ইদানিং আমাদের সমাজ ও রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে বেশ কিছু কনসেপ্ট আলোচনা করা হয়। যেমন, সেকুলারিজম (ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ/ইহজাগতিকতাবাদ), প্লুরালিজম (বহুত্ববাদ), বুদ্ধিবৃত্তিক স্বাধীনতা এবং ইসলাম ও ইসলামের মধ্যে ফিরকার সাথে এর সম্পর্ক বা সংঘর্ষ কী। আজ আমরা এসব বিষয় নিয়ে আলোচনা করবো।
১. Pluralism (বহুত্ববাদ): সমাজ সম্পর্কে দৃষ্টিভঙ্গি থেকে সেকুলার গোষ্ঠী বহুত্ববাদকে সংজ্ঞায়িত করে। সমাজে বিভিন্ন ধরণের, বিভিন্ন চিন্তার মানুষ থাকে এবং বিভিন্ন (রাজনৈতিক/সামাজিক) ভাবে তারা তাদের মত/দাবীসমূহ প্রকাশ করে থাকে। সমাজের মানুষের বিভিন্ন ধাঁচের চিন্তাসমূহকে সেকুলার ফ্রেমওয়ার্কের মধ্যে থেকে সমাজে জায়গা করে দেওয়া ও সহ-অবস্থানের সুযোগ দেয়ার নামই হচ্ছে প্লুরালিজম। তবে এ ক্ষেত্রে সেকুলার পুঁজিবাদী ফ্রেমওয়ার্ক তার বিরুদ্ধে কাজ করে এমন কোন চিন্তার অবস্থানের সুযোগ দিতে চায় না।
পুঁজিবাদী জীবনব্যবস্থার মৌলিক ভিত্তি সেকুলারিজম তথা ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ; এটিই সমাজের মানুষের জীবন সম্পর্কে দৃষ্টিভংগি নির্ধারন করে দেয়। এই সেকুলার ভিত্তি হচ্ছে জীবন থেকে ধর্মের পৃথকীকরণ। অর্থাৎ কোন দল বা ব্যক্তি যখন সেকুলার পুঁজিবাদী আদর্শের মধ্যে পরিচালিত হবে, তখন তাকে মূলত পুঁজিবাদী সেট করে দেওয়া নীতির মধ্যে থেকেই কাজ করতে হবে। এক্ষেত্রে এ ব্যবস্থায় গড়ে উঠা কোন ব্যক্তি বা গোষ্ঠী সমকামীতা, মদ খাওয়া কিংবা পতিতাবৃত্তির বৈধতার জন্য দাবি তুলতে পারে, কারণ এর সাথে পুঁজিবাদের সংঘর্ষ নেই। আবার এ আদর্শ মসজিদ, মাদ্রাসা, দান-খয়রাতের সংস্থার বৈধতাকেও সুযোগ করে দিতে পারে।
ইসলামী জীবন ব্যবস্থায়ও সমাজে বিভিন্ন ধরণের মানুষই থাকবে, কিন্তু তা সেকুলার পুঁজিবাদী দৃষ্টিভঙ্গি যেভাবে রাখতে চায় সেভাবে নয়। ইসলামী সমাজ ব্যবস্থার ভিত্তি এর আকীদা; তথা লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ মুহাম্মাদুর রাসূলু্ল্লাহ। আর এই আকীদাকে ভিত্তি করেই রাজনৈতিক দল, মত, গোষ্ঠী ও আন্দোলন প্রতিষ্ঠিত হবে। ইসলামী আকীদার সাথে সাংঘর্ষিক কোন দৃষ্টিভঙ্গি/চিন্তার সুযোগ এ সমাজে থাকতে পারবে না। অর্থাৎ একের অধিক দল, মত ও গোষ্ঠী ও ব্যক্তিবর্গ থাকলেও প্রত্যেককে ইসলামী আকীদার ভিত্তিতেই চলতে হবে। এবং তাদের মধ্যে ইসলামের মৌলিক বিষয় ব্যতীত শাখা প্রশাখা নিয়ে মতপার্থক্য থাকতে পারে। এবং এ সব কিছু ইসলামী আকীদার ফ্রেমওয়ার্কের মধ্যে থেকেই হবে, এর বাইরে গিয়ে নয়। অর্থাৎ, সে একটি সঠিক মত তথা আল্লাহর হুকুমটি খুঁজতে গিয়ে একটি ফিকহী মতামতে উপনীত হতে পারে কিংবা ইসলামী আকীদা ও আদর্শের প্রসারের নিমিত্তে কোনো রাজনৈতিক পলিসির প্রচারক হতে পারে। কিন্তু তার এই স্বাধীনতা কোনোভাবেই তাকে ইসলামী আকীদার বাইরে গিয়ে কোনো সুস্পষ্ট হারামকে প্রচার কিংবা প্রসার করবার অনুমতি দেবে না। সুতরাং, একজন মুসলিম একইসাথে ইসলাম ও পুঁজিবাদীদের পণ্য Pluralism (বহুত্ববাদ), যা কুফরের অস্তিত্বকে প্রচার করে তা গ্রহণ করতে পারে না।
২. ফিরকা: বর্তমান গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় আমরা বহুতত্ত্বের পাশাপাশি বহুদলীয় সংঘাতময় রাজনীতি দেখি। অনেক সময় আমরা এই মানদন্ডে ইসলামের রাজনীতিকেও পরিমাপ করা শুরু করি। এবং এই মানদন্ড আমাদের মুসলিম উম্মাহ’র মাঝে ঐক্য সম্ভব নয় এমন চিন্তাও সৃষ্টি করে দেয়। আর এক্ষেত্রে অনেকে বুঝে কিংবা না বুঝে ইসলামের দলীলগুলোকে ভুলভাবে ব্যাখ্যা করে, যাতে করে মুসলিম উম্মাহ’র মাঝে পরাজিত মানসিকতা তৈরি হয়।
“বনী ইসরাইল (আহলে কিতাবীরা/ইহুদী-খ্রীস্টানরা) বাহাত্তরটি ফিরকায় বিভক্ত হয়েছিল। আমার উম্মত তিহাত্তরটি ফিরকায় বিভক্ত হবে। তার মধ্যে এই জামা’আত ছাড়া বাকি সবাই জাহান্নামে যাবে।” [আবু দাউদ, মুসনাদে আহমদ, হাকিম]
এই হাদীসটির ভুল অর্থ নিয়ে আমাদের সমাজে প্রচলিত হচ্ছে, মুসলিম উম্মাহ’র মধ্যে অনেকগুলো দল হবে, এদের মধ্যে একটি দল জান্নাতে যাবে, বাকিগুলো সব জাহান্নামে।
‘ফিরকা’ শব্দটি বহু শব্দের অর্থ প্রকাশ করে। কুর’আনে আল্লাহ ফিরকা শব্দটি কোথাও অংশবিশেষ বুঝাতে ব্যবহার করেছেন। আবার কোথাও নিন্দাসূচক অর্থে সেইসকল দলকে বুঝিয়েছেন, যারা ওহীকে বিকৃত করে নিজেদের বাসনা দিয়ে জীবন পরিচালিত করতো।
উক্ত হাদীসে আল্লাহ’র রাসূল(সা) ইহুদী ও খৃস্টানদের উদাহরণ এনে বুঝিয়েছেন, তারা বিভক্ত হয়ে পড়েছিল যেসব ইস্যুতে, তার অনুসরণকারীরাও তাদের মতোই পথভ্রষ্ট হবে।
ইহুদী ও খৃস্টনরা নবী-রাসূলদের ব্যাপারে মতভেদ করেছিল, তাদের প্রতি নাযিলকৃত কিতাবের ব্যাপারে মতভেদ করেছিল এবং একে অপরকে কাফির/মুরতাদ বলে সম্বোধন করতো।
সুতরাং, ইহুদী-খ্রীস্টানরা দ্বীনের বুনিয়াদী বিষয়গুলো নিয়ে মতভেদ করেছিল। নবী-রাসূল, কিয়ামত দিবস, আল্লাহর একত্ব, পুনরুত্থান, জান্নাত-জাহান্নামের মতো ঈমানের ভিত্তিসমূহ নিয়ে তারা মতভেদে জড়িয়ে পড়েছিল। রাসূল (সা) আলোচ্য ‘ফিরকা’ বিষয়ক হাদীসে আমাদেরকে ইহুদী-খ্রীস্টানদের মতো মতভেদ করতে নিষেধ করেছেন। এর মানে হলো, দ্বীনের ভিত্তিসমূহ নিয়ে মতভেদ নিষিদ্ধ।
অর্থ্যাৎ ফিরকা হচ্ছে ঐ সকল দল যারা দ্বীনের মৌলিক বিষয় নিয়ে মতভেদ করে (যেমন কাদিয়ানী, ঈসমাঈলী ও আলাওয়ী শিয়া ইত্যাদি)। কিন্তু দ্বীনের শাখাপ্রশাখার ক্ষেত্রে মতভেদ করলে তা উপরোক্ত হাদীসে উল্লেখিত ফিরকা হবে না, কারণ এই মতভেদ বৈধ। সাহাবীগণ (রা) এরূপ মতভেদ করেছেন। বর্তমান উম্মাহর মাঝে বৈধ দল, মত ও গোষ্ঠী যেমন রয়েছে, তেমনি ফিরকাও রয়েছে। প্রত্যেককে আলাদাভাবে চিহ্নিত করতে হবে। যেমন হাদীসে এসেছে:
“সত্ত্বরই আমার উম্মত ৭০-এরও কিছু বেশি ফিরকায় বিভক্ত হবে। তাদের মধ্যে সবচেয়ে বড় ফিরকা হবে একদল যারা বিভিন্ন বিষয়ে নিজেদের মনগড়া সিদ্ধান্ত দেবে এবং তারা হালালকে হারাম করবে ও হারামকে হালাল করবে”। [হাকিম]
এ হাদীস অনুযায়ী বর্তমান সময়ের সবচেয়ে বড় ফিরকা হচ্ছে যারা আল্লাহর আইন তৈরির একচ্ছত্র অধিকারকে নিজেদের অধিকার হিসেবে বিবেচনা করে, সমাজের জন্য কোনটি বৈধ তথা হালাল এবং কোনটি অবৈধ তথা হারাম তা আইনগতভাবে নির্ধারন করা নিজেদের অধিকার বলে বিবেচনা করে। এবং সেকুলার গণতন্ত্র হচ্ছে সেই ব্যবস্থা যা এর উপর ভিত্তি করে পরিচালিত। সুতরাং যারা যেনে বুঝে সেকুলার গণতন্ত্রকে ব্যবস্থারূপে গ্রহণ করে, তারাও হাদীসে বর্ণিত পথভ্রষ্ট ফিরকার অংশ বলে বিবেচিত হবে।
৩. বুদ্ধিবৃত্তিক স্বাধীনতা: ইসলামে বুদ্ধিবৃত্তিক স্বাধীনতা রয়েছে, ফলে ব্যক্তি ভালো-মন্দ যেকোনো চিন্তা ও কাজকে বুদ্ধিবৃত্তিকভাবে বুঝে নিতে পারবে। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি উদ্ভাবনের ক্ষেত্রেও চিন্তা থাকবে উন্মুক্ত। তবে যেহেতু একজন মুসলিমের কাজের ভিত্তি হলো হালাল-হারাম, তাই পুঁজিবাদের তথাকথিত স্বাধীনতার বুলি উড়িয়ে স্বেচ্ছাচারিতার সুযোগ ইসলামে নেই, কর্মের ক্ষেত্রে শরীআহর গন্ডির ভিতরেই অবস্থান থাকতে হবে। ইসলামী সমাজে বুদ্ধিবৃত্তিক বা চিন্তার স্বাধীনতার উদাহরণ দিতে গেলে, সাহাবাদের (রা) চিন্তাগুলো উঠে আসে। বদরের যুদ্ধের পরে বন্দীদের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিয়ে আল্লাহ’র রাসূল (সা) সাহাবাদের মত জানতে চান। উমার (রা) ভিন্ন সকলেই একই মত এবং রাসূল (সা) তা শাসক হিসেবেই গ্রহণ করেন। রাষ্ট্রের শাসক হিসেবে যখন সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়, তাই সকলেই মেনে নিতে বাধ্য, যদিওবা তার মত ভিন্ন হতে পারে। একইভাবে, আবু বকর (রা) খিলাফতকালে উমার (রা) এর নিজস্ব মত থাকলেও, তিনি খলীফার মতকেই মেনে নিয়েছেন। কারণ শরীয়াহ’র দুটো মূলনীতি হলো “খলীফার আদেশ মতভেদের অবসান ঘটায়” ও “খলীফার আদেশ মান্য করা বাধ্যতামূলক”।
অর্থাৎ রাষ্ট্র যখন কোন বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে (লেনদেন ও শাস্তির বিধানের ক্ষেত্রে), তা ব্যতিরেকে অন্য বিষয়াবলী শরীয়াহ’র গন্ডির মধ্যে পালন করাই বুদ্ধিবৃত্তিক স্বাধীনতা, কারণ যেহেতু ইসলামী আকীদাহ একটি বুদ্ধিবৃত্তিক তথা নিশ্চিত আকীদা, তাই ইসলামী আদর্শের গন্ডির ভেতরে থাকাটা বুদ্ধিবৃত্তিক স্বাধীনতার পরিপন্থী নয়। এবং এর সাথে সেকুলার আকীদা থেকে উৎসরিত প্লুরালিজমের কোনো সম্পর্ক নেই, বরং এ স্বাধীনতা পুরোটাই ইসলামী আকীদা থেকে উৎসরিত।
পুঁজিবাদী জীবন ব্যবস্থায় Pluralism এর দোহাই দিয়ে তারা মানুষকে নিজেদের তাড়নার দাসে পরিণত করে রেখেছে এবং ইসলামের রাজনীতিকে তারা ফিরকা হিসেবে সাব্যস্ত করতে চায়। পাশাপাশি ইসলামে বুদ্ধিবৃত্তিক স্বাধীনতার কোন অবকাশ নেই বলে প্রচারণা চালায়। কিন্তু মূল বাস্তবতা ভিন্ন; তা হলো, পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় পুঁজিবাদ নিজেই তার ফ্রেমওয়ার্কের সমালোচনা করার কোন সুযোগ রাখে না, যদিও বহুত্ববাদের প্রচারণা তারাই চালায়। ফিরকার দোহাই দিইয়ে পুঁজিবাদী গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা টিকিয়ে রাখার মাধ্যমে তারা উম্মাহ’র মধ্যে ঐক্যের ফাটল ধরিয়ে রেখেছে আর বুদ্ধিবৃত্তিক স্বাধীনতাকেও তারা নিজেদের সংজ্ঞায় সংজ্ঞায়িত করেছে, যাতে করে ইসলামী সমাজ প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে উম্মাহ’র মাঝে পরাজিত মানসিকতা তৈরি হয়।
১৯২৪ সালে ইসলামি খিলাফত রাষ্ট্র ধ্বংস হয়ে যাওয়ার পর থেকে সেকুলার পুঁজিবাদ ইসলামী রাষ্ট্রকে ভেঙ্গে জাতীয়তাবাদী রাষ্ট্রসমূহে পরিণত করে। রাজনৈতিক, সামরিক আগ্রাসনের পাশাপাশি সে সাংস্কৃতিক আগ্রাসনও চালিয়ে যাচ্ছে মুসলিমদের উপর। মুসলিম উম্মাহ’র মাঝে বপন করছে পুঁজিবাদের নিজস্ব চিন্তা থেকে উৎসরিত বিষফোঁড়া।
ফলশ্রুতিতে মুসলিম উম্মাহ’র মাঝে তাদের নিজেদের অজান্তেই ইসলামী আকীদার সাথে সাংঘর্ষিক চিন্তাসমূহ লালিত হচ্ছে। এর পাশাপাশি মুসলিমদের মাঝে পরাজিত মানসিকতাবোধ তৈরির জন্যও বিভিন্ন চিন্তা প্রবেশ করাচ্ছে। জাতীয়তাবাদ, দেশপ্রেম ইত্যাদির পাশাপাশি ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ দ্বারা গড়া বহুত্ববাদ (Pluralism) তারা আমাদের মাঝে প্রবেশ করিয়েছে। ইসলামের দলীলগুলো সম্পর্কে তাদের নিজেদের ব্যাখ্যা জুড়ে দিয়েছে, যা আমাদের মধ্যে ভুল ধারণা তৈরি করছে এবং ইসলাম বাস্তবায়নের থেকে মুসলিম উম্মাহকে দূরে সরিয়ে রাখছে।