আমরা যদি পুঁজিবাদী অর্থনৈতিক ব্যবস্থা পরীক্ষা করে দেখি, তাহলে দেখতে পাব যে এর দৃষ্টিভঙ্গি হল এটি মানুষের প্রয়োজন (needs) এবং এসব প্রয়োজন পূরণের উপকরণ নিয়ে কাজ করে। পুঁজিবাদী অর্থনৈতিক ব্যবস্থা মানুষের কেবলমাত্র বস্তুগত দিকটি নিয়েই আলোচনা করে এবং এটি তিনটি মূল নীতির উপর প্রতিষ্ঠিত:
১. প্রয়োজনের সাথে সংশ্লিষ্ট পণ্য ও সেবার আপেক্ষিক অভাব (relative scarcity) রয়েছে। এর অর্থ হল মানুষের ক্রমবর্ধমান প্রয়োজন পূরণের জন্য পণ্য ও সেবার অপর্যাপ্ততা। তাদের দৃষ্টিতে এটাই হল সমাজের অর্থনৈতিক সমস্যা।
২. অধিকাংশ অর্থনৈতিক গবেষণা ও অধ্যয়নের ভিত্তি হল উৎপাদিত পণ্যের মূল্য (value)।
৩. উৎপাদন, ভোগ ও বন্টনে দামের (price) ভূমিকা। দাম হল পুঁজিবাদী অর্থনৈতিক ব্যবস্থার একটি মৌলিক বিষয়।
পণ্য ও সেবার আপেক্ষিক অভাবের ক্ষেত্রে বলা যায়, পণ্য ও সেবা মানুষের অভাব পূরণের উপকরণ হওয়ায় এ অবস্থার সৃষ্টি হয়। তারা বলে মানুষের প্রয়োজন রয়েছে যা পূরণ করতে হয় এবং এ প্রয়োজন পূরণের উপকরণ থাকতেই হবে। এ প্রয়োজনসমূহ পুরোপুরিই বস্তুগত (materialistic)। এগুলো হয় দৃশ্যমান (tangible), যেমন: খাদ্য ও বস্ত্রের প্রয়োজন, অথবা এমন সব প্রয়োজন যা মানুষ অনুভব করে এবং এগুলো অদৃশ্যমান (intangible) অর্থাৎ সেবার প্রয়োজন, যেমন: ডাক্তার বা শিক্ষকের সেবা। নৈতিক প্রয়োজন, যেমন: গৌরব ও সম্মান অথবা আধ্যাত্মিক প্রয়োজন, যেমন: স্রষ্টার উপাসনা করা, এগুলো অর্থনৈতিকভাবে স্বীকৃত নয়। একারণে এগুলো পরিত্যাগ করা হয়, ফলে অর্থনৈতিক আলোচনায় এগুলোর কোন স্থান নেই।
প্রয়োজন পূরণের উপকরণসমূহকে পণ্য ও সেবা বলা হয়। পণ্য হল দৃশ্যমান প্রয়োজন পূরণের উপকরণ এবং সেবা হল অদৃশ্যমান প্রয়োজন পূরণের উপকরণ। তাদের দৃষ্টিতে যা পণ্য ও সেবাকে প্রয়োজন পূরণ করতে দেয়, তা হল পণ্য ও সেবার মধ্যে থাকা সুযোগ-সুবিধা বা উপযোগ। এই উপযোগ এমন একটি বৈশিষ্ট্য যা প্রয়োজন পূরণের জন্য আকাঙ্খিত বস্তু থেকে পাওয়া যায়। যেহেতু প্রয়োজন হল অর্থনৈতিক আকাঙ্খা, সেহেতু আকাঙ্খিত প্রতিটি বস্তুই অর্থনৈতিকভাবে উপকারী – হোক তা অপরিহার্য বা তা নয়, কিংবা কিছু সংখ্যক লোক এটিকে উপকারী মনে করুক এবং অন্য কিছু সংখ্যক এটিকে ক্ষতিকর মনে করুক। এটি ততক্ষণ পর্যন্ত অর্থনৈতিকভাবে উপকারী যতক্ষণ পর্যন্ত কেউ একে আকাঙ্খিত মনে করে। যেকোন বস্তুকে অর্থনৈতিকভাবে লাভজনক কিনা শুধুমাত্র সে দৃষ্টিতে বিবেচনা করা হয়, যদিও বা জনমত এটিকে অলাভজনক বা ক্ষতিকারক মনে করে। সেকারণে মদ ও হাসিস অর্থনীতিবিদদের কাছে লাভজনক, কেননা কিছু লোক এগুলো চায়।
অন্য কোন বাস্তবতা বিবেচনায় না এনে কেবলমাত্র প্রয়োজন পূরণ করে- এ দৃষ্টিভঙ্গি থেকে অর্থনীতিবিদ প্রয়োজন পূরণের উপকরণের দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করে অর্থাৎ পণ্য ও সেবার দিকে লক্ষ্য করে। সুতরাং সে প্রয়োজন ও উপযোগ এ দু’টি যেরূপ বিদ্যমান ঠিক সেভাবেই দেখে, কিন্তু এগুলো কিরকম হওয়া উচিত সেদিকে দৃষ্টিপাত করেনা অর্থাৎ সে অন্য কোন কিছুকে বিবেচনায় না এনে উপযোগকে প্রয়োজন পূরণের নিয়ামক হিসেবে দেখে। সুতরাং কিছু লোকের চাহিদা মেটানোর কারণে সে মদকে অর্থনৈতিকভাবে মূল্যবান হিসেবে বিবেচনা করে এবং অর্থনৈতিক মূল্য বিবেচনা করে মদ প্রস্তুতকারীকে একজন সেবাপ্রদানকারী হিসেবে মনে করে। কারণ এটি কিছু ব্যক্তির অভাব পূরণ করে।
এটিই হল পুঁজিবাদে প্রয়োজন ও তা পূরণের উপকরণের প্রকৃতি। সেকারণে অর্থনীতিবিদ সমাজের প্রকৃতির তোয়াক্কা করে না, কিন্তু তারা অর্থনৈতিক বস্তুগত সম্পদ বা অর্থনৈতিক পণ্যের ব্যাপারে যত্মশীল কারণ এগুলো প্রয়োজন পূরণ করে। সুতরাং তাদের মতানুসারে অন্য কোন কিছু বিবেচনায় না এনে মানুষের প্রয়োজন পূরণের উপকরণ যোগানের জন্য পণ্য ও সেবা সরবরাহ নিশ্চিত করা দরকার। অর্থাৎ, প্রয়োজন পূরণের উপকরণ সরবরাহ করা দরকার। প্রয়োজন পূরণের উপকরণ হিসেবে পণ্য ও সেবা যেহেতু সীমিত সেহেতু এগুলো মানুষের সব প্রয়োজন পূরণের জন্য পর্যাপ্ত নয়। কারণ তাদের দৃষ্টিতে এই প্রয়োজনসমূহ অসীম এবং ক্রমাগত বৃদ্ধি পাচ্ছে। এটি একারণে যে, মানুষের রয়েছে এমন কিছু মৌলিক প্রয়োজন যা তাকে পূরণ করতেই হয় এবং এমন কিছু প্রয়োজন রয়েছে যা নগরায়নের সাথে সাথে বৃদ্ধি পায়। এ চাহিদাসমূহ গুনিতক হারে বাড়তেই থাকে এবং এগুলো পুরোপুরি পূরণ করা দরকার। যদিও পণ্য ও সেবা যতই বৃদ্ধি পাক না কেন, এগুলো কখনই পূরণ হবার নয়। এ ভিত্তি থেকে অর্থনৈতিক সমস্যার সূত্রপাত হয়, যা হল প্রয়োজনের অতিরিক্ত বোঝা এবং এগুলো পূরণের জন্য উপকরণের অপ্রতুলতা অর্থাৎ মানুষের সব অভাব পূরণের জন্য পণ্য ও সেবার অপ্রতুলতা।
এ দৃষ্টিভঙ্গি থেকে সমাজ একটি অর্থনৈতিক সমস্যার সম্মুখীন হয় এবং তা হল পণ্য ও সেবার আপেক্ষিক দুষ্প্রাপ্যতা। এ দুষ্প্রাপ্যতার অপরিহার্য ফল হল কিছু প্রয়োজন আংশিকভাবে পূরণ হয় এবং কিছু কখনই পূরণ হয় না। যেহেতু এটাই হল অবস্থা সেহেতু এটি অপরিহার্য যে সমাজের সদস্যগণ এমন আইনের ব্যাপারে একমত হবেন- যা নির্ধারণ করবে কোন প্রয়োজনগুলো পূরণ হওয়া উচিত এবং কোনগুলো নয়। অন্যকথায় এমন আইন প্রণয়ন করা জরুরী যা অসীম অভাব পূরণ করার জন্য সীমিত সম্পদ বন্টনের ব্যবস্থা করবে। সুতরাং তাদের দৃষ্টিভঙ্গি মানুষের চেয়ে প্রয়োজন ও সম্পদকে বেশী গুরুত্ব প্রদান করেছে। অর্থাৎ সমস্যা হল প্রয়োজন পূরণের জন্য সম্পদকে সুলভ করতে হবে, কিন্তু সেটা প্রত্যেক ব্যক্তির জন্য নয়। সুতরাং এটি অপরিহার্য যে যেসব আইন প্রণয়ন করা হবে সেগুলোকে অবশ্যই সর্বোচ্চ পরিমাণ উৎপাদনের নিশ্চয়তা প্রদান করতে হবে যাতে করে সম্পদের সর্বোচ্চ সরবরাহ অর্জন করা সম্ভবপর হয়। অর্থাৎ সামগ্রিতকভাবে জাতির কাছে পণ্য ও সেবা সরবরাহ করা যায়, অবশ্যই প্রত্যেক ব্যক্তির কাছে নয়। সুতরাং পণ্য ও সেবার বন্টন উৎপাদনের সমস্যার সাথে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত এবং অর্থনীতি অধ্যয়ন ও গবেষণার উদ্দেশ্য হল সমাজের ভোগের জন্য পণ্য ও সেবা বৃদ্ধি করা। সুতরাং এটি অবাক হওয়ার বিষয় নয় যে যেসব নিয়ামক জাতীয় আয়ের (GDP and GNP) আকারকে প্রভাবিত করে সেগুলোর অধ্যয়ন বাদ বাকী সব কিছুর উপর প্রাধান্য লাভ করে। কারণ জাতীয় আয় বৃদ্ধির অধ্যয়ন অর্থনৈতিক সমস্যা অর্থাৎ প্রয়োজনের বিপরীতে পণ্য ও সেবার দুষ্প্রাপ্যতার সমস্যার সমাধান করার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। কারণ তারা মনে করে উৎপাদন বৃদ্ধি করা ছাড়া দরিদ্রতা ও বঞ্চনা নিরসন করা সম্ভব নয়। সুতরাং সমাজ যেসব অর্থনৈতিক সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছে সেগুলোর সমাধান কেবলমাত্র উৎপাদন বৃদ্ধির মাধ্যমেই করা সম্ভব।
উৎপাদিত পণ্যের মূল্য (value) বলতে এর গুরুত্বের মাত্রাকে বুঝায়; যেখানে কোন এক বিশেষ ব্যক্তির বা কোন এক বিশেষ বস্তুর সাপেক্ষে সে মাত্রা নির্ধারিত হয়। প্রম ক্ষেত্রে এটাকে ‘উপযোগের মূল্য’ (The Value of The Benefit) বলা হয় এবং দ্বিতীয় ক্ষেত্রে এটিকে ‘বিনিময়ের মূল্য’ (value of exchange) বলা হয়। একটি বস্তু থেকে প্রাপ্ত উপযোগকে যেভাবে বর্ণনা করা যায় তার চুম্বকাংশ হল: একটি বস্তুর যে কোন এককের উপযোগের মূল্য এর প্রান্তিক উপযোগ দ্বারা পরিমাপ করা হয় অর্থাৎ সর্বনিম্ন প্রয়োজন যে পরিমাণ বস্তু দ্বারা পূরণ করা যায় সে পরিমাণ বস্তুর উপযোগ। তারা এটিকে ‘প্রান্তিক উপযোগ তত্ত্ব’ বা ‘The Theory Of Marginal Utility’ বলে। এর অর্থ হল উপযোগ কেবলমাত্র এর উৎপাদকের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে পরিমাপ করা হয় না অর্থাৎ উৎপাদন খরচ দ্বারা মূল্যায়িত হয় না, তাহলে সেক্ষেত্রে চাহিদা বিবেচনা না করে কেবল যোগানই বিবেচনা করা হত। আবার এটিকে কেবলমাত্র ভোক্তার দৃষ্টিভঙ্গি থেকে বিবেচনা করা ঠিক হবে না অর্থাৎ এর উপযোগ এবং চাহিদা বিবেচনা করার সাথে সাথে এর আপেক্ষিক দুষ্প্রাপ্যতা বিবেচনা করতে হবে। কেননা এতে করে যোগানের বিষয়টি হিসেবে না এনে চাহিদা বিবেচনা করা হবে। বাস্তবিকভাবে তারা বলে যে, যোগান ও চাহিদার ভিত্তিতে একত্রে উপযোগকে দেখা উচিত। সুতরাং সর্বনিম্ন যে উপযোগ প্রয়োজন পূরণ করে তার ভিত্তিতে একটি বস্তুর উপযোগ পরিমাপ করা হয় অর্থাৎ সন্তুষ্টির সর্বনিম্ন বিন্দু থেকে। সুতরাং এক টুকরো রুটির মূল্য সবচেয়ে কম ক্ষুধার্ত থাকা অবস্থায় পরিমাপ করা হবে, সর্বাধিক ক্ষুধার্ত অবস্থায় নয় এবং সেসময় বাজারে রুটি সুলভ থাকতে হবে এবং যখন সুলভ নয় এমন অবস্থায় পরিমাপ করা যাবে না।
বিনিময়ের মূল্যের ক্ষেত্রে বলা যায়, এটি হল একটি বস্তুর এমন বৈশিষ্ট্য যা থাকার কারণে সেটি বিনিময়ের উপযোগী হয়। একটি বস্তুর বিনিময়ের শক্তিমত্তা আপেক্ষিকভাবে অন্য একটি বস্তুর সাথে তুলনা করে নিরূপণ করা হয়; যেমন: ভূট্টার সাথে গমের বিনিময় মূল্য হিসেব করতে হলে দেখতে হবে এক একক গম পাবার জন্য কত একক ভূট্টা বিনিময় করতে হয়। তারা কেবলমাত্র ‘উপযোগ’ শব্দ দ্বারা উপযোগের মূল্য এবং কেবলমাত্র ‘মূল্য’ শব্দ দ্বারা বিনিময়ের মূল্য বুঝিয়ে থাকে।
মূল্যের দিক থেকে সামঞ্জস্যপূর্ণ দু’টি পণ্য ও সেবার মধ্যে বিনিময় সংঘটিত হয়। সেকারণে অর্থনীতিবিদদের জন্য মূল্য অধ্যয়ন করা অপরিহার্য। কেননা এটি হল বিনিময়ের ভিত্তি এবং এমন একটি উপযোগ যা পরিমাপ করা যায়। এটি এমন একটি মানদন্ড যার মাধ্যমে পণ্য ও সেবা পরিমাপ করা হয় এবং এর মাধ্যমে কোন কাজ উৎপাদনমুখী কিনা তা পরিমাপ করা হয়।
তাদের দৃষ্টিতে উৎপাদন হল কাজের মাধ্যমে উপযোগ সৃষ্টি বা বৃদ্ধি করা। সুতরাং কোন কাজটি উৎপাদনশীল এবং কোনটির অনেক বেশী উৎপাদনশীলতা রয়েছে তা চিহ্নিত করার জন্য বিভিন্ন উৎপাদিত পণ্য ও সেবার জন্য একটি সূক্ষ্ম মানদন্ড থাকা উচিত। এ মানদন্ড হল বিবিধ পণ্য ও সেবার বিষয়ে সামাজিক মূল্য। অন্য কথায় এটি হল ব্যয়কৃত শ্রম ও প্রদত্ত সেবার যৌথ মূল্যায়ন। আধুনিক সময়ে ‘ভোগ করার জন্য উৎপাদন’ দ্বারা ‘বিনিময়ের জন্য উৎপাদন’ প্রতিস্থাপিত হওয়ায় এ মূল্যায়ন অপরিহার্য হয়ে পড়েছে। অবস্থা এখন এমন হয়ে দাঁড়িয়েছে যে, কার্যত প্রত্যেক ব্যক্তি তার উৎপাদনকে অন্য আরেকজনের উৎপাদিত পণ্যের সাথে বিনিময় করে থাকে। পণ্য ও সেবার ক্ষতিপূরণের (compensation) মাধ্যমে বিনিময় সম্পাদিত হয়। সেকারণে পণ্যের মূল্যের ক্ষেত্রে একটি মানদন্ড থাকা উচিত যাতে করে বিনিময় করা যায়। সুতরাং উৎপাদন ও ভোগের ক্ষেত্রে ‘মূল্য কী’ – সে ব্যাপারে জ্ঞান থাকা অপরিহার্য হয়ে পড়েছে অর্থাৎ উপকরণসমূহ ব্যবহার করে মানুষের অভাব পূরণ করার ক্ষেত্রে অত্যাবশ্যকীয় উপাদান।
আধুনিক ইতিহাসে, এ বিনিময়ের মূল্যকে এর একটি মূল্য দ্বারা চিহ্নিত করা হয় এবং এ ধরনের মূল্য প্রণিধানযোগ্য হয়ে পড়েছে। উনড়বত সম্প্রদায়ে পণ্যসমূহের মূল্য একটি আরেকটির সাথে সম্পর্কযুক্ত নয়, বরং একটি বিশেষ পণ্যের সাথে সম্পর্কযুক্ত – যাকে অর্থ (money) বলা হয়। অর্থের সাথে কোন পণ্য বা সেবার বিনিময়ের অনুপাতকে তাদের দাম (price) বলা হয়। সুতরাং দাম হল অর্থের তুলনায় একটি পণ্য বা সেবার বিনিময়ের পরিমাণ। অতএব বিনিময়ের মূল্য (value of exchange) ও দামের (price) মধ্যে পার্থক্য হল বিনিময়ের মূল্য হল একটি বস্তুর সাথে অপর কিছুর বিনিময়ের হার – হতে পারে সেটি অর্থ, পণ্য বা সেবা। অন্যদিকে দাম হল অর্থের সাথে বিনিময় মূল্য। এর অর্থ হল সব পণ্যের দাম একটি নির্দিষ্ট সময়ে একসাথে বাড়তে পারে এবং অপর একটি নির্দিষ্ট সময়ে একসাথে হ্রাস পেতে পারে। অন্যদিকে একে অপরের তুলনায় আপেক্ষিকভাবে সব পণ্যের বিনিময় মূল্য একটি নির্দিষ্ট সময়ে একসাথে বাড়া বা কমা সম্ভব নয়। আবার বিনিময় মূল্যে কোনরূপ পরিবর্তন না এনে পণ্যের দামে পরিবর্তন আসা সম্ভব। সুতরাং পণ্যের দাম হল এর মূল্যসমূহের মধ্যে অন্যতম একটি। অন্য কথায় এটি অর্থের তুলনায় পরিমাপ করা একটি মূল্যমাত্র। যেহেতু দাম হল অন্যতম একটি মূল্য সেহেতু একটি বস্তু উপকারী কিনা বা উপযোগের মাত্রা কতটুকু সে ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেয়ার জন্য দামকে ব্যবহার করা স্বাভাবিক। সুতরাং একটি পণ্যকে ফলদায়ক ও উপকারী তখনই বিবেচনা করা হবে যখন সমাজ এ বিশেষ পণ্য ও সেবাকে একটি দাম দ্বারা মূল্যায়ন করে। পণ্য বা সেবার উপযোগের মাত্রা এমন একটি দাম দ্বারা পরিমাপ করা হয় যা অধিকাংশ ভোক্তা মালিকানায় নেয়া বা সদ্ব্যবহার করবার জন্য দিতে সম্মত থাকে – হোক সে পণ্য কৃষিজাত বা শিল্পজাত এবং সে সেবা একজন ব্যবসায়ী, পরিবহন শ্রমিক, ডাক্তার বা প্রকৌশলীর।
উৎপাদন, ভোগ, বন্টনের ক্ষেত্রে দাম যে ভূমিকা রাখে তা হল, দামের ব্যবস্থাপনা (price mechanism) নির্ধারণ করে কোন উৎপাদক পণ্য উৎপাদন করবে এবং কোন উৎপাদক পণ্য উৎপাদন করবে না। একইভাবে দামই নির্ধারণ করে কোন ভোক্তা পণ্য দিয়ে তার প্রয়োজন মেটাবে এবং কোন ভোক্তা পণ্য ভোগ করতে সমর্থ হবে না। একটি পণ্যের উৎপাদন খরচ বাজারে এর সরবরাহ নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে প্রধান নিয়ামক ও পণ্যের উপযোগ বাজারে এর চাহিদা নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে প্রধান ভূমিকা রাখে এবং উভয়ক্ষেত্রে দাম দ্বারা এসব পরিমাপ করা হয়। সুতরাং পুঁজিবাদী অর্থনীতিতে চাহিদা ও যোগান (demand and supply) অধ্যয়ন করা মৌলিক ইস্যু। যোগান বলতে বাজারে সরবরাহ করা বুঝায় এবং একইভাবে চাহিদা বলতে বাজারের চাহিদা বুঝায়। চাহিদা দাম উল্লেখ ব্যতিরেকে যেমনি বলা যায় না, তেমনি সরবরাহও দাম ব্যতিরেকে bমূল্যায়ন করা যায় না। তবে চাহিদা দামের ব্যস্তানুপাতে পরিবর্তিত হয়, অর্থাৎ যদি দাম বাড়ে তাহলে চাহিদা কমে এবং দাম কমলে চাহিদা বাড়ে। সরবরাহের ক্ষেত্রে এ সম্পর্কটি ঠিক উল্টো, অর্থাৎ দামের অনুপাতে যোগান পরিবর্তিত হয়। সরবরাহের পরিমাণ বৃদ্ধি পায় যদি দাম বাড়ে এবং সরবরাহ হ্রাস পায় যদি দাম কমে যায়। যোগান ও চাহিদা এ উভয়ক্ষেত্রে দামের সবচেয়ে বড় প্রভাব রয়েছে; ফলে উৎপাদন ও ভোগের ক্ষেত্রেও রয়েছে এর বড় প্রভাব।
পুঁজিবাদীদের মতে দামের ব্যবস্থাপনা হল সমাজে ব্যক্তির মধ্যে পণ্য ও সেবা বন্টনের আদর্শ পদ্ধতি। কেননা মানুষ যে শ্রম ব্যয় করে তার ফলই হল উপযোগ। সুতরাং ক্ষতিপূরণ (compensation) যদি শ্রমের সমান না হয় তাহলে সন্দেহাতীতভাবে উৎপাদন কমে যাবে। সুতরাং সমাজে পণ্য ও সেবা বন্টনের আদর্শ পদ্ধতি হল এমন একটি ব্যবস্থা যা সর্বোচ্চ উৎপাদনকে সুনিশ্চিত করে। এ পদ্ধতি হল দামের পদ্ধতি – যাকে দামের ব্যবস্থা বা দামের ব্যবস্থাপনা বলা হয়। তারা মনে করে দামের ব্যবস্থাপনা স্বয়ংক্রিয়ভাবে অর্থনৈতিক সাম্যাবস্থার (economic equilibrium) সৃষ্টি করে। যেহেতু এটি ভোক্তাকে কিছু পণ্যের ব্যাপারে তার চাহিদা এবং অন্যকিছুর ব্যাপারে চাহিদা না থাকার ভিত্তিতে বিভিনড়ব অর্থনৈতিক কর্মকান্ডের মাধ্যমে অর্জিত সমাজের মালিকানাধীন সম্পদের বন্টনের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিতে পছন্দ করার সুযোগ দেয়। সুতরাং যা প্রয়োজন ও পছন্দনীয় তা μয় করার জন্য তাদের আয়কে ব্যয় করে। সুতরাং যে ভোক্তা মদ পছন্দ না করে সে সেটি ক্রয় না করে অন্য কিছুর পেছনে তার আয় ব্যয় করবে। মদ অপছন্দ করে এমন ক্রেতার সংখ্যা যদি বৃদ্ধি পায়, অথবা সবাই মদকে অপছন্দ করা শুরু করে, তাহলে ক্রমহ্রাসমান চাহিদার কারণে মদ উৎপাদন করা অলাভজনক হয়ে যাবে। এভাবে মদের উৎপাদন বন্ধ হয়ে যাবে এবং একই নিয়ম অন্য পণ্য ও সেবার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। ভোক্তাগণ কী ক্রয় করবে এবং কী ক্রয় করবে না এ ব্যাপারে তারা স্বাধীন বিধায় উৎপাদনের পরিমাণ ও প্রকরণকে তারাই নির্ধারণ করে। তারা তা করে দামের মাধ্যমে এবং পণ্য ও সেবার বন্টনও ঘটে, যদিও ভোক্তা কর্তৃক প্রদেয় দাম সরাসরি উৎপাদক পায় না এবং ভোক্তা উৎপাদককে দেয়ও না।
দামের ব্যবস্থাপনা উৎপাদনের উদ্দীপক। এটি বন্টনের নিয়ন্ত্রক এবং উৎপাদক ও ভোক্তার মধ্যে সম্পর্ক স্থাপনকারী, অর্থাৎ এটি এমন একটি উপায় যার মাধ্যমে উৎপাদন ও ভোগের মধ্যে সাম্যাবস্থা অর্জন হয়।
দামের ব্যবস্থাপনা উৎপাদনের উদ্দীপক, কেননা যে কোন মানুষের কোন ফলদায়ক প্রচেষ্টা ও ত্যাগের কারণ হল বস্তুগত লাভ। পুঁজিবাদী অর্থনীতিবিদরা এ সম্ভাবনা বাদ দিয়েছে যে কোন মানুষ আধ্যাত্মিক বা নৈতিক কারণে প্রচেষ্টা চালাতে পারে। যখন তারা নৈতিক উদ্দেশ্যকে সনাক্ত করে তখন সেটিকে বস্তুগত লাভের জন্য করা হয় বলে ধরে নেয়। তারা বিবেচনা করে যে, মানুষ কেবলমাত্র তার বস্তুগত অভাব ও ইচ্ছা পূরণের জন্য প্রচেষ্টা ব্যয় করে। এ প্রয়োজন পূরণ হতে পারে ব্যক্তি সরাসরি যা উৎপাদন করে সেগুলোর ভোগ থেকে অথবা এমন কোন আর্থিক পুরস্কার থেকে যার মাধ্যমে সে অন্যদের উৎপাদিত পণ্য ও সেবা ক্রয় করতে সক্ষম হয়। যেহেতু মানুষ অন্যের সাথে প্রচেষ্টা বিনিময় করার মাধ্যমে তার অধিকাংশ বা সব প্রয়োজন পূরণের জন্য অন্যের উপর নির্ভরশীল, সেহেতু প্রয়োজন পূরণ করার প্রচেষ্টা আর্থিক পুরস্কারের দিকে কেন্দ্রীভূত হয়। এই আর্থিক পুরস্কার তাকে পণ্য ও সেবা প্রাপ্তিতে সহায়তা করে এবং একইভাবে সে যেসব পণ্য উৎপাদন করে তা পাওয়া তার লক্ষ্য থাকে না। সুতরাং আর্থিক পুরস্কার বা দাম পণ্য উৎপাদনের জন্য মূল লক্ষ্য হিসেবে কাজ করে। অর্থাৎ দাম হল এমন একটি উপায় যা উৎপাদককে তার প্রচেষ্টা বিনিয়োগ করতে উদ্বুদ্ধ করে। সুতরাং দাম উৎপাদনের উদ্দীপক।
দাম হল এমন একটি উপায় যা বন্টনকে নিয়ন্ত্রণ করে। কারণ মানুষ তার সব প্রয়োজন পুরোপুরি পূরণ করতে চায় এবং প্রয়োজন পূরণের জন্য পণ্য ও সেবা অর্জনে সে প্রাণান্তকর প্রচেষ্টা চালায়। যদি প্রত্যেক মানুষকে তার প্রয়োজন পূরণের জন্য স্বাধীনভাবে ছেড়ে দেয়া হত তাহলে সে তার পছন্দমত যে কোন পণ্য লাভ করতে ও ভোগ করতে ক্ষান্ত হত না। যেহেতু প্রত্যেক ব্যক্তি একই লক্ষ্যকে সামনে রেখে প্রচেষ্টা চালায়, সেহেতু একজন মানুষকে তার প্রয়োজন পূরণের ক্ষেত্রে সে সীমায় থেমে যেতে হয় যেখানে সে নিজের প্রচেষ্টা অন্যের প্রচেষ্টার সাথে বিনিময় করতে সমর্থ হয়, অর্থাৎ তার প্রচেষ্টার কারণে সে যে আর্থিক ক্ষতিপূরণ লাভ করে সে সীমা পর্যন্ত অর্থাৎ দামের সীমা পর্যন্ত। সুতরাং দাম স্বাভাবিকভাবে মানুষকে কোন কিছু লাভ ও ব্যয় করার ক্ষেত্রে একটি সীমার মধ্যে বেধে রাখার জন্য বাধ্য করে এবং এই সীমাটি হল তার আয়ের সীমা। সুতরাং দাম মানুষকে চিন্তা, মূল্যায়ন, তার পূরণ করতে হবে এমন তুলনামূলক প্রয়োজনের মধ্যে পার্থক্য করতে দেয়, অর্থাৎ যা তার জন্য অপরিহার্য সেটি সে গ্রহণ করে এবং যা কম গুরুত্বপূর্ণ তা ছেড়ে দেয়। সুতরাং দাম কিছু পণ্যের ক্ষেত্রে ভোক্তাকে আংশিক চাহিদা পূরণ করতে বাধ্য করে – যাতে করে গুরুত্বপূর্ণ অন্য প্রয়োজনগুলো সে পূরণ করতে পারে।
সুতরাং দাম হল এমন একটি উপায় যা ব্যক্তির জন্য প্রয়োজনীয় উপযোগসমূহের বন্টন নিয়ন্ত্রণ করে। উপযোগ প্রাপ্তির আকাঙ্খা করে এমন ভোক্তাদের মধ্যে সীমাবদ্ধ উপযোগের বন্টনকে নিয়ন্ত্রণ করে দাম। ভোক্তাদের আয়ের বৈষম্যের কারণে তাদের আয় তাদের ব্যয়কে একটি সীমার মধ্যে বেধে রাখে। এর কারণে কিছু পণ্য কেবল সামর্থবান লোকেরাই ভোগ করতে পারে এবং বাকী কিছু পণ্য কম দামের হওয়ায় সবাই ভোগ করতে পারে। সুতরাং কিছু পণ্য ও সেবার ক্ষেত্রে দাম বেশী ও অন্য কিছুর জন্য দাম কম এবং কিছু ভোক্তার চেয়ে অন্য কিছু ভোক্তার কাছে দামের তুলনামূলক যথার্থতা ঠিক করে দেয়ার মাধ্যমে দাম ভোক্তাদের মধ্যে উপযোগ বন্টনের ক্ষেত্রে নিয়ন্ত্রকের কাজ করে।
দাম উৎপাদন ও ভোগের মধ্যে সাম্যাবস্থা আনয়ন করে এবং এটি উৎপাদক ও ভোক্তার মধ্যকার সেতুবন্ধন হিসেবে কাজ করে। কেননা ভোক্তার আকাঙ্খা পূরণকারী উৎপাদক লাভের মাধ্যমে পুরস্কৃত হন। অন্যদিকে যেসব উৎপাদকের পণ্য ভোক্তাদের দ্বারা গৃহীত হবে না, সে লোকসানের মাধ্যমে শেষ হয়ে যাবে। যে পদ্ধতির মাধ্যমে উৎপাদক ভোক্তার আকাঙ্খা চিহ্নিত করে, তা হল দাম। যদি ভোক্তার কাছে কোন পণ্যের চাহিদা থাকে তাহলে এর দাম বেড়ে যাবে, ফলে ভোক্তার আকাঙ্খা পূরণ করতে গিয়ে এর উৎপাদনও বেড়ে যাবে। যদি ভোক্তাগণ একটি বিশেষ পণ্য ক্রয় করা থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়, তাহলে বাজারে এর দাম কমে যাবে ও সে পণ্যের উৎপাদন হ্রাস পাবে। সুতরাং পণ্যের দাম বাড়ার সাথে সাথে উৎপাদনের জন্য বিনিয়োগকৃত সম্পদ বৃদ্ধি পায় এবং দাম কমার সাথে সাথে হ্রাস পায়। এভাবে উৎপাদন ও ভোগের মধ্যে সাম্যাবস্থা অর্জনে দাম সহায়তা করে এবং উৎপাদক ও ভোক্তার মধ্যে সেতুবন্ধন রচনা করে এবং এই প্রক্রিয়া স্বয়ংক্রিয়ভাবে সম্পাদিত হয়। সুতরাং পুঁজিবাদীদের মতে, দাম হল অর্থনীতির ভিত্তি যার উপর এটি দাঁড়িয়ে থাকে এবং তাদের মতে এটি অর্থনীতির স্তম্ভ হিসেবে কাজ করে।
এই হল পুঁজিবাদী অর্থনৈতিক ব্যবস্থার সারমর্ম – যাকে রাজনৈতিক অর্থনীতি বলা হয়। গভীর অধ্যয়নের পর পুঁজিবাদী অর্থনৈতিক ব্যবস্থার নিম্নলিখিত ত্রুটিসমূহ পরিষ্কার হয়ে উঠে।