থাকাকে বাধ্যতামূলক করে দিয়েছে, তাই একইসাথে এ হাদীসটি মুসলিমদের উপর একজন খলীফা নিযুক্ত করাকেও বাধ্যতামূলক করেছে।
আবু হুরায়রা (রা.) থেকে আল-আরাজ ও সেই সূত্রে ইমাম মুসলিম বর্ণনা করেন, রাসূল (সা) বলেছেন,
“নিশ্চয়ই, ইমাম হচ্ছেন ঢাল স্বরূপ যার পেছনে থেকে মুসলিমরা যুদ্ধ করে এবং যার মাধ্যমে নিজেদেরকে রক্ষা করে।”
(সহীহ্ মুসলিম, হাদীস নং-১৮৪১)
আবু হাজিমের বরাত দিয়ে ইমাম মুসলিম আরও বর্ণনা করেন যে, আমি আবু হুরায়রার সাথে পাঁচ বছর অতিবাহিত করেছি
এবং তাঁকে বলতে শুনেছি, রাসূল (সা) বলেছেন,
“বনী ইসরাইলকে শাসন করতেন নবীগণ। যখন এক নবী মৃত্যুবরণ করতেন তখন তাঁর স্থলে অন্য নবী আসতেন, কিন্তু আমার পর আর কোনও নবী নেই। শীঘ্রই অনেক সংখ্যক খলীফা আসবেন। তাঁরা (রা.) জিজ্ঞেস করলেন তখন আপনি আমাদের কী করতে আদেশ করেন? তিনি (সা) বললেন, তোমরা একজনের পর একজনের বাই’আতপূর্ণ করবে, তাদের হক আদায় করবে। অবশ্যই আল্লাহ্ (সুবহানাহু ওয়া তা’আলা) তাদেরকে তাদের উপর অর্পিত দায়িত্বের ব্যাপারে জবাবদিহি করবেন।”
(সহীহ্ বুখারী, হাদীস নং-৩৪৫৫; সহীহ্ মুসলিম, হাদীস নং-৪৭৫০)
প্রথম হাদীসে খলীফাকে ঢাল হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে, যেখানে ‘ঢাল শব্দটি নিরাপত্তা বা আত্মরক্ষার প্রতীক হিসাবে উল্লেখিত হয়েছে। মূলতঃ এ হাদীসে ইমামকে ‘ঢাল’ হিসেবে বর্ণনা করে ইমামের উপস্থিতির বিষয়টিকে প্রশংসা করা হয়েছে এবং সেইসাথে, ইমামের উপস্থিতির ব্যাপারে অনুরোধ (তালাব) জানানো হয়েছে। হুকুম শারী’আহ্’র নীতি অনুযায়ী যখন আল্লাহ্ এবং তাঁর রাসূল (সা) আমাদেরকে এমন কোন কাজের ব্যাপারে অবহিত করেন যার সাথে তিরষ্কার সূচক শব্দ ব্যবহৃত হয়, তখন ধরে নেয়া হয় যে মুসলিমদের সে কাজ থেকে বিরত থাকতে বলা হয়েছে। বিপরীতভাবে কুর’আনের কোনও আয়াত বা রাসূলের (সা) কোনও হাদীসে যদি কোনও কোন কাজের ব্যাপারে প্রশংসা সূচক শব্দ উল্লেখিত হয়, তবে ধরে নেয়া হয় যে, মুসলিমদের সে কাজটি করতে উৎসাহিত বা আদেশ করা হয়েছে। আর, এ কাজটি যদি”আল্লাহ’র কোন আদেশ বাস্তবায়নের জন্য অবশ্য পালনীয় হয় কিংবা, এ কাজে অবহেলা প্রদর্শন করলে যদি”আল্লাহ’র কোন আদেশ লঙ্ঘিত হয়, তাহলে এটি অকাট্য আদেশ (Decisive Command) বা অবশ্য পালনীয় কাজ হিসাবে গৃহীত হয়। এই হাদীসগুলো থেকে আমরা এটাও জানতে পারি যে, মুসলিমদের বিভিন্ন বিষয় দেখাশুনার দায়িত্ব হচ্ছে খলীফাদের – যা কিনা প্রকৃতপক্ষে মুসলিমদের উপর একজন খলীফা নিয়োগ করার ব্যাপারটিকেই নির্দেশ করে। এছাড়া,”আল্লাহ’র রাসূল (সা) মুসলিমদের খলীফার আনুগত্য করার নির্দেশ দিয়েছেন এবং খলীফার কর্তৃত্বকে চ্যালেঞ্জ করে কেউ তার সাথে বিরোধে লিপ্ত হলে তার সাথে যুদ্ধ করার নির্দেশ দিয়েছেন, যা প্রকৃতঅর্থে একজন খলীফা নিয়োগ করার বাধ্যবাধকতা ও তার খিলাফতকে যুদ্ধের মাধ্যমে হলেও রক্ষা করারই একটি নির্দেশ। আব্দুল্লাহ্ বিন আমর বিন আল আস (রা.) হতে ইমাম মুসলিম বর্ণনা করেন, রাসূল (সা) বলেছেন,
“যখন একজন ইমামের হাতে বাই’আত গ্রহণ সম্পূর্ণ হয়ে যায় তখন তাকে যথাসাধ্য মান্য করবে, এমতাবস্থায় যদি কেউ তার সাথে বিরোধ করতে আসে ( বাই’আত দাবি করে) তবে দ্বিতীয় জনকে হত্যা করবে।”
(সহীহ্ মুসলিম, হাদীস নং-১৮৪৪)
অতএব, খলীফার আনুগত্যের আদেশটি প্রকৃতপক্ষে একজন খলীফা নিয়োগ করার আদেশ, কারণ একজন খলীফা উপস্থিত না থাকলে খলীফাকে মান্য করার আদেশটি রহিত হয়ে যায়। আর, যারা খলীফার সাথে দ্বন্দে লিপ্ত হয় তাদের সাথে যুদ্ধ করার আদেশটি মূলতঃ একজন খলীফার উপস্থিতির বাধ্যবাধকতার বিষয়ে বর্ধিত দলিল-প্রমাণ উপস্থাপন করে।
আর সাহাবীদের ইজ্মার বিষয়ে বলা যায় যে, তাঁরা (রা) রাসূল (সা) এর মৃত্যুর পর তাঁর (সা) উত্তরাধিকারী হিসেবে একজন খলীফা নিয়োগের প্রয়োজনীয়তার ব্যাপারে ঐকমত্যে পৌঁছেছিলেন। তাঁরা সকলেই আবু বকর (রা) কে রাসূল (সা) এর উত্তরাধিকারী হিসেবে এবং আবু বকর (রা.) এর মৃত্যুর পর তাঁর উত্তরাধিকারী হিসেবে উমর (রা.) কে নিয়োগ করেন। পরবর্তীতে একইভাবে, তাঁরা উসমান (রা.) এর মৃত্যুর পর আলী (রা.) কে তাঁর উত্তরাধিকারী হিসাবে নিয়োগ করেন। মুসলিমদের উপর একজন খলীফা নিয়োগের ব্যাপারে সাহাবীদের (রা.) ঐক্যমত রাসূল (সা) এর মৃত্যুর পরপরই খুব জোরালোভাবে প্রকাশিত হয়েছিল। আর, এ কারণেই তাঁরা (রা.) রাসূল (সা) এর দাফনকার্য সম্পাদন করার চাইতেও খলীফা নিয়োগের বিষয়টিকে বেশী গুরুত্ব দিয়েছিলেন। যদিও তাঁদের প্রত্যেকেরই এটা জানা ছিল যে, যে কোন ব্যক্তির মৃত্যুর পর যত শীঘ্র সম্ভব তাঁর দাফনকার্য সম্পন্ন করা মুসলিমদের জন্য অবশ্য পালনীয় কাজ।
রাসূল (সা) এর মৃত্যুর পর সাহাবাদের (রা.) উপর সর্বপ্রথম বাই’আত রাসূল (সা) এর দাফন কার্য সম্পন্ন করা ফরয ছিল; কিন্তু তা না করে তাঁরা (রা.) মুসলিমদের প্রথম খলীফা নির্বাচনে ব্যস্ত ছিলেন। অন্যান্য সাহাবারা (রা.) নীরব থেকে রাসূল (সা) এর দাফন কার্য ২ রাত বিলম্ব করার ব্যাপারে সম্মতি দিয়েছিলেন, যদিও তাঁদের বাই’আত রাসূল (সা) এর দাফন কার্য শীঘ্রই সম্পন্ন করার সু্যোগ ও সামর্থ্য ছিল। রাসূল (সা) সোমবার সকালের শেষার্ধে ইন্তেকাল করলেন। কিন্তু, সেদিন সমস্ত দিন, এমনকি রাতেও তাঁকে দাফন করা হল না। মঙ্গলবার রাতে, আবু বকর (রা.) কে বাই’আত দিয়ে
খলীফা নিযুক্ত করার পর, বাই’আত রাসূল (সা) এর দাফন কার্য সম্পন্ন করা হল। সুতরাং, রাসূল (সা) এর দাফন দুই রাত্রি বিলম্বিত হয়েছিল এবং তাঁর দাফন কার্য সম্পাদন হবার পূর্বেই আবু বকর (রা.) কে বাই’আত দেয়া হয়েছিল।
সুতরাং, মৃতব্যক্তিকে দাফন না করে তার পূর্বে খলীফা নিয়োগে ব্যস্ত থাকার এই কাজটি সকল সাহাবাদের (রা.) সম্মিলিত ঐক্যমতের (ইজমা আস-সাহাবা) একটি গুরুত্বপূর্ণ দলিল। যদি না মুসলিমদের উপর একজন খলীফা নিয়োগ করা বাধ্যতামূলক হত এবং মৃতব্যক্তির দাফন কার্য হতে খলীফা নিয়োগের ব্যাপারটি অধিক গুরুত্বপূর্ণ হত, তবে সকল সাহাবীরা (রা.) সম্মিলিতভাবে এ বিষয়ে কখনোই ঐক্যমতে পৌঁছাতেন না।
এছাড়া, মুসলিমদের উপর একজন খলীফা নিয়োগ করা যে ফরয (বাধ্যতামূলক) এ ব্যাপারে সকল সাহাবাই (রা.) সারাজীবন সম্মতি প্রকাশ করেছেন। যদিও কাকে খলীফা নির্বাচিত করা হবে এ ব্যাপারে তাঁদের মধ্যে মতপার্থক্য ছিল; কিন্তু একজন খলীফা যে নিয়োগ করতে হবে এ ব্যাপারে তাঁদের মধ্যে কোন মতবিরোধ ছিল না – হোক তা রাসূল (সা) এর মৃত্যুর পর কিংবা খোলাফায়ে রাশেদীনদের মৃত্যুর পর। সুতরাং, খলীফা নিয়োগের ব্যাপারে সাহাবাদের (রা.) এই সম্মিলিত ঐক্যমত সুস্পষ্টভাবে প্রমাণ করে যে, মুসলিমদের উপর একজন খলীফা নিয়োগ করা ফরয বা বাধ্যতামূলক।
২. বর্তমান বিশ্বে প্রচলিত যে শাসনব্যবস্থাগুলো আছে, এগুলো তাদের ভিত্তি, চিন্তা, ধ্যান-ধারণা, মাপকাঠি, গঠন, এমনকি যে বিধিবিধান দিয়ে এ ব্যবস্থাগুলো তাদের কার্যাবলী পরিচালনা করে এবং যে সংবিধান ও আইন-কানুনের মাধ্যমে এ ব্যবস্থাগুলো তাদের বিধিবিধানগুলো বাস্তবায়ন ও কার্যকর করে – এ সমস্ত দিক থেকেই ইসলামী শাসনব্যবস্থা (খিলাফত) থেকে সম্পূর্ণ আলাদা।
খিলাফতের শাসন কাঠামো রাজতান্ত্রিক নয়:
খিলাফত কোন রাজতান্ত্রিক ব্যবস্থা নয় কিংবা এর সাথে সাদৃশ্যপূর্ণও নয়। রাজতান্ত্রিক ব্যবস্থায় রাজপুত্র উত্তরাধিকার সূত্রে বাদশাহ্ হয় যেখানে সাধারণ জনগণের বলার কিছু থাকে না। অন্যদিকে, খিলাফত শাসনব্যবস্থায় খলীফা নিয়োগ করার পদ্ধতি হল বাই’আত। রাজতান্ত্রিক ব্যবস্থায় রাজা-বাদশাহ্দের জন্য রয়েছে বিশেষ সুবিধা, যে কারণে সে নিজেকে সকল আইনের উর্ধ্বে রাখতে পারে। কিছু রাজতান্ত্রিক ব্যবস্থায় বাদশাহ্কে জাতির প্রতীক হিসাবে বিবেচনা করা হয়, যেখানে সে রাজ্যের মালিক কিন্তু শাসক নয়। আবার কিছু রাজতান্ত্রিক ব্যবস্থায় সে মালিক এবং একইসাথে রাজ্যের শাসকও; যেখানে সে তার রাজ্য ও জনগণকে তার ইচ্ছামত শাসন করে। জনগণের উপর অত্যাচার, নির্যাতন ও দুঃশাসনের মাত্রা যত ভয়াবহ হোক না কেন, এদুটি ক্ষেত্রেই সে সকল প্রকার জবাবদিহিতার উর্ধ্বে। অপরদিকে, খিলাফত রাষ্ট্রব্যবস্থা খলীফাকে বিশেষ কোন অধিকার প্রদান করে না – যা তাকে রাজতান্ত্রিক ব্যবস্থার মত জনগণের উপরে স্থান দেয়। না এ ব্যবস্থায় তিনি এমন কোন অধিকার প্রাপ্ত হন যাতে বিচার বিভাগের সামনে তাকে সাধারণ জনগণ থেকে আলাদা কোন মানুষ হিসাবে বিবেচনা করা হয়। এছাড়া, রাজতান্ত্রিক ব্যবস্থার মত তিনি জাতির কাছে কোন প্রতীকও নন। বরং, তিনি শাসন ও কর্তৃত্বের দিক থেকে জনগণের একজন প্রতিনিধি। যার অর্থ হচ্ছে, উম্মাহ্ (জনগণ) তাকে নির্বাচিত করেছে এবং বাই’আত মাধ্যমে স্বেচ্ছায় নিয়োগ দিয়েছে, যেন তিনি আল্লাহ্ প্রদত্ত আইন দিয়ে তাদের শাসন করেন। খলীফার সমস্ত কাজ, সিদ্ধান্ত এবং জনগণের স্বার্থসংশিষ্ট বিষয়সমূহ দেখভাল করার প্রক্রিয়া সম্পূর্ণভাবে আল্লাহ্ প্রদত্ত সীমারেখা দ্বারা নির্ধারিত।
খিলাফত রাষ্ট্রের শাসনব্যবস্থা সাম্রাজ্যবাদী ব্যবস্থার অনুরূপ নয়:
সাম্রাজ্যবাদ ইসলামের সাথে পুরোপুরি সাংঘর্ষিক। ইসলামী শাসনব্যবস্থায় জাতি ও বর্ণভেদে এ বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলের মানুষেরা শাসিত হয়েছে। যদিও এ অঞ্চলগুলো সবসময় একটি কেন্দ্রের সাথে যুক্ত ছিল, কিন্তু তা সত্ত্বেও এটি সাম্রাজ্যবাদী ব্যবস্থার অনুরূপ ছিল না। সাম্রাজ্যবাদীরা তাদের অধীনস্থ বিভিন্ন জাতি ও বর্ণের জনগোষ্ঠীকে কখনও এক দৃষ্টিতে দেখেনা। বরং, তারা শাসন, অর্থায়ন এবং ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্রে সবসময় কেন্দ্রকে গুরুত্ব দিয়ে থাকে। ইসলামী শাসনব্যবস্থার লক্ষ্য হচ্ছে এর অধীনস্থ সকল অঞ্চলের জনগণের মাঝে সমতা তৈরী করা। ইসলাম গোত্রবাদকে প্রত্যাখান করেছে এবং শারী’আহ্ আইন অনুযায়ী রাষ্ট্রের অমুসলিম জনগোষ্ঠীকে পরিপূর্ণ নাগরিক অধিকার দিয়েছে ও সেইসাথে তাদের নাগরিক কর্তব্য নির্ধারণ করেছে। স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার ক্ষেত্রে ইসলাম অমুসলিমদেরকেও মুসলিমদের মতোই জবাবদিহিতার সম্মুখীন করেছে। ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে রাষ্ট্রের প্রতিটি নাগরিককে ইসলামী রাষ্ট্র সমান
নাগরিক সুবিধা প্রদান করেছে। বিপরীতভাবে, ইসলামী রাষ্ট্রের বাইরে বসবাসরত মুসলিমদেরকে ইসলামী রাষ্ট্র নাগরিক সুবিধা প্রদান থেকে বিরত থেকেছে। সকল নাগরিককে সমান অধিকার প্রদানের দিক থেকে ইসলামী শাসনব্যবস্থা সাম্রাজ্যবাদী ব্যবস্থা থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন। সাম্রাজ্যবাদী রাষ্ট্রগুলো তাদের ক্ষমতাকে সুসংহত করার লক্ষ্যে বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলে উপনিবেশ (Colony)স্থাপন করে সে অঞ্চলসমূহকে শোষণ করে কেন্দ্রকে ক্রমাগত শক্তিশালী করে। অপরদিকে, খিলাফত রাষ্ট্র কখনই তার অধীনস্থ অঞ্চলসমূহকে উপনিবেশ হিসেবে দেখে না এবং এ অঞ্চলগুলো থেকে ধনসম্পদ লুটপাট করে কেন্দ্রকেও সম্পদশালী করে না। বরং খিলাফত রাষ্ট্র সব অঞ্চলকে সমান গুরুত্ব দিয়ে দেখে, তা কেন্দ্র থেকে যত দূরেই অবস্থিত হোক না কেন, কিংবা, সে অঞ্চলের মানুষ যে বর্ণেরই হোক না কেন। এ রাষ্ট্র প্রতিটি অঞ্চলকে রাষ্ট্রের অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে বিবেচনা করে এবং প্রতিটি অঞ্চলের জনগণ কেন্দ্রে বসবাসকারী নাগরিকের মতই সমান নাগরিক সুবিধা ভোগ করে। একই সাথে, এ রাষ্ট্র এর অধীনস্থ সকল অঞ্চলে একই শাসন কর্তৃত্ব, কাঠামো এবং আইন-কানুন প্রয়োগ করে।
খিলাফত ফেডারেল রাষ্ট্রও নয়:
খিলাফত রাষ্ট্রব্যবস্থা ফেডারেল রাষ্ট্রব্যবস্থার মতোও নয়, যেখানে রাষ্ট্রের বিভিনড়ব অঞ্চলসমূহ স্বায়ত্বশাসন ভোগ করে এবং সাধারণ কিছু আইনকানুন দিয়ে ঐক্যবদ্ধ থাকে। প্রকৃত অর্থে, খিলাফত একটি ঐক্যবদ্ধ ব্যবস্থা। যেখানে পশ্চিমের মারাকেশ পূর্বের খোরাসানের মতই সমান গুরুত্ব সহকারে বিবেচিত হয়। আবার, আল ফায়ূম প্রদেশ কায়রোর মতই বিবেচিত হয় – যদিও বা এটা হয় ইসলামী রাষ্ট্রের রাজধানী। এ রাষ্ট্রে সব অঞ্চলের জন্য সমানভাবে অর্থায়ন করা হবে, একইভাবে নির্ধারণ করা হবে বাজেট। প্রতিটি প্রদেশের জন্য ন্যায্যভাবে এবং প্রয়োজন অনুযায়ী বাজেট বরাদ্দ করা হবে। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, যদি কোন প্রদেশ হতে সংগৃহীত ট্যাক্স উক্ত প্রদেশের প্রয়োজনের দ্বিগুণ হয়, তাহলেও ঐ প্রদেশের প্রয়োজন অনুযায়ীই ব্যয় নির্ধারণ করা হবে, উক্ত প্রদেশ থেকে কতটুকু ট্রাক্স সংগৃহীত হল তার উপর নির্ভর করে নয়। আবার, অন্য কোন প্রদেশের সংগৃহীত ট্যাক্স যদি প্রয়োজনীয় ব্যয়ের চাইতে কম হয়, তাহলে সাধারণ বাজেট থেকে ঐ প্রদেশের ব্যয় মেটানো হবে; সে প্রদেশের ট্যাক্স যাই সংগৃহীত হোক না কেন।
খিলাফত প্রজাতান্ত্রিক (Republic) ব্যবস্থা নয়:
রাজতান্ত্রিক ব্যবস্থার নিষ্ঠুর আচরণের ফলস্বরূপ প্রজাতান্ত্রিক ব্যবস্থার উদ্ভব হয়, যেখানে রাজা-বাদশাহরা ছিল স্বাধীন, সার্বভৌম ও স্বেচ্ছাচারী এবং তারা নিজেদের ইচ্ছানুযায়ী রাজ্য ও জনগণকে শাসন করত। সুতরাং, রাজতন্ত্রে রাজার ইচ্ছাই ছিল আইন। প্রজাতান্ত্রিক ব্যবস্থা গণতন্ত্রের মাধ্যমে জনগণের কাছে সার্বভৌমত্ব ও কর্তৃত্ব হস্তান্তরের চেষ্টা চালায়। ফলে, মানুষ আইন প্রণয়ন করতে শুরু করে এবং সেইসাথে, জনগণ তাদের ইচ্ছানুযায়ী যে কোনকিছু অনুমোদন ও নিষিদ্ধ করার ক্ষমতা প্রাপ্ত হয়। এ ব্যবস্থায় শাসন-কর্তৃত্ব বাস্তবিকভাবে প্রজাতন্ত্রের প্রেসিডেন্ট, তার কেবিনেট বা মন্ত্রী পরিষদের হাতে ন্যস্ত হয়। কিছু কিছু ক্ষেত্রে শাসন-কর্তৃত্ব প্রধানমন্ত্রী ও তার কেবিনেটের হাতে অর্পণ করা হয় এবং এক্ষেত্রে, রাজা বা রাণীকে নেহায়েত প্রতীক হিসাবে ব্যবহার করা হয়।
উপরে বর্ণিত প্রতিটি (প্রজাতান্ত্রিক) ব্যবস্থা থেকে ইসলামী শাসনব্যবস্থা সম্পূর্ণ আলাদা। ইসলামে মানুষের আইন তৈরির কোন অধিকার নেই। এ অধিকার শুধুমাত্র আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়া তা’আলার। আল্লাহ্ ছাড়া আর কারো কোন ব্যাপারে অনুমতি প্রদান বা নিষেধাজ্ঞা জারি করার ক্ষমতা নেই। ইসলামী দৃষ্টিকোন থেকে মানুষকে আইন প্রণয়নের ক্ষমতা প্রদান করা অত্যন্ত ভয়াবহ অপরাধ। পবিত্র কুর’আনে আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়া তা’আলার। বলেন:
“তারা আল্লাহ’র পরিবর্তে তাদের ধর্মযাজক ও সাধুদেরকে নিজেদের প্রভূ বানিয়ে নিয়েছে।”
[সূরা আত-তাওবা: ৩১]
রাসূল (সা) এই আয়াতের ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে বলেছেন, বনী ইসরাইলীরা তাদের ধর্মযাজক ও সাধুদের হাতে আইন প্রণয়নের ক্ষমতা দিয়েছিল, যা তাদের কাছে প্রেরিত আল্লাহ’র বিধানের বিপরীত ছিল। অর্থাৎ, তাদের ধর্মযাজকেরা যে কাজকে অনুমোদন দিত তারা তাই করতো, আর যার উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করতো তারা তা থেকে বিরত থাকতো। এটাই হচ্ছে আল্লাহ’র পরিবর্তে তাদের (ধর্মযাজকদের) প্রভু হিসাবে মেনে নেয়ার অর্থ। ইসলামে আল্লাহ’র পরিবর্তে কাউকে প্রভু হিসাবে গ্রহণ করাকে শিরক বলা হয়, যা কিনা ভয়ঙ্কর অপরাধ হিসাবে বিবেচিত হয়।
সুতরাং, উপরোক্ত আয়াতটি সেই সমস্ত মানুষের ভয়ঙ্কর অপরাধের দিকে নির্দেশ করছে যারা আল্লাহ’র আইন অনুসরণের পরিবর্তে নিজেদের হাতে আইন প্রণয়ের ক্ষমতা তুলে নিয়েছে। আদি ইবনে হাতিমের রেওয়াতে তিরমিযী বর্ণনা করেন,
“আমি একদিন একটি স্বর্ণের ক্রস গলায় ঝুলানো অবস্থায় রাসূলুল্লাহ (সা) এর নিকট উপস্থিত হলাম। তিনি (সা) বললেন, ‘হে আদি! এই মূর্তিকে ছুঁড়ে ফেলে দাও।’ তখন আমি তাঁকে (সা) পবিত্র কালামের এই আয়াতটি তিলাওয়াতকরতে শুনেছি যে, তারা আল্লাহ’র পরিবর্তে তাদের ধর্মযাজক ও সাধুদের নিজেদের প্রভু বানিয়ে নিয়েছে। অতঃপর রাসূল(সা) বললেন, “তারা এইসব আলেম ও দরবেশদের উপাসনা করে না; কিন্তু, (আল্লাহ্’র পক্ষ থেকে) তাদের জন্য যা নিষিদ্ধ করা হয়েছিল, তারা (ধর্মযাজকেরা) তাদের জন্য তা হালাল করেছে। আর, তাদের জন্য যা হালাল করা হয়েছিল তারা (ধর্মযাজকেরা) তাদের জন্য তা নিষিদ্ধ করেছে।” (সূনানে তিরমিযী, হাদীস নং-৩০৯৫)
বস্তুতঃ ইসলাম মন্ত্রী পরিষদ দ্বারা শাসিত কোন ব্যবস্থা নয় – যেখানে মন্ত্রীদের রয়েছে নির্দিষ্ট ক্ষমতা ও পৃথক বাজেট। এই ধরনের ব্যবস্থায় (প্রজাতন্ত্রে) সাধারণত এতবেশী প্রশাসনিক জটিলতা (red tape) থাকে, যে কারণে এক মন্ত্রনালয়ের উদ্বৃত্ত বাজেট সহজে অন্য মন্ত্রনালয়ে স্থানান্তরিত হয় না; যা জনগণের সমস্যার সমাধানের ক্ষেত্রে অনেক প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করে। তাছাড়া, এক বিষয়ে একাধিক মন্ত্রনালয়ের হস্তক্ষেপের ফলে অনেক জটিলতার সৃষ্টি হয়। অথচ জনগণের স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়সমূহকে একটি একক প্রশাসনিক কাঠামোর আওতায় নিয়ে আসলে খুব সহজেই এসব সমস্যা এড়ানো সম্ভব হয়।
রিপাবলিকান বা প্রজাতান্ত্রিক ব্যবস্থায় শাসনকার্য পরিচালনার দায়িত্ব বিভিনড়ব মন্ত্রীদের মধ্যে ভাগ করে দেয়া হয় এবং প্রতিটি মন্ত্রনালয়ের মন্ত্রীগণ একত্রিত হয়ে একটি মন্ত্রী পরিষদ গঠিত হয়। এভাবে সম্মিলিতভাবে মন্ত্রী পরিষদের মাধ্যমে শাসনকার্য পরিচালনা করা হয়। ইসলামী রাষ্ট্রব্যবস্থায় প্রজাতন্ত্রের মতো কোন মন্ত্রীপরিষদ নেই যারা কিনা সম্মিলিতভাবে শাসনকার্য পরিচালনা করে। বরং, এখানে খলীফাকে জনগণ”আল্লাহ’র কিতাব ও রাসূল (সা) এর সুনড়বাহ্ অনুসারে শাসন করার জন্য বাই’আত দিয়ে থাকে। তবে, এক্ষেত্রে খলীফা তার গুরুভার লাঘব করার জন্য প্রতিনিধিত্বকারী সহকারী (Delegated Assistants) নিয়োগ করতে পারেন। এদের আক্ষরিক অর্থেই খলীফার সহকারী হিসাবে বিবেচনা করা হয়, যারা খিলাফতের গুরুদায়িত্ব পালনে খলীফাকে সহায়তা করেন।
খিলাফত গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা নয়:
জনগণকে আইন প্রণয়নের ক্ষমতা প্রদানের দিক থেকে বিবেচনা করলে বলা যায় যে, খিলাফত রাষ্ট্রব্যবস্থা গণতান্ত্রিক নয়; যেখানে জনগণই তাদের ইচ্ছানুযায়ী কোন বিষয়কে অনুমোদন দেয়, নিষিদ্ধ করে, উৎসাহিত করে কিংবা তিরস্কার করে। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা কোন অবস্থাতেই শারী’আহ্ আইনের কাছে দায়বদ্ধ নয়। বরং, তাদের আইনু-কানুনের মূলভিত্তি হচ্ছে ব্যক্তিস্বাধীনতা (freedom) । অবিশ্বাসীরা জানে যে, মুসলিমরা গণতন্ত্রকে এর প্রকৃত চেহারায় গ্রহণ করবে না। এ কারণে সাম্রাজ্যবাদী শক্তি, বিশেষ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, একথা বলে মুসলিম বিশ্বে গণতন্ত্রের বিস্তার ঘটাতে চেয়েছে যে, গণতন্ত্র শুধুমাত্র শাসক নির্বাচনের একটি পদ্ধতি। এভাবেই তারা মুসলিম উম্মাহ্কে প্রতারিত করেছে এবং উম্মাহ্কে শাসনব্যবস্থা হিসাবে গণতন্ত্রকে মেনে নিতে প্ররোচিত করেছে। যেহেতু মুসলিম দেশসমূহ ইতিমধ্যে প্রকৃত রাজতান্ত্রিক কিংবাপ্রজাতান্ত্রিক ব্যবস্থার মোড়কে বিভিনড়ব স্বৈরশাসকদের স্বৈরাচারী শাসনের নীচে নানাভাবে অত্যাচার-নির্যাতনের শিকার হচ্ছে এবং সেইসাথে, মুসলিম বিশ্বে জনগণের আবেগ-অনুভূতিকে প্রচন্ডভাবে অবদমিত রাখা হয়েছে, তাই এ ভূমিগুলোতে নতুন শাসক নির্বাচনের পদ্ধতি হিসাবে গণতন্ত্রের বিস্তার ঘটানো সহজ। এভাবেই তারা গণতন্ত্রের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিক সম্পর্কে আলোচনাকে সযতেড়ব এড়িয়ে গেছে – যা হচ্ছে স্রষ্টার পরিবর্তে তাঁর সৃষ্ট মানুষকে আইন প্রণয়নের ক্ষমতার বিষয়টি।
দূর্ভাগ্যবশত কিছু ইসলামী শাস্তি বিদ, যাদের মধ্যে কিছু উলামাও আছেন, তারা সৎ কিংবা অসৎ নিয়তে এই প্রতারণার ফাঁদে পা দিয়েছেন। যদি তাদের কাছে গণতন্ত্র সম্বন্ধে জানতে চাওয়া হয়, তাহলে তারা বলেন এটা শাসক নির্বাচন করার একটি পদ্ধতি মাত্র। আর, এদের মধ্যে যারা অবিশ্বাসীদের মতোই মুসলিমদের সাথে প্রতারণা করতে চায়, তারা গণতান্ত্রিক মতবাদ প্রচার-প্রসারের ক্ষেত্রে গণতন্ত্রের প্রকৃত অর্থটি এড়িয়ে গিয়েই এ বিষয়ে জনগণকে তথ্য প্রদান করে। তারা এ বিষয়ে আলোচনা সবসময় পরিহার করতে চায় যে, গণতন্ত্রের প্রকৃত অর্থ হচ্ছে মানুষকে সার্বভৌমত্ব প্রদান করা, মানুষের হাতে আইন প্রণয়নের ক্ষমতা অর্পণ করা, সংখ্যা গরিষ্ঠের ইচ্ছানুযায়ী আইন প্রণয়ন করা; এমনকি সংখ্যাগরিষ্ঠের
ইচ্ছানুযায়ীই যে কোন বিষয়ে অনুমোদন, নিষেধাজ্ঞা, উৎসাহ প্রদান কিংবা তিরষ্কার করা। এ সকল গুরুত্বপূর্ণ আলোচনার পরিবর্তে এ মতবাদের প্রচারকরা শুধুমাত্র নির্বাচনের বিষয়টি জনসম্মুখে তুলে ধরে।
গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় একজন ব্যক্তিকে তার ইচ্ছানুযায়ী যা খুশী তাই করার জন্য অবশ্যই স্বাধীন হতে হবে (তা না হলে সে সার্বভৌম হবে কিভাবে?) অতএব, এ ব্যবস্থায় সে চাইলে মদ পান করতে পারে, যিনাহ্ করতে পারে, ধর্মত্যাগ করতে পারে কিংবা পবিত্র বিষয় নিয়ে কটুক্তিও পারে। এ সবকিছুই গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় ব্যক্তি স্বাধীনতার নামে অনুমোদিত। মূলতঃ এটাই হচ্ছে গণতন্ত্রের প্রকৃত বাস্তবতা এবং প্রকৃত অর্থ। এ সবকিছু অনুধাবন করার পরেও কিভাবে একজন মুসলিম, যে কিনা ইসলামী আক্বীদাহ্’র উপর বিশ্বাস করে বলতে পারে যে, গণতন্ত্র মুসলিমদের জন্য অনুমোদিত কিংবা গণতন্ত্র ইসলাম থেকেই উত্থিত?
ইসলাম জনগণ কর্তৃক খলীফা নির্বাচনের জন্য একটি সুনির্দিষ্ট পদ্ধতি নির্ধারণ করেছে। যদিও ইসলামে সার্বভৌমত্ব সম্পূর্ণভাবে শারী’আহ্’র, কিন্তু উম্মাহ্’র (জনগণ) বাই’আতের মাধ্যমে নির্বাচিত হওয়া যে কারও খলীফা হবার একটি মৌলিক শর্ত। ইসলামী শাসনব্যবস্থায় সেই সপ্তম শতাব্দীর প্রথম ভাগ থেকেই খলীফা নির্বাচন হয়েছে, যখন সমগ্র বিশ্ব স্বৈরশাসক ও রাজা-বাদশাহদের ভয়ঙ্কর অত্যাচার, নির্যাতন ও নিপীড়নের অতল গহ্বরে নিমজ্জিত ছিল। কেউ যদি খোলাফায়ে রাশেদীন অর্থাৎ, আবু বকর (রা.), উমর (রা.), উসমান (রা.) এবং আলী (রা.) এর নির্বাচন প্রক্রিয়াকে গভীরভাবে বিশ্লেষণ করেন, তবে এটা তার কাছে স্পষ্টভাবে প্রতীয়মান হবে যে, এদের প্রত্যেককে খলীফা হিসাবে নির্বাচনের ক্ষেত্রেই মুসলিম উম্মাহ্’র প্রভাবশালী অংশ এবং উম্মাহ্’র প্রতিনিধিদের কাছ থেকে বাই’আত গ্রহণ করা হয়েছিল। উমর (রা.) এর শাসনামলের শেষের দিকে আব্দুর রহমান বিন আউফ (রা.) কে নিয়োগ দেয়া হয়েছিল মুসলিম উম্মাহ্’র প্রতিনিধিদের (তৎকালীন মদীনার জনগণ) কাছ থেকে খলীফা নির্বাচনের ব্যাপারে মতামত সংগ্রহের জন্য। মদীনার জনগণ খলীফা পদে কাকে নির্বাচিত করতে চায় এ তথ্য অনুসন্ধানে তিনি মদীনার বহুসংখ্যক মানুষের বাসগৃহে প্রবেশ করে জনগণের মতামত যাচাই করেছিলেন। তিনি মদীনার নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সকলের সাথে এ বিষয়ে কথা বলেছিলেন যতক্ষণ পর্যন্ত তিনি এ সিদ্ধান্ত পৌঁছেছিলেন যে, সামগ্রিকভাবে জনমতের পাল্লা উসমান (রা.) এর দিকেই ভারী হয়েছে। এরপর, উসমান (রা.)কে বাই’আতের মাধ্যমে খলীফা হিসাবে নির্বাচন করা হয়।
পরিশেষে একথা বলা যায় যে, গণতন্ত্র একটি কুফরী ব্যবস্থা। এটি এ কারণে নয় যে, এটা মানুষকে শাসক নির্বাচনের ক্ষমতা দেয়; কারণ এটি প্রকৃতঅর্থে মূল আলোচ্য বিষয়ও নয়। বরং এটি এ কারণে যে, যে কোন গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার মূলভিত্তিই হল মানুষের আইন প্রণয়নের ক্ষমতা, এ মহাবিশ্বের স্রষ্টা আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়া তা’আলার নয়। আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা বলেন:
“বস্তুত সার্বভৌমত্ব ও শাসন কর্তৃত্ব আল্লাহ্ ছাড়া আর কারো জন্য নয়।”
[সূরা ইউসুফ: ৪০]
“কিন্তু ‘না, তোমার রব এর শপথ, এরা কিছুতেই ঈমানদার হতে পারে না, যতক্ষণ পর্যন্ত না তারা তাদের পারস্পরিক মতভেদের ব্যাপারসমূহে তোমাকে ফায়সালাকারী হিসেবে মেনে নেবে। অতঃপর তুমি যাই ফায়সালা করবে, সে সম্পর্কে তারা নিজেদের মনে কিছুমাত্র কুন্ঠাবোধ করবে না, বরং এর সম্মুখে নিজেদেরকে পূর্ণরূপে সোপর্দ করে দেবে।”
[সূরা আননিসা: ৬৫]
এরকম আরও অনেক প্রসিদ্ধ দলিল রয়েছে যা নিশ্চিত করে যে, আইন প্রণয়নের একমাত্র ক্ষমতা হল আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়া তা’আলার। এছাড়া, আরও গভীরভাবে বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় যে, গণতন্ত্র ব্যক্তিস্বাধীনতাকে স্বীকৃতি দেয়, যেখানে কোন নারী বা পুরুষ হালাল-হারামের প্রতি লক্ষ্য না করেই যা খুশী তাই করতে পারে। গণতন্ত্র ধর্মীয় স্বাধীনতার নামে ধর্মত্যাগের অধিকার প্রদান করে এবং ধর্ম পরিবর্তনের ক্ষেত্রে কোনরূপ বাঁধা আরোপ করে না। এছাড়া, মালিকানা অর্জনের স্বাধীনতা মূলতঃ ধনীকে অসৎ ও প্রতারণাপূর্ণ উপায়ে দূর্বলকে শোষণ করার অনুমোদন দেয়; ফলে, ধনীর সম্পদ বৃদ্ধি পেতে থাকে এবং দরিদ্র আরও বেশী দরিদ্র হতে থাকে। মত প্রকাশের স্বাধীনতা সত্য বলাকে উৎসাহিত করে না, বরং উম্মাহ্’র পবিত্র আবেগ-অনুভূতিকে নির্মম আঘাতে ক্ষতবিক্ষত করতেই তা ব্যবহার করা হয়ে থাকে। এটি এ পর্যায়ে ব্যবহৃত হয়ে থাকে যে, যারা মত প্রকাশের ছদ্মাবরণে ইসলামকে আক্রমণ করে তাদের তীক্ষ্ণ বুদ্ধিমত্তার মানুষ হিসাবে গণ্য করা হয় এবং এ হীনচেষ্টার জন্য তাদেরকে পুরস্কৃতও করা হয়।
উপরোক্ত আলোচনা থেকে এটা স্পষ্টভাবে প্রতীয়মান হয় যে, ইসলামী শাসনব্যবস্থা (খিলাফত রাষ্ট্রব্যবস্থা) রাজতান্ত্রিক, সাম্রাজ্যবাদী, ফেডারেল, প্রজাতান্ত্রিক কিংবা গণতান্ত্রিক কোনটিই নয়।
৩. খিলাফত রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠানসমূহ বর্তমান প্রচলিত শাসনব্যবস্থার প্রতিষ্ঠানসমূহের অনুরূপ নয়, যদিও কোন কোন অংশকে আপাতদৃষ্টিতে সদৃশ মনে হতে পারে। বস্তুতঃ খিলাফত রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠানসমূহ উদ্ভুত হয়েছে হিজরতের পর মদীনা আল-মুনাওওরায় রাসূলুল্লাহ্ (সা) কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত প্রথম ইসলামী রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠানসমূহ থেকে। এই শাসনব্যবস্থাই পরবর্তীতে খোলাফায়ে রাশেদীন (রা.) কর্তৃক অনুসৃত হয়েছিল, যারা শাসক হিসাবে রাসূল (সা) এর উত্তরাধিকারী হয়েছিলেন।
(এ বিষয়ের সাথে) প্রাসঙ্গিক ইসলামী দলিল-প্রমাণগুলোর সতর্কতার সাথে বিশ্লেষণ এটা নিশ্চিত করে যে, খিলাফত রাষ্ট্র
নিমড়বলিখিত প্রতিষ্ঠানসমূহ নিয়ে গঠিত ছিল:
২. খলীফার প্রতিনিধিত্বকারী সহকারী (মু’ওয়ায়ীন আত তাফউয়ীদ বা Delegated Assistants)
৩. খলীফার নির্বাহী সহকারী (মু’ওয়ায়ীন আত তানফীদ – Executive Assistants)
৪. গভর্ণরবৃন্দ (উ’লাহ্ – Wulah)
১১. বাইতুল মাল (রাষ্ট্রীয় কোষাগার)
১২. তথ্য বিভাগ (আল ই’লাম – I’laam)
১৩. উম্মাহ্ কাউন্সিল (মাজলিস আল-উম্মাহ্ – Majlis al-Ummah)
এই বইয়ের উদ্দেশ্যই হচ্ছে এই প্রতিষ্ঠানসমূহকে বিস্তৃত আকারে শারী’আহ্ দলিল-প্রমাণের বিশ্লেষণসহ উৎস থেকে বিশদভাবে আলোচনা করা। আমরা আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়া তা’আলার কাছে প্রার্থনা করছি যেন তিনি বিজয়ের মাধ্যমে আমাদের সম্মানিত করেন এবং দ্বিতীয় খোলাফায়ে রাশেদীন প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে আমাদেরকে সাহায্য করে ইসলাম এবং মুসলিমদের হারানো গৌরব ফিরিয়ে দেন। সেইসাথে, এ খিলাফতের মাধ্যমেই কাফের ও মুশরিকদের অপমানিত করেন। সর্বোপরি, সমগ্র বিশ্বব্যাপী ইসলামের সুসংবাদকে ছড়িয়ে দিয়ে পৃথিবীর সর্বত্র সুবিচার প্রতিষ্ঠিত করেন।
“আল্লাহ্ তো নিজের কাজ সম্পূর্ণ করবেনই। আল্লাহ্ প্রতিটি জিনিসের জন্য একটি তকদীর বা মাত্রা নির্দিষ্ট করে রেখেছেন।”
[সূরা আত-তালাক: ৩]
১৪ই জ্বিল-হজ্ব ১৪২৫ হিজরী
২৪/০১/২০০৫ইং