হাজ্জাজ ইবন ইলাত (রা)

নাম হাজ্জাজ, কুনিয়াত বা ডাকনাম আবু কিলাব, মতান্তরে আবু মুহাম্মাদ ও আবু আবদুল্লাহ। পিতা ইলাত ইবন খালিদ। বনী সুলাইম গোত্রের সন্তান।

ইবন সাদ বলেন, রাসূল সা: যখন খাইবারে তখন তিনি তার খিদমতে ‍হাজির হয়ে ইসলাম গ্রহণ করেন। তারপর মদীনায় বসতি স্থাপন করেন। ইবন শিহাব থেকে বর্ণিত। তিনিই প্রথম ব্যক্তি যিনি রাসূলুল্লাহর সা: নবুওয়াত সত্য বলে স্বীকার করে তার কাছে লোক পাঠান। (আল ইসাবা-১/৩১৩)।

তার ইসলাম গ্রহণ সম্পর্কে একটি চমকপ্রদ কাহিনী ইতিহাসে দেখা যায়। ইবন আব আদ দুনিয়া ‘হাওয়াতিফুল জিন’ গ্রন্থে এবং ইবন আসাকির ওয়াসিলা ইবনুল আসকা (রা) থেকে বর্ণনা করেছেন। তিনি বলেছেন: হাজ্জাজের ইসলাম গ্রহণের ঘটনাটি ছিল এমন। তিনি একটি কাফিলার সাথে মক্কায় যাচ্ছেন। একটি নির্জন ভীতিজনক উপত্যকায় রাত হলে তারা ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে পড়ে। হাজ্জাজের সঙ্গী সাথীরা তাকে অনুরোধ করে বলে! আবু কিলাব, তুমিরাত জেগে বসে বসে তোমার নিজের ও সঙ্গীদের জন্য নিরাপত্তা ‍কামনা করতে থাক। হাজ্জাজ পাহারাদারীর দায়িত্ব নিয়ে জেগে জেগে নিম্নোক্ত কথাগুলি জপতে থাকেন:

উয়িজু নাফসী ওয়া উয়িজু সাহবী,

মিন কুল্লি জিন্নিয়্যিন বিহাজান নাকবি,

হাত্তা আউবা ‍সালেমান ওয়া রাকবী।

আমি আমার নিজের ও আমার সঙ্গীদের জন্য পানাহ চাই, এই গিরিপথের সকল জিন থেকে, যাতে আমি ও আমার কাফিলা নিরাপদে ফিরে যেতে পারি।

তিনি উপরোক্ত কথাগুলি জপছেন। এমন সময় অদৃশ্য থেকে কারও কন্ঠে কুরআনের নিম্নের ‍আয়াত তিলাওয়াত করতে শুনতে পান:

ওহে জিন ও মানবজাতি! আকাশ মন্ডলী ও পৃথিবীর সীমা তোমরা যদি অতিক্রম করতে পার, অতিক্রম কর! কিন্তু তোমরা তা পারবে না শক্তি ছাড়া।- সূরা আর রাহমান-৩৩।

তারা মক্কায় পৌঁছে কুরাইশদের মজলিসে ঘটনাটি বর্ণনা করেন। কুরাইশরা বলে: আবু কিলাব, তুমিও তো দেখছি বে দ্বীন হয়ে গিয়েছ। এতো সেই বানী যা মুহাম্মাদের ধারণা মতে তার ওপর নাযিল হয়। জবাবে হাজ্জাজ বলেন: আল্লাহর কসম, আমি ও আমার সঙ্গীরা এই বাণীই শুনতে পেয়েছি। তাদের এ আলোচনার মাঝখানে আসী ইবন ওয়ালিল উপস্থিত হয়। লোকেরা তাকে বলে: আবু হিশাম, এই আবু কিলাব কি বলছে, শুনেছ? বিষয়টি সে জানতে চাইলে লোকেরা তাকে অবহিত করে। সবকিছু শুনে সে বলে : এতে অবাক হওয়ার কি আছে? তারা যার কাছ থেকে শুনেছে, সেই মুহাম্মাদের ওপর ভর করে তার মুখ দিয়ে বলে থাকে। (হায়াতুস সাহাবা-৩/৫৭৬-৭৭)।

হাজ্জাজের সহধর্মিণী তখনও মক্কায় বসবাস করেন। তার সকল সম্পদও সেখানে। ইসলাম গ্রহণের পর এসব সহায় সম্পদ মদীনায় সরিয়ে নেওয়ার প্রয়োজন অনুভব করেন। অন্যথায় তার ইসলাম গ্রহণের কথা কুরাইশরা জানতে পেলে সব হাতিয়ে নেবে। তার সম্পর্কে মক্কাবাসী পৌত্তলিকরাও সন্দিহান ছিল। তার অর্থ সম্পদ সহজে মক্কা থেকে সরিয়ে নেওয়া সম্ভবও ছিল না। এ কারণে হাজ্জাজ মক্কা গিয়ে গুজব ছড়িয়ে দেন যে, খাইবারে মুহাম্মাদ সা: পরাজিত হয়েছে।

মুহুর্তের মধ্যে খবরটি সারা শহরে ছড়িয়ে পড়ে। মক্কার মুশরিকদের এভাবে খুশী করে তিনি বললেন: মুহাম্মাদের সা: সকল আসবাবপত্র বিক্রি হচ্ছে। আমার বাসনা, অন্য ব্যবসায়ীদের পৌঁছার পূর্বেই আমি সেগুলি খরিদ করি। মক্কার বিভিন্ন লোকের নিকট আমার বহু অর্থ কড়ি পাওনা আছে। তোমরা একটু চেষ্টা করলে সহজে আদায় হতে পারে। মক্কাবাসীরা এই ভাল কাজটির জন্য কোমর বেধে লেগে গেল। তারা চেষ্টা তদবীর করে তার পাওনা অর্থ আদায় করে দিল। রাসূল সা: এর সম্মানিত চাচা হযরত আব্বাস (রা) তখন মক্কায়। তিনি নিজের বাড়ীতে বসে সব কিছু শুনছেন। তিনি এত ব্যাথা পেলেন যে, খবরের সত্য মিথ্যা যাচাইয়ের জন্য ঘর থেকেও বের হলেন না। তিনি একটি ছেলের মাধ্যমে হাজ্জাজকে ডেকে পাঠালেন। হাজ্জাজ গেলে এবং আব্বাসকে (রা) আসল কথা খুলে বললেন। তিনি বললেন: আমার বকেয়া আদায়ের জন্য আমি এ কথা ছড়িয়েছি। আমি নিজেই ইসলাম গ্রহণ করেছি। মক্কাবাসীরা জানতে পেলে আমার প্রাপ্য এক কপর্দকও দেবে না। আল্লাহর ইচ্ছায় রাসুল সা: নিরাপদেই আছেন। খাইবারে মুসলিম বাহিনী বিজয়ী হয়েছে এবং রাসূল সা: খাইবারের নেতা হুয়াই ইবন আখতারের কন্যাকে বিয়ে করে তার সাথে দাম্পত্য জীবন যাপন করছেন। আমি কুরাইশদের ক্ষমতার আওতা থেকে বের হয়ে না যাওয়া পর্যন্ত এই গোপন তথ্য কারও নিকট প্রকাশ করবেন না।

অঙ্গীকার অনুযায়ী হযরত আব্বাস (রা) তিনদিন সম্পূর্ণ চুপ থাকলেন। চতুর্থ দিন যখন নিশ্চিত হলেন যে, হাজ্জাজ মক্কাবাসীদের নাগালের বাইরে চলে গেছে, তখন তিনি পোশাক পাল্টে হাজ্জাজের বাড়ী গেলেন এবং তার স্ত্রীর নিকট আসল ঘটনা প্রকাশ করলেন। তারপর তিনি কাবার চত্বরে আসলেন। সেখানে আগে থেকে এই বিষয়ে আলোচনা চলছিল। তিনি লোকদের বললেন: মুহাম্মাদ সা: খাইবার জয় করেছেন এবং হুয়াই ইবন আখতারের কন্যা এখন তার স্ত্রী। বনী আবী হাকীক তথা ইয়াসরিবের নেতৃবৃন্দের গর্দান উড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। হাজ্জাজ তোমাদের ধোকা দিয়ে তার অর্থ সম্পদ নিয়ে চম্পট দিয়েছে। লোকেরা প্রশ্ন করলো, আপনি কার কাছে এসব কথা শুনলেন? বললো: হাজ্জাজের কাছে। লোকেরা হাজ্জাজের স্ত্রীর নিকট জিজ্ঞেস করলে তিনিও সমর্থন করলেন। পঞ্চম দিনে মদীনা থেকেও খবর এসে গেল। কিন্তু এখন তাদের করণীয় কিছুই নেই। শিকার তাদের নাগালের বাইরে। তারা চুপ হয়ে গেল। (ইবন সাদ-৪/২, পৃ. ১৪-১৫)

খাইবার যুদ্ধের অল্প কিছুদিন পূর্বে হাজ্জাজ ইসলাম গ্রহণ করেন। এ যুদ্ধেই তিনি সর্বপ্রথম মুসলিম বাহিনীর সাথে যোগ দেন। মক্কা বিজয়ের সময় তিনি মদীনার বাইরে ছিলেন। হযরত রাসূলে কারীম সা: অভিযানের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে তাকে মদীনায় ডেকে পাঠান। মক্কা বিজয়ের দিন হযরত খালিদ ইবন ওয়ালীদ (রা) এক হাজার সৈন্যের একটি বাহিনী নিয়ে বনী সুলাইমের পথে মক্কায় প্রবেশ করেন। এই বাহিনীতে আব্বাস ইবন মিরদাস, খুফাফ ইবন নুদবাহ ও হাজ্জাজ ইবন ইলাত- এ তিনজন তিনটি পতাকা বহন করেন। (হায়াতুস সাহাবা-১/১৬৭)।

হাজ্জাজ ছিলেন ধনী ব্যক্তি। তিনি মক্কা থেকে তার সকল সম্পদ সরিয়ে আনতেও সক্ষম হয়েছিলেন। মদীনায় তিনি নিজের জন্য একটি বাড়ী ও একটি মসজিদ নির্মাণ করেন। (আল ইসাবা-৩২৭)

তার মৃত্যুকাল সম্পর্কে দুটি বর্ণনা আছে। একটি মতে তিনি হযরত উমার ফারুকের (রা) খিলাফতকালের প্রথম দিকে মৃত্যুবরণ করেন। আর অন্য একটি মতে তিনি হযরত আলী (রা) ও আয়িশার মধ্যে সংঘটিত উটের যুদ্ধে শাহাদাত বরণ করেন। প্রথম বর্ণনাটি অধিকতর নির্ভরযোগ্য। উটের যুদ্ধে হাজ্জাজ নন বরং তার ছেলে শহীদ হন।

উসমান ইবন তালহা (রা)

কুদামাহ ইবন মাজউন (রা)

Leave a Reply