নাম সিনান, পিতা আমর ইবনুল আকওয়া। কুনিয়াত বা ডাক নামের ব্যাপারে মতভেদ আছে। যথা: আবু মুসলিম, আবু ইয়াস, আবু আমের ইত্যাদি। তবে পুত্র ইয়াসের নাম অনুসারে আবু ইয়াস ডাক নামটি অধিক প্রসিদ্ধ। (আল ইসতিয়াব)।
সীরাত বিশেষজ্ঞরা সালামার ইসলাম গ্রহণের সময়কাল সম্পর্কে নীরব। তবে এতটুকু ঐতিহাসিক সত্য যে, হিজরী ৬ষ্ঠ সনের পূর্বেই তিনি ইসলাম গ্রহণ করেন এবং মদীনায়ও হিজরত করেন। অধিকাংশ মুহাজির পরিবার পরিজন সহ হিজরাত করেন; কিন্তু হযরত সালামা আল্লাহর রাস্তায় স্ত্রী ও সন্তানদের ত্যাগ করেই হিজরাত করেন।
মদীনায় আসার পর তিনি প্রায় সকল যুদ্ধেই অংশগ্রহণ করেন। হুদাইবিয়ার সন্ধির প্রেক্ষাপটে ‘বাইয়াতে রিদওয়ান’ বা ‘বাইয়াতে শাজারা’ এর ইসলামের ইতিহাসে এক বিশেষ গুরুত্ব রয়েছে। ৬ষ্ঠ হিজরীতে হুদাইবিয়ার ঘটনাকালে হযরত রাসূলে পাক সা: যখন মক্কার কাফিরদের হাতে হযরত উসমানের শাহাদাতের খবর শুনেন এবং রাসুলুল্লাহর সা: সাথে হুদাইবিয়ায় আগত মুসলমানদের নিকট থেকে মৃত্যুর বাইয়াত বা শপথ নেন, তখন হযরত সালামা রাসুলুল্লাহর সা: হাতে তিনবার বাইয়াত করেন। তিনি বলেছেন: ‘হুদাইবিয়ার গাছের নীচে আমি রাসুলুল্লাহর হাতে সা: মৃত্যুর বাইয়াত করলাম। তারপর একপাশে চলে গেলাম। লোকের ভিড় কিছুটা কমে গেলে রাসুলুল্লাহ সা: আমাকে দেখে বললেন: সালাম তোমার কী হল, তুমি যে বাইয়াত করলে না? বললাম: ইয়া রাসুলুল্লাহ, আমি তো বাইয়াত করেছি। রাসুল বললেন: তাতে কি হয়েছে, আর একবার কর। আমি আবারো বাইয়াত করলাম। এ সময় রাসুলুল্লাহ সা: তাকে একটি ঢাল উপহার দেন। এরপর আবার তিনি রাসুলুল্লাহর সা: নজরে পড়েন। তিনি জিজ্ঞেস করেন: সালামা, বাইয়াত করবে না? সালামা আরজ করেন: ইয়া রাসুলাল্লাহ, আমি তো দুবার বাইয়াত করেছি। বললেন: আবারো একবার কর। সালামা তৃতীয়বার বাইয়াত করেন। এবার রাসুলুল্লাহ সা: জিজ্ঞেস করেন: সালামা ঢালটি কি করেছো? তিনি বললেন: আমার চাচা একেবারে খালি হাতে ছিলেন, আমি সেটা তাকে দিয়েছি। তার কথা শুনে রাসুলুল্লাহ হেসে উঠে বলেন: তোমার দৃষ্টান্ত সেই ব্যক্তির মত যে দুআ করে, হে আল্লাহ আমাকে এমন বন্ধু দান কর যে আমার নিজের জীবন অপেক্ষা অধিকতর প্রিয় হবে।
হুদাইবিয়ায় রাসুলুল্লাহর সা: হাতে বাইয়াত চলছে, এর মধ্যে মক্কাবাসীদের সাথে মুসলমানদের সন্ধি হয়ে গেল। মুসলমানরা শান্তির নি:শ্বাস ফেলে একে অপরের সাথে কোলাকুলি করতে লাগলো। হযরত সালামা নিশ্চিন্তে একটি গাছের তলায় শুয়েছিলেন। এমন সময় চারজন মুশরিক (অংশীবাদী) তার পাশে এসে বসে। তারা রাসুলুল্লাহ সা: সম্পর্কে এমন সব আলাপ আলোচনা করতে শুরু করে যা তার শুনতে ইচ্ছা হলো না। তিনি উঠে অন্য একটি গাছের নিচে গিয়ে বসলেন। তার সরে যাওয়ার পর এই চার মুশরিক নিজেদের অস্ত্র শস্ত্র রেখে শুয়ে পড়ে। এমন সময় কেউ একজন চেঁচিয়ে বলে ওঠে: ‘মুহাজিরগণ, ছুটে এস, ইবন যানীমকে হত্যা করা হয়েছে।’ এ আওয়ায কানে যেতেই সালামা অস্ত্র হাতে তুলে নিয়ে ঐ চার মুশরিকের দিকে ছুটে যান। তারা তখনও শুয়ে ছিল। সালামা তাদের অস্ত্র নিজ দখলে নিয়ে বলেন, যদি ভালো চাও সোজা আমার সাথে চলো। আল্লাহর কসম, কেউ মাথা উঁচু করলে তার চোখ ফুটো করে ফেলবো। তিনি তাদেরকে নিয়ে রাসুলুল্লাহর সা: খিদমতে হাজির হন। সালামার চাচাও প্রায় ৭০/৭১ জন মুশরিককে বন্দী করে নিয়ে আসেন। হযরত নবী কারীম সা: তাদের সকলকে ছেড়ে দেন। এ ঘটনারই প্রেক্ষাপটে কুরআনের এ আয়াত নাযিল হয়:
‘আর সেই আল্লাহ, তিনিই তো মক্কার মাটিতে কাফিরদের ওপর তোমাদেরকে বিজয় দানের পর তাদের হাতকে তোমাদের থেকে এবং তোমাদের হাতকে তাদের বিরত রেখেছেন।’ (সূরা আল ফাতহ/৩)।
মুসলমানদের কাফিলা মদীনায় প্রত্যাবর্তনকালে একটি পাহাড়ের নিকট তাবু স্থাপন করে। মুশরিকদের মনে কিছু অসৎ উদ্দেশ্য কাজ করে। হযরত রাসূলে কারীম সা: তা অবগত হন। তিনি তাবু পাহারার প্রয়োজন অনুভব করেন। তিনি সেই ব্যক্তির জন্য মাগফিরাতের দুআ করেন যে সেই পাহাড়ের ওপর বসে পাহার দেবে। এই সৌভাগ্য হযরত সালামা অর্জন করেন। তিনি রাতভর বার বার পাহাড়ের ওপর উঠে শত্রুর পদধ্বনি শোনার চেষ্টা করেন।
হযরত রাসূলে কারীমের কিছু উট ‘জী-কারওয়া’-র চারণক্ষেত্রে চরতো। একদিন বনু গাতফান মতান্তরে বনু ফাযারার লোকেরা অতর্কিত হামলা চালিয়ে রাখালকে হত্যা করে উটগুলি লুট করে নিয়ে যায়। হযরত সালামা ইবন আকওয়া ঘটনাস্থলের পাশেই ছিলেন। শেষ রাতে তিনি বের হয়েছেন, আবদুর রহমান ইবন আউফের দাস তাকে খবর দিল, রাসুলুল্লাহর উটগুলি লুট হয়ে গেছে। সালামা আবদুর রহমানের দাসকে মদীনায় পাঠিয়ে দিলেন রাসুলুল্লাহকে সা: খবর দেওয়ার জন্য। আর তিনি পাহাড়ের চূড়ায় উঠে ‘ইয়া সাবাহাহ’ (শত্রুর আক্রমণের সতর্ক ধ্বনি) বলে এমন জোরে চেঁচিয়ে ওঠেন যে, সে আওয়ায মদীনার এক প্রান্ত থেকে অপর প্রান্ত পর্যন্ত পৌঁছে যায়। তিনি একাকী ডাকাত দলের পিছু ধাওয়া করেন। ডাকাতরা পানি তালাশ করছিল, এমন সময়ে তিনি সেখানে পৌঁছে যান। তিনি ছিলেন দক্ষ তীরন্দায। নির্ভুল তাক করে তীর ছাড়ছিলেন, আর মুখে গুণগুণ করে আওড়াচ্ছিলেন:
‘আনা ইবনুল আকওয়া
আল-য়াউম য়াউমুর রুদ্দায়ি।’
অর্থাত আমি আকওয়ার ছেলে- আজকের দিনটি নিচ প্রকৃতির লোকদের ধ্বংস সাধনের দিন। তিনি এমনভাবে আক্রমণ করেন যে, ডাকাতরা উট ফেলে পালিয়ে যায়। তারা দিশেহারা হয়ে তাদের চাদরও ফেলে যায়। এর মধ্যে হযরত রাসূলে কারীম সা: আরও লোকজন সংগে করে সেখানে উপস্থিত হন। সালামা আরজ করেন, ইয়া রাসূলুল্লাহ, আমি তাদের পানি পান করতে দেইনি। এখনই পিছু ধাওয়া করলে তাদের ধরা যাবে। রাসুল সা: বলেন, পরাজিত করার পর ক্ষমা কর। (বুখারী, কিতাবুল মাগাযী, বাবু গাযওয়া জী কারওয়াহ, সীরাতু ইবন হিশাম-২/২৮১-৮২, হায়াতুস সাহাবা ১/৫৫৯-৬১)। ঘটনাটি বিভিন্ন গ্রন্থে ভিন্ন ভিন্নভাবে বর্নিত হয়েছে।
খাইবার যুদ্ধে তিনি চরম বীরত্ব প্রদর্শন করেন। খাইবার বিজয়ের পর হযরত রাসূলে কারীমের হাতে হাত দিয়ে তিনি মদীনায় প্রত্যাবর্তন করেন।
খাইবারের পর তিনি সাকীফ ও হাওয়াযিনের যুদ্ধে যোগদান করেন। এই অভিযানের সময় এক ব্যক্তি উটে আরোহণ করে মুসলিম সেনা ছাউনীতে আসে এবং উটটি বেঁধে আস্তে করে মুসলিম সৈনিকদের সাথে নাশতায় শরীক হয়ে যায়। তারপর চারদিকে সতর্ক দৃষ্টি ফেলে মুসলমানদের শক্তি আঁচ করে আবার উটে চড়ে দ্রুত কেটে পড়ে। এভাবে এসে আবার চলে যাওয়ায় গুপ্তচর বলে মুসলমানদের বিশ্বাস হয়। এক ব্যক্তি তার পিছু ধাওয়া করে। সালামাও তাঁকে অনুসরণ করেন এবং দৌড়ে আগে গিয়ে লোকটিকে পাকড়াও করার পর তরবারির এক আঘাতে তাকে হত্যা করেন। তারপর নিহত ব্যক্তিটির বাহনটি নিয়ে ফিরে আসেন। রাসুলুল্লাহ সা: জিজ্ঞেস করেন: লোকটিকে কে হত্যা করেছে? লোকেরা বললো: সালামা। রাসুল সা: ঘোষণা করেন: নিহত ব্যক্তির যাবতীয় জিনিস সেই পাবে। হিজরী ৭ম সনে হযরত রাসূলে কারীম সা: আবু বকরের নেতৃত্বে বনী কিলাবের বিরুদ্ধে একটি বাহিনী পাঠালেন। সেই বাহিনীতে সালামাও ছিলেন। তিনি এই অভিযানে একাই সাতজনকে হত্যা করেন। যারা পালিয়ে গিয়েছিল তাদের অনেক নারীকে তিনি বন্দী করে নিয়ে আসেন। এই বন্দীদের মধ্যে একটি সুন্দরী মেয়েও ছিল। হযরত আবু বকর মেয়েটিকে হযরত সালামার দায়িত্বে অর্পণ করেন। হযরত সালামা মেয়েটিকে মদীনায় নিয়ে আসলেন। রাসুলুল্লাহ সা: বললেন: মেয়েটিকে আমার জিম্মায় ছেড়ে দাও। সালামা মেয়েটিকে রাসূলুল্লাহর সা: জিম্মায় দিয়ে দিলেন। রাসুলুল্লাহ সা: এ মেয়েটির বিনিময়ে কাফিরদের হাতে বন্দী মুসলমানদের মুক্ত করেন।
হযরত সালামা ইবনুল আকওয়া (রা) ইসলাম গ্রহণের পর কাফিরদের সাথে সংঘটিত প্রায় সকল যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। কোন কোন বর্ণনা মতে তিনি মোট চৌদ্দটি যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। সাতটি রাসুলুল্লাহর সা: সাথী হিসাবে, আর অবশিষ্ট সাতটি রাসুলুল্লাহ সা: প্রেরিত বিভিন্ন অভিযান। মুসতাদরিকের একটি বর্ণনা মতে তার অংশগ্রহণ করা যুদ্ধের সংখ্যা মোট ষোল। একবার তিনি বলেন: আমি রাসুলুল্লাহর সাথে সাতটি এবং যায়িদ ইবন হারিসার সাথে নয়টি যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছি। (রিজালুন হাওলার রাসূল-৫৫৫)
পদাতিক বাহিনীর যারা তীর বর্শা নিয়ে যুদ্ধ করতো, তাদের মধ্যে সালামা ছিলেন অন্যতম দক্ষ ব্যক্তি। শত্রু সৈন্যরা যখন আক্রমণ চালাতো তিনি পিছু হটে যেতেন। আবার শত্রুরা যখন পিছু হটে যেত বা বিশ্রাম নিত, তিনি অতর্কিত আক্রমণ চালাতেন। এই ছিল তার যুদ্ধ কৌশল। এই কৌশল অবলম্বন করে তিনি একাই মদীনার উপকন্ঠে ‘জী কারাদ’ যুদ্ধে উয়াইনা ইবন হিসন আল ফিযারীর নেতৃত্বে পরিচালিত বাহিনীকে পর্যুদস্ত করেন। তিনি একাই তাদের পিছু ধাওয়া করেন, তাদের ওপর আক্রমণ পরিচালনা করেন এবং তাদের আক্রমণ প্রতিহত করেন। এভাবে মদীনা থেকে বহু দূর পর্যন্ত তাদের তাড়িয়ে নিয়ে যান।
বীরত্ব ও সাহসিকতায় বিশেষত: দ্রুত দৌড়ানোর ক্ষেত্রে সাহাবা সমাজের মধ্যে সালামা ছিলেন বিশেষ স্থানের অধিকারী। আলা ইসাবা গ্রন্থকার লিখেছেন: তিনি ছিলেন অন্যতম বীর এবং অশ্বের চেয়ে দ্রুতগামী। হুদাইবিয়ার সন্ধির সময় মতান্তরে ‘জী কারাদ’ অভিযানের সময় রাসুলে কারীম সা: তার প্রশংসায় মন্তব্য করেন: ‘খায়রু রাজ্জালীনা সালামা ইবনুল আকওয়া- সালামা ইবন আকওয়া আমাদের পদাতিকদের মধ্যে সর্বোত্তম।’ (রিজালুন হাওলার রাসূল-৫৫৫)
হযরত সালামা ছিলেন অত্যন্ত শক্ত মানুষ। দু:খ বেদনা কি জিনিস তা যেন তিনি জানতেন না। তবে খাইবার যুদ্ধে তার ভাই মতান্তরে চাচা হযরত আমের ইবন আকওয়ার লাশের পাশে দাঁড়িয়ে একটি বিষাদ ভরা গান গুণগুণ করে গেয়েছিলেন। যার শেষ চরণটি ছিল এমন: “(হে আল্লাহ) আমাদের ওপর প্রশান্তি নাযিল করুন, শত্রুর মুখোমুখি আমাদের পদসমূহ দৃঢ়মূল করুন।”
এই খাইবার যুদ্ধে তার ভাই আমের তরবারি দিয়ে সজোরে একজন মুশরিককে আঘাত হানেন। কিন্তু আঘাতটি ফসকে গিয়ে নিজের দেহে লাগে এবং তাতেই তিনি শাহাদাত বরণ করেন। এ ঘটনার পর মুসলমানদের কেউ কেউ মন্তব্য করলো: ‘হতভাগা আমের- শাহাদাতের সৌভাগ্য থেকে বঞ্চিত হলো।’ শুধু এই দিন, যখন অন্যদের মত সালামার মনেও এই ধারণা জন্মালো যে, তাঁর ভাই জিহাদ ও শাহাদাতের সাওয়াব থেকে বঞ্চিত হয়েছে, তখন ভীষণ ব্যথিত ও বিমর্ষ হলেন। তিনি দৌড়ে রাসুলুল্লাহর সা: কাছে গিয়ে প্রশ্ন করেন:
-ইয়া রাসুলুল্লাহ, আমেরের সকল নেক আমল ব্যর্থ হয়ে গেছে।-এ কথা কি ঠিক?
রাসূল সা: বললেন:
-সে মুজাহিদ হিসেবে নিহত হয়েছে। তার জন্য দুটি পুরষ্কার রয়েছে। এখন সে জান্নাতের নদী সমূহে সাঁতার কাটছে। (রিজালুন হাওলার রাসূল:৫৫৫-৫৫৬)।
হযরত সালামা (রা) হযরত রাসূলে কারীমের সা: ওফাতের পর থেকে হযরত উসমানের (রা) শাহাদাত পর্যন্ত মদীনায় ছিলেন। হযরত উসমানের (রা) হত্যার পর এই বীর মুজাহিদ বুঝতে পারলেন, মুসলিম জাতির মধ্যে ফিতনা বা আত্ম কলহের দ্বার খুলে গেছে। যে ব্যক্তি তার ভাইদের সংগে করে সারাটি জীবন কাফিরদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছে, এখন তার পক্ষে সেই ভাইদের বিরুদ্ধে অস্ত্র ধারণ করা শোভন নয়। মুশরিকদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে যে দক্ষতার জন্য তিনি রাসুলুল্লাহর সা: প্রশংসা কুড়িয়েছেন, একজন মুমিনের বিরুদ্ধে সেই দক্ষতার সাথে যুদ্ধ করা অথবা সেই দক্ষতা কাজে লাগিয়ে একজন মুসলমানকে হত্যা করা কোনভাবেই সঙ্গত নয়।
এ উপলদ্ধির পর তিনি নিজের জিনিসপত্র উটের পিঠে চাপিয়ে মদীনা ছেড়ে সোজা ‘রাবজা’ চলে যান। সেখানেই আমরণ বসবাস করতে থাকেন। এই রাবজাতেই ইতিপূর্বে হযরত আবু যার আল গিফারী (রা) চলে এসেছিলেন মদীনা ছেড়ে এবং এখানেই শেষ নি:শ্বাস ত্যাগ করেছিলেন।
হযরত সালামা (রা) বাকী জীবনটা এই রাবজায় কাটিয়ে দেন। মৃত্যুর কয়েকদিন আগে হঠাত তার মনে মদীনায় যাওয়ার প্রবল ইচ্ছা জাগে। তিনি মদীনা যান। সেখানে দুই দিন কাটানোর পর তৃতীয় দিন আকস্মিকভাবে মৃত্যুবরণ করেন। এভাবে তার হাবীবের পবিত্র ভূমিতে শহীদ ও সত্য নিষ্ঠ বন্ধুদের পাশেই তিনি সমাহিত হন। (রিজালুন হাওলার রাসূল-৫৫৬-৫৭)।
তার মৃত্যু সন সম্পর্কে ঐতিহাসিকদের মতপার্থক্য আছে। সঠিক মত অনুযায়ী তিনি হিজরী ৭৪ সনে মৃত্যু বরণ করেন। অন্য একটি মতে তার মৃত্যু সন হিজরী ৬৪। ওয়াকিদী ও তার অনুসারীদের ধারণা তিনি আশি বছর জীবিত ছিলেন। ইবন হাজার বলেন, মৃত্যু সন সম্পর্কে প্রথম মতানুযায়ী ওয়াকিদীর এ ধারণা সঠিক নয়। কারণ তাতে হুদাইবিয়ার বাইয়াতের সময় তাঁর বয়স দাড়ায় দশের কাছাকাছি। আর এ বয়সে কেউ মৃত্যুর বাইয়াত করতে পারে না। তাছাড়া আমি ইবন সা’দে দেখেছি, তিনি হযরত মুআবিয়ার (রা) খিলাফতকালের শেষ দিকে ইনতিকাল করেন। বালাযুরীও এমনটি উল্লেখ করেছেন। (আল ইসাবা-২/৬৭)।
হযরত সালামা (রা) রাসুলুল্লাহর সা: ঘনিষ্ট সাহচর্য লাভের সুযোগ পেয়েছিলেন। বহু অভিযানে রাসুলুল্লাহর সফর সঙ্গী হওয়ার গৌরবও অর্জন করেছিলেন। এই সুযোগ তিনি যথাযথভাবে কাজে লাগিয়েছেন। তাছাড়া আবু বকর, উমার, উসমান ও তালহা (রা) থেকেও হাদীস বর্ণনা করেছেন। তার বর্ণিত হাদীসের সংখ্যা সাতাত্তর (৭৭)। তার মধ্যে ষোলটি মুত্তাফাক আলাইহি অর্থাত বুখারী ও মুসলিম কর্তৃক বর্ণিত। ৫টি বুখারী ও ৯টি মুসলিম এককভাবে বর্ণনা করেছেন। (তাহজীবুল কামাল-১৪৮) আর তাঁর নিকট থেকে যারা হাদীস বর্ণনা করেছেন, তাদের মধ্যে বিশেষ উল্লেখযোগ্য ব্যক্তিরা হলেন- ইয়াস ইবন সালামা, ইয়াযীদ ইবন উবাইদ, আবদুর রহমান ইবন আবদিল্লাহ, মুহাম্মাদ ইবন হানাফিয়া প্রমূখ।
আল্লাহর রাস্তায় খরচের ব্যাপারে হযরত সালামা ছিলেন দরাযহস্ত। কেউ কিছু আল্লাহর ওয়াস্তে চাইলে তিনি খালি হাতে ফিরাতেন না। তিনি বলতেন, যে আল্লাহর ওয়াস্তে দেয় না সে কোথায় দেবে? তবে আল্লাহর ওয়াস্তে চাওয়াকে তিনি পছন্দ করতেন না।
তিনি নিজের জন্য সাদকার মাল হারাম মনে করতেন। যদি কোন জিনিস সাদকার বলে সন্দেহ হত, তিনি তা থেকে হাত গুটিয়ে নিতেন। এ কারণে নিজের সাদকা করা কোন জিনিস দ্বিতীয়বার অর্থের বিনিময়ে খরিদ করাও পছন্দ করতেন না।
তিনি হারাম ও হালালের ব্যাপারে এতই সতর্ক ছিলেন যে, জুয়ার সাথে সাদৃশ্য দেখায় এমন কোন খেলায় তিনি বাচ্চাদের খেলতে দিতেন না।
মদীনায় যে সকল সাহাবী ফাতওয়া দান করতেন সালামা (রা) ছিলেন তাদেরই একজন। ইবন সা’দ যিয়াদ ইবন মীনা হতে বর্ণনা করেছেন। তিনি বলছেন: ইবন আব্বাস, ইবন উমার, আবু সাঈদ আল খুদরী, আবু হুরাইরা, আবদুল্লাহ ইবন আমর ইবনুল আস, জাবির ইবন আবদিল্লাহ, রাফে ইবন খাদীজ, সালামা ইবন আকওয়া প্রমূখ সাহাবী মদীনায় ফাতওয়া দিতেন। (হায়াতুস সাহাবা-৩/২৫৪)।
ইমাম বুখারী ‘আল আদাবুল মুফরাদ’ (পৃ. ১৪৪) গ্রন্থে আবদুর রহমান ইবন রাযীন থেকে বর্ণনা করেছেন। তিনি বলেন: আমরা রাবজা দিয়ে যাচ্ছিলাম। আমাদের বলা হলো, এখানে সালামা ইবন আকওয়া আছেন। আমি তাঁর কাছে গিয়ে সালাম জানালাম। তিনি নিজের দুটি হাত বের করে আমাদেরকে দেখিয়ে বললেন: আমি এই দুটি হাত দিয়ে রাসুলুল্লাহর সা: হাতে বাইয়াত করেছি। তিনি তার একটি পাঞ্জা বের করলেন। পাঞ্জাটি যেন উটের পাঞ্জার মত বৃহদাকৃতির। (হায়াতুস সাহাবা-২/৪৯৮-৯৯)
হযরত সালামাকে একবার জিজ্ঞেস করা হয়েছিল, হুদাইবিয়ার দিনে আপনারা কোন্ কথার ওপর রাসূলুল্লাহর সা: হাতে বাইয়াত করেছিলেন? বলেছিলেন: মাওত, অর্থাত মৃত্যুর ওপর। (আল ইসতিয়াব, হায়াতুস সাহাবা-১/২৪৯)।
হযরত সালামার (রা) পুত্র ‘ইয়াস’ একটি মাত্র কথায় পিতার ফজীলাত ও বৈশিষ্ট্য চমতকার রূপে তুলে ধরেছেন। তিনি বলছেন: ‘মা কাজাবা আবী কাততু- আমার আব্বা কক্ষণো মিথ্যা বলেন নি। (রিজালুন হাওলার রাসূল-৫৫৪)।
সত্যনিষ্ঠ মানুষদের মধ্যে সর্বোচ্চ স্থান লাভের জন্য একজন মানুষের জীবনে এই একটি মাত্র গুণই যথেষ্ট। তিনি তার জীবনের প্রতিটি পর্যায়ে এই সততার দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন।
‘আল ইলতিয়াব ফী আসমায়িল আসহাব’ গ্রন্থের লেখক আবু উমার ইউসুফ আল কুরতুবী ইবন ইসহাকের সূত্রে হযরত সালামা সম্পর্কে একটি অভিনব কাহিনীর উল্লেখ করেছেন। ইবন ইসহাক বলেন, ‘আমি শুনেছি নেকড়ে বাঘ যার সংগে কথা বলেছে, সালামা সেই ব্যক্তি। সালামা বলেছেন, আমি একটি নেকড়েকে হরিণ শিকার করতে দেখলাম। আমি তাকে তাড়া করে তার মুখ থেকে হরিণটি বের করে আনলাম। তখন নেকড়েটি বললো, ‘তোমার কি হল, আল্লাহ আমাকে যে রিযিক দিয়েছেন আমি তো তাই খেতে চাচ্ছি। আর তা তোমারও সম্পদ নয় যে, তুমি আমার মুখ থেকে কেড়ে নেবে। সালামা বলেন, আমি বললাম, ‘ওহে আল্লাহর বান্দারা, এই দেখ অভিনব ঘটনা। নেকড়ে কথা বলছে, আমার কথা শুনে নেকড়েটি বললো, এর থেকেও আশ্চর্য ঘটনা হলো, আল্লাহর রাসূল তোমাদেরকে আল্লাহর বন্দেগীর দিকে আহবান জানাচ্ছেন, আর তোমরা তা অস্বীকার করে মূর্তি পূজার দিকে ধাবিত হচ্ছো। সালামা বলেন, অত:পর আমি রাসুলুল্লাহর সা: খিদমতে হাজির হয়ে ইসলাম গ্রহণ করি। আল্লাহই ভালো জানেন, কে এই নেকড়ে।’ (আল ইসতিয়াব)।