মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ সা: ও আবু সুফইয়ান ইবন হারেসের মধ্যে যতখানি গভীর ও শক্ত সম্পর্ক ছিল তা খুব কম লোকের সাথেই ছিল। তার দুজন একই পরিবারে একই সময়ে জন্মগ্রহণ করেন। তারা দুজন পরষ্পর চাচাতো ভাই। আবু সুফইয়ানের পিতা হারেস ইবন আবদুল মুত্তালিব ছিলেন রাসূলুল্লাহর সা: বড় চাচা। তিনি ইসলাম পূর্ব যুগে মারা যান। (টীকা: সীরাতু ইবন হিশাম-১/১৬৩)।
রাসূল সা: ও আবু সুফইয়ান পরষ্পর দুধ ভাই। হযরত হালীমা আস সাদিয়্যাহ তাদের দুজনকে দুধ পান করান। রাসুল সা: নবুওয়াত প্রাপ্তির পূর্ব পর্যন্ত তাদের দুজনের মধ্যে গভীর সম্পর্ক ছিল। দুজনের চেহারার মধ্যেও যথেষ্ট মিল ছিল। ইবনুল মোবারক ইবরাহীম ইবন মুনজির প্রমূখের মতে আবু সুফইয়ানের নাম মুগীরা এবং কুনিয়াত বা ডাক নাম আবু সুফইয়ান। (আল ইসাবা-৪/৯০, সীরাতু ইবন হিশাম-১/৬৪৭)।
নানাদিক দিয়ে দুজনের মধ্যে এত গভীর সম্পর্ক থাকার কারণে এটাই স্বাভাবিক ছিল যে, রাসূলুল্লাহর সা: নবুওয়াত প্রাপ্তির সূচনালগ্নেই আবু সুফইয়ান তার ওপর ঈমান আনবেন এবং তার দাওয়াতে সাড়া দেবেন। কিন্তু যা স্বাভাবিক ছিল তা না হয়ে ঘটলো তার বিপরীত। মক্কায় রাসুল সা: ইসলামের দাওয়াত দেওয়া শুরু করতেই আবু সুফইয়ানের সব বন্ধুত্ব ও আত্মীয়তা হিংসা বিদ্বেষ, শত্রুতা ও অবাধ্যতার রূপ নিল।
রাসুল সা: যখন দাওয়াত দিতে শুরু করেন আবু সুফইয়ান তখন কুরাইশদের একজন নামযাদা অশ্বারোহী বীর এবং একজন শ্রেষ্ঠ কবি। তিনি তার জিহবা ও তীর রাসুল সা: ও তার দাওয়াতের বিরোধিতায় নিয়োজিত করেন। ইসলাম ও মুসলমানদের শত্রুতায় তিনি তার সকল শক্তি একীভূত করেন। রাসূল সা: বিরুদ্ধে কুরাইশরা যত যুদ্ধের পরিকল্পনা করে আবু সুফইয়ান তাতে ইন্ধন যোগায়। কুরাইশদের হাতে মুসলমানরা যত রকমের কষ্টভোগ করে তাতে তার বিরাট অবদান ছিল। তিনি তার কাব্য শক্তি রাসূল সা: হিজা বা নিন্দায় নিয়োজিত করেন। রাসূল সা: এর বিরুদ্ধে তিনি একটি অশালীন কবিতাও রচনা করেন। রাসূল সা: হাসসান ইবন সাবিত (রা) তার একটি বিখ্যাত কাসীদার একটি লাইনে বলেন: তুমি নিন্দা করেছ মুহাম্মাদের, আমি জবাব দিয়েছি, এর প্রতিদান আল্লাহর কাছে। মূলত: এ লাইনটি আবু সুফইয়ানের উদ্দেশ্যে বলা হয়েছে। (আল ইসাবা-৪/৯০)
হযরত রাসূলে কারীমের সাথে আবু সুফইয়ানের এ শত্রুতা দীর্ঘ বিশ বছর চলে। এ দীর্ঘ সময়ে আল্লাহর রাসূল সা: মুসলমানদের বিরুদ্ধে যতরকম ষড়যন্ত্র করা যেতে পারে সবই তিনি করেন। বদর যুদ্ধের ব্যাপারে তার সম্পর্কে একটি চমকপ্রদ বর্ণনা সীরাত গ্রন্থসমূহে পাওয়া যায়। হযরত আবু রাফে বর্ণনা করেন: আমি বদর যুদ্ধের পর মক্কায় যমযম কূপের নিকট বসে তীর বানাচ্ছি, এমন সময় আবু লাহাব এসে আমার পাশে বসলো। সে কোন কারণবশত: বদরে অংশগ্রহণ না করে অন্য একজনকে নিজের পরিবর্তে পাঠিয়েছিল। তারপর আবু সুফইয়ান ইবন হারেস ইবন আবদুল মুত্তালিব এলো। আবু লাহাব তাকে কাছে বসিয়ে তার কাছে বদরের ঘটনা বিস্তারিত জানতে চায়। আবু সুফইয়ান বলে: আল্লাহর কসম, তারা ছিল এমন একটি দল যাদের কাছে আমরা আমাদের কাঁধ: সমর্পণ করেছিলাম। তারা তাদের ইচ্ছামত আমাদের পরিচালিত করে, ইচ্ছেমত আমাদের বন্দী করে। আল্লাহর কসম, এত কিছু সত্ত্বেও আমি আমাদের লোকদের তিরষ্কার করি না। কারণ, আমরা আসমান ও যমীনের মাঝে সাদা কালো উড়ন্ত অশ্বের ওপর কিছু সাদা ধবধবে আরোহী দেখতে পেয়েছি। আল্লাহর কসম, কোন কিছুই তাদের মুকাবিলা করতে সক্ষম হবে না। আবু রাফে সাথে সাথে বলে ওঠেন, আল্লাহর কসম,তারা ফিরিশতা ছাড়া অন্য কিছু নয়। আবু লাহাব আবু রাফের গালে এক থাপ্পড় বসিয়ে দেয়। (সীরাতু ইবন হিশাম-১/৬৪৬-৪৭, হায়াতুস সাহাব-৩/৫৩০)
অবশেষে মক্কা বিজয়ের প্রাক্কালে ইসলামের সাথে আবু সুফইয়ানের শত্রুতার সমাপ্তি ঘটে। ইতিহাসে তার ইসলাম গ্রহণের কাহিনীটি এভাবে বর্ণিত হয়েছে: আবু সুফইয়ান বলেন, ইসলম যখন সবল হয়ে ওঠলো এবং এ খবর ছড়িয়ে পড়লো যে, রাসূল সা: মক্কা জয়ের জন্য এগিয়ে আসছেন। তখন আমি চারদিকে অন্ধকার দেখতে লাগলাম। আমি আপন মনে বলতে লাগলাম, এখন কোথায় যাব, কার সাথে যাব এবং কোথায় কার সাথে থাকবো?
এসব চিন্তা ভাবনার পর আমার স্ত্রী ও পুত্র কন্যাদের কাছে গিয়ে বললাম, মক্কা থেকে বের হওয়ার জন্য তৈরী হও। মুহাম্মাদের মক্কায় প্রবেশের সময় ঘনিয়ে এসেছে। মুসলমানরা আমাকে পেলেই হত্যা করবে।
তারা আমাকে বললো, আপনি এখন দেখতে পাচ্ছেন আরব-অনারব সকলেই মুহাম্মাদের আনুগত্য স্বীকার করে তার দ্বীন কবুল করছে। আর আপনি এখনও তার শত্রুতার জেদ ধরে বসে আছেন? অথচ আপনারই সর্বপ্রথম তার সাহায্য সহযোগিতায় এগিয়ে আসা উচিত ছিল। এভাবে তারা আমাকে মুহাম্মাদের দ্বীনের প্রতি উতসাহী ও আকৃষ্ট করে তুলতে লাগলো। অবশেষে আল্লাহ তাআলা আমার অন্তর দুয়ার উন্মুক্ত করে দিলেন।
আমি তক্ষুণি উঠে আমার দাস মাজকুরকে একটি উট ও একটি ঘোড়া প্রস্তুত করতে নির্দেশ দিলাম। আমার পুত্র জাফরকেও আমি সংগে নিলাম। আমরা খুব দ্রুত মক্কা মদীনার মাঝখানে ‘আবওয়া’র দিকে চললাম। আমি আগেই জেনেছিলাম মুহাম্মাদ সেখানে পৌঁছেছেন। আমি ‘আবওয়ার’ কাছাকাছি পৌঁছে ছদ্মবেশ ধারণ করলাম, যাতে কেউ আমাকে চিনে ফেলে রাসূলুল্লাহর সা: সামনে হাজির পেয়ে ইসলামের ঘোষণা দেওয়ার পূর্বে মেরে না ফেলে। আমি প্রায় এক মাইল দূর থেকে পায়ে হেটে এগুতে লাগলাম। আর দেখতে লাগলাম মুসলমানদের অগ্রগামী দলগুলি একটির পর একটি মক্কার দিকে চলছে। কেউ আমাকে চিনতে পারে এই ভয় ও আশংকায় আমি তাদের পথ থেকে একটু দূর দিয়ে এগুতে লাগলাম। এই জনস্রোতের মধ্যে হঠাত রাসূলুল্লাহ সা: আমার নজরে পড়লেন। আমি খুব ত্বরিত গতিতে তার সামনে হাজির হয়ে আমার মুখাবরণ খুলে ফেললাম। তিনি আমাকে চিনতে পেরেই আমার দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নিলেন। আমি ঘুরে আবার তার সামনে গেলাম। তিনি আবারও মুখ ঘুরিয়ে নিলেন। এভাবে কয়েকবার করলেন।
আমার বিশ্বাস ছিল, আমার ইসলাম গ্রহণে রাসূল সা: অত্যন্ত খুশী হবেন। কিন্তু মুসলমানরা যখন দেখলো রাসূল সা: আমার দিক থেকে মুখ ঘুরিয়ে নিচ্ছেন তারাও মুখ কালো করে আমার দিক থেকে মুখ ঘুরিয়ে নিল। আবু বকর আমাকে দেখে অত্যন্ত কঠিনভাবে মুখ ঘুরিয়ে নিলেন। আমি অত্যন্ত অসহায়ভাবে উমার ইবনুল খাত্তাবের দিকে তাকালাম। তিনিও তার সাথী অপেক্ষা অধিকর কঠোরতার সাথে মুখ ঘুরিয়ে নিলেন। তিনি বরং একজন আনসারীকে আমার বিরুদেধ উসকে দিলেন। সেই আনসারী আমাকে লক্ষ্য করে বললো: ওরে আল্লাহর দুশমন! তুই আল্লাহর রাসূল ও তার সাহাবীদের কষ্ট দিয়েছিস। উক্ত আনসারী উচ্চ কন্ঠে আমাকে ভর্তসনা ও গালি গালাজ করছে, আর মুসলমানরা আমার পাশে ভিড় করে অত্যন্ত নির্দয়ভাবে তা শুনে উপভোগ করছে।
এমন সময় আমি আমার চাচা আব্বাসকে দেখলাম। আমি তার দিকে একটু এগিয়ে গিয়ে বললাম, চাচা, আমার আশা ছিল রাসূলুল্লাহর সা: সাথে আমার আত্মীয়তা এবং আমার কাওমের মধ্যে আমার মর্যাদার কারণে তিনি আমার ইসলাম গ্রহণে খুশি হবেন। আপনি রাসূল সা: এর সাথে আমার ব্যাপারে কথা বলে তাকে একটু রাজী করান। তিনি বললেন, তোমার দিক থেকে মুখ ঘুরিয়ে নিয়েছেন এ দৃশ্য দেখার পর আমি রাসূলুল্লাহর সা: কাছে তোমার প্রসঙ্গে একটি কথাও বলতে পারবো না। তবে, যদি কখনও সুযোগ আসে বলবো। কারণ, আমি রাসূলুল্লাহকে যেমন সম্মান করি তেমন ভয়ও করি।
আমি বললাম, চাচা, আমাকে তাহলে কার দায়িত্বে ছেড়ে দিচ্ছেন?
তিনি বললেন, এই মাত্র তুমি যা শুনলে তার অতিরিক্ত আমি কিছুই করতে পারবো না। দুশ্চিন্তা ও দূর্ভাবনায় আমার অন্তর ভরে গেল। হঠাত আমি আমার চাচাতো ভাই আলী ইবন আবু তালিবকে দেখলাম। বিষয়টি আমি তাকে বললাম। তিনিও চাচা আব্বাসের মত জবাব দিলেন, আমি আবার চাচা আব্বাসের কাছে গিয়ে বললাম, চাচা যদি আপনি আমার প্রতি রাসূলুল্লাহর অন্তর নরম করতে না পারেন, তাহলে এতটুকু অন্তত: লক্ষ্য করুন, যে লোকটি আমাকে নিন্দা করছে ও গালি দিচ্ছে এবং মানুষকে আমার প্রতি ক্ষেপিয়ে তুলছে, তাকে একটু ঠেকান। তিনি বললেন, লোকটি কেমন- একটু বর্ণনা দাওতো। আমি বর্ণনা দিলাম। তিনি বললেন, সে তো নুয়াইমান ইবনুল হারেস আন নাজ্জারী। তিনি নুয়াইমানের কাছে গিয়ে বললেন, শোন নুয়াইমান! আবু সুফইয়ান হচ্ছে রাসূলুল্লাহর চাচাতো ভাই এবং আমার ভাতিজা। যদিও আজ রাসূলুল্লাহ তার প্রতি নারাজ, তবে একদিন তিনি রাজী হয়ে যাবেন। সুতরাং তাকে এভাবে লাঞ্ছিত করো না। এভাবে বার বার তাকে বুঝালেন। অবশেষে নুয়াইমান রাজী হয়ে গেলেন এবং বললেন, এই মুহুর্তের পর থেকে আমি আর তাকে কটু কথা বলবো না।
রাসূলুল্লাহ সা: মক্কা মদীনার পথে ‘জাহফাহ’ নামক স্থানে অবতরণ করলেন। আমি রাসূল সা: এর তাঁবুর দরযায় গিয়ে বসলাম, আর আমার ছেলে জাফর আমার পাশে দাড়িয়ে থাকলো। রাসূল সা: বের হওয়ার সময় আমাকে দেখে মুখ ঘুরিয়ে নিলেন। আমি কিন্তু এতেও হতাশ হলাম না। এভাবে তিনি যখন যেখানে অবতরণ করতে লাগলেন আমি আমার ছেলেকে নিয়ে তার তাঁবুর দরযায় গিয়ে বসতে লাগলাম। আর রাসূল সা: ও একই আচরণ করে যেতে লাগলেন। এভাবে কিছুকাল চললো। আমি খুব কষ্ট পেতে লাগলাম। দুনিয়াটা আমার জন্য সংকীর্ণ হয়ে পড়লো।
ইবন ইসহাক বলেন: আবু সুফইয়ান হারেস ও আবদুল্লাহ ইবন আবী উমাইয়্যা ‘নীকুল উকাব’ নামক স্থানে (মক্কা মদীনার পথে) আবার রাসুল সা: এর সাথে সাক্ষাতের আবেদন জানালেন। হযরত উম্মু সালামা তাদের সম্পর্কে বললেন, ইয়া রাসুলুল্লাহ, আপনার চাচাতো ভাই ও ফুফাতো ভাই দুজন এসেছে সাক্ষাত করতে। রাসূল সা: বললেন: তাদের আর কোন প্রয়োজন আমার নেই। আমার চাচাতো ভাই আমার সম্মান নষ্ট করেছে, আর ফুফাতো ভাই- সে আমাকে মক্কায় যা বলার বলেছে। আবু সুফইয়ানের সাথে তার পুত্র জাফরও ছিল। যখন রাসূল সা: এর এ কথা তার কানে পৌঁছলো, আবু সুফইয়ান বললেন: আল্লাহর কসম, হয় তিনি আমাকে সাক্ষাতের অনুমতি দেবেন নয়তো আমি আমার এ ছেলের হাত ধরে যমীনের যে দিকে ইচ্ছা চলে যাব এবং ক্ষুধা তৃষ্ণায় মৃত্যুবরণ করবো। এ কথা যখন রাসূল সা: শুনলেন, তিনি একটু নরম হলেন এবং তাদেরকে সাক্ষাতের অনুমতি দিলেন। তারা দুজন রাসূল সা: এর নিকট পৌছে ইসলামের ঘোষণা দেন। (সীরাতু ইবন হিশাম-২/৪০০-৪০১)।
আবু সুফইয়ান বলেন: রাসূল সা: মক্কায় প্রবেশ করেন এবং আমি ও তার কাফিলার সাথে মক্কায় প্রবেশ করলাম। তিনি মসজিদে যাওয়ার জন্য বের হলেন, আমি তার সাথে সাথে চললাম। মুহুর্তের জন্যও তার পিছু ছাড়লাম না।
অত:পর হুনাইন অভিযানের সময় ঘনিয়ে এলো। সমগ্র আরববাসী ঐক্যবদ্ধ হয়ে মুসলমানদের বিরুদ্ধে যুদ্ধের প্রস্তুতি নিল। এবার তারা ইসলাম ও মুসলমানদের একটা কিছু করেই ছাড়বে। রাসূল সা: তার বাহিনী নিয়ে তাদের মুকাবিলার জন্য বের হলেন। আমিও চললাম। আমি কাফিরদের বিশাল বাহিনী দেখে মনে মনে বললাম: আল্লাহর কসম, রাসূলুল্লাহর প্রতি অতীতের সকল শত্রুতার প্রতিদান আজ আমি দেব: আজ আমি আমার কাজের মাধ্যমে আল্লাহর রাসূল সা: কে খুশী করবো।
দুই বাহিনী মুখোমুখি হলো। কাফিরদের তীব্র আক্রমণে মুসলমানরা ঠিকতে না পেরে ময়দান ছেড়ে পালাতে শুরু করলো। আমি তখন দেখলাম রাসূল সা: ময়দানের মাঝখানে তার ‘শাহবা’ খচ্চরের উপর পাহাড়ের মত অটল আছেন। তিনি প্রচণ্ড বেগে তরবারি চালিয়ে নিজেকে ও আশেপাশের সংগীদের রক্ষা করছেন। তখন তাকে সিংহের মত সাহসী মনে হচ্ছিল। এ দৃশ্য দেখে আমি আমার ঘোড়ার উপর থেকে লাফিয়ে পড়ে উন্মুক্ত তরবারি হাতে রাসূল সা: এর দিকে ছুটলাম। আল্লাহই জানেন, আমি তখন রাসূল সা: সামনে মৃত্যুর আশা করছিলাম। আমার চাচা আব্বাস রাসূলুল্লাহর সা: খচ্চরের লাগাম ধরে তার এক পাশে, আর আমি অন্য পাশে দাড়ালাম। আমি বাঁ হাতে রাসূল সা: বাহন এবং ডান হাতে তরবারি ধরে তীব্র আক্রমণ চালালাম। এ দৃশ্য দেখে রাসূল সা: চাচা আব্বাসকে জিজ্ঞেস করেন: এ কে? চাচা বললেন: আপনার ভাই, আপনার চাচার ছেলে- আবু সুফইয়ান ইবন হারেস। ইয়া রাসূল সা: আপনি তার প্রতি সন্তুষ্ট হয়ে যান। রাসূল সা: বললেন: আমি সন্তুষ্ট হয়েছি। আমার প্রতি তার সকল শত্রুতা আল্লাহ ক্ষমা করে দিয়েছেন।
আমি আনন্দে আত্মহারা হয়ে পড়লাম এবং রাসূল সা: পায়ে চুমু খেলাম। তিনি আমার দিকে ফিলে বললেন: আমার ভাই, সামনে এগিয়ে যাও, আক্রমণ কর। রাসূল সা: এর এই কথায় আমার সাহস বেড়ে গেল। আমি তীব্র আক্রমণ চালিয়ে প্রতিপক্ষ বাহিনীকে তাদের স্থান থেকে হটিয়ে দিলাম। আমার সাথে অন্য মুসলিমরাও আক্রমণ চালালো। আমরা তাদের ছত্রভঙ্গ করে প্রায় এক ফারসাখ পর্যন্ত তাড়িয়ে নিয়ে গেলাম।”
আবু সুফইয়ান ইবন হারেস এই হুনাইনের ময়দান থেকে রাসূল সা: সন্তুষ্টি ও সাহচর্য লাভে ধন্য হন। তবে জীবনে আর কখনো রাসূলুল্লাহর সা: প্রতি চোখ উঁচু করে তাকিয়ে দেখেননি। অতীত আচরণের কথা মনে করে লজ্জা ও অনুশোচনায় রাসূল সা: চেহারা মুবারকের প্রতি দৃষ্টি নিক্ষেপ করতে সাহস পাননি।
ইসলাম গ্রহণের পর আবু সুফইয়ান তার অতীত জাহিলী জীবনের কাজ ও আচরণ এবং আল্লাহর কিতাব থেকে বঞ্চিত হওয়ার কথা চিন্তা করে অনুশোচনায় জর্জরিত হয়েছেন। পরবর্তী জীবনে রাত দিন শুধু কুরআন তিলাওয়াত, কুরআনের বিধি বিধান ও উপদেশাবলী অনুধাবনে অতিবাহিত করতেন। তিনি দুনিয়ার সকল সুখ সম্পদ হতে দূরে থেকে নিজের সকল অঙ্গ প্রত্যঙ্গ একীভূত করে আল্লাহর দিকে মনোযোগী হয়ে পড়েন। একদিন তিনি মসজিদে ঢুকছেন। রাসূল সা: তাকে দেখে হযরত আয়িশাকে ডেকে বলেন: আয়িশা, এ লোকটিকে তুমি চেন? আয়িশা বললেন: না, ইয়া রাসূলুল্লাহ। রাসূল সা: বললেন: এ হচ্ছে আমার চাচাতো ভাই আবু সুফইয়ান ইবন হারেস। দেখ, সে সবার আগে মসজিদে ঢোকে, আর সবার পরে মসজিদ থেকে বের হয়। তার জুতোর ফিতে থেকে তার দৃষ্টি কখনও অন্যদিকে যায় না।
হযরত রাসূলে কারীমের ইনতিকালের পর আবু সুফইয়ান সন্তান হারা মায়ের মত ভীষণ কান্নাকাটি করেন। একটি কাসীদায় তার সেই বিয়োগ ব্যথা অতি চমতকার রূপে ফুটিয়ে তোলেন। ইসলাম গ্রহণের পর আবু সুফইয়ান তখনকার স্বীয় অনুভূতি ব্যক্ত ও ক্ষমা প্রার্থনা করে একটি স্বরচিত কাসীদা রাসূল সা: কে পাঠ করে শোনান। কাসীদার একটি লাইনে তিনি যখন বলেন:‘তিনি আমাকে সত্যের পথ দেখিয়েছেন যাকে আমি বিতাড়িত করেছিলাম’ তখন রাসূল সা: তার বুকে থাপ্পড় মেরে বলে ওঠেন: তুমিই আমাকে বিতাড়িত করেছিলে।’ (সীরাতু ইবন হিশাম-২/৪০০-৪০১)
হযরত উমারের খিলাফতকালে আবু সুফইয়ান অনুভব করেন, তাঁর জীবন-সন্ধা ঘনিয়ে এসেছে। তিনি একদিন নিজ হাতে একটি কবর খোঁড়েন। এর তিনদিন পর তিনি এই দুনিয়া থেকে বিদায় নেন। মৃত্যুর সাথে তার যেন একটি চুক্তি ছিল। মৃত্যুর পূর্বে স্ত্রী, সন্তান ও পরিবারের লোকদের বলেন: ‘তোমরা আমার জন্য কেদোঁনা। আল্লাহর কসম, ইসলাম গ্রহণের পর আমি কোন পাপ কাজ করিনি।’ এতটুকু বলার পর তিনি শেষ নি:শ্বাস ত্যাগ করেন। খলীফা উমার তার জানাযার নামায পড়ান। তার মৃত্যুসন হিজরী ১৫ মতান্তরে হিজরী ২০। হিশাম ইবন উরওয়াহ পিতা উরওয়াহ থেকে বর্ণনা করেন। রাসূল সা: বলেন: আবু সুফইয়ান জান্নাতের অধিবাসী যুবকদের নেতা। (আল ইসাবা-৪/৯০)।