কাজের সংজ্ঞা
ভাড়া করার সাথে ভাড়াকৃত বস্তুর উপযোগ ব্যবহারের বিষয়টি সম্পর্কিত। একজন শ্রমিককে ভাড়া করার/নিয়োগ দেয়ার অর্থ হলো তার সামর্থ্যকে কাজে লাগানো। একজন শ্রমিককে নিয়োগ/ভাড়া করার ক্ষেত্রে কাজটির প্রকৃতি, কাজের সময়কাল, পারিশ্রমিক ও শ্রমের পরিমাণ সঠিকভাবে নির্ধারণ করা প্রয়োজন। কাজটি অজ্ঞাত যাতে না হয় সেজন্য কাজের প্রকৃতি নির্ধারণ করে দিতে হবে, কেননা কাজ সম্পর্কে অজ্ঞ রেখে কোন ব্যক্তিকে নিয়োগ/ভাড়া করা অবৈধ (ফাসিদ)। কার্যকাল নির্ধারণ করাটাও জরুরি, অর্থাৎ সেটি কি দৈনিক, সাপ্তাহিক, মাসিক নাকি বাৎসরিক হবে। একইভাবে শ্রমিকের কাজের পারিশ্রমিকও সুনির্ধারিত হতে হবে। ইবনে মাসউদ হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ্ (সা) বলেন: “তোমাদের মধ্যে কেউ যদি কোন শ্রমিককে নিয়োগ দেয় তবে তাকে অবশ্যই তার পারিশ্রমিক জানাতে হবে” [আল-দারাকুন্তি কর্তৃক কান্জ আল-উম্মাল-তে বর্ণিত]। হয়েছে শ্রমিককে যে পরিমাণ শ্রম দিতে হবে তা নির্ধারণ করে দেয়াও জরুরী। তদনুসারে, শ্রমিকের কাছ থেকে তার সাধ্যের অতিরিক্ত কাজ দাবী করা অনুমোদিত নয়। কারণ, আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা বলেন:
“আল্লাহ্ কোন ব্যক্তির উপর তার সাধ্যের অতীত বোঝা চাপান না।”
[সূরা বাক্বারাহ্: ২৮৬]
আবু হুরাইরাহ্ থেকে বুখারী ও মুসলিম বর্ণনা করেছেন যে, নবী (সা) এ ব্যাপারে বলেন:
“আমি যদি তোমাকে কোন কিছুর আদেশ দেই, তবে তোমার পক্ষে যতদূর সম্ভব কর।”
শ্রমিককে কখনই তার স্বাভাবিক সামর্থ্যরে অতিরিক্ত কোন দায়িত্ব গ্রহণের জন্য বলা উচিত নয়। যেহেতু বাস্তবে সামর্থ্য পরিমাপ করা কঠিন, সেহেতু প্রতিদিনকার কর্মঘন্টা নির্দিষ্ট করে দেয়া সম্ভাব্য সবচেয়ে ভাল উপায়। এর পাশাপাশি কাজের প্রকৃতিও সঠিকভাবে বর্ণনা করতে হবে, যেমন: নরম বা শক্ত মাটি কাটা, ধাতব দ্রব্যাদি প্রস্তুতকরণ, বা পাথর কাটা। যে পরিমাণ শ্রম বিনিয়োগ করতে হবে সে সম্পর্কে একটি ধারনা প্রদান করতে হবে। সুতরাং কোন কাজকে এর ধরন, কার্যকাল, পারিশ্রমিক এবং ব্যয়কৃত শ্রমের ভিত্তিতে সংজ্ঞায়িত করতে হবে। যখন শারী’আহ্ একজন শ্রমিককে কোন কাজে নিয়োগের অনুমোদন দেয় তখন কাজটিকে ধরন, কার্যকাল, পারিশ্রমিক এবং ব্যয়কৃত শ্রমের ভিত্তিতে সংজ্ঞায়িত করার শর্ত জুড়ে দিয়েছে। কার্য সম্পাদনের জন্য পারিশ্রমিক হিসেবে শ্রমিক যা পায় তা হল তার ব্যয়কৃত শ্রমের বিনিময়ে অর্জিত সম্পত্তি।
কাজের ধরন
প্রত্যেক হালাল বা আইনগতভাবে বৈধ কাজের জন্য চুক্তি করা অনুমোদিত। যেমন: ব্যবসা, চাষাবাদ, কলকারখানার কাজ, সেবা বা প্রতিনিধিত্বের কাজের জন্য কাউকে নিয়োগ/ভাড়া করা। বিচারিক কাজে বাদী বা বিবাদীর বক্তব্য/প্রতিক্রিয়া প্রকাশ/জ্ঞাত করার জন্য, প্রমাণাদি সংগ্রহ করে বিচারককে প্রদান করার জন্য, অধিকার দাবী ও লোকদের মধ্যকার বিবাদ নিরসনের জন্য একজন ব্যক্তিকে নিয়োগ দেয়া যেতে পারে। এছাড়াও কূপ খনন, নির্মাণকাজ, গাড়ী বা উড়োজাহাজ চালানো, বই ছাপানো, মুসাফ নকল করা, যাত্রী বহন করা ইত্যাদি বৈধ কাজের জন্য যে কাউকে নিয়োগ/ভাড়া করা যেতে পারে।
একটি সুনির্দিষ্ট কাজের জন্য, কিংবা বিশেষ ধরনের কাজের জন্য কাউকে ভাড়া করা যায়। একটি নির্দিষ্ট কাজের জন্য কোন একজন নির্দিষ্ট ব্যক্তির সাথে যদি ভাড়ার চুক্তি করা হয়, যেমন: যদি নির্দিষ্ট একটি কাপড় সেলাই করার জন্য, অথবা বিশেষ একটি গাড়ী চালানোর জন্য খালিদ মুহাম্মদকে ভাড়া করে, তবে মুহাম্মদেরই কাজটি করা উচিত এবং সেটি করে দেয়ার জন্য তার জায়গায় অন্য কাউকে নিয়োগ দিতে পারবে না। যদি মুহাম্মদ অসুস্থ হয় বা কাজটি করতে অসমর্থ হয় তাহলে তার পরিবর্তে অন্য কেউ কাজটি করতে পারবে না, কারণ এক্ষেত্রে কাজটি সম্পাদন করার জন্য শ্রমিক সুনির্দিষ্ট। যদি ঐ নির্দিষ্ট পোষাকটি নষ্ট হয়ে যায় বা বিশেষ গাড়িটি ভেঙ্গে যায়, তাহলে মুহাম্মদ ঐ দু’টি ব্যতিত অন্য কোন কাজ করতে বাধ্য নয়, কারণ চুক্তিতে কাজের ধরন সুনির্ধারিত করে দেয়া হয়েছিল।
যাহোক, যদি কোন একজনের দায়িত্বে, কিংবা বিশেষ ধরনের শ্রমিক বা বিশেষ কাজের উপর ভিত্তি করে ভাড়ার চুক্তিটি করা হয় তবে হুকুম ভিন্ন হবে। এসব ক্ষেত্রে নিয়োগকৃত ব্যক্তি নিজেই কাজটি করতে পারে এবং তার পক্ষ হয়ে কাজ করার জন্য অন্য একজনকে নিয়োগও দিতে পারে। যদি সে অসুস্থ হয়, অথবা কাজটি করতে অসমর্থ হয় তবে কাজটি করে দেয়ার জন্য তার বদলে অন্য আরেকজনকে পাঠাতে বাধ্য থাকবে। নিয়োগ প্রদানকারী ব্যক্তির নির্দেশক্রমে চুক্তি অনুসারে সে তখন যেকোন গাড়ি চালনা, অথবা যেকোন পোশাক সেলাই করার ব্যাপারে দায়িত্বশীল হবে। কারণ, কেবলমাত্র নির্দিষ্ট কোন একটি কাজ সম্পাদনের জন্য চুক্তি হয়নি, বরং নির্দিষ্ট ধরনের কাজ করার জন্য চুক্তি হয়েছে; সুতরাং চুক্তিতে উল্লেখিত ধরনের অন্তভর্‚ক্ত যে কোন কাজ করার ব্যাপারে নিয়োগকৃত ব্যক্তি বাধ্য থাকবে। এক্ষেত্রে এটির নির্দিষ্টতা চুক্তিতে উল্লেখিত কাজের ধরনের ভিত্তিতে নির্ধারিত হয় এবং কাজটির নাম উল্লেখ করার মাধ্যমে নির্ধারিত হয় না, যা নিয়োগকৃত ব্যক্তিকে চুক্তিতে বর্ণিত কাজের ধরনের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ যেকোন কাজ করার স্বাধীনতা প্রদান করে।
কাজের ধরন সঠিকভাবে বর্ণনা করার মধ্যে কাজটি সম্পর্কে শ্রমিকের কাছে বর্ণনা প্রদান করাও অন্তভর্‚ক্ত, যাতে শ্রমিক তার শ্রমের ধরন সম্পর্কে ধারনা লাভ করতে পারে, যেমন: একজন প্রকৌশলীর কাজ। যে কাজটি সম্পাদন করতে হবে সেটার বিষয়ে এই বর্ণনায় উল্লেখ থাকতে হবে। যে প্রকৃতির শ্রম দিতে হবে সে ব্যাপারে এটি ধারনা দেয়, যেমন: একটি কূপ খনন করা। এরূপ বর্ণনার মাধ্যমে কাজকে সংজ্ঞায়িত করা এবং নামকরণের মাধ্যমে কাজকে সংজ্ঞায়িত করা একই অর্থ বহন করে। একারণে, কাজের বর্ণনা প্রদান করে, অথবা বিশেষভাবে নামকরণের মাধ্যমে কাজকে সংজ্ঞায়িত করা গ্রহণযোগ্য। অদৃশ্য হওয়া সত্ত্বেও বর্তমান ও বাস্তবের মতোই কোন একজনের দায়িত্বের আওতাভূক্ত হওয়ার জন্য এটি যথেষ্ট। সুতরাং, বিশেষভাবে সুনির্দিষ্ট নামের একজন প্রকৌশলীকে ভাড়া করা যেমন অনুমোদিত, তেমনি কাজের বর্ণনার মাধ্যমেও একজন প্রকৌশলীকে ভাড়া করা অনুমোদিত। একইভাবে কোন একটি নির্দিষ্ট জামা সেলাই করার জন্য একজন দর্জিকে ভাড়া করা যেমন অনুমোদিত, তেমনি নির্দিষ্ট বর্ণনার জামা সেলাই করার জন্য একজনকে ভাড়া করাও অনুমোদিত।
যদি কোন ব্যক্তি একটি কাজ করতে রাজী হয়, তবে সে অন্য আরেকজনকে তার চেয়ে কম পারিশ্রমিকে কাজটি সম্পাদন করতে দিতে পারে এবং এভাবে মুনাফা করতে পারে। এর কারণ হল, যে কোন পারিশ্রমিকের বিনিময়ে অন্য আরেকজনকে ভাড়া করা তার জন্য অনুমোদিত। দর্জি বা ছুতারের মতো ব্যবসায়ী যেমনিভাবে তার কাজ করে দেয়ার জন্য শ্রমিক ভাড়া করতে পারে, এবং তেমনিভাবে ঠিকাদাররা কোন কাজ করে দেয়ার ব্যাপারে নিজেদের চুক্তিবদ্ধ করার পরে সে কাজ সম্পাদনের জন্য অন্য শ্রমিকদেরকে ভাড়া করতে পারে যা তাদের জন্য অনুমোদিত, এক্ষেত্রে তারা তাদের কর্মচারীদেরকে কত টাকা পারিশ্রমিক দেয় তা বিবেচ্য বিষয় নয়; এটি একটি নির্দিষ্ট কাজ বা নির্দিষ্ট সময়ের জন্য কাউকে ভাড়া করা হিসেবেই বিবেচিত হবে। এধরনের সব শ্রমিক ব্যক্তি পর্যায়ের শ্রমিকের ধরনের মধ্যে অন্তর্ভূক্ত, যা শারী’আহ্ কর্তৃক অনুমোদিত।
নিয়োগকৃত শ্রমিকদের পারিশ্রমিক থেকে কোন অংশ গ্রহণ করার শর্তে, অথবা তাদের তত্ত্বাবধায়ক হিসেবে নিজেকে নিয়োগ করে তাদের পারিশ্রমিকের একটি অংশ গ্রহণ করা কোন ব্যক্তির জন্য অনুমোদিত নয়। কারণ এতে করে সে শ্রমিকদের পারিশ্রমিকের একটি অংশ অন্যায়ভাবে দখল করে। আবু সাঈদ আল-খুদরী হতে আবু দাউদ বর্ণনা করেছেন যে, রাসূলুল্লাহ্ (সা) বলেছেন: “বন্টনের ক্ষেত্রে সাবধান হও”, “আমরা বলেছিলাম: “হে রাসূলুল্লাহ্ (সা), বন্টন কী?” তিনি (সা) বলেন: “লোকেরা কোন কিছুতে একমত হয়, কিন্তু সেটি হতে একটি অংশ কমিয়ে দেয়।” আতা হতে আরেকটি বর্ণনা এসেছে যে, রাসূলুল্লাহ্ (সা) বলেছেন: “একদল লোকের উপর কারও নিয়ন্ত্রণ রয়েছে এবং এজন্য সে তাদের প্রাপ্য হতে নিয়ে নেয়।” সুতরাং, যদি একজন ঠিকাদার প্রতিদিন এক দিনার পারিশ্রমিকের বিনিময়ে এক ব্যক্তিকে একশজন শ্রমিক এনে দিতে বলে এবং কাজ শেষে প্রত্যেককে এক দিনারের চেয়ে কম করে প্রদান করে, তবে তা অনুমোদিত নয়। যে পরিমাণ পারিশ্রমিক দেয়ার ব্যাপারে সে চুক্তিবদ্ধ হয়েছিল, সেটার সমপরিমাণই প্রত্যেক শ্রমিকের জন্য নির্ধারিত পারিশ্রমিক হিসেবে বিবেচিত হবে। যদি নির্দিষ্ট এই পরিমাণ থেকে কোন কিছু নেয়া হয় তবে শ্রমিকদের অধিকার হতে সে কোন কিছু নিল। যদি সে পারিশ্রমিক উল্লেখ না করে একশ শ্রমিক এনে দেয়ার চুক্তি করে থাকে তবে শ্রমিকদেরকে চুক্তিকৃত পরিমাণের চেয়ে কম দিতে পারে, কারণ এক্ষেত্রে সে ওয়াদাকৃত পরিমাণ থেকে হরাস করে না।
কাজের ধরনকে সংজ্ঞায়িত করার এটাও একটি শর্ত যে, এটা এমনভাবে করতে হবে যাতে কাজ সম্পর্কে পরিষ্কার ধারনা জন্মায় এবং নিয়োগের বিষয়টি একটি জ্ঞাত পরিমন্ডলে সমাপ্ত হয়। এর কারণ হল, অজ্ঞাত কাজের জন্য ভাড়া করা অবৈধ। সুতরাং যদি কেউ একজন শ্রমিককে এই বলে ভাড়া করে যে, দশ দিরহামের বিনিময়ে কিছু পণ্যের বাক্সকে মিশওে পৌঁছে দেবে, তবে তা অবৈধ হবে। এটিও বৈধ হবে যদি সে বলে যে, প্রতি টন বহনের জন্য এক দিনার করে দেয়ার শর্তে তাকে ভাড়া করা হয়েছে, কিংবা এক টন বহনের জন্য এক দিনার করে দেয়ার শর্তে তাকে ভাড়া করা হয়েছে এবং এর চেয়ে বেশি হলে তা হিসাব করা হবে। এটা ততক্ষণ পর্যন্ত বৈধ হবে যতক্ষণ পর্যন্ত সে এমন শব্দসমূহ ব্যবহার করে যা নির্দেশ করে যে তাকে সবগুলো বাক্স বহন করতে হবে। কিন্তু যদি সে সেগুলোকে এই শর্তে বহন করতে বলে যে, এক টনের জন্য এক দিনার দেয়া হবে এবং যা অতিরিক্ত হবে তা তদনুসারে হিসাব করা হবে, অর্থাৎ অবশিষ্টটির যতটুকু বহন করা হবে তা হিসাব করা হবে, তাহলে তা বৈধ হবে না, কারণ এক্ষেত্রে চুক্তির কিছু বিষয় অনির্ধারিত। তবে যদি সে তাকে প্রত্যেক টন এক দিনারের বিনিময়ে বহনের জন্য বলে থাকে তবে তা বৈধ হবে, এটা অনেকটা এরকম যে তার জন্য প্রতি ঘনমিটার পানি উত্তোলনের বিনিময়ে এক পয়সা করে দেয়ার শর্তে সে তাকে ভাড়া করেছে, যা অনুমেদিত। সুতরাং, এটি শর্ত যে নিয়োগ/ভাড়া করার বিষয়টি অবশ্যই একটি জ্ঞাত বিষয়ের উপর হতে হবে। এতে যদি অজ্ঞাত কিছু থেকে থাকে তবে নিয়োগটি অবৈধ হয়ে যাবে।
কাজের ব্যাপ্তিকাল
কিছু নিয়োগ/ভাড়ার ক্ষেত্রে, যে কাজের জন্য নিয়োগ/ভাড়া করা হচ্ছে তার ব্যাপ্তিকাল উল্লেখ না করে ধরন উল্লেখ করা জরুরী, যেমন: সেলাই করা, নির্দিষ্ট গন্তব্যে গাড়ী চালনা করা। কিছু নিয়োগের/ভাড়ার ক্ষেত্রে কাজের পরিমাণ উল্লেখ না করে কাজের ব্যাপ্তিকাল উল্লেখ করা জরুরী। এর একটি উদাহরণ হল: একটি গর্ত বা খাল খনন করার জন্য কাউকে এক মাসের জন্য ভাড়া করা, এক্ষেত্রে কাজের পরিমাণ উল্লেখ করা জরুরী নয়, শুধু উল্লেখ করতে হবে যে খনন কাজটি একমাসব্যপী চলবে, হোক সেটা কম বা বেশী। এবং কিছু নিয়োগের/ভাড়ার ক্ষেত্রে কাজের ধরন ও ব্যাপ্তিকাল উভয়ই উল্লেখ করতে হবে, যেমন: একটি বাড়ি নির্মাণ করা, একটি তেল পরিশোধনাগার তৈরি করা এবং এধরনের অন্যান্য কাজ। সুতরাং যে ধরনের নিয়োগের/ভাড়ার ক্ষেত্রে কাজের ব্যাপ্তিকাল উল্লেখ করা প্রয়োজন সেগুলোর প্রত্যেকটির ক্ষেত্রে ব্যাপ্তিকাল উল্লেখ করতে হবে, কারণনিয়োগের/ভাড়ার প্রকৃতি সম্পর্কে জানা প্রয়োজন। কিছু কিছু কাজের ক্ষেত্রে কাজের ব্যাপ্তিকাল উল্লেখ না করলে কাজটি অজ্ঞাত থেকে যায় এবং সেক্ষেত্রে নিয়োগ/ভাড়া করা অবৈধ হয়ে যায়। যদি নিয়োগের/ভাড়ার চুক্তিটি একটি নির্দিষ্ট সময়ের জন্য সম্পাদিত হয়, যেমন: একমাস বা একবছরের জন্য, তাহলে এ সময়কাল অতিবাহিত হওয়ার আগে কোন পক্ষ চুক্তি ভঙ্গ করতে পারবে না। যদি কোন শ্রমিককে পুনরায় ভাড়া করা হয়, যেমন: মাসিক বিশ দিরহামের বিনিময়ে, তবে তাকে প্রতিমাসে চুক্তিকৃত কাজে যোগদান করতে হবে এবং ভাড়ার চুক্তিতে কার্যকাল উল্লেখ করতে হবে। এটা জরুরী নয় যে, চুক্তির পরপরই ভাড়ার কার্যকাল (যেমন: একমাস) অবিলম্বে শুরু করতে হবে। সুতরাং, রজব মাসে কাজ করার জন্য
একজন শ্রমিককে মহররম মাসে ভাড়া করা যাবে। যদি চুক্তিপত্রে কার্যকাল উল্লেখ করা হয়, কিংবা অনিশ্চয়তা দূর করার জন্য কার্যকাল উল্লেখ করার প্রয়োজন হয়, তাহলে কার্যকালকে সময়ের এককে, অর্থাৎ মিনিট, ঘন্টা, সপ্তাহ বা মাসে উল্লেখ করতে হবে।
কাজের পারিশ্রমিক
চুক্তির শর্ত হিসেবে এই বিষয়ের উপর জোর দিতে হবে যে, পারিশ্রমিক হিসেবে প্রদেয় সম্পত্তির যথোপযুক্ত সাক্ষী বা বর্ণনা এমনভাবে উপস্থাপিত হতে হবে যাতে এ বিষয়ক যেকোন অনিশ্চয়তা দূরীভূত হয়। কারণ, রাসূলুল্লাহ্ (সা) এ বিষয়ে বলেছেন: “যে কেউ কোন ব্যক্তিকে ভাড়া করলে সে যাতে ঐ ব্যক্তিকে তার পারিশ্রমিকের ব্যাপারে অবহিত করে।” নিয়োগের/ভাড়ার প্রতিদান হতে পারে আর্থিক, অনার্থিক, সম্পত্তি, কিংবা কোন উপযোগ। পণ্য অথবা উপযোগ যেটাই হোক, মূল্য আছে এরকম যে কোন কিছুই মজুরি হিসেবে দেয়া যাবে, তবে শর্ত হচ্ছে যে তা জানা থাকতে হবে; কিন্তু অজ্ঞাত হলে সেটি অবৈধ। যদি কোন ব্যক্তিকে পারিশ্রমিক হিসেবে কর্তনকৃত ফসলের একটি অংশের বিনিময়ে ফসল কাটার জন্য ভাড়া করা হয় তবে তা অবৈধ, কেননা এক্ষেত্রে পারিশ্রমিক অজ্ঞাত। কিন্তু যদি তাকে এক বা দুই সা’র (A Cubic Mesure) বিনিময়ে ভাড়া করা হয় তবে তা বৈধ। শ্রমিককে খাবার বা বস্ত্র প্রদানের মাধ্যমে নিয়োগ দেয়া অনুমেদিত কিংবা তার খাবার ও বস্ত্রের সাথে সাথে মজুরিও দেয়া যাবে, কারণ এটি দুগ্ধদানকারী মহিলার ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য।
আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা বলেন:
“আর সন্তানের অধিকারী, অর্থাৎ পিতার উপর হলো সে সমস্ত নারীর খোর-পোষের দায়িত্ব প্রচলিত নিয়ম অনুযায়ী।”
[সূরা বাকারাহ্ : ২৩৩]
সুতরাং, দুগ্ধ প্রদানের পারিশ্রমিক হিসেবে তারা খোর-পোষ এবং পোষাকের অধিকারী হয়েছিল। যদি সেবাদানকারী মায়ের ক্ষেত্রে এটা অনুমোদিত হয় তবে এটি অন্যান্য ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য, কেননা এধরনের বর্ণনাসমূহ ভাড়া করার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য।
সংক্ষেপে, এমনভাবে পারিশ্রমিক নির্ধারণ করতে হবে যাতে করে এ সম্পর্কিত যে কোন ধরনের অজ্ঞতা দূরীভূত হয় এবং কোন ধরনের বিরোধ ব্যতিরেকে তা যথাযথভাবে মিটিয়ে দেয়া যায়, কারণ লোকদের মধ্যকার বিরোধ নিরসনের লক্ষ্যকে সামনে রেখেই মূলতঃ সকল ধরনের চুক্তি করা হয়। কাজ শুরুর আগেই পারিশ্রমিকের বিষয়ে একমত হতে হবে এবং এটি মাকরুহ্ বা অপছন্দনীয় যে, কাজ শুরু করার পর একজন শ্রমিকের মজুরী নির্ধারণ করা হয়। যদি কোন কাজের বিষয়ে নিয়োগের/ভাড়ার চুক্তি হয় তাহলে শ্রমিক চুক্তির জোরেই পারিশ্রমিক পাওয়ার যোগ্য হয়ে যায়, তবে কাজ শেষ করার পূর্বেই তার কাছে এটি হস্তান্তর করা বাধ্যতামূলক নয়। তবে কাজ শেষ হওয়া মাত্রই পারিশ্রমিক প্রদান করতে হবে, কেননা এ সম্পর্কে আবু হুরাইরাহ্ হতে বুখারী বর্ণনা করেছেন যে, রাসূলুল্লাহ্ (সা) একটি হাদীসে কুদসীতে বলেন: “বিচার দিবসে আমি তিন ধরনের ব্যক্তির প্রতিপক্ষ হব: একজন হল সেই ব্যক্তি যে আমার নামে কাউকে কোন কথা দিল এবং পরবর্তীতে তা ভঙ্গ করল, যে ব্যক্তি একজন মুক্ত মানুষকে বিয়ে করল এবং এর মূল্য আত্মসাৎ করল, এবং সেই ব্যক্তি যে কাজের জন্য কাউকে ভাড়া করল এবং পুরো শ্রম আদায় করার পরও তাকে তার পারিশ্রমিক দিল না।” তবে যদি পারিশ্রমিক বিলম্বিত করার কোন শর্ত চুক্তিতে উল্লেখ থাকে তাহলে নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত বিলম্ব করা উচিত। যদি এরূপ কোন শর্ত থাকে যে পারিশ্রমিক দৈনিক, মাসিক বা তারচেয়ে কম বা বেশি কিস্তিতে পরিশোধ করা হবে, তাহলে নির্ধারিত সময় সেটাই যেটা দু’পক্ষের সম্মতিতে নির্ধারিত হবে। এটা জরুরী নয় যে নিয়োগকারী ব্যক্তি সম্পূর্ণ উপযোগ আগে গ্রহণ করবে, বরং এটা যথেষ্ট যে শ্রমিক শ্রম প্রদানের জন্য নিজেকে তৈরী রাখে, যার মাধ্যমে নিয়োগকারীর কাছ থেকে পারিশ্রমিক প্রাপ্য হয়ে যায়। সুতরাং, যদি একজন ব্যক্তি আরেকজন ব্যক্তিকে তার বাড়ীতে কাজ
করার জন্য ভাড়া করে থাকে, এবং এরপর শ্রমিক কাজ করার জন্য তার বাড়ীতে উপস্থিত হয় তাহলে যে সময়ের জন্য তাকে ভাড়া করা হয়েছিল সে সময় অতিবাহিত হওয়ার পরেই শ্রমিক তার পারিশ্রমিকের দাবীদার হয়ে যাবে। যদিও পুরো চুক্তিটি হয়েছিল কোন একটি সেবা প্রদানের জন্য যা হয়ত সুযোগ থাকা সত্ত্বেও নিয়োগকারী পুরোপুরি গ্রহণ করতে পারেনি, তদুপরি শ্রমিক তার পারিশ্রমিক পাওয়ার যোগ্য হয়ে যাবে। কারণ অক্ষমতাটি ছিল নিয়োগকারী ব্যক্তির, শ্রমিকের নয়। তবে সাধারণ কর্মচারীর ক্ষেত্রে, যদি তাকে সুনির্দিষ্ট কোন কাজ করার জন্য নিয়োগ দেয়া হয়, তবে তার দায়িত্বের মধ্যে থাকলে সে তা করতে পারবে, যেমন: একজন চিত্রকর, যে তার দোকানে নিজেই কাজ করে এবং একজন পোষাক প্রস্তুতকারী, যে তার নিজের দোকানে কাজ করে। সুতরাং, যতক্ষণ পর্যন্ত না সে সেটা গ্রাহকের কাছে হস্তান্তর করবে ততক্ষণ পর্যন্ত তার দায়িত্ব শেষ হবে না, এবং যতক্ষণ পর্যন্ত না সে কাজটি পুরোপুরি শেষ করে গ্রাহককে তা হস্তান্তর করবে ততক্ষণ পর্যন্ত সে পারিশ্রমিক পাবার যোগ্য হবে না। এর কারণ হল, চুক্তির মাধ্যমে প্রাপ্ত জিনিসটি তার জিম্মায় রয়েছে এবং যতক্ষণ পর্যন্ত না সে গ্রাহকের কাছে তা হস্তান্তর করবে ততক্ষণ পর্যন্ত সে দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি পাবে না। একইভাবে, চুক্তি এরূপ হতে পারে যে নিয়োগকারীর কর্তৃত্বাধীন স্থানে চুক্তিকৃত কাজটি করতে হবে, যেমন: যদি নিয়োগকারীপোষাক প্রস্তুতকারী বা চিত্রকরকে যথাক্রমে সেলাই করা বা রং করার জন্য তার বাড়ীতে নিয়ে আসে তবে এক্ষেত্রে নিয়োগকৃত ব্যক্তি যখন কাজটি শেষ করবে তখন সে দায়িত্ব থেকে মুক্ত হবে এবং পারিশ্রমিক পাবার যোগ্য হবে, কারণ সে নিয়োগকারী ব্যক্তির কর্তৃত্বাধীন রয়েছে এবং একারণে কাজটি অবিলম্বে শেষ করতে হয়।
কাজের পেছনে ব্যয়কৃত শ্রম
একজন শ্রমিককে ভাড়া করার জন্য যে চুক্তি করা হয় তা শ্রমিকের ব্যয়কৃত শ্রম থেকে প্রাপ্ত উপযোগের উপর প্রয়োগ হয়; এবং প্রাপ্ত উপযোগ অনুসারে পারিশ্রমিক নির্ধারিত হয়। প্রদত্ত শ্রম মজুরি বা উপযোগের মানদন্ড হতে পারে না, অন্যথায় একজন পাথরশ্রমিকের পারিশ্রমিক একজন প্রকৌশলীর চেয়ে অনেক বেশী হতে পারে, কেননা একজন পাথরশ্রমিক কর্তৃক প্রদত্ত শ্রমের পরিমাণ অনেক বেশি এবং এটি বাস্তবতার সাথে সাংঘর্ষিক। সুতরাং, পারিশ্রমিক হল প্রাপ্ত উপযোগের তুল্যবিনিময়, প্রদত্ত শ্রমের নয়। এর পাশাপাশি, কর্মচারীদের দক্ষতা অনুসারে পারিশ্রমিক ভিন্ন ও পরিবর্তিত হয় এবং এটি একই কর্মচারীর জন্য প্রাপ্ত উপযোগের মানের পার্থক্যের ভিত্তিতে ভিন্ন হতে পারে, কিন্তু কখনওই প্রদত্ত শ্রমের মাত্রার ভিন্নতার দরুন নয়। উভয়ক্ষেত্রেই চুক্তি করা হয়েছিল নিয়োগকারী ব্যক্তির প্রাপ্ত উপযোগের ভিত্তিতে, নিয়োগকৃত ব্যক্তির প্রদত্ত শ্রমের পরিমাণের ভিত্তিতে নয়। সুতরাং যেটা বিবেচিত হয় সেটা হচ্ছে শ্রমের ফলাফল বা প্রদত্ত শ্রম হতে প্রাপ্ত উপযোগ, এটা হতে পারে ভিন্ন কর্মচারীর মাধ্যমে সম্পাদিত ভিন্ন কাজ, অথবা ভিন্ন কর্মচারীর মাধ্যমে একই ধরনের কাজ, এবং প্রদত্ত শ্রমের প্রতি কোন গুরুত্ব দেয়া হয় না। এটা সত্য যে, কাজের ফলাফল হচ্ছে শ্রমের ফসল, হোক তা ভিন্ন ভিন্ন কাজের ক্ষেত্রে কিংবা ভিন্ন ভিন্ন লোক কর্তৃক একই কাজ সম্পাদনের ক্ষেত্রে; কিন্তু কাজটির উদ্দেশ্য হচ্ছে ফলাফল, কেবলমাত্র শ্রম নয়, যদিওবা পারিশ্রমিক নিরূপনের ক্ষেত্রে এটার দিকে নজর দেয়া হয়। সুতরাং একজন লোককে যদি নির্মাণ কাজের জন্য ভাড়া করা হয় তাহলে তার পারিশ্রমিক নির্ধারিত হওয়া উচিত সময় বা কাজের ভিত্তিতে। যদি এটি কাজ দ্বারা নিরূপিত হয় তবে অবশ্যই দালানটির অবস্থানে সেটার দৈর্ঘ্য, প্রস্থ, ঘনত্ব ও দালান তৈরির সামগ্রী, ইত্যাদির মধ্যে তার শ্রমের ফলাফল পরিলক্ষিত হবে। যদি কাজটি সময় দ্বারা মূল্যায়িত হয় তবে অধিক পরিমাণ সময় অতিক্রান্ত হলে কাজের উপযোগও অধিক হবে এবং কম পরিমাণ সময় অতিবাহিত হলে কাজের উপযোগও কম হবে। অতএব, সময় উল্লেখ সহকারে কাজের বর্ণনাই হচ্ছে প্রাপ্ত উপযোগের মানদন্ড। যদি কাজটি সময় দ্বারা নিরূপিত হয় তবে নিয়োগকৃত ব্যক্তির স্বাভাবিক সামর্থ্যরে বাইরে অতিরিক্ত কাজ করা উচিত নয়, এবং তাকে কঠোর পরিশ্রমে বাধ্য করা উচিত নয়।
নিষিদ্ধ উপযোগ লাভের জন্য ভাড়া করার ক্ষেত্রে হুকুম
ভাড়ার বিষয়টি আইনত বৈধ হতে হলে তা থেকে প্রাপ্ত উপযোগের প্রকৃতিকে হালাল বা বৈধ হতে হবে। সুতরাং নিষিদ্ধ কোন কিছু করার জন্য কাউকে ভাড়া করা উচিত নয়। তদনুসারে, ক্রেতার কাছে মদ বহনের জন্য বা মদ প্রস্তুত করার জন্য একজন শ্রমিককে ভাড়া করা উচিত নয়। একইভাবে শূকরের মাংস বা পঁচা মাংস বহনের জন্য কাউকে ভাড়া করা উচিত নয়।
আনাস বিন মালিক হতে তিরমিযী বর্ণনা করেছেন যে, তিনি বলেছেন:
“মদের ব্যাপারে দশ ব্যক্তির উপর রাসূলুল্লাহ্ (সা) অভিশম্পাত করেছেন: এর প্রস্তুতকারী, এটি প্রেরণ করার জন্য আহ্বানকারী, এর পানকারী, এর বহনকারী, এটি প্রস্তুতের আদেশকারী, এর পরিবেশনকারী, এর বিক্রেতা যার জন্য এটি বিয়ে করা হয়, এর ক্রেতা এবং যার জন্য এটি ক্রয় করা হয়।”
সুদের সাথে সম্পর্কিত কোন কাজের জন্য ভাড়া করা অনুমোদিত নয়, কারণ এক্ষেত্রে নিষিদ্ধ উপযোগ লাভের জন্য ভাড়া করা হয়, এবং যেহেতু ইবনে মাসুদ থেকে ইবনে মাজাহ্ বর্ণনা করেছেন যে, নবী (সা) সুদখোর, সুদের দালাল, সুদের দুই সাক্ষী ও সুদের হিসাবরক্ষাকারী কেরাণীকে অভিশম্পাত করেছেন।
ব্যাংক, টাকশাল বিভাগ ও সুদকে নিয়ে কাজ করে এমন সব প্রতিষ্ঠানের কর্মচারীদের কাজকে নিরীক্ষা করতে হবে। যে কাজের জন্য তাদেরকে ভাড়া করা হচ্ছে তা যদি সুদ সম্পর্কিত কাজের কোন অংশ হয়, এক্ষেত্রে সুদ হতে পারে ব্যক্তির কাজের সরাসরি ফলাফল, কিংবা হতে পারে তার কাজটির সাথে সাথে অন্যদের কাজের সমন্বিত ফলাফল, তবে এধরনের কাজ করা মুসলিমদের জন্য নিষিদ্ধ। এর মধ্যে রয়েছে ব্যবস্থাপক, হিসাবরক্ষক, হিসাব নিরীক্ষক এবং প্রত্যেকটি কাজ যা সুদের সাথে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে জড়িত কোন উপযোগ প্রদান করে। কিন্তু যেসব কাজ প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে সুদের সাথে সম্পৃক্ত নয় সেগুলো অনুমোদিত, যেমন: কুলি, পাহারাদার, পরিষ্কারক বা এধরনের কাজ, কেননা এধরনের কাজে নিয়োগ দেয়া হয় অনুমোদিত উপযোগের উপর ভিত্তি করে, এবং যেহেতেু সুদের হিসাবরক্ষক ও সুদের সাক্ষীর জন্য যা প্রযোজ্য তা তাদের উপরে প্রযোজ্য নয়। সরকারী কর্মচারীদের মধ্যে সুদের বিষয়ে দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যাংক কর্মকর্তাদের ক্ষেত্রেও একই বিষয় প্রযোজ্য, এদের মধ্যে সেসব কর্মচারী অন্তর্ভুক্ত যারা কৃষকদের জন্য সুদভিত্তিক ঋণ নিয়ে কাজ করে এবং সেসব রাজস্ব কর্মকর্তা যারা সুদ নিয়ে কাজ করে এবং এতিম শিশুদের বিভাগে চাকুরীরত কর্মকর্তাগণ যারা সুদের বিনিময়ে সম্পত্তি ধার দিয়ে থাকে। এসবই নিষিদ্ধ কাজ; এ কাজের সাথে জড়িত যে কেউই ভয়ঙ্কর গোনাহর সাথে সম্পৃক্ত, কারণ যেহেতু সে সুদের হিসাবরক্ষণকারী অথবা এ বিষয়ক কাজের সাক্ষী, সেহেতু এটা তার উপর প্রযোজ্য। একইভাবে, আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা কর্তৃক নিষিদ্ধকৃত যে কোন কাজে সম্পৃক্ত হওয়া মুসলিমের জন্য অবৈধ।
যেসব কাজ থেকে মুনাফা অর্জন বা তাতে শরীক হওয়া নিষিদ্ধ কারণ তা আইনত অবৈধ যেমন বীমা কোম্পানী, শেয়ার হোল্ডিং কোম্পানী, সমবায় সমিতি কিংবা এধরনের যেকোন প্রতিষ্ঠান, সেসব কাজের ক্ষেত্রে তা পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে পরীক্ষা করতে হবে। যদি নিয়োগকৃত ব্যক্তির কাজ অবৈধ হয়, অথবা এটি একটি অবৈধ (বাতিল) কিংবা ত্রুটিযুক্ত (ফাসিদ) চুক্তি হয়, বা সেগুলো থেকে উদ্ভুত হয়, তবে একজন মুসলিমের জন্য এসব দায়িত্ব পালন করা অনুমোদিত নয়, কারণ একজন মুসলিমের জন্য অবৈধ বা ত্রুটিযুক্ত বা এগুলো থেকে উদ্ভূত কাজের সাথে সম্পৃক্ত হওয়া অনুমোদিত নয়। হুকুম শারী’য়াহ্’র সাথে সাংঘর্ষিক কোন চুক্তি বা কাজের সাথে সম্পৃক্ত হওয়া একজন মুসলিমের জন্য অনুমোদিত নয়, সুতরাং ভাড়ার বিনিময়ে একটি নিষিদ্ধ কাজে সম্পৃক্ত হওয়া তার জন্য অনুমোদিত নয়। এটা অনেকটা সেই বীমা কর্মকর্তার মত যে অপছন্দ করার পরেও এর নথিপত্র সংরক্ষণ করে, যে ব্যক্তি বীমা চুক্তির ব্যাপারে দর কষাকষি/মধ্যস্থতা করে, অথবা যে ব্যক্তি বীমা গ্রহণ করে। একইভাবে, যে কর্মচারী হোল্ডিং সদস্যপদ অনুসারে সমবায় সমিতির লভ্যাংশ বন্টন করে, যে কর্মকর্তা কোম্পানীর শেয়ার বিক্রি করে, অথবা যে শেয়ার স্টকের হিসবাবরক্ষণ নিয়ে কাজ করে এবং যে সমবায় সমিতির জন্য প্রচারণা চালায় এবং এধরনের কাজসমূহ সম্পাদন করে।
যেসব কোম্পানী বৈধভাবে প্রতিষ্ঠিত, সেসব কোম্পানীর সকল বৈধ কাজসমূহ এবং বিভিন্ন পদে যোগদান করাও বৈধ। যদি একজন ব্যক্তির জন্য কোন কাজ করার বৈধতা না থাকে তবে কাজটি করার জন্য সে কর্মচারী হিসেবে যোগদান করতে পারে না এবং সেটা করার জন্য সে নিয়োগের আমন্ত্রণ গ্রহণ করতে পারে না। সুতরাং যেসব কাজ করা নিষিদ্ধ, সেসব কাজ করার জন্য মুসলিমগণ অন্য কাউকে ভাড়াও করতে পারবে না বা নিজে পারিশ্রমিকের বিনিময়ে সেই কাজে নিয়োজিতও হতে পারবে না।
নিয়োগকারী ও কর্মচারী কারও জন্যই মুসলিম হওয়া শর্ত নয়। সুতরাং, একজন মুসলিম কোন অমুসলিমকে নিয়োগ/ভাড়া করতে পারে, রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর কাজ ও সাহাবীদের (রা) ঐকমত্য থেকে এটি জানা যায় যে, রাষ্ট্রীয় কাজসহ যেকোন মুবাহ্ বা অনুমোদিত কাজে একজন মুসলিম একজন অমুসলিমকে ভাড়া করতে পারে। রাসূলুল্লাহ্ (সা) একজন ইহুদীকে কেরানি, আরেকজন ইহুদীকে অনুবাদক এবং একজন মুশরিককে পথ প্রদর্শক হিসেবে নিয়োগ দিয়েছিলেন। আবু বকর (রা) ও ওমর (রা) তহবিলের হিসাবরক্ষক হিসেবে খ্রীস্টান ব্যক্তিদেরকে নিয়োগ দিয়েছিলেন। যেরকম মুসলিমদের জন্য অমুসলিমদের ভাড়া করা বৈধ সেরকম একজন অমুসলিমও বৈধ কাজের জন্য মুসলিমদেরকে ভাড়া করতে পারে। নিয়োগদানকারী ব্যক্তি মুসলিম বা অমুসলিম যাই হোক না কেন, তার জন্য নিষিদ্ধ কাজ করা বৈধ নয়। সুতরাং, একজন মুসলিমকে একজন খ্রীস্টান তার হয়ে কাজ করার জন্য ভাড়া করতে পারে। তবে এর মধ্যে ঐ ধরনের কাজ অন্তর্ভুক্ত নয় যেখানে একজন মুসলিমকে কাফেরের কাছে অপমানিত হতে হয়। বরং, এটি হল বৈধ কোন কাজ করার জন্য নিজেকে অন্যের কাজে নিয়োজিত করা, এবং এক্ষেত্রে নিয়োগকর্তা বা কর্মচারী কারও জন্য ইসলামে বিশ্বাস করা শর্ত নয়। আলী (রা.) একজন ইহুদীর জন্য প্রতি বালতি পানি এক খেজুরের বিনিময়ে তুলে দেয়ার কাজে নিজেকে নিয়োজিত করেছিলেন এবং এ বিষয়টি তিনি রাসূলুল্লাহ্কে (সা) অবহিত করেছিলেন এবং তিনি (সা) এটা নিষেধ করেননি। এছাড়াও, ভাড়া হল বিনিময়ের একটি চুক্তি যাতে মুসলিমদের জন্য অমর্যাদাকর কোন কিছু থাকতে পারবে না। তবে সে কাজের উদ্দেশ্য যদি হয় সর্বশক্তিমান আল্লাহ্’র নৈকট্য অর্জন, তাহলে নিয়োগকৃত ব্যক্তিটি মুসলিম হওয়া বাঞ্চণীয়। উদাহরণস্বরূপ: নামাজে ইমামতি করা, আজান দেয়া, হজ্জ্ব করা, যাকাত বন্টন করা এবং কুর’আন ও হাদীস শিক্ষা দেয়া। কারণ, এগুলো মুসলিম ব্যতিরেকে অন্য কারও জন্য আইনত বৈধ নয়, সুতরাং এসব কাজ করানোর জন্য মুসলিম ব্যতিত অন্য কাউকে নিয়োগ করা হয় না। এ ধরনের কাজের ইল্লাহ্ বা শারী’আহ্গত কারণ হল, একজন মুসলিম ব্যতিরেকে অন্য কারও জন্য এগুলো বৈধ নয়। তবে কাজের উদ্দেশ্য যদি হয় সর্বশক্তিমান আল্লাহ্’র নৈকট্য অর্জন এবং কাজটিতে যদি অমুসলিমের অংশগ্রহণে শারী’আহ্গত কোন প্রতিবন্ধকতা না থাকে তবে তাকে ভাড়া করা বৈধ। সংক্ষেপে বলা যায় যে, একজন নিয়োগদানকারী ব্যক্তি যদি কাজটিকে আল্লাহ্’র নৈকট্য অর্জনের মাধ্যম হিসেবে বিবেচনা করে, কিন্তু নিয়োগকৃত ব্যক্তি সেরকম মনে না করে তবে বিষয়টি পরীক্ষা করে দেখতে হবে। যদি সেগুলো মুসলিম ব্যতিত অন্য কারও জন্য বৈধ না হয়, যেমন: বিচারিক কাজ (কাদা’আ), তাহলে একজন অমুসলিমকে কাজটি করার জন্য নিয়োগ দেয়া যাবে না। তবে যদি একজন অমুসলিমের জন্য কাজটি করা বৈধ হয়, যেমন: জিহাদ করা, তাহলে তাকে একাজের জন্য ভাড়া করা যাবে। সুতরাং, একজন জিম্মি বা অমুসলিমকে জিহাদের জন্য ভাড়া করা যাবে এবং বায়তুল মাল থেকে তার পারিশ্রমিক দেয়া হবে।
প্রার্থনা বা জনসেবামূলক কাজের জন্য কাউকে নিয়োগ/ভাড়া করা
চুক্তি হিসেবে ভাড়ার সংজ্ঞায় শর্ত রয়েছে যে, শ্রম হতে প্রাপ্ত উপযোগের বিনিময়ে পারিশ্রমিক প্রদান করতে হবে এবং এটাও রয়েছে যে উপযোগ হল এমন একটি বিষয় যা নিয়োগকারী ব্যক্তি পুরোপুরি গ্রহণ করতে পারে, এ থেকে বোঝা যায় যে সকল ধরনের উপযোগ লাভের জন্য নিয়োগ দেয়া অনুমোদিত, যা নিয়োগকৃত ব্যক্তি হতে নিয়োগকারী পুরোপুরি গ্রহণ করতে পারে। এটি হতে পারে চাকরের কাছ থেকে প্রাপ্ত উপযোগ, কিংবা একজন কারিগরের কাজ থেকে প্রাপ্ত উপযোগ, যদিনা শরীয় নির্দেশনা পাওয়া যায় যে এধরনের উপযোগ নিষিদ্ধ। এর কারণ হল, জিনিসসমূহ আদতে বৈধ এবং এদের মধ্যে উপযোগ একটি। এটা বলা অসত্য হবে যে, এটি এমন একটি চুক্তি বা লেনদেন যা আদতে বৈধ হওয়ার চেয়ে বরং প্রকৃতপক্ষে শারী’আহ্ দ্বারা সীমাবদ্ধ হওয়া উচিত। এটা অসত্য কারণ, চুক্তি হচ্ছে নিয়োগটি নিজেই, উপযোগ নয়। উপযোগ হচ্ছে এমন একটি বিষয় যার উপর লেনদেন সম্ভব হয় ও চুক্তি সাধিত হয়, এবং এজন্যই উপযোগ কোন লেনদেন বা চুক্তি নয়। সুতরাং, নিষিদ্ধ নয় এমন সব ধরনের উপযোগের জন্য ভাড়া করা বৈধ, এক্ষেত্রে অনুমতির ব্যাপারে শারী’আহ্ উৎসে কোন নির্দেশনা থাকুক বা না থাকুক। সুতরাং, একজন ব্যক্তি একটি টাইপরাইটারে তার জন্য টাইপ করার কাজে নির্দিষ্ট পৃষ্ঠার জন্য নির্দিষ্ট পারিশ্রমিকের বিনিময়ে পুরুষ বা নারীকে ভাড়া করতে পারে, কারণ এক্ষেত্রে এমন একটি উপযোগ লাভের জন্য ভাড়া করা হচ্ছে যার বিষয়ে কোন নিষেধাজ্ঞা উল্লেখ করা হয়নি। সুতরাং, এ ব্যাপারে অনুমোদনের বিষয়ে শারী’আহ্ উৎসে কোন সুনির্দিষ্ট দলিল না থাকা সত্ত্বেও কাউকে ভাড়া করা বৈধ। এমন একজন ব্যক্তিকেও নিয়োগ দেয়া বৈধ যে সুনির্দিষ্ট সময়ে সুনির্দিষ্ট কাজের জন্য পরিমাপ ও ওজন করবে। সুয়াইদ ইবনে কায়েসের হাদীসের মাধ্যমে ইবনে দাউদ বর্ণনা করেছেন যে, তিনি বলেছেন: “রাসূলুল্লাহ্ (সা) বাজারে আমাদের কাছে আসলেন এবং তিনি (সা) আমাদের সাথে পণ্যদ্রব্য বিনিময় করলেন এবং আমরা তাঁর (সা) কাছে বিক্রয় করলাম। সেখানে একজন ব্যক্তি ছিল যে পারিশ্রমিকের বিনিময়ে ওজন করছিল। অতঃপর রাসূলুল্লাহ্ (সা) বললেন, ‘পরিমাপ কর এবং পাল্লার ওজনে অধিক কর।’ সুতরাং, এ ধরনের ভাড়া করা বৈধ এবং এ ব্যাপারে দলিল রয়েছে। কিন্তু ইবাদতের ক্ষেত্রে, হোক সেটি ফরয বা নফল, তা পরীক্ষা করে দেখতে হবে। যদি এ কাজের উপযোগ আদায়কারী ব্যক্তি ব্যতিরেকে অন্য কারও মধ্যে সঞ্চারিত না হয়, যেমন: নিজের জন্য হজ্জ্ব করা, নিজের যাকাত প্রদান করা, তবে সে এর জন্য কোন পারিশ্রমিক পাবে না, কারণ পারিশ্রমিক হল একটি উপযোগের প্রতিফলস্বরূপ এবং এসব ক্ষেত্রে আর কারও জন্য নয় বরং আদায়কারী ব্যক্তির নিজের জন্যই তা নির্দিষ্ট থাকে। তদানুসারে এসব কাজে তাকে ভাড়া করা অনুমোদিত নয়, কারণ এগুলো তার উপর ফরয। কিন্তু যদি ইবাদতের উপযোগ এমন হয় যে তা সম্পাদনকারীকে ছাড়িয়ে যায় তাবে এজন্য কাউকে ভাড়া করা অনুমোদিত। উদাহরণস্বরূপ: অন্যদের জন্য আজান দেয়া, নামাজে ইমামতি করা, একজন মৃত ব্যক্তির পক্ষে হজ্জ্ব করার জন্য কাউকে ভাড়া করা, অথবা একজন ব্যক্তির পক্ষে যাকাত প্রদান করার জন্য কাউকে ভাড়া করা। এগুলো সবই বৈধ, কারণ পারিশ্রমিকের বিনিময়ে কোন একটি উপযোগ লাভের জন্য এধরনের চুক্তি করা হয়। এখানে পারিশ্রমিক হল উপযোগের প্রতিফল, যা অন্য একজন ব্যক্তি কর্তৃক সম্পাদিত হয়েছে বিধায় এধরনের নিয়োগ বৈধ। এ প্রসঙ্গে উসমান ইবনে আবি আল আ’স থেকে আত তিরমিযী বর্ণনা করেছেন যে, তিনি বলেছেন: “সর্বশেষ যে কাজটি করার জন্য রাসূলুল্লাহ্ (সা) আমাকে নির্দেশ দিয়েছিলেন তা হচ্ছে এমন একজন মুয়াজ্জিন নিয়োগ করা যিনি আজানের জন্য পারিশ্রমিক গ্রহণ করেন না।” এ হাদীসের মাধ্যমে রাসূলুল্লাহ্ (সা) এমন একজন মুয়াজ্জিনকে কাজে লাগাতে বলেছেন যিনি তার কাজের জন্য পারিশ্রমিক গ্রহণ করেন না, কিন্তু এর মাধ্যমে তিনি মুয়াজ্জিনের জন্য পারিশ্রমিক গ্রহণ করাকে নিষিদ্ধ করেননি। এর দ্বারা বোঝা যায় যে, এমন কিছু মুয়াজ্জিন আছেন যারা পারিশ্রমিক গ্রহণ করেন এবং কিছু আছেন যারা পারিশ্রমিক গ্রহণ করেন না। সুতরাং, রাসূলুল্লাহ্ (সা) তাকে পারিশ্রমিক গ্রহণকারী মুয়াজ্জিনদের মধ্য হতে কাউকে নিয়োগ দিতে নিষেধ করেছেন। এই নিষেধাজ্ঞা আজান দেয়ার বিনিময়ে পারিশ্রমিক গ্রহণ করাকে পারিশ্রমিক গ্রহণ না করা হতে বিচ্ছিন্ন করার দিকে নির্দেশ করে। যা দ্বারা বোঝা যায় যে আজান দিয়ে পারিশ্রমিক গ্রহণ করা অপছন্দনীয়। তবে এর দ্বারা আজান দেয়ার বিনিময়ে পারিশ্রমিক গ্রহণ করার নিষেধাজ্ঞার প্রতি নির্দেশ করা হয়নি। বরং এটা নির্দেশ করে যে, এটি বৈধ।
শিক্ষাদানের ক্ষেত্রে, একজন ব্যক্তি তার সন্তানদেরকে অথবা নিজেকে বা পছন্দনীয় কাউকে শিক্ষাদানের জন্য কাউকে নিয়োগ/ভাড়া করতে পারে। কারণ, শিক্ষা হল একটি বৈধ (মুবাহ্) উপযোগ, যার জন্য পারিশ্রমিক গ্রহণ করা যায়। সুতরাং, একাজের জন্য নিয়োগ/ভাড়া করা বৈধ। এবং শারী’আহ্ কুর’আন শিক্ষা দেয়ার জন্য পারিশ্রমিক গ্রহণ করাকে অনুমোদন দিয়েছে। সুতরাং, বৃহত্তর যুক্তিবিচারে কুর’আন ছাড়া অন্য কিছু শিক্ষা দিয়ে পারিশ্রমিক গ্রহণ করাও বৈধ।
ইবনে আব্বাস থেকে বুখারী বর্ণনা করেছেন যে, রাসূলুল্লাহ্ (সা) বলেছেন যে:
“সর্বোত্তম বিষয় হচ্ছে আল্লাহ্’র কিতাব শিক্ষা দিয়ে পারিশ্রমিক গ্রহণ করা।”
এছাড়াও, সাহল ইবনে সা’দ আস সা’য়িদী থেকে বুখারী বর্ণনা করেছেন যে, রাসূলুল্লাহ্ (সা) একজন মহিলাকে একজন পুরুষের সাথে কুর’আনের যতটুকু সে জানে তার বিনিময়ে বিয়ে দিয়েছেন, অর্থাৎ ঐ ব্যক্তি তার স্ত্রীকে কুর’আনের যতটুকু সে জানে তা শিক্ষা দিবে। এ ব্যাপারে সাহাবাদের (রা.) ঐকমত্য ছিল যে, শিক্ষার জন্য বায়তুল মাল থেকে বরাদ্দ নেয়া বৈধ, সুতরাং এর জন্য পারিশ্রমিক গ্রহণ করা বৈধ।
আল-ওয়াদিয়া ইবনে আতা’আ হতে সাদাকা আল-দিমাশকি এবং সাদাকা আল-দিমাশকি হতে আবি শিবা কর্তৃক বর্ণিত আছে যে, তিনি বলেছেন: “তিনজন ব্যক্তি ছিলেন যারা মদীনার বালকদের শিক্ষা দিতেন এবং ওমর আল-খাত্তাব (রা) তাদের প্রত্যেককে প্রতিমাসে পনের দিনার করে পারিশ্রমিক প্রদান করতেন।” এসব কিছুই নির্দেশ করে যে, শিক্ষাদানের বিনিময়ে পারিশ্রমিক গ্রহণ করা বৈধ। পারিশ্রমিক নেয়ার বিষয়ে নিরুৎসাহিত করে যে হাদীসসমূহ এসেছে সেগুলোতে কুর’আন শিক্ষা দেয়ার জন্য লোকদের ভাড়া করার উপর নিষেধাজ্ঞা প্রদান নয়, বরং সেসব হাদীসের মূল লক্ষ্য ছিল কুর’আন শিক্ষা দেয়ার জন্য পারিশ্রমিক নেয়ার ব্যাপারে নিরুৎসাহিত করা। এগুলো সবই কুর’আন শিক্ষা দিয়ে পারিশ্রমিক গ্রহণ করাকে অপছন্দনীয় বলে নির্দেশ করে, কিন্তু এর জন্য কাউকে নিয়োগ/ভাড়া করাকে নিষিদ্ধ করেনি। পারিশ্রমিক গ্রহণের অপছন্দনীয়তা এর বৈধতা অস্বীকার করে না, সুতরাং কুর’আন শিক্ষা দিয়ে পারিশ্রমিক গ্রহণ করা অপছন্দনীয়, তথাপিও এ কাজের জন্য কাউকে নিয়োগ/ভাড়া করা যাবে।
একজন ডাক্তার নিয়োগ/ভাড়া করার ক্ষেত্রে বলা যায় যে এটা বৈধ, কেননা এতে এমন একটি উপযোগ রয়েছে যা নিয়োগকারী গ্রহণ করতে পারে, কিন্তু আরোগ্যকরণের জন্য তাকে ভাড়া করা যাবে না, কারণ এটা তখন অজ্ঞাত বিষয়ের উপর ভাড়া করা হবে। তবে একজন রোগীকে পরীক্ষানিরীক্ষা করার জন্য ডাক্তার ভাড়া করা যাবে, কারণ এটা জ্ঞাত উপযোগের উপর করা হবে এবং একজন রোগীর সেবার উদ্দেশ্যে একটি নির্দিষ্ট সময়ের জন্য ডাক্তার ভাড়া করা যাবে, কারণ এক্ষেত্রে নির্ধারিত কাজের জন্য একজনকে ভাড়া করা হচ্ছে। রোগীর চিকিৎসার জন্য ডাক্তারকে ভাড়া করা বৈধ, কারণ তার চিকিৎসা এমনভাবে জ্ঞাত যা অজ্ঞানতাকে দূরীভূত করে, যদিওবা রোগের ধরন পরিচিত নাও হতে পারে, তথাপি এক্ষেত্রে এটুকু জানাই যথেষ্ট যে, রোগী অসুস্থ।
একজন ডাক্তারকে ভাড়া করার বৈধতার বিষয়টি প্রতিষ্ঠিত, কারণ ঔষধ এমন একটি উপযোগ যা নিয়োগকারী ব্যক্তি গ্রহণ করতে পারে, সুতরাং, এটার ভিত্তিতে নিয়োগ দেয়া বৈধ। এছাড়াও এটা উল্লেখ আছে যে, রাসূলুল্লাহ্ (সা) ঔষধের জন্য ভাড়া করার বৈধতার প্রতি নির্দেশ করেছেন। আনাস (রা) থেকে বুখারী বর্ণনা করেছেন যে, তিনি বলেছেন: “রাসূলুল্লাহ্ (সা) আবু তাইয়্যিবাকে রক্তমোক্ষক কাঁচ প্রয়োগের জন্য ডেকেছিলেন এবং এরপর তাকে দুই সা’আ (A Cubic Mesure) খাদ্য দিয়েছিলেন এবং তার উপর ন্যস্তকৃত কাজের ভার কমিয়ে দেয়ার জন্য তার মনিবের কাছে সুপারিশ করেছিলেন।” সে সময় উত্তপ্ত কাঁচের পেয়ালা ব্যবহার করে চামড়ার উপরে আংশিক শূন্যস্থান তৈরী করে রক্তমোক্ষণ করার এক ধরনের চিকিৎসা পদ্ধতিতে লোকদের চিকিৎসা করা হত। সুতরাং, এটা করার মাধ্যমে পারিশ্রমিক গ্রহণ করার অর্থ হল এ ব্যাপারে ডাক্তার ভাড়া করা বৈধ। রাফি’আ ইবনে খাদিজ থেকে তিরমিযী বর্ণনা করেছেন যে, রাসূলুল্লাহ্ (সা) এ ব্যাপারে বলেছেন: “রক্তমোক্ষক কাঁচ প্রয়োগকারীর উপার্জন কুৎসিত (কাবিহ্)”, যা একজন রক্তমোক্ষক কাঁচ প্রয়োগকারীকে ভাড়া না করার ব্যাপারে কোন নির্দেশনা প্রদান করে না। বরং, রক্তমোক্ষক কাঁচ প্রয়োগের মাধ্যমে উপার্জন করাকে অপছন্দনীয় হিসেবে নির্দেশ করে, যদিওবা মা’দান ইবনে আবি তালহা থেকে মুসলিম কর্তৃক বর্ণিত হাদীসের ভিত্তিতে এটিকে মুবাহ্ বলা হয়েছে, যেখানে রাসূলুল্লাহ্ (সা) রসুন ও পেঁয়াজ খাওয়াকে নিন্দনীয় বলেছেন, যদিও এগুলো বৈধ। এসবই ব্যক্তি পর্যায়ের শ্রমিকের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য।
কিন্তু যে শ্রমিকের উপযোগ সার্বজনীন তার ক্ষেত্রে তার প্রদত্ত সেবাকে এমনভাবে বিবেচনা করা হয় যে রাষ্ট্রকে তা জনগণের জন্য সরবরাহ করার ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হয়। এর কারণ হল, যদি কোন কাজের উপযোগ ব্যক্তিকে ছাড়িয়ে কোন সম্প্রদায়ের কাছে পৌঁছে যায় এবং সম্প্রদায়ের জন্য প্রয়োজনীয় হয় তবে তা জনস্বার্থ হিসেবে বিবেচিত হবে এবং বায়তুল মালকে সকল মানুষের জন্য তা সরবরাহ করার ব্যবস্থা করতে হবে। এর একটি উদাহরণ হল, যখন শাসক জনগণের বিচারকার্য সম্পাদনের জন্য মাসিক বেতনের ভিত্তিতে একজন বিচারককে নিয়োগ/ভাড়া করে, কিংবা বিভিন্ন বিভাগে ও সেবার জন্য কর্মকর্তা নিয়োগ করে এবং মুয়াজ্জিন ও ইমামকে নিয়োগ/ভাড়া করে। এছাড়াও, জনগণের জন্য শিক্ষা ও চিকিৎসা সেবা নিশ্চিত করার জন্য রাষ্ট্রকে কর্মচারী নিয়োগ/ভাড়া করতে হয়। শিক্ষা ক্ষেত্রে শিক্ষকদেরকে ভাতা প্রদানের বিষয়ে সাহাবীদের (রা) ঐকমত্য বা ইজমা অনুসারে তাদেরকে বায়তুল মাল থেকে সুনির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ পারিশ্রমিক হিসেবে দেয়া হত। এটা একারণেও যে, রাসূলুল্লাহ্ (সা) দশজন নিরক্ষর মুসলিমকে অক্ষরজ্ঞান প্রদান করাকে মুশরিক যুদ্ধবন্দীদের মুক্তিপণ হিসেবে ধার্য করে দিয়েছিলেন, আর এই মুক্তিপণ হল গণীমতের মালের অন্তর্ভূক্ত, যার মালিক হলেন সকল মুসলিম। চিকিৎসা সেবার ক্ষেত্রে এর কারণ হল, একজন চিকিৎসককে রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর জন্য উপহার হিসেবে প্রেরণ করা হয়েছিল এবং তিনি তাকে মুসলিমদের কল্যাণে নিয়োজিত করেন। এখানে বাস্তবতা হল, রাসূলুল্লাহ্ (সা) উপহার গ্রহণ করেছিলেন, কিন্তু তার উপযোগ নিঃশেষ করে ফেলেননি বা ব্যবহার করেননি, বরং তাকে মুসলিমদের সেবায় নিযুক্ত করেন। এ থেকে দলিল পাওয়া যায় যে, এ ধরনের উপহার মুসলিম জনসাধারণের, ব্যক্তিগতভাবে কেবল তাঁর (সা) নয়। যেহেতু রাসূলুল্লাহ্ (সা) একটি উপহার পাবার পর সেটাকে সব মুসলিমের জন্য বরাদ্দ করেন, সেহেতু এ থেকে এই নির্দেশনা পাওয়া যায় যে, এটি সাধারণ মুসলিম জনগণের অধিকারভূক্ত জিনিসসমূহের একটি। সুতরাং, বায়তুল মাল থেকে শিক্ষক ও ডাক্তারদেরকে ভাতা প্রদান করা যাবে। তবে ব্যক্তিগতভাবে যে কেউ ডাক্তার ও শিক্ষক ভাড়া করতে পারে। কিন্তু রাষ্ট্র তার নাগরিকদের জন্য শিক্ষা ও চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে বাধ্য, এক্ষেত্রে জিম্মী বা মুসলিম এবং ধনী বা দরিদ্রের মধ্যে কোন পার্থক্য নেই। এর কারণ হল, এটি আজান ও বিচারব্যবস্থার মতই, যার উপযোগ ব্যক্তিকে ছাড়িয়ে যায় এবং এগুলো জনগণের জন্য প্রয়োজনীয়; সুতরাং, এগুলো জনসেবার মধ্যে অন্তভর্‚ক্ত এবং রাষ্ট্রকে সকল নাগরিকের জন্য এসব সেবার ব্যবস্থা করতে হবে এবং বায়তুল মালকে এগুলোর নিশ্চয়তা প্রদান করতে হবে।