মুসলিম উম্মাহ’র উপর পশ্চিমা উপনিবেশিক সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের বিরূপ প্রভাব

কালচারিং বা চিন্তা বিকাশ প্রক্রিয়া কী?

কালচারিং বা চিন্তা বিকাশ প্রক্রিয়া বুঝতে হলে আমাদেরকে চিন্তা কাকে বলে তা আগে বুঝতে হবে। মস্তিষ্কে সংরক্ষিত পূর্ব ধারণার ভিত্তিতে মানুষের ইন্দ্রিয়ের (নাক, কান,ত্বক, জিহ্বা, চোখ) মাধ্যমে কোন বাস্তবতা সর্ম্পকে গৃহীত তথ্যাদি যাচাই করে সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রক্রিয়াই হল চিন্তা। অর্থাৎ চিন্তার জন্য চারটি অপরিহার্য উপাদান আবশ্যক: বাস্তবতা, পঞ্চইন্দ্রিয়, মস্তিষ্ক ও পূর্বধারণা (Previous Information)। কালচারিং বা চিন্তা বিকাশ প্রক্রিয়ায় আমরা যা শিখি তা মূলত পূর্বধারণা (Previous Information) হিসেবে মস্তিষ্কে সংরক্ষিত থাকে এবং তা পরবর্তীতে নতুন কোন বাস্তবতা সর্ম্পকে সিদ্ধান্ত গ্রহণে কাজে লাগে। ইসলামে তাফসীর, হাদীসশাস্ত্র, ফিকহ ইত্যাদি এর কালচার। এছাড়া পুনর্জাগরণের জন্য নির্দিষ্ট কালচার তথা হালাকাহ, প্রশ্ন-উত্তর পর্ব প্রভৃতি এর অপরিহার্য অংশ। গান, নাচ, নাটক, চলচ্চিত্র, সাহিত্য ইত্যাদি পুজিবাদী কালচারের উপকরণ।

১. পশ্চিমা উপনিবেশিক সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের হাতিয়ারসমূহ:

১.১. রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানসমূহ: পুঁজিবাদী রাষ্ট্রের নির্বাহী বিভাগ, আইন বিভাগ ও বিচার বিভাগ সবই এর  আক্বীদা ধর্মনিরপেক্ষতার ভিত্তিতে গড়ে উঠা মানুষের সার্বভৌমত্বের সর্বোচ্চ বহিপ্রকাশ। সেকারণে এ বিভাগসমূহের অধীন বিভিন্ন রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান পুঁজিবাদী বুদ্ধিবৃত্তিক নেতৃত্বের প্রকাশ ঘটায় ও প্রচার করে।

১.২. শিক্ষাব্যবস্থা: পশ্চিমা উপনিবেশবাদীরা মুসলিম ভূমিসমূহ দখল করে নেয়ার পর এর স্থায়ীত্ব সুনিশ্চিত ও ইসলামের পূণরুত্থানের পথকে রুদ্ধ করতে শিক্ষাব্যবস্থার মাধ্যমে উম্মাহকে কালচার করার জন্য ইসলামবিদ্বেষী ধর্মনিরপেক্ষ ভাবধারার পাঠ্যক্রম প্রণয়ন করে। শায়খ তাকিউদ্দিন আন নাবাহানি (র) তাকাত্তুল আল হিযবী বইয়ে উল্লেখ করেন যে, 

(উপনিবেশবাদীরা বস্তু থেকে স্পিরিটকে পৃথক করা বা রাষ্ট্র থেকে ধর্মকে আলাদা করার জীবন সর্ম্পকিত দৃষ্টিভঙ্গি নির্ভর দৃঢ় দর্শনের উপর ভিত্তি করে শিক্ষা ও সাংস্কৃতিক পাঠ্যক্রম বাস্তবায়ন করে। উপনিবেশবাদীরা তাদের ব্যক্তিত্বগুলোকে আমাদের কালচারিং একমাত্র ভিত্তি করে। তারা তাদের হাদারাহ, ধারণা, ব্যক্তি, ইতিহাস ও লাইফস্টাইলকে চিন্তার প্রাথমিক উৎসে পরিণত করে। এটা যেন যথেষ্ট ছিল না, উপনিবেশবাদীরা উদ্দেশ্যমূলকভাবে তাদের ব্যক্তিত্বসমূহকে পরিবর্তিত করে আমাদের জন্য আদর্শ হিসেবে উপস্থাপন করে। তারা সচেতনভাবে উপনিবেশবাদের প্রকৃত চেহারা গোপন করে কিছু দিক ও ধারণা পছন্দ করে ও গুরুত্বারোপ করে। তারা পাঠ্যক্রমের ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র বিষয়গুলোতে হস্তক্ষেপ করে যাতে করে এগুলো সাধারণ লক্ষ্য থেকে সামান্যতম বিচ্যুত না হয়। একারণে মুসলিমগণ ভুল চিন্তুা দ্বারা বিকশিত হচ্ছে যেখানে আমাদেরকে চিন্তার প্রক্রিয়া শেখানো হয় না, বরং শেখানো হয় কীভাবে অন্যরা চিন্তা করে। এর কারণ হল আমাদের পরিবেশ, ব্যক্তিত্ব, ইতিহাস থেকে চিন্তাকে আলাদা করা হয়েছে এবং এগুলো আমাদের আদর্শ থেকে উৎসারিত নয়। সেকারণে আমরা এমন ব্যক্তিতে পরিণত হলাম যারা জনবিচ্ছিন্ন এবং পরিস্থিতি সর্ম্পকে অসচেতন।) এর প্রকৃষ্ঠ প্রমাণ পাওয়া যায় উপমহাদেশে শিক্ষাক্ষেত্রে বাস্তবায়নের জন্য প্রণীত ম্যাকলে কমিশন রিপোর্টের শেষের দিকে এই ইংরেজ শিক্ষাবিদ উল্লেখ করে যে, ‘এ কমিশন বাস্তবায়িত হলে এ অঞ্চলের লোকেরা গায়ের রঙের দিক থেকে হবে ভারতীয় কিন্তু চিন্তাচেতনায় হবে বৃটিশ।’ 

১.৩. রাজনৈতিক দলসমূহ: উপনিবেশবাদীদের প্রত্যক্ষ সহযোগিতায় মুসলিম ভূমিসমূহতে পশ্চিমা চিন্তাধারার ধারক ও বাহক রাজনৈতিক দল প্রতিষ্ঠিত হয়েছে এবং এর নেতৃবৃন্দ দোসর (এজেন্ট) হিসেবে তাদের স্বার্থের অনুকূলে এবং ইসলাম ও মুসলিমদের বিরুদ্ধে কাজ করেছে। এসব দলগুলো জাতীয়তাবাদ, দেশপ্রেম, গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ, সমাজতন্ত্র প্রভৃতি চিন্তার দিকে উম্মাহকে ক্রমাগত আহ্বান করছে। দৃষ্টান্ত হিসেব বলা যায় ১৮৮৫ সালে বৃটিশ শিক্ষাবিদ অ্যালান অক্টোভিয়ান হিউম ভারতীয়দের অধিকার নিয়ে কথা বলার জন্য দেশপ্রেমে উদ্ধুদ্ধ কংগ্রেস পার্টি প্রতিষ্ঠা করে। ওসমানীয় খিলাফতকে ধ্বংস করার জন্য আরব ও তুর্কীদের জাতীয়তাবাদের ভিত্তিতে রাজনৈতিকভাবে সংগঠিত হতে উপনিবেশবাদীরা বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, যুবসংঘ, পাঠাগার, বিজ্ঞান ক্লাব প্রভৃতির মাধ্যমে উম্মাহকে কালচার করেছে। দূর্ভাগ্যবশত এসব ভুল চিন্তার ভিত্তিতে গড়ে উঠা রাজনৈতিক দলসমূহ এখনও সব মুসলিম ভূমিতে উপনিবেশবাদীদের মদদে কাজ করে চলেছে।

১.৪. বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানসমূহ: পুঁজিবাদে রাজনীতি অর্থনীতিকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হয়। সেকারণে কাঁচামাল সংগ্রহ, জ্বালানীর অবিরত সরবরাহ, সস্তা শ্রম ও বাজারের জন্য রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক উপনিবেশ একটি স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। একারণে বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানসমূহ বিজ্ঞাপন, কর্পোরেট সোশ্যাল রেসপোনসিবিলিটি (CSR) ইত্যাদির নামে উম্মাহ’র বিশেষত যুবসমাজের ইসলামি চেতনাকে ধ্বংস করে পশ্চিমা চিন্তা (যেমন: জাতীয়তাবাদ, দেশপ্রেম, ভোগ) ও লাইফস্টাইলকে (যেমন: ফ্রি মিক্সিং) বিস্তৃত করছে।

১.৫. মিডিয়া: প্রযুক্তিগত উৎকর্ষতা ও প্রভাব তৈরি করার সক্ষমতার কারণে আমাদের জীবনে ইলেকট্রনিক, প্রিন্ট ও সোশ্যাল মিডিয়ার প্রভাব অনস্বীকার্য। এসব মিডিয়া ব্যবহার করে উপনিবেশবাদী, দালাল শাসক, উচ্ছিষ্টভোগী বুদ্ধিজীবি, সাংবাদিক, শিক্ষাবিদ, সংস্কৃতিকর্মীরা সেক্স ও ভায়োলেন্সনির্ভর চলচ্চিত্র, নাটক, বিজ্ঞাপন, টক শো, শিক্ষা ও বিনোদনমূলক অনুষ্ঠান, প্রামাণ্যচিত্র ইত্যাদির মাধ্যমে উম্মাহর মধ্যে পশ্চিমা আদর্শিক চিন্তা ও জীবনাচরণের বিস্তার করে চলেছে। অগভীর চিন্তার অধিকারী হওয়ায় অনুুকরণপ্রিয় উম্মাহ এসব দ্বারা দারুণভাবে প্রভাবিত হচ্ছে।

২. পশ্চিমা সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের  কুপ্রভাব:

একটি আদর্শিক জাতি সাধারণত অন্য কোন জাতির উপর শাসনব্যবস্থা বাস্তবায়নের পর কালচারিং এর মাধ্যমে সে আদর্শের বুদ্ধিবৃত্তিক নেতৃত্ব জনগনের মধ্যে প্রতিষ্ঠিত করে। আর তা না করলে শাসনব্যবস্থা অপসারিত হওয়ার পর সে জাতি পূর্বাবস্থায় ফেরত যায়। এমনটি ঘটেছিল আন্দালুসিয়া ও বলকান অঞ্চলে ইসলামি শাসনব্যবস্থা অবসানের পর। পুঁজিবাদী পশ্চিমারা মুসলিম ভূমিসমূহ দখলের পর তাদের ঘৃণ্য শাসনব্যবস্থা বাস্তবায়নের পর এর স্থায়ীত্ব সুনিশ্চিত করতে মুসলিম জনগোষ্ঠীকে বিভিন্ন উপকরণ ব্যবহার করে কালচারিং করে আসছে ও পুঁজিবাদী বুদ্ধিবৃত্তিক নেতৃত্বকে জনগনের চিন্তার ক্ষেত্রে পূর্বধারণা করার অপচেষ্টা এখন অবধি অব্যাহত রেখেছে। 

২.১. ইসলামি আক্বীদার বিষয়ে সন্দেহ সৃষ্টি করা:

আল্লাহ, তাঁর ফেরেশতাগণ, কিতাবসমূহ, রাসূলগণ, কিয়ামত দিবস, ভাগ্যের ভাল মন্দ, আখিরাত এই সাতটি মৌলিক বিষয়ের উপর বিশ্বাসকে আক্বীদা বলা হয়। পশ্চিমারা বিভিন্ন উপকরণ ব্যবহার করে বিশেষ করে পাঠ্যক্রমের মাধ্যমে এসব মৌলিক বিশ্বাসের বিষয়ে সন্দেহ সৃষ্টি করার চেষ্টা করেছে। ডারউইনিজম বা বিবর্তনবাদের মাধ্যমে স্রষ্টার ধারণা সর্ম্পকে অবিশ্বাস বা সন্দেহ সৃষ্টি করা, রিয্ক বা আজলের সাথে মানুষের কাজকে সর্ম্পকিত করে এর সঠিক ধারণা থেকে উম্মাহকে সরিয়ে নিয়ে আসার অপচেষ্টা অব্যাহত রয়েছে। স্রষ্টার ধারণার ক্ষেত্রে অবিশ্বাস বা সন্দেহ সৃষ্টিতে খুব বেশী সফল না হলেও ক্বাদার ভাল মন্দের বিষয়ে উম্মাহ আজ দারুণভাবে বিভ্রান্ত।

২.২ জীবনের দৃষ্টিভঙ্গির উপর প্রভাব:

‘আমি জ্বীন ও মানুষকে সৃষ্টি করেছি কেবলমাত্র আমার ইবাদতের জন্য’। (আল কোরআন)

এ আয়াতের মাধ্যমে পৃথিবীতে মানুষকে প্রেরণের উদ্দেশ্য সর্ম্পকে ধারণা পাওয়া যায়। সেকারণে মানুষের জীবনের সব কাজ এ উদ্দেশ্যকে ঘিরেই আবর্তিত হওয়া উচিত। কিন্তু পশ্চিমা পুজিবাদী সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের কারণে পৃথিবীতে প্রেরণের উদ্দেশ্য মুসলিম উম্মাহকে আজ সার্বক্ষণিকভাবে তাড়িত করে না। চিরস্থায়ী আখেরাতের সাফল্য নয়, বরং ক্ষণস্থায়ী দুনিয়ার সাফল্যই আজ তার কাছে মুখ্য।

২.৩. চিন্তার পদ্ধতি হিসেবে বৈজ্ঞানিক চিন্তা পদ্ধতি গ্রহণ করা:

চিন্তার তিনটি পদ্ধতি রয়েছে: বুদ্ধিবৃত্তিক (Rational), যৌক্তিক (Logical), বৈজ্ঞানিক (Scientific)। আব্বাসীয় খিলাফতের সময়ে আলেমগণের ইসলামি চিন্তার প্রক্রিয়ায় গ্রীকদের যৌক্তিক চিন্তাপদ্ধতির অনুপ্রবেশ ঘটে-যা এখন অবধি বলবৎ রয়েছে। আর ইউরোপে শিল্প বিপ্লবের পর থেকে প্রথমে মিশনারীদের মাধ্যমে এবং পরবর্তীতে মুসলিম ভূমিসমূহ দখল উত্তর শাসনব্যবস্থা বাস্তবায়ন করে বিভিন্ন সাংস্কৃতিক উপকরণের মাধ্যমে পশ্চিমারা মুসলিমদের মধ্যে বৈজ্ঞানিক চিন্তার পদ্ধতিকে বিকশিত করেছে। আমাদের জীবনে বৈজ্ঞানিক ও যৌক্তিক চিন্তার জন্য স্ব স্ব ক্ষেত্র থাকা সত্ত্বেও ইসলামিক আক্বীদা থেকে শুরু করে বিভিন্ন বিষয়ে বুদ্ধিবৃত্তিক (Rational) চিন্তা পদ্ধতিকে মুসলিমদের গুরুত্ব দেয়া উচিত। ইসলামিক আক্বীদা ও শরী’আহ অনুধাবনে বৈজ্ঞানিক ও যৌক্তিক চিন্তা পদ্ধতি অকার্যকর এবং অপ্রয়োজনীয়ও বটে। কিন্তু সাধারণ মুসলিম থেকে শুরু করে অনেক আলেমগণ ইসলামকে বুঝার ক্ষেত্রে বৈজ্ঞানিক ও যৌক্তিক চিন্তা পদ্ধতি গ্রহণ করছে।  বৈজ্ঞানিক চিন্তা পদ্ধতিকে শ্রেষ্ঠত্ব প্রদান করার মাধ্যমে পশ্চিমারা নিজেদের শ্রেষ্ঠত্বই জাহির করতে চায়। পশ্চিমা পুজিবাদী সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের কারণে মুসলিম উম্মাহ আজকে এ সত্যটুকু বুঝতে অক্ষম হচ্ছে।

২.৪. চিন্তার গুনগত মানের অবনমন:

গুনগত মানের বিচারে চিন্তা তিনধরনের: অগভীর (Shallow), গভীর (Deep), আলোকিত (Enlightened)। পশ্চিমা পুজিবাদী সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের কারণে মুসলিম উম্মাহ ইসলামসহ জীবনের বিভিন্নক্ষেত্রে গভীর (Deep) ও আলোকিত (Enlightened) চিন্তা প্রয়োগ করছে না, বরং অগভীর (Shallow) চিন্তা উম্মাহ থেকে শুরু করে আলেমগণের মধ্যে মহামারী আকারে ছড়িয়ে পড়েছে। চিন্তা ও কর্মে কাফেরদের অন্ধ অনুকরণই এর নগ্ন বহিপ্রকাশ।

২.৫. প্রাথমিক মূল্যবোধ পরিবর্তন:

মানুষ যে কোন কাজের পেছনে চার ধরনের মূল্যবোধ অন্বেষণ করে। এ মূল্যবোধ হল যে কোন কাজের পেছনে তাৎক্ষণিক লক্ষ্য। এগুলো হল: বস্তুগত, মানবিক, আধ্যাত্মিক, নৈতিক মূল্যবোধ। ইসলামে আধ্যাত্মিক মূল্যবোধ প্রাথমিক এবং অন্যান্যগুলোর তুলনায় প্রণিধানযোগ্য। অপরদিকে পুজিবাদে অন্যান্য তিনটির তুলনায় বস্তুগত মূল্যবোধ প্রাথমিক বা অগ্রগণ্য। পশ্চিমা পুজিবাদী সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের কারণে আধ্যাত্মিক নয়, বরং বস্তুগত মূল্যবোধ মুসলিম উম্মাহ’র কাছে আজ প্রণিধানযোগ্য হয়ে উঠেছে।

২.৬. সুখ (Happiness) সর্ম্পকিত ধারণার পরিবর্তন:

পুজিবাদী ব্যবস্থায় ইন্দ্রিয়ের পরিতৃপ্তিকেই (Pleasure) সুখ (Happiness) মনে করা হয়। কিন্তু ইসলামে ‘সুখ’ (Happiness) একটি ধারণা বা concept এবং তা হল আল্লাহ সুবহানাহু তা’আলা’র সন্তুষ্টি। রাসূলুল্লাহ (সা) বলেন, ‘তুমি উপরের (বৈষয়িকভাবে ভাল অবস্থান) দিকে তাকিও না, বরং নীচের (বৈষয়িকভাবে অপেক্ষাকৃত মন্দ অবস্থানে) দিকে তাকাও, তবেই আল্লাহ’র নেয়ামত সর্ম্পকে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতে পারবে।’ মূলত: এ চিন্তাই মানুষকে সুখের সত্যিকারের অনুভূতি দিতে পারে। পশ্চিমা পুঁজিবাদী সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের কারণে উম্মাহ কাফেরদের মত ইন্দ্রিয়ের পরিতৃপ্তি (Pleasure) বা ভোগকে সুখ (Happiness) ভাবছে; খেলাধুলা, সেক্স ও ভায়োলেন্সনির্ভর চলচ্চিত্র, গান, নাটক, সাহিত্য ইত্যাদির মাধ্যমে বিনোদিত হওয়াকে নিজের অধিকার মনে করছে। 

২.৭. ইসলামি জীবনাদর্শ সর্ম্পকে আত্মবিশ্বাসহীনতা:

ইসলামি বুদ্ধিবৃত্তিক নেতৃত্ব ও গুরুত্বপূর্ণ ইসলামিক হুকুমসমূহ (পর্দা, জিহাদ, বহুবিবাহ, ইসলামি রাষ্ট্রব্যবস্থা) সর্ম্পকে ক্রমাগত নেতিবাচক প্রচারণায় প্রভাবিত, সাংস্কৃতিক দখলদারিত্বের শিকার, ফিকরাহ ত্বরীকার ব্যাপারে যথাযথ জ্ঞানহীন উম্মাহ’র আলেম ও সাধারণ মুসলিমগণ ইসলামী জীবনাদর্শের বিষয়ে হীনমন্যতায় ভুগছেন। পরাজিত মানসিকতা থেকেই তারা তাদাররুজ (gradualism), ব্যাংকিং ও বীমা ব্যবস্থার ইসলামীকীকরণ, পরস্পর বিপরীতধর্মী ইসলাম ও গণতন্ত্রের মধ্যে মধুচন্দ্রিমাময় সর্ম্পক আবিষ্কার করছে।

২.৮. পূর্ণজাগরণের সঠিক পথ অনুধাবন করতে না পারা:

এটি সবাই বুঝতে পারছে যে, উম্মাহ’র অবনমন ঘটেছে। কিন্তু পশ্চিমা সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের কুপ্রভাবের দরুণ এ অবনমনের প্রকৃতি ও তা থেকে উত্তরণের উপায় বাতলানো সম্ভবপর হচ্ছে না। উম্মাহ’র অবনমনের সত্যিকারের কারণ তার বুদ্ধিবৃত্তিক অধপতন এবং সর্বোচ্চ রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান খিলাফতের অনুপস্থিতি এবং এর থেকে উত্তরণের জন্য প্রয়োজন এমন একটি আদর্শিক রাজনৈতিক দল যা বুদ্ধিবৃত্তিক ও রাজনৈতিক সংগ্রামে নিজেকে নিয়োজিত করবে। কিন্তু সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের শিকার হওয়া উম্মাহ’র অভিভাবকতুল্য অধিকাংশ আলেমগণ ব্যক্তি মুসলিমের নৈতিক বা আধ্যাত্মিক পদস্খলনকেই অবনমনের কারণ ভাবছেন এবং নৈতিক বা আধ্যাত্মিক পরিশুদ্ধি বা ইসলাহকে এর সমাধান মনে করছেন। অধিকাংশ আলেমগণ ইসলামকে ফিকরাহ ও ত্বরীকার সমষ্টি হিসেবে দেখেন না। বিধায় ইসলাম প্রতিষ্ঠার পদ্ধতি যে ইসলামের মধ্যেই রয়েছে এ ব্যাপারে তারা ওয়াকিবহাল নন।

২.৯. কাজের ভিত্তি পরিবর্তন:

একজন প্রকৃত মুসলিমের কাজের ভিত্তি হল আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া ত’আলা’র সন্তুষ্টি অর্জন। শরী’আহ সংজ্ঞায়িত খায়ের (কল্যাণকর) শার্ (অকল্যাণকর) বা হালাল হারাম- ই তার জন্য হুসন (নৈতিক) কুব্হ (অনৈতিক) হওয়া উচিত। এখানে বাস্তবতা দ্বারা প্রভাবিত হওয়া বা মানব মস্তিষ্ক ব্যবহারের কোন সুযোগ নেই। পুজিবাদে কাজের ভিত্তি হল লাভ বা Benefit । কিন্তু পশ্চিমা শিক্ষাব্যবস্থা ও অন্যান্য উপকরন ব্যবহার করে  কালচারিং করার কারণে উম্মাহ’র কাজের ভিত্তি পরিবর্তিত হয়ে গেছে। উম্মাহ হুসন কুব্হ নির্ধারণ এর ক্ষেত্রে পুজিবাদে কাজের ভিত্তি-লাভ বা Benefit কে গ্রহণ করছে।

উপসংহার:

পশ্চিমারা মুসলিম ভূমিসমূহ দখল করে নেয়ার পর তাদের ব্যবস্থাসমূহ বাস্তবায়ন করে বিভিন্ন উপকরণের মাধ্যমে উম্মাহকে সাফল্যজনকভাবে কালচার করতে সমর্থ হয়েছে। কালচারিং এর মাধ্যমে ভূমির উপনিবেশবাদ থেকে মস্তিষ্কের উপনিবেশবাদে সফল হওয়ায় দ্বিতীয় মহাযুদ্ধোত্তর সময়ে তারা প্রত্যক্ষ উপনিবেশবাদ থেকে সফলভাবে Neocolonialism বা নব্য উপনিবেশবাদে রূপান্তরিত হতে পেরেছে। কালচারিং এর কারণেই বৃটেন এখনও পৃথিবীর অনেক জায়গায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাথে প্রতিযোগিতা করতে পারছে; যদিও দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পর এর অর্থনৈতিক ও সামরিক শক্তি বহুলাংশে হ্রাস পেয়েছে। তেরশ বছরের ইতিহাসে ইসলামী ভূমির যেসব অংশে খিলাফত রাষ্ট্র সফলভাবে উম্মাহকে ইসলামের বুদ্ধিবৃত্তিক নেতৃত্বের মাধ্যমে কালচারিং করতে সমর্থ হয়েছিল সেসব অংশের মুসলিমগণ ইসলামকে ধারণ করার ক্ষেত্রে এখনও অপেক্ষাকৃত ভাল অবস্থানে আছে। তবে আশার কথা এই যে, কুফর দিয়ে কালচার করার ঘৃণ্য পশ্চিমা উপনিবেশবাদী অপচেষ্টা সত্ত্বেও উম্মাহ তার অর্ন্তনিহিত খায়ের, শক্তিশালী আক্বীদা ও আদর্শিক ইসলামি রাজনীতির কারণে আবার ইসলামের দিকে ব্যাপকভাবে ফিরে আসতে শুরু করেছে। উম্মাহ’র এই উত্তম প্রবণতাই অনতিদূর ভবিষ্যতে দ্বিতীয় খোলাফায়ে রাশেদার ভীত রচনা করবে, ইনশাআল্লাহ। আল্লাহ সুবহানাহু তা’আলা পবিত্র কুরআনে বলেন,

“তারা (কাফের) চায় মুখের ফুৎকারে আল্লাহ’র নূরকে নিভিয়ে দিতে, কিন্তু তিনি তাঁর নূরকে প্রজ্জলিত রাখবেনই; যদিও কাফেররা তা অপছন্দ করে।’’ (সূরা আস-সফ: ৮)  

Leave a Reply