জীবন থেকে দ্বীনকে পৃথকীকরণের ধারণার বশবর্তী হয়ে পশ্চিমারা নিজেদেরকে আইন তৈরির ক্ষমতা প্রদান করেছে। এটা এই দৃষ্টিভঙ্গী পোষণ করে যে মানুষ অন্যের তোয়াক্কা না করে এমন জীবনযাপন করবে যাতে সে নিজেকে পরিতুষ্ট করতে পারে; যেখানে তার নিজের খেয়ালখুশীর প্রতিফলন ঘটবে কিন্তু অন্যদের নয়। তারা মনে করে মানুষ এরূপ অধিকার ভোগ করতে পারবে না যদি না সে স্বাধীন হয়। আর এটা থেকেই পাওয়া যায় বিশ্বাস, মালিকানা, মতপ্রকাশ ও ব্যক্তিগত স্বাধীনতার ধারণা। এটা স্বাধীনতার এ ধারণাকে পবিত্র বলে বিবেচনা করে। এই স্বাধীনতার সুনির্দিষ্ট কৌশলগত অর্থ রয়েছে।
বিশ্বাসের স্বাধীনতা একজনকে পছন্দসই ধর্ম বেছে নেয়ার সুযোগ করে দেয়। অথবা দৈনন্দিন ব্যাপার হলেও তাকে এক বিশ্বাস থেকে অন্য বিশ্বাসে স্থানান্তরিত হওয়াকে অনুমোদন দেয়। এমনকি এটা তাকে ধর্ম পুরোপুরি পরিত্যাগ করতেও সুযোগ দেয়।
মালিকানার স্বাধীনতা তাকে যে কোন কিছুর, যে কোনভাবে মালিক হওয়ার স্বাধীনতা প্রদান করে। এমনকি এটা তাকে তার সম্পত্তি যেভাবে খুশী সেভাবে হস্তান্তর বা পরিত্যক্ত করবার স্বাধীনতা দেয়। যদি এটি সে তার উত্তরাধিকারকে না দিয়ে প্রিয় পোষা কুকুরকে উপহার হিসেবে দিতে চায় তাহলে কেউ তাতে বাঁধা প্রদান করতে পারবে না।
মত প্রকাশের স্বাধীনতা তাকে খেয়ালখুশী মতো, অবাধে ও নিয়ন্ত্রনহীনভাবে সবকিছু বলবার স্বাধীনতা প্রদান করে, হোক সেটা সত্য বা মিথ্যা। তার উপলদ্ধি এবং খেয়ালখুশীর বিরুদ্ধে যায় এরকম যে কোন মতামতকে সে অবজ্ঞা বা সমালোচনা করতে পারে।
ব্যক্তিগত স্বাধীনতার কারণে তারা ব্যক্তিগত বিষয়াবলীর ক্ষেত্রে কোন মূল্যবোধ, নৈতিক বাধ্যবাধকতা, আধ্যাত্মিক সীমারেখার দ্বারস্থ হয় না।
গণতন্ত্রের মৌলিক অপরিহার্যতা স্বাধীনতার এই ধারণা এর পক্ষালম্বনকারীদের এমন এক বোধের দিকে নিয়ে গেছে যা তাদেরকে পশুর চেয়ে অধম করে দিয়েছে।
বিশ্বাসের স্বাধীনতা পুঁজিবাদী সমাজে ধর্মের উপর বিশ্বাসের গুরুত্বকে হালকা করে দিয়েছে। তাদের পোষাক পরিবর্তনের মতো ধর্ম পরিবর্তনকে সহজতর করে দিয়েছে। বস্তুবাদী চিন্তার প্রসার ও ধমীর্য় চিন্তাকে গন্ডীভূত করে ফেলবার কারণে নৈতিক, মানবিক ও আধ্যাত্মিক মূল্যবোধ অস্তিত্বহীন হয়ে পড়েছে। একারণে লোকদের হৃদয় থেকে সমবেদনা উঠে গেছে এবং নেকড়ের মত দূর্বলের উপর সবলের আধিপত্য চলছে।
মত প্রকাশের স্বাধীনতার কারণে তারা ইচ্ছেমতো যা খুশী বলতে পারে এবং যে কোন কিছুর দিকে লোকদের আহ্বান করতে পারে। সে কারণে তাদের সমাজে সব ধরণের অদ্ভুদ, মিথ্যা, খেপাটে ধরণের মতামতের প্রাদুর্ভাব দেখা যায়। যে কোন সাধারণ লোক রাসূলুল্লাহ (সা) এর বিরুদ্ধে বিষোদগার করছে এবং তাকে বিরত করার কোন আইন নেই। যেমন: সালমান রুশদী, যে বিশ্বাসের স্বাধীনতাকে অজুহাত হিসেবে গ্রহণ করেছে এবং মত প্রকাশের স্বাধীনতায় সে আশ্রয় গ্রহণ করেছে।
মালিকানার স্বাধীনতার প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো লাভ এবং এটা পুঁজিবাদের মধ্যে ভয়াবহতা তৈরি করেছে ও লোকদের ভবিষ্যত নির্ধারণ করা, তাদের সম্পদ হরণ করা, সম্পদকে ব্যবহার করা এবং লোকদের রক্ত শোষণ করার জন্য উপনিবেশবাদকে পদ্ধতি হিসেবে গ্রহণ করেছে। একারণে অন্যদের সাথে হারাম উপার্জনের মাধ্যমে প্রতিযোগীতায় লিপ্ত হতে হয়, মুসলিমদের রক্তের বিনিময়ে ব্যবসা করতে হয়, বিভিন্ন স¤প্রদায় ও জাতিসমূহের মধ্যকার যুদ্ধে উস্কানি দিতে হয় যাতে অতি লাভে তাদের নিকট পণ্য ও সামরিক সরঞ্জাম বিক্রি করা যায়। এই পুঁজিবাদী রাষ্ট্রসমূহ যে কোন ধরণের আধ্যাত্মিক, নৈতিক ও মানবিক মূল্যবোধ বিবর্জিত। তবে যদি তারা বাধ্য হয় তাহলে ধর্মকে আচ্ছাদন হিসেবে ব্যবহার করে তাদের স্বার্থ, কুৎসিত চেহারা ও দুর্গন্ধযুক্ত আচরণকে আঁড়াল করার জন্য নৈতিক ও মানবিক বোধের কথা বলে বেড়ায়।
ব্যক্তিস্বাধীনতা গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের সমাজগুলোকে পশুর সমাজে রূপান্তরিত করেছে। তাদের লাম্পট্য এমন এক পর্যায়ে গিয়ে পৌঁছেছে যে, পশুরাও এ অধঃপতিত অবস্থায় কখনও যায়নি। আইনের মাধ্যমে তারা অস্বাভাবিক ও ভ্রান্ত যৌন সম্পর্ককে বৈধতা দিয়েছে। তাদের মধ্যে এমনসব অভ্যাস দেখা যাবে যা চতুষ্পদ জন্তুর মধ্যে দেখা যায় না। তারা দলগত যৌনাচার ও নিকটাত্নীয় এমনকি মায়ের, বোন ও মেয়ের সাথেও যৌনাচারে লিপ্ত হয়। তারা পশুর সাথেও যৌনাচারে লিপ্ত হয়। এ কারণে তাদের এমন রোগ হয়েছে যা আগে কখনওই হয়নি। তাদের সমাজে ভঙ্গুর পরিবার খুব বেশী দেখতে পাওয়া যায় এবং একই পরিবারের সদস্যদের মধ্যে পারস্পরিক সম্মানবোধ হারিয়ে গেছে। ব্যক্তিগত স্বাধীনতা মানে সব বন্ধন থেকে মুক্ত হওয়া এবং যে কোন ধরণের মূল্যবোধকে গ্রহণ করা ও পরিবারকে ধ্বংস করবার স্বাধীনতা। এইসব স্বাধীনতার নামে সব ধরণের পাপকাজ করা হয় এবং সব নিষিদ্ধ জিনিষকে বৈধতা দেয়া হয়।
সেকারণে স্বাধীনতার নামে ব্যভিচার, সমকামীতা, সমকামী স্ত্রীলোক, নগ্নতা এবং অ্যালকোহল, যে কোন ঘৃণ্য ও গর্হিত কাজকে অনুসরণ করা যে কোন ধরণের চাপ বা বাধ্যবাধকতা ছাড়া স্বাধীনভাবে করা হয়।
এগুলোই হলো গণতন্ত্রের প্রত্যক্ষ প্রভাব। এগুলো হলো মানুষের প্রবৃত্তির ফসল, আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা এবং তাঁর ঐশী বাণীর এক্ষেত্রে কোন ভূমিকা নেই। কোন ধর্মেরই এ ব্যাপারে কিছু করার নেই। আমরা যদি গণতন্ত্রের সমর্থক ও চিন্তাবিদদের দিকে লক্ষ্য করি, তাহলে দেখব যে, যা তাদের মনে একে প্রতিষ্ঠা দিয়েছে এবং যে পরিস্থিতিতে এর উদ্ভব ঘটেছে তা সত্যিকার অর্থেই একটি কুফর ভিত্তির উপর স্থাপিত হয়েছে। আর এটা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে কিছু লোকের কথার উপর ভিত্তি করে, যেমন: রাজা ১৫তম লুইসের মতে, ‘আমরা স্রষ্টা ছাড়া আর কারও কাছ থেকে মুকুট গ্রহণ করি না।’ এবং রাজা ১৪ তম লুইস বলেন, ‘রাজার কতৃর্ত্ব আসে স্রষ্টার প্রতিনিধিত্বের মাধ্যমে। স্রষ্টা হলেন এর একচেটিয়া উৎস এবং জনগণ নয়। স্রষ্টা ছাড়া আর কারও কাছে রাজাগণ তাদের কর্তৃত্বের জন্য জবাবদিহী করেন না।’ বোদ্ধাগণ জ্যাঁ জ্যাক রুশো’র সামাজিক চুক্তির মতবাদকে ‘ফ্রেঞ্চ ধর্মনিরপেক্ষ বিপ্লব’ বলে আখ্যায়িত করেছেন।
সুতরাং উপরে উল্লেখিত সবকিছু থেকে আমরা পরিষ্কার বুঝতে পারি ইসলামের সাথে গণতন্ত্র পুরো মাত্রায় সাংঘর্ষিক। এর উৎস যা থেকে এটি এসেছে, যে বিশ্বাস থেকে এটি উৎসারিত হয়েছে, যে ভিত্তির উপর এটি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে এবং যে চিন্তা ও ব্যবস্থা এটিকে নিয়ে এসেছে তা থেকেও বিষয়টি সুস্পষ্ট হয়ে উঠেছে।
— যে উৎস থেকে এটি এসেছে সেটি হল মানুষ। তার কাজ ও বিভিন্ন বিষয়ে বিবেচনার জন্য, হুস্ন (পছন্দীয়) এবং কুব্হ (তিরষ্কারযোগ্য) এর বিষয়ে সে নিজেই শাসকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছে। এটা আর কোন কিছুই নয়, বরং তার খেয়ালখুশী ও প্রবত্তির অনুসরণ। এর সৃষ্টির শেকড় হল ইউরোপের দার্শনিকগণ।
ইসলামের ক্ষেত্রে তা গণতন্ত্রের সম্পূর্ণ বিপরীত। এটা আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা’র পক্ষ থেকে এসেছে। তিনি এটা নাযিল করেছেন তার বান্দা ও প্রেরিত রাসূল মুহম্মদ (সা) এর উপর। ইসলামে শাসকগণ আইন জারির ক্ষেত্রে তার প্রবৃত্তি নয়, শারী’আহ্’র শরণাপন্ন হয়। শারী’আহ্’র বাণীসমূহকে বুঝা পর্যন্ত মনের ব্যবহার সীমাবদ্ধ রাখতে হয়।
— যে বিশ্বাস থেকে গণতন্ত্র উৎসারিত হয়, তা হলো জীবন থেকে দ্বীনকে পৃথকীকরণের বিশ্বাস বা আক্বীদাহ্ এবং এটা এসেছে আপোষমূলক সমাধানের মাধ্যমে। এটা ধর্মকে পুরোপুরি প্রত্যাখ্যান করেনি, বরং জীবন ও রাষ্ট্রের উপর এর প্রভাবকে বিলুপ্ত করেছে এবং সর্বোপরি মানুষকে তার নিজের ব্যবস্থা প্রণয়নের ক্ষমতা দিয়েছে। এই বিশ্বাসের ভিত্তিতেই এর সভ্যতা গড়ে উঠেছে এবং বুদ্ধিবৃত্তিক দিকনির্দেশনা নির্ধারিত হয়েছে।
ইসলামের ক্ষেত্রে এর সম্পূর্ণ বিপরীত চিত্র পাওয়া যায়। এতে ইসলামী আক্বীদাহ্’র আলোকে জীবনের সকল কর্মকান্ড পরিচালিত হয় এবং রাষ্ট্র আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা’র আদেশ ও নিষেধ অনুযায়ী পরিচালিত হয়। অন্যকথায় ইসলামি আক্বীদাহ্ থেকে উৎসারিত ইসলামী শারী’আহ্ ভিত্তিক হুকুমের মাধ্যমে জীবন পরিচালিত হয়। এই আক্বীদাহ্’র ভিত্তিতেই এর সভ্যতা গড়ে উঠেছে এবং বুদ্ধিবৃত্তিক দিকনির্দেশনা নির্ধারিত হয়েছে।
— যে ভিত্তির উপর গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত তা হলো মানুষের সার্বভৌমত্ব। জনগণ হলো সকল ক্ষমতার উৎস। এর উপর নির্ভর করে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা তিনটি শক্তির জন্ম দিয়েছে; আইন, নির্বাহী ও বিচারিক ক্ষমতা, যাতে সে এর সার্বভৌমত্ব ও কতৃর্ত্বের বাস্তব প্রয়োগ করতে পারে।
ইসলামে শারী’আহ্’র উপর সার্বভৌমত্ব ন্যস্ত এবং উম্মাহ্’র আইন তৈরির ক্ষমতা নেই। তবে ইসলাম মুসলিমদের আল্লাহ্ প্রদত্ত আদেশ—নিষেধকে কার্যকর করার দায়িত্ব অর্পণ করেছে এবং শারী’আহ্গত দলিলের ভাষায় খিলাফত রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে তার বাস্তব প্রতিফলন ঘটে।
— গণতন্ত্র এমন এক ব্যবস্থা ও চিন্তা নিয়ে এসেছে যার ভিত্তি মানুষের প্রবৃত্তিজাত এবং তা হলো লাভ। অন্যদিকে ইসলামের আইন প্রক্রিয়া শারী’আহ্ এবং শারী’আহ্ থেকে উৎসারিত আইনের উপর নির্ভরশীল অর্থাৎ এটি এই নির্দেশিত পথের অনুমোদন ও অনুসরণের উপর নির্ভরশীল।
— গণতন্ত্রের এমন কিছু উপাদান রয়েছে যা থেকে ইসলাম লাভবান হতে পারে; এ ধরণের উক্তি ভিত্তিহীন এবং দলিল নির্ভর নয়। আমরা গণতন্ত্রের কিছু প্রভাব দেখতে পেয়েছি যা এমন এক মন্দ পরিস্থিতির উদ্ভব ঘটিয়েছে যা কোনো কল্যাণ বয়ে নিয়ে আসেনি। মানবতার জন্য আগত সবোর্ত্তম উম্মতের গণতন্ত্র থেকে নেওয়ার কিছু নেই। ইসলামের কী এমন কোনো ঘাটতি রয়ে গেছে যে তা পূরণের জন্য গণতন্ত্রের মুখাপেক্ষী হতে হবে।