দ্বীনকে পূর্ণাঙ্গ করে আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা বান্দার প্রতি তাঁর বিশেষ অনুগ্রহ পূর্ণ করেছেন।
তিনি সুবহানাহু ওয়া তা’আলা বলেন,
“এবং সত্য ও ইনসাফ (এর আলোকে) আপনার ররের কথাগুলো পরিপূর্ণ হয়ে গেছে। তাঁর কথা পরিবর্তন করার কেউ নেই। এবং তিনি সর্বশ্রোতা, সর্বজ্ঞ।”
(সূরা আল আনআম: ১১৫)
নিশ্চয়ই দ্বীনকে পূর্ণাঙ্গ করা বান্দার প্রতি আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা’র একটি বিশেষ রহমত। কুর’আনকে তিনি (সুবহানাহু ওয়া তা’আলা) সুরক্ষিত করেছেন এবং পরিবর্তন ও রদবদল হতে নিরাপদ রেখেছেন। তিনি (সুবহানাহু ওয়া তা’আলা) বলেন,
“নিশ্চয়ই সন্দেহাতীতভাবে আমি কুর’আন নাযিল করেছি এবং নিশ্চয়ই আমি তা সংরক্ষন করবো।”
[সূরা হিজর: ৯]
তিনি (সুবহানাহু ওয়া তা’আলা) একে সংরক্ষণ করেছেন যাতে তা কেয়ামত পর্যন্ত মানবজাতির জন্য প্রমাণ হয়ে থাকে।
যেহেতু রাসূলুল্লাহ্ (সা) পৃথিবীতে নাযিলকৃত সর্বশেষ আসমানী ওহী গ্রহণ করেছেন সেহেতু তাঁর পর আল্লাহ্’র নির্দেশ মোতাবেক কুর’আন এবং সুন্নাহ্’কে দৃঢ়ভাবে আকড়ে ধরে নবুয়্যতের দায়িত্ব সর্বোত্তম পন্থায় পালন করতে মুসলিমরা বাধ্য। আর তা করলে তখন আমরা দাবি করতে পারবো যে আমরা রাসূলুল্লাহ্ (সা) ও তাঁর সাহাবীগণের প্রদর্শিত পথের উপর রয়েছি। যার স্বপক্ষে অসংখ্য দলিল আছে।
মানুষের চিন্তা ও সহজাত প্রবৃত্তি (ফিতরাহ্) সাথে সঙ্গতিপূর্ণ সত্য এই দ্বীনের দাওয়াহ্ বহন করতে গিয়ে মুসলিমদের যেহেতু অন্যান্য জাতির সংস্পর্শে আসতে হয়েছিল সেহেতু অন্যান্য জাতিগুলো পাল্টাপাল্টি কিংবা আত্মরক্ষার খাতিরে তাদের বিশ্বাসকে মুসলিমদের সামনে উপস্থাপন করেছিল। না বুঝে কখনও কখনও কিছু মুসলিম এসব চিন্তাসমূহ দ্বারা প্রভাবিত হয়ে পড়ে। ফলে তাদের চিন্তা ও দাওয়াহ্’তে এর নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। যদিও তার ঠিক পরই আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা কতৃর্ক মনোনিত দ্বীনের মিনার এবং পথিকৃত সম্মানিত আলেমগণ মুসলিমদের সতর্ক করা শুরু করেন। সত্য প্রতিষ্ঠিত হয়। সুতরাং তারা দ্বীনকে কুফরের সংমিশ্রণের হতে মুক্ত করতে সক্ষম হন। তারা জাল দলিলসমুহকে রুখে দিয়ে প্রতারণামূলক কর্মকান্ডকে ব্যর্থ করে দেন। ফলে দ্বীন তার ঔজ্জ্বল্যতা ফিরে পায়। বর্তমান ক্ষতিকর পরিস্থিতি পূর্বে এভাবেই কখনো ভালো কখনো খারাপ পরিস্থিতি বিরাজ করছিল। সুতরাং এ থেকে পরিত্রাণের উপায় কী?
প্রাথমিক স্বর্ণযুগে ইসলামকে ফিরিয়ে আনতে তৎকালীন ভালো অবস্থার পেছনে কারণগুলো অনুসন্ধান করা এখন সময়ের দাবি।
ইসলামকে সকল সন্দেহের ঊর্ধ্বে রাখতে, ইসলাম বহির্ভূত যেকোনো চিন্তা সংযোজনের প্রতারণামূলক অপচেষ্টাকে ব্যর্থ করতে হলে প্রথমেই আমাদের উত্তরাধীকার সূত্রে প্রাপ্ত পশ্চিমা দুষিত মানসিকতা হতে মুক্ত হতে হবে। যে মানসিকতা লাভ-ক্ষতি আর খেয়াল-খুশিকে দাওয়াহ্ পরিচালনার মাপকাঠিতে পরিণত করে ফলে আমরা এর সাথে সঙ্গতিপূর্ণ বিষয়কে গ্রহণ এবং অসঙ্গতিপূর্ণ বিষয়কে বর্জন করছি। তারপর এই দৃষ্টিভঙ্গীর আলোকে শারী’আহ্ দলীলের ব্যাখ্যা দিচ্ছি। এবং শেষে এর যথার্থতা সমর্থনে বিভিন্ন দলীল পেশ করছি। হুকুম শুধুমাত্র একমাত্র আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা’র এটাই সঠিক ইসলামী মানসিকতা। সুতরাং নিজের পছন্দ-অপছন্দ এবং ইচ্ছানুযায়ী আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা’র বিধানকে অনুধাবনের চেষ্টা কোনভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। আমাদের খেয়ালখুশির প্রাধান্যও গ্রহণযোগ্য নয়। শত্রুর ভয়, গণবিচ্ছিন্নতা, শাসকগোষ্ঠীর ইসলামবিরোধী অবস্থান এবং পারিপার্শ্বিক অবস্থা ও পরিস্থিতির ভয়ে ভীত হওয়াটা যেমন গ্রহণযোগ্য নয়। ঠিক তেমনি অবস্থার দোহাই দিয়ে দাওয়াহ্ বহনকারীর দায়িত্বকে হালকা করাটাও গ্রহণযোগ্য নয়। আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা সব জানেন এবং সব বিষয়ের খবর রাখেন। তিনি মানুষের প্রকৃতি, প্রয়োজন, সামর্থ্য, বাস্তব জীবন, শত্রু ও শত্রুকে মোকাবেলা এবং তদুপরী সকল বিষয়ে সম্যক অবগত।
আমরা ইতিমধ্যে বর্ণনা করেছি যে ইজতিহাদের সঠিক পদ্ধতি হচ্ছে প্রথমে সমস্যার বাস্তবতাকে সঠিকভাবে অনুধাবন করা। তারপর শারী’আহ্ দলীলের নির্দেশনা অনুযায়ী উক্ত সমস্যাটির সমাধান বের করা। আর এই প্রক্রিয়ায় বর্তমান বাস্তবতায় যেকোনো সমস্যা সম্পর্কে আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা’র হুকুমসমুহ সম্পর্কে জ্ঞান অর্জন করা সম্ভব। অন্যভাবে বললে এ প্রক্রিয়ায় অগ্রসর হলে আমরা বলতে সক্ষম হবো বিদ্যমান কোন সমস্যার প্রতি শারী’আহ্’র হুকুম কি, পাশাপাশি এই হুকুম পালনের পথে প্রতিবন্ধক পারিপার্শ্বিক অবস্থা, পরিস্থিতি, বাঁধা-বিপত্তি এবং এই হুকুম হতে ঈস্পিত স্বার্থ অর্জন ইত্যাদির ব্যাপারে শারী’আহ্ দৃষ্টিভঙ্গী। এ বিষয়ে আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা বলেন,
“হে বিশ্বাসীগণ! তোমরা আল্লাহ্ ও তাঁর রাসূলের সামনে অগ্রণী হয়ো না, এবং আল্লাহ্’কে ভয় করো। নিশ্চয় আল্লাহ্ সবকিছু শোনেন ও জানেন।”
(সূরা আল-হুজুরাত: ১)
তিনি সুবহানাহু ওয়া তা’আলা আরও বলেন,
“আল্লাহ্ ও তাঁর রসূলের পক্ষ থেকে কোন বিষয়ের সিদ্ধান্ত আসার পর তাতে ভিন্নতা পোষণ করা মু’মিন পুরুষ কিংবা নারী কারও ক্ষেত্রেই সঙ্গত নয়। এবং যে আল্লাহ্ ও তাঁর রসূলের আদেশ অমান্য করে সে প্রকাশ্য পথভ্রষ্টতায় পতিত হয়।”
(সূরা আল আহযাব: ৩৬)
ভিন্ন এই দুই মানসিকতাই মুলতঃ বিদ্যমান সমস্যা সমাধানে আল্লাহ্’র হুকুম বোঝার ক্ষেত্রে মুসলিমদের মধ্যে ব্যাপক মতপার্থক্য তৈরি করে।
পশ্চিমা চিন্তা দ্বারা প্রভাবিত মানসিকতা পরিস্থিতি-পারিপার্শ্বিক অবস্থা, লাভ-ক্ষতির আশংকা ইত্যাদি ভিত্তিহীন মিথ্যা অজুহাতে শারী’আহ্’র অকাট্য অনেক দলিলকে পরিত্যাগ এবং প্রত্যাখ্যান করেছে। ঊদাহরণস্বরূপ সুদকে সুস্পষ্ট হারাম ঘোষণা করা হয়েছে এবং এর কারণ বা ব্যাখ্যা খোঁজার কোনো অবকাশ নাই; অথচ বাস্তবতা, পরিস্থিতি, লাভ-ক্ষতির হিসাব কিংবা পারিপার্শ্বিকতা দ্বারা প্রভাবিত হয়ে তারা সুদের লেনদেনকে বৈধতা দানে ভিন্ন হুকুম নিয়ে হাজির হয়েছে।
এ ধরনের মানসিকতার উপর কিছু দল প্রতিষ্ঠিত হয়েছে এবং তারা এমন কিছু হুকুম নিয়ে এসেছে যা শারী’আহ্ অনুমোদিত নয় বরং চরম সাংঘর্ষিক। এই কারণে পুরোপুরি বিপরীতধর্মী হওয়া সত্ত্বেও তারা দাবি করে গণতন্ত্র ইসলাম থেকে এসেছে যা আমরা ইতিপূর্বে আলোচনা করেছি। তারা আরও দাবি করে কুফর শাসনব্যবস্থায় অংশগ্রহণ করা শারী’আহ্ অনুমোদিত এবং দ্বীন প্রতিষ্ঠায় আন্দোলনকারী দলসমূহের জন্য এটাই একমাত্র অবশিষ্ট পথ। যদিও তা পবিত্র কুর’আনের আয়াত এবং রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর সুন্নাহ্’র সাথে সম্পূর্ণ সাংঘর্ষিক।
যখন আমরা ধাপে ধাপে ইসলামী শাসন বাস্তবায়ন বা এর আহ্বান নিয়ে আলোচনা করছি তখন মুলত আমরা একই সাথে তা সংশ্লিষ্ট চিন্তাগুলোর অসাড়তা ও দুষণ নিয়েও আলোচনা করছি, যেমন: কুফর শাসনব্যবস্থায় অংশগ্রহণ। এ বিষয় নিয়ে বিদ্যমান সন্দেহ নিরসন এবং এসব কুফর চিন্তাসমুহ প্রচার করার পক্ষে যাতে কোনো অজুহাত অবশিষ্ট না থাকে সে লক্ষ্যে এখন আমরা এই উল্লেখিত বিষয়টির উপর আলোকপাত করবো।
আমরা আরও জানি এসব দলগুলো কতৃর্ক ধারণকৃত পশ্চিমা চিন্তা দ্বারা প্রভাবিত দুষিত কুফর মানসিকতা যদি পরিশোধিত না হয় তাহলে আমাদের এসব উপদেশ কোনও কাজেই আসবে না। যেমন যদি আমরা তাদেরকে বুঝাতে সক্ষমও হই যে ক্ষমতা ভাগাভাগি একটি কুফর দুষিত চিন্তা কিন্তু তাদের যদি মানসিকতা অপরিবর্তিত থাকে, তাহলে তখন তারা এই চিন্তার বিকল্প খুঁজতে একই মানসিকতাকে প্রয়োগ করবে। সুতরাং আমাদের এমন মানসিকতার ব্যাপারে যথেষ্ট সতর্ক থাকতে হবে যা শারী’আহ্ অনুমোদিত নয়। পথভ্রষ্ট চিন্তাগুলোর জন্ম লাভে এ ধরনের মানসিকতাগুলো উর্বর ভুমি হিসেবে কাজ করে।
বর্তমান সময়ে ক্ষমতার ভাগাভাগি বলতে কি বুঝায় এবং এর যথার্থতার প্রতি এর পক্ষালম্বনকারীরা কি যুক্তি উপস্থাপন করে?
ক্ষমতা ভাগাভাগি বলতে তারা বুঝায় এমন এক শাসনব্যবস্থায় অংশগ্রহণ করা যার ভিত্তি ইসলাম নয় এবং ইসলাম ছাড়া অন্য কিছু দ্বারা পরিচালিত শাসনব্যবস্থা। আর তাই নিজেদের ও নিজেদের মতামতকে ক্ষমতার স্বাদ দিতে তারা গণতান্ত্রিক খেলায় অংশগ্রহণের মাধ্যমে পার্লামেন্টে প্রবেশ করে এবং কল্পনা করে এভাবে কোনও এক সময়ে তারা সম্পূর্ণ ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হবে। যা হবে ক্রমাণ্বয়ে বা ধাপে ধাপে এবং তাদের মতে ইসলাম একে অনুমোদন দেয়।
তাদের মতে ক্ষমতা ভাগাভাগির যৌক্তিকতা শারী’আহ্ ও বুদ্ধিবৃত্তিক যুক্তি দ্বারা অনুমোদিত। তাদের পক্ষ থেকে বুদ্ধিবৃত্তিক দৃষ্টিকোন থেকে প্রদত্ত যুক্তি :
— বর্তমান যুগে ইসলামকে ঐতিহাসিক রূপে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত করা সম্ভব নয়। কারণ ইসলামী বিশ্বের সব অঞ্চল এখন বিস্ময়কর বস্তুগত ও অবস্তুগত (সম্মান, প্রভাব ইত্যাদি) ক্ষমতার অধিকারী বিভিন্ন আন্তর্জাতিক শক্তির সমর্থনপুষ্ট কেন্দ্রীয় কর্তৃপক্ষের অধীনে নিয়ন্ত্রিত। ইসলাম প্রতিষ্ঠার আন্দোলনসমূহকে তারা পর্যবেক্ষণ করছে এবং তাদেরকে সীমাবদ্ধ গণ্ডীর মধ্যে রাখতে ও তাদের সাফল্যের পথে অন্তরায় সৃষ্টির প্রয়াস চালাচ্ছে। আর এই কারণে তাদের মতে অতীতের সাথে বর্তমানের সাদৃশ্যতা অনুসন্ধান করা বাস্তবসম্মত নয়।
— অতীতে সব মুসলিমদের সম্পৃক্ততায় ইসলামী দাওয়াহ্ সংগঠিত হতো অথচ বর্তমানে গুটি কয়েক গোষ্ঠীকে এই আন্দোলনে পাওয়া যাচ্ছে। আর অধিকাংশ মুসলিম এই নেতৃত্বের আওতার বাইরে থাকায় জাহেল সরকারগুলো এর নানামুখী সুবিধা লুটে নিচ্ছে এবং যা আন্দোলনকে কঠিন পরিস্থিতিতে পতিত করেছে। এজন্য আধুনিক ইসলামী আন্দোলনগুলো ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হতে প্রচলিত রাজনৈতিক দলগুলোকে অনুসরণ করছে।
প্রচলিত রাজনৈতিক দলগুলো ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হতে বিভিন্ন পন্থা অবলম্বন করছে। যার মধ্যে রয়েছে গণতান্ত্রিক খেলা অথবা সেনা অভ্যূত্থান অথবা সশস্ত্র গণবিপ্লব।
যেহেতু আধুনিক ইসলামী আন্দোলনগুলোর জন্য সেনা অভ্যূত্থানের লক্ষ্যে নিজ দেশের সেনাবাহিনীর ভেতর সমর্থন তৈরির সকল দরজা বন্ধ এবং চারিদিকে স্বৈরাচারী শাসকের কারণে গণবিপ্লবের দরজাও বন্ধ, তাই এখন তাদের জন্য একটি পথটিই অবশিষ্ট আছে যে পথে অন্যান্য রাজনৈতিক দলগুলো কাজ করছে। যা তাদের অনৈসলামী শাসনব্যবস্থায় অংশগ্রহণের দিকে ধাবিত করে।
তারা আরও যোগ করে: ইসলামী আন্দোলনগুলো যে মহান আদর্শকে সামনে নিয়ে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে তা অর্জন করতে হলে এর সাথে সাংঘর্ষিক পার্শ্বিক বিষয়গুলোকে এখন আমাদের পাশ কাটাতে হবে। কারণ জুজ’ঈ বা আংশিক বিষয়ের সাথে যদি কু’ল্লী বা সামগ্রিক বিষয়ের দ্বন্দ্ব হয় তাহলে কু’ল্লীকে প্রাধান্য দিতে হবে। ইসলামী শারী’আহ্’র বাস্তবতা এবং এর উদার দৃষ্টিভঙ্গী ঊপলদ্ধি করা সম্ভব হবে না যদি আংশিক বিষয়ের সাথে দ্বন্দ্বের কারণে মূল লক্ষ্য অর্জন ব্যাহত হয়। একইভাবে ইসলাম প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রেও মুসলিমদের সব সময় কঠিন এবং কেবলমাত্র একটি পথেই সীমাবদ্ধ থাকা ঠিক নয়। যদি প্রথম রাস্তাটি প্রয়োগ করা সম্ভব না হয় তখন দ্বিতীয়, তৃতীয় ও চতুর্থ ইত্যাদি রাস্তাগুলো প্রয়োগ করা যায়। এমনকি কোন এক পর্যায়ে চারটি পথেই একসঙ্গে কাজ করা যায় যতক্ষন না উত্তম পথটি বের হয়ে আসে।
উল্লেখিত বুদ্ধিবৃত্তিক যুক্তির উপর আলোচনা
শারী’আহ্ হুকুম থেকে বিচ্যুততে উপস্থাপিত বুদ্ধিবৃত্তিক যুক্তি থেকে তাদের ইসলামী শিক্ষার অজ্ঞতা পরিষ্কার প্রতীয়মান যদিও তারা মুখে উসূল ও শারী’আহ্’র কথা বলে। শারী’আহ্ হুকুম বের করা কিংবা এমনকি শুধুমাত্র শারী’আহ্ হুকুম জানার প্রক্রিয়া কি সে সম্পর্কেও তাদের নূন্যতম ইসলামী জ্ঞান নেই। তারা পদ্ধতি (Method) ও ধরণ (Style) আলাদা করতে পারে না। ‘শারী’আহ্ নমনীয়’ এই চিন্তার প্রভাব এবং যুগের সাথে তাল মেলানোর অজুহাত তাদেরকে শারী’আহ্ হুকুম এবং শারী’আহ্ হুকুমকে শারী’আহ্ বহিভূর্ত হুকুম দ্বারা পরিবর্তনের প্রতি বার বার প্রেরণা যোগায়।
যুগের সাথে অনেক কিছু পাল্টে গেছে এই অজুহাতে রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর পদ্ধতি ও শারী’আহ্ পরিত্যাগ করার অজুহাতটি মোটেও গ্রহণযোগ্য ও সঠিক নয় বরং এতে সমাজের বাস্তবতা সম্পর্কে তাদের অজ্ঞতাই পরিষ্কারভাবে ফুটে উঠে। কেননা সমাজের বাস্তবতা অনুধাবনে এর মৌলিক উপাদনসমূহ গুরুত্বপূর্ণ, এর পরিবর্তনশীল ঊপাদান নয়। গোত্রতান্ত্রিক, সরল অথবা জটিল রাষ্ট্রকাঠামো, গণতান্ত্রিক অথবা একনায়কতান্ত্রিক বিভিন্ন সমাজের বিভিন্ন রূপ থাকতে পারে কিন্তু প্রত্যেকটি সমাজের গঠনের মৌলিক উপাদান (জনগণ, চিন্তা, আবেগ এবং ব্যবস্থা) একই। সে কারণে মৌলিক উপাদানগুলোকেই বিবেচনা করতে হবে। বিভিন্ন রাষ্ট্রকাঠামো পরিবর্তনের জন্য বিভিন্ন পদ্ধতির কোন প্রয়োজন নাই। রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর প্রদর্শিত পদ্ধতিতে সমাজের ভ্রান্ত চিন্তা, ভ্রান্ত ধারণা এবং ভ্রান্ত রীতিনীতি ও ঐতিহ্যকে চ্যালেঞ্জ করে সমাজ পরিবর্তন করা শারী’আহ্ হুকুম। সুতরাং এটি একটি প্রতিষ্ঠিত কাজ। মুলত চিন্তার পার্থক্যই সমাজের পার্থক্য; কোথাও দেশপ্রেম বা সঙ্কীর্ণ জাতীয়তাবাদের উপর তৈরি সমাজ অথবা কোথাও আদর্শিক পুঁজিবাদ বা সমাজতন্ত্রের ভিত্তিতে তৈরি সমাজ। এটা সর্বজনবিদিত যে আদর্শিক চিন্তা অন্য সব চিন্তার চেয়ে অত্যন্ত শক্তিশালী এবং একে ছুঁড়ে ফেলা কঠিন কাজ। আর তাই সমাজভেদে চিন্তার পার্থক্যের কারণে কোথাও পরিবর্তনের কাজ সহজ কোথাও কঠিন কিন্তু পদ্ধতি একই এবং অপরিবর্তনীয়। রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর সময়ের গোত্রতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থা এবং আমাদের বর্তমান সরল বা জটিল রাষ্ট্রব্যবস্থার পার্থক্য হয়তো আমাদের সমাজ পরিবর্তনের কাজকে সহজ কিংবা কঠিনতর করবে কিন্তু পদ্ধতির নিয়মে কোন পরিবর্তন আসবে না। প্রতিটি রাষ্ট্রকেই তার নিরাপত্তা ও অবস্থান সুসংহতকরণে সেনাবাহিনী হোক কিংবা অনুরূপ কোন গোষ্ঠী হোক কারও না কারও উপর নির্ভর করতেই হয়। রাসূলুল্লাহ্ (সা) ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে এ ধরণের গোষ্ঠীর নিকট নুসরাহ্ চেয়েছিলেন। তিনি (সা) যখন একটি নতুন সমাজ গঠনের কাজ শুরু করেন তখন তিনি (সা) সমাজের মৌলিক উপাদানের উপর মনোনিবেশ করেন। তিনি (সা) দৃঢ় ঈমানসম্পন্ন দাওয়াহ্ বহন ও রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার আন্দোলন পরিচালনায় সক্ষম (মুহাজিরীন) একটি গোষ্ঠিকে প্রস্তুত করেন এবং দাওয়াহ্ ও দাওয়াহ্ বহনকারীদের গ্রহণকারী এবং রাষ্ট্রপ্রতিষ্ঠায় সক্ষম ক্ষমতার অধিকারী (আনসার) একটি জনপ্রিয় ভিত্তি (Popular Base) তৈরি করেন। তাই নুসরাহ্ অনুসন্ধান করা ক্ষমতায় যাওয়ার পদ্ধতি। রাসূলুল্লাহ্ (সা) নুসরাহ্ অনুসন্ধানের সময় অনেক প্রতিকূলতা, সংকটের সম্মুখীন হওয়া সত্ত্বেও এ পদ্ধতির উপর অটল ছিলেন। যারা মক্কায় রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর কাজের পদ্ধতিকে নিরীক্ষা করেছে তারা দেখবে যে তিনি (সা) পরিবর্তনের জন্য সমাজের ভিত্তিগুলো নিয়ে কাজ করেছেন। স্থান, কাল এবং অঞ্চলভেদেও তার পদ্ধতি পরিবর্তিত হয়নি। কারণ অঞ্চল বা সমাজভেদে পার্থক্য মানে কাঠামোর পার্থক্য মৌলিক উপাদানের নয়। এ পার্থক্য কাজকে সহজ বা কঠিন করে মাত্র।
শারী’আহ্’র নমনীয় এ ভ্রান্ত দৃষ্টিভঙ্গীর আলোকে নমনীয়তার অজুহাতে শারী’আহ্’কে ইচ্ছেমতো পরিবর্তন করার অধিকার কাউকে দেয়া হয়নি। আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা শারী’আহ্’কে সম্পূর্ণ করেছেন। মানব জীবনের নতুন-পুরাতন সকল সমস্যার সমাধান এতে রয়েছে। তবে সমাধানগুলো হুকুম একমাত্র আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা’র এই ভিত্তি থেকে উৎসারিত নিয়মতান্ত্রিক কিছু উসূল (মূলনীতি)-এর মধ্যে সীমাবদ্ধ।
শারী’আহ্ অনেক বিস্তৃত, এ দৃষ্টিভঙ্গীর দোহাই দিয়ে আল্লাহ্’র বাণীকে পরিত্যাগ করা কিংবা শারী’আহ্ বহির্ভূত বিষয়বস্তুর প্রবেশ করানোর চেষ্টা কোনভাবেই গ্রহণযোগ্য না। কিছু মুসলিম চিন্তাবিদ এ দৃষ্টিভঙ্গী থেকে শারী’আহ্’র কিছু বিষয়কে পরিত্যাগ করেছেন। তাদের মতে যেহেতু শারী’আহ্’র শাস্তির উদ্দেশ্যই হলো অপরাধকে নিরুৎসাহিত করা সেহেতু যা কিছু অপরাধকে নিরুৎসাহিত করে তাই শারী’আহ্’তে গ্রহণযোগ্য। যেহেতু শারী’আহ্’র শাস্তিসমূহ যুগের সাথে মানানসই হচ্ছে না, এবং মানুষ চিন্তা-চেতনা দিয়ে তা প্রত্যাখান করেছে সেহেতু আমরা একই উদ্দেশ্য অর্জিত হয় এমন শারী’আহ্ বহির্ভূত শাস্তিকেও গ্রহণ করতে পারি। আর শারীআ’হ্ নমনীয় ও বিবর্তনযোগ্য বলেই এটা সম্ভব।
তারা আরও বলে যেহেতু জিহাদ ফি সাবিলিল্লাহ ইসলাম প্রচারের জন্য এবং জিহাদ ছাড়াও অন্য অনেক উপায় যেমন: রেডিও, টেলিভিশন, অন্যান্য প্রচারমাধ্যমসহ আধুনিক সভ্যতার অনেক উপকরণের মাধ্যমে ইসলামের প্রচার সম্ভব, সেহেতু এসব আধুনিক মাধ্যমকে জিহাদের বিকল্প হিসেবে গ্রহণ করতে পারি। শারীআ’হ্ যদি নমনীয় ও বিবর্তনযোগ্য না হতো তাহলে আমরা এরূপ করতে পারতাম না।
ইসলামী শাসন প্রতিষ্ঠার পদ্ধতির ক্ষেত্রে তারা মনে করে, যে পদ্ধতি ব্যবহার করে এই লক্ষ্য অর্জন সম্ভব হবে, সেটাই অনুসরণ করা উচিত। কেবল একটি পথে পড়ে থাকা এবং এর বাইরে না যাওয়াটা অপরিহার্য নয়। তাদের মতে অনমনীয় ও দৃঢ় মনোভাব ইসলামের উদার, নমনীয় ও বিবর্তনশীল প্রকৃতির সাথে সাংঘর্ষিক, আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা এতে কঠোরতা রাখেননি।
সুতরাং এরূপ দৃষ্টিভঙ্গী থেকে ‘শারী’আহ্’কে নমনীয়’ বলা হারাম। কারণ এটা দ্বীনের হুকুমসমূহকে বাতিল করে দেয় এবং এটা ইসলামের প্রকৃতির সাথে সাংঘর্ষিক। বরং এটি পশ্চিমা চিন্তা দ্বারা প্রভাবিত এবং তাদের চিন্তার অনুকরণ।
আর সামগ্রিক বিষয়ের সাথে আংশিক বিষয়ের দ্বন্দ্বে সামগ্রিককে গুরুত্ব দিতে হবে; তাদের এই দৃষ্টিভঙ্গীটিও ব্যাখ্যা করা প্রয়োজন। কারণ আপাতদৃষ্টিতে মনে হবে তাদের এই দৃষ্টিভঙ্গীর সাথে উসূলী চিন্তাবিদদের সামঞ্জস্যতা আছে। অথচ বাস্তবতা হচ্ছে উসূলী চিন্তাবিদগণ যে অর্থে এই মুলনীতিকে ব্যবহার করেন তারা তা করে না। তাদের চিন্তা ও কর্মের মাপকাঠির বেহাল দশার এটি আরেকটি নমূনা। তাই সমস্ত শারী’আহ্’কে নমনীয় আখ্যা দিতে কোন একটি নির্দিষ্ট বিষয়ে শারী’আহ্’র উদারতা ও নমনীয়তাকে উদাহরণ হিসেবে হাজির করা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়।
এ বিষয়ে সবশেষে বলা দরকার শারী’আহ্’র হুকুম বুঝবার ক্ষেত্রে যুক্তি প্রয়োগের কোন সুযোগই ইসলামে নেই। উসুলী চিন্তাবিদগণের বর্ণনা মতে বাস্তবতা থেকে হুকুমের মানাত (Object) পাওয়া যায়, ফরজ বা হারামের নির্দেশনা নয়। তাই বাস্তবতাকে এর মত করেই বুঝতে হবে। তারপর শারী’আহ্ দলিলের আলোকে হুকুম বের করতে হবে। সুতরাং নীতিগতভাবে যৌক্তিক বিবেচনা মূল্যহীন।
আর ক্ষমতার ভাগাভাগিতে শারী’আহ্’র যৌক্তিকতার বিষয়ে শারী’আহ্ আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা’র দ্বীন ব্যতীত অন্যকোনও দ্বীন দ্বারা পরিচালিত শাসনব্যবস্থায় অংশগ্রহণকে স্পষ্ট নিষেধ করেছে। এর বেশকিছু কারণ রয়েছে।
— আল্লাহ্’র নাযিলকৃত বিধান দ্বারা যারা শাসনকার্য পরিচালনা না করাকে সুস্পষ্টভাবে কুফর (অবিশ্বাসী), যুলুম (অবিচার) এবং ফিসক (পাপাচারী) হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়েছে। তিনি (সুবহানাহু ওয়া তা’আলা) বলেন,
“এবং যারা আমার প্রদত্ত বিধান দ্বারা শাসনকার্য পরিচালনা করে না তারাই কাফের।”
(সূরা মায়িদাহ্: ৪৪)
তিনি (সুবহানাহু ওয়া তা’আলা) বলেন,
“এবং যারা আমার প্রদত্ত বিধান দ্বারা শাসনকার্য পরিচালনা করে না তারাই জালিম।”
(সূরা মায়িদাহ্: ৪৫)
তিনি (সুবহানাহু ওয়া তা’আলা) বলেন,
“এবং যারা আমার প্রদত্ত বিধান দ্বারা শাসনকার্য পরিচালনা করে না তারাই ফাসেক।”
(সূরা মায়িদাহ্: ৪৭)
— হাকিমিয়্যাহ বা সার্বভৌমত্ব একমাত্র আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা’র জন্য। তিনি (সুবহানাহু ওয়া তা’আলা) বলেন,
“হুকুম একমাত্র আল্লাহ্’র। তিনি নির্দেশ দিয়েছেন যে তোমরা শুধুমাত্র তারই ইবাদত করবে।”
(সূরা ইউসুফ: ৪০)
— এছাড়া আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা’র শারী’আহ্ বাদ দিয়ে অন্যকোনও আইন বা বিধানের শরণাপন্ন হওয়াকে কঠোরভাবে নিষেধ করেছেন এবং একে ঈমান বিরোধী কাজ হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। তিনি সুবহানাহু ওয়া তা’আলা বলেন,
“কিন্তু না, তোমার রবের শপথ! ততক্ষণ পর্যন্ত তারা ঈমানদার হতে পারবে না, যতক্ষণ তাদের বিবাদ-বিসম্বাদের বিচার ভার তোমার (মুহাম্মদ (সা)) উপর ন্যস্ত না করে।”
(সূরা আন নিসা: ৬৫)
— আল্লাহ্ যা নাযিল করেছেন তা ছাড়া অন্য কোন কিছুর শরণাপন্ন হওয়ায় তিনি মুনাফেকদের সমালোচনা করেছেন :
“আপনি কি তাদেরকে প্রত্যক্ষ করেননি যারা দাবী করে যা আপনার প্রতি অবতীর্র্ণ হয়েছে এবং যা আপনার পূর্বে অবতীর্ণ হয়েছে সেই সব বিষয়ের উপর তারা ঈমান এনেছে কিন্তু তারা (বিরোধপূর্ণ বিষয়ের) মিমাংসার জন্য তাগুতের শরণাপন্ন হতে চায়, অথচ তা প্রত্যাখ্যান করার জন্য তাদেরকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। কিন্তু শয়তান তাদেরকে প্রতারিত করে পথভ্রষ্ট করে ফেলতে চায়।”
(সূরা নিসা: ৬০)
— আল্লাহ্’র আইনের উপর অন্য কারও আইনকে প্রাধান্য দেয়া যাবে না। যে তা করলো সে মূলত আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা’র হুকুমের উপর জাহেলিয়াতকে প্রাধান্য দিল।
“তারা কি জাহেলিয়াত আমলের ফয়সালা কামনা করে? আল্লাহ্ অপেক্ষা বিশ্বাসীদের জন্যে উত্তম ফয়সালাকারী কে?”
(সূরা মায়িদাহ্: ৫০)
মূলত এটাই হুকুম। কিন্তু তাদের দৃষ্টিতে মন্ত্রীসভায় অংশগ্রহণ করা নিম্নোক্ত দলিলের কারণে মৌলিক হুকুমের একটি ব্যতিক্রম।
১. (সমকালীন) শাসনব্যবস্থায় ইউসুফ (আ:) এর অংশগ্রহণ
২. আন-নাজ্জাশীর অবস্থা
৩. আল-মাসলাহা (জনস্বার্থ)