গণতন্ত্র

পশ্চিমা সভ্যতা দুনিয়া থেকে দ্বীনের পৃথকীকরণ বিশ্বাসের উপর প্রতিষ্ঠিত। এই চিন্তা ও ভিত্তিতে বিশ্বাসের দরুণ পশ্চিমারা জনগণের জীবন থেকে দ্বীনের প্রতিটি প্রভাব বিনষ্ট করেছে। এর অনুকরণে তারা মৌলিক চিন্তার আদলে এর উপর ভিত্তি করে জীবন সম্পর্কিত সকল চিন্তা ও সমাধান বিকশিত করেছে। অতএব গণতন্ত্রের মাধ্যমে মানুষ নিজেদের উপর আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা’র কর্তৃত্বের পরিবর্তে নিজেদের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করেছে। ফলে নিজেদের কাজের মাপকাঠি হিসেবে তারা স্বার্থকে গ্রহণ করলো এবং সর্বোচ্চ মাত্রার ঈন্দ্রীয়গত পরিতুষ্টিকে সুখ হিসেবে সংজ্ঞায়িত করলো। এটাই ছিল ব্যক্তিপূঁজার চিন্তা পরবর্তীতে ব্যক্তিস্বাধীনতার পূঁজার দিকে ধাবিত করে। এসব চিন্তার উপরে ভিত্তি করেই পাশ্চাত্য সভ্যতা গড়ে উঠেছে এবং পাশাপাশি এসব চিন্তার সাথে সাংঘর্ষিক সকর চিন্তার বিরোধিতা করেছে। এসব চিন্তা গ্রহণের ফলে নিজেদের সন্ধানকৃত সুখের পরিবর্তে পাশ্চাত্য কেবল দুর্ভোগেরই শিকার হয়েছে। এরূপ ঘটাই স্বাভাবিক কারণ মানুষ হচ্ছে দুর্বল যে নিজের বা অন্যের জন্য আইন প্রণয়নের যোগ্যতা রাখেনা। যে সমাজে স্বার্থপরতা প্রবল থাকে এবং ব্যক্তিস্বাধীনতার কর্তৃত্ব থাকে সেরকম একটি সমাজ কেবল পাশবিকই হতে পারে যেখানে জংলী আইনকানুনের রাজত্ব থাকে।

এরপর পশ্চিমারা মনকে স্বাধীন রাজত্ব প্রদান করলো। বিভিন্ন বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার ও উদ্ভাবনে তারা মনোনিবেশের ফলে তারা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে ব্যাপক অগ্রগতি লাভ করলো। এভাবে যখন সে ক্ষমতার অধিকারী হয়ে উঠলো তখন পৃথিবীর উপর সে সত্যের জোরে নয় বরং ক্ষমতার জোরে আধিপত্য বিস্তার করলো। প্রথমে বস্তুগতভাবে ও পরবতীর্তে বুদ্ধিবৃত্তিভাবে সে নিজেকে পৃথিবীর উপর চাপিয়ে দিল। অন্যভাবে বলতে গেলে, একটি দেশের নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার পর তারা প্রথমে এমন শাসকবর্গকে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত করলো যারা তাদের স্বার্থ রক্ষা করবে এবং সেজন্য উপযোগী ব্যবস্থাও আরোপ করবে। এমন মিডিয়া ও পাঠ্যসূচী প্রতিষ্ঠা করলো যা তাদের চিন্তা ও জীবনব্যবস্থার পক্ষে প্রচারণা চালাবে। জনগণকে তারা উপলব্ধি করানোর চেষ্টা করলো যে জীবন সম্পর্কে দৃষ্টিভঙ্গী তাদেরকে ক্ষমতাধর অবস্থায় পৌঁছে দিয়েছে।

তখন সে নিজের স্বার্থের অনুকূলে পুরো পৃথিবীকে বিভক্ত করে ফেললো। শিল্পোন্নত, উৎপাদনশীল, শক্তিশালী, আধিপত্যবাদী এবং ঔপনিবেশিবাদী রাষ্ট্রগুলোকে তারা আধুনিক ও প্রগতিশীলদের কাতারে ফেললো। এবং অবশিষ্ট দরিদ্র, পরনির্ভরশীল, দুর্বল এবং নিয়ন্ত্রিত রাষ্ট্রগুলোকে তারা পশ্চাৎপদদের কাতারে ফেললো। এই বিভক্তিকে আরও গভীর করা, এবং এসব রাষ্ট্রের সার্বিক পরিস্থিতি কিংবা চলমান পরিস্থিতি অসঙ্গতিপূর্ণ যেকোনো পরিবর্তনের চেষ্টাকে প্রতিরোধ করলো।

তারপর তারা নিজেদের দেশে ব্যক্তিস্বাধীনতার দরজা খুলে দিল এবং জনগণকে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা উপভোগের সুযোগ করে দিল। বৈষম্য বজায় রেখে জনগণকে মৌলিক চাহিদা ও পাশাপাশি ভোগবিলাসের চাহিদা পূরণের সুযোগ করে দিল। একই সময়ে এসব দরিদ্র দেশসমূহ যাতে বৈজ্ঞানিক জ্ঞানকে কাজে লাগিয়ে বস্তুগত উন্নতি সাধন করতে না পারে এজন্য তারা এসব জাতিকে বৈজ্ঞানিক জ্ঞান হতে বঞ্চিত রাখলো। মৌলিক শিল্প কাঠামো গড়তে বাঁধা প্রদান করেছে যাতে অতি প্রয়োজনীয় মৌলিক চাহিদার জন্যেও এসব দেশকে পশ্চিমাদের মুখাপেক্ষী থাকতে হয়। এসব দেশকে দুর্বল করার মাধ্যমে তারা এগুলোকে নিজেদের বাজারে পরিণত করলো। এসব দেশের জনগণকে তারা রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা এবং নিরাপত্তা থেকে বঞ্চিত করলো। আর এজন্যেই শিল্পোন্নত ধনী দেশগুলো দরিদ্র দেশগুলোকে নিজেদের উপনিবেশ বানাতে পরস্পরের সাথে দ্বন্দ্বে লিপ্ত। এই দ্বন্দ্ব আবার এ পর্যায়ের না যে তাদের একে অপরের সাথে যুদ্ধ লিপ্ত। বরং তাদের পারস্পরিক দ্বন্দ্বের পরিণতি হচ্ছে এসব দরিদ্র দেশের জনগণ একে অপরের সাথে সংঘর্ষে লিপ্ত, অথবা ঐ রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রনহীন বিভিন্ন বিদ্রোহী গোষ্ঠী ও বিপ্লবের উৎপত্তি। ফলে এসব রাষ্ট্রের স্থিতিশীলতা ও নিরাপত্তা ব্যাপকভাবে বিঘ্নিত হয় এবং জনগণের ভিতরে ক্রোধের আগুন জ্বলে ওঠে। না বললে নয় যে এর মাধ্যমে তারা এসব দেশের জনগণের ভেতর বর্ণবাদ, গোত্রবাদ এবং জাতীয়তাবাদকে উস্কে দিয়েছে।          

অনুরূপভাবে, পাশ্চাত্য দেশসমূহ নিজেদের জনগণের জন্য সামাজিক নিরাপত্তা যেমন ঔষধ, শিক্ষা, বেকার ভাতা, বার্ধক্য ভাতা প্রভৃতি বিষয় সরবরাহ করেছে অথচ অন্যান্য দেশে এসব বিষয়কে নিষেধ করেছে।

উপনিবেশীকরণের বিভিন্ন উপকরণ হিসেবে পাশ্চাত্য কিছু বৈশ্বিক প্রতিষ্ঠান যেমনঃ আন্তর্জাতিক আদালত, জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদ, বিশ্বব্যাংক ও অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল প্রভৃতি প্রতিষ্ঠা করেছে। বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর মধ্যকার দ্বন্দ্ব-সংঘাত থামানোর জন্য অথবা দরিদ্র দেশগুলোতে দেওয়া ত্রাণের নিরাপত্তার জন্য তারা আন্তর্জাতিক সামরিক বাহিনী গঠন করেছে। গরিব দেশগুলোর অভ্যন্তরীণ বিভিন্ন বিষয় পরোক্ষভাবে নিয়ন্ত্রণের জন্য এবং তাদের কাছ থেকে অঙ্গীকার আদায়ের জন্য বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা ও প্রতিষ্ঠান যেমন সেভ দি চিলড্রেন এবং মেডিসিন সানস ফ্রন্টিয়ারস প্রতিষ্ঠা করেছে।

প্রকৃতপক্ষে, জীবন থেকে দ্বীনের পৃথকীকরণ এবং এ থেকে উদ্ভূত স্বার্থের ধারণা থেকে পাশ্চাত্য উপনিবেশকরণের ধারণা প্রবল হয়েছে। তবে এই উপনিবেশীকরণ বর্তমানে তার আদিম চেহারায় আর নেই। বরং তা চিন্তা, উপকরণ ও ধরণ পাল্টে এক গুপ্ত উপনিবেশবাদে পরিণত করা হয়েছে। বাহ্যিকভাবে এটি করুণা এবং ভিতরগতভাবে যুলুম। এভাবেই পশ্চিমারা বিভিন্ন বিষয়ে বিভ্রান্তি ছড়িয়েছে এবং নিজেদেরকে এমনভাবে উপস্থাপন করেছে যাতে জনগণ তাদেরকে একমাত্র অনুকরণীয় আদর্শ বলে ভাবতে শুরু করে এবং মুসলিমরা তাদেরকে কিবলা বানিয়ে মাথানত করে। তাদের অবস্থার উন্নতি হয়েছে গণতন্ত্র ও ব্যক্তিস্বাধীনতার চিন্তা থেকে এরূপ দাবি করার মতো বড় প্রতারণা এবং মুনাফিকী আর কী হতে পারে? পাশ্চাত্যের পছন্দকৃত স্বর্গে (?) যারা বাস করতে চায় তাদের জন্য পাশ্চাত্য হচ্ছে আশ্রয় ও করুণা। পাশাপাশি উপনিবেশিকতাবাদের প্রকৃত চেহারা যা হচ্ছে জনগণকে শোষণ করা ও তাদের সম্পদ অন্যায়রূপে দখল করা, তাদেরকে দুর্বল করে রাখা, অর্থনৈতিক ও প্রযুক্তিগত দিক থেকে তাদেরকে পশ্চাৎপদ করে রাখা, নিজেদের সম্পদের জন্য তাদেরকে স্থায়ী বাজারে পরিণত করা এবং পুরো বিশ্বকে নিয়ন্ত্রণের যে কারণ সেগুলোকে তারা গোপন করেছে। পাশ্চাত্যের সভ্যতা এবং এর উপনিবেশিকতাবাদের ইতিহাস অনেক দীর্ঘ, আলোচনার সুবিধার্থে যার কিছু অংশ আমরা উপস্থাপন করেছি মাত্র।

হ্যা, ঠিক এভাবেই পশ্চিমারা সত্যকে বিকৃত করেছে, বিষয়বস্তুকে উল্টে ফেলেছে এবং নিজেদের ইচ্ছানুযায়ী বিভিন্ন বিষয়কে জনগণের প্রকৃত উপলব্ধি থেকে অন্ধকারে রেখেছে। ফলে বিভিন্ন বিভ্রান্তিমূলক চিন্তা জনগণকে প্রভাবিত করতে লাগলো, যার মধ্যে ‘জোর যার মুল্লুক তার’ অন্যতম। শ্লোগাণটি ‘শক্তিশালীর যুক্তি শক্তিশালী’ এবং ‘দুর্বলের যুক্তি দুর্বল’ এই মূলনীতির উপর প্রতিষ্ঠিত ছিল।

আদর্শিক দল বা গোষ্ঠীর মূল ভূমিকা এখানেই যাতে সবকিছুই তার প্রকৃত অবস্থায় ফিরে আসে, দৃষ্টিভঙ্গী ঠিক হয় এবং প্রতারণা বন্ধ হয়। দল যদি বাস্তবতা দ্বারা আক্রান্ত হয় তাহলে সে সঠিক উপলব্ধি হারিয়ে ফেলবে এবং এমন সমাধানের প্রস্তাব দিবে যা সাধারণত তার শত্রুরা দিয়ে থাকে। তবে দল যদি বাস্তবতাকে সঠিকভাবে অনুধাবন করতে পারে এবং সমাধান খুঁজতে সঠিক প্রক্রিয়ায় শারী’আহ্’কে অনুসরণ করতে পারে তাহলে জনগণের সামনে সে সঠিক সমাধান উপস্থাপন করতে পারবে এবং জনগণকে পাশ্চাত্যের নষ্ট চিন্তা থেকে ইসলামের আলোকিত চিন্তায় আনতে সক্ষম হবে।

উপরের সংক্ষিপ্ত আলোচনা থেকে আমরা বুঝতে পারছি যে বিভিন্ন দেশকে বস্তুগত অগ্রগতির উপকরণ অর্জনে বাঁধাপ্রদান এবং নিজেদেরকে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে জ্ঞানচর্চার ব্যাপক স্বাধীনতা প্রদানের মাধ্যমে পশ্চিমারা তাদের ক্ষমতাধর অবস্থা ধরে রেখেছে। প্রকৃতপক্ষে, তাদের মাত্রাতিরিক্ত সম্পদের পিছনে গণতন্ত্র নয় বরং দায়ী হচ্ছে তাদের ঔপনিবেশিকতাবাদ, বিভিন্ন জাতিসমূহের রক্তশোষণ এবং সম্পদ লুণ্ঠন।

আর গণতন্ত্র কী ও তা বাস্তবায়নের পরিণতি কী; তা এক ভিন্ন আলোচনা।

পাশ্চাত্যে ‘জীবন থেকে দ্বীনের পৃথকীকরণ’ এই ধারণাটি জন্ম হয়েছে জীবনের বিভিন্ন বিষয়ে চার্চের হস্তক্ষেপের ফলে সৃষ্ট দুর্ভোগের কারণে। এসব হস্তক্ষেপ ধর্মের নামে চালানো হলেও এসব ব্যাপারে ধর্মের কোনো মন্তব্য ছিলনা। কারণ খ্রিস্টান ধর্মে পার্থিব বিষয়সমূহের জন্য কোনো আইনকানুন নেই। ধর্মের নামে পাদ্রীগণ বিভিন্ন অন্যায় আইনকানুন তৈরি করেছিল যার ফলে কিছু বিশেষ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়; এর মধ্যে একটি ছিল ধর্মকে পুরোপুরি প্রত্যাখ্যান করা এবং অন্যটি ছিল ধর্মকে স্বীকার করা কিন্তু জীবন থেকে একে বিচ্ছিন্ন করে ফেলা। প্রথম প্রতিক্রিয়াটির ভিত্তিতে গড়ে ওঠা চিন্তাগুলোর উপর ভর করে সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রের শাসনের উত্থান ঘটে এর শাসনে জনগণ পিষ্ট হয় এবং কয়েক দশক যেতে না যেতে তা ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়। দ্বিতীয় প্রতিক্রিয়াটির ভিত্তিতে গড়ে ওঠা চিন্তাগুলোর উপর ভর করে পুঁজিবাদী রাষ্ট্রের শাসনের উত্থান ঘটে যা ধ্বংসের পথে এগুচ্ছে। যার নমূনা চিন্তা এবং বাস্তবতার নিরিখে সুস্পষ্ট।

‘জীবন থেকে দ্বীনের পৃথকীকরণ’ এই ধারণাটি ধর্মকে তার অধিকার থেকে বঞ্চিত রেখে মানুষকে আইন প্রণয়নের অধিকার দিয়েছে। সৃষ্টিকর্তার ধারণাকে স্বীকার করে নেয়া সত্ত্বেও তারা একে এমন একটি ব্যক্তিকেন্দ্রিক চিন্তায় পরিণত করেছে যাতে এর কোন বক্তব্য কিংবা প্রভাব সমাজের উপর না পড়ে। সমাজের বিষয়ে যার কিছু বলার নেই এবং যা সমাজে কোনো প্রভাবও রাখতে পারবেনা। তাদের জন্য এটা ভুল নয় যদি কেউ আল্লাহ্, যীশু, বুদ্ধ বা অন্য কোন ব্যক্তির উপাসনা করে। এমনকি ধর্ম হতে উদ্ভুত নয় এমন বিশ্বাসে কেউ বিশ্বাসী হওয়াটাও তাদের দৃষ্টিতে দোষের নয়। কিন্তু সর্বদা মানুষকে সকল বিষয়ের একমাত্র ব্যবস্থাপক মানতে হবে। তাদের দৃষ্টিতে এ বিষয়টির সাথে কোন আপোষ-আলোচনার সুযোগ নাই। তাদের মতে মানুষ নিজেই নিজের বিষয়াদির ব্যবস্থাপনা করবে এবং তার প্রবৃত্তিকে সন্তুষ্টির ব্যবস্থা করবে। এ চিন্তা থেকে গণতন্ত্রের ধারণা উদ্ভুত হয়েছে যার অর্থ ‘জনগণের শাসন, জনগণের দ্বারা শাসন এবং জনগণের জন্য শাসন।’

‘জনগণের শাসন’ বলতে বুঝায় জনগণ নিজেই নিজের প্রভূ অর্থাৎ আইন তৈরি করবে অর্থাৎ বিধানদাতা।

‘জনগণের দ্বারা শাসন’ বলতে বুঝায় জনগণ তার প্রণীত আইন দ্বারা শাসন করবে।

এবং ‘জনগণের জন্য শাসন’ বলতে বুঝায় জনগণ তার প্রণীত আইন কতৃর্ক শাসিত হবে।

তাদের মতে তিন ধরনের কতৃর্পক্ষের আবির্ভাব ঘটে,

১.আইন তৈরির জন্য কর্তৃপক্ষ। এ কর্তৃপক্ষ আইন ও কানুন তৈরি, এগুলো সংশোধন, রহিতকরণ এবং প্রয়োগ পর্যবেক্ষণ  করে।

২.নির্বাহী কর্তৃপক্ষ। এ কর্তৃপক্ষ সাধারণ আইন বা জনগণের সাধারণ ইচ্ছা ও আইন কতৃর্পক্ষ কতৃর্ক প্রণীত আইন প্রয়োগ করে।

৩.বিচারকার্য সম্পাদনের জন্য কতৃর্পক্ষ। এটি আইনী কর্তৃপক্ষ কর্তৃক প্রণীত আইন ও কানুন দ্বারা তার সামনে উত্থাপিত যে কোন বিষয়ের বিচারকার্য সম্পাদন করে।

এগুলো হলো গণতন্ত্রের মৌলিক বৈশিষ্ট্য। এটা বলা সম্ভবপর যে, অন্যদের থেকে পার্থক্যকারী এই রকম বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন আদর্শের নামই হল গণতন্ত্র। এর যে কোনটি বাদ পড়েছে এমন কোন ব্যবস্থার নাম গণতন্ত্র নয়। এই বৈশিষ্ট্যসমূহের মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য হলো মানুষের সার্বভৌমত্ব। একে গণতান্ত্রিক চিন্তার প্রাথমিক অবলম্বন ও গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার মেরুদন্ড হিসেবে বিবেচনা করা হয়।

সুতরাং ইসলামে কি গণতন্ত্র আছে? গণতন্ত্রের এ উপরিল্লিখ বৈশিষ্ট্য কি ইসলামে বিদ্যমান? যদি এ বাস্তবতা ইসলামে বিদ্যমান থাকে তখনই আমরা বলতে পারি, ‘গণতন্ত্র ইসলাম থেকে এসেছে’ এবং ‘খোলাফায়ে রাশেদীনগণ সর্বপ্রথম গণতন্ত্র প্রয়োগ করেছিলেন’ এবং ‘গণতন্ত্র হলো সে হারানো সম্পদ যা পুনরায় আমাদের কাছে ফিরে এসেছে?’ আর যদি তা বিদ্যমান না থাকে তাহলে গণতন্ত্র মোটেও ইসলাম থেকে আসেনি। কাজেই আমাদেরকে অবশ্যই গণতন্ত্র সম্পর্কে ইসলামের মতামত জানতে হবে।

নিশ্চয়ই গণতন্ত্র সেই মতাদর্শের ভিত্তির সাথে সঙ্গতিপূর্ণ যে মতাদর্শের ভিত্তি হচ্ছে জীবন থেকে দ্বীনকে পৃথকীকরণ। এ ভিত্তি হতে গণতন্ত্র জন্ম লাভ করেছে এবং একই আইন গ্রহণ করেছে। এটি পরিত্যাজ্য একটি ভিত্তির শাখা, এবং এই ভিত্তির উপর বিশ্বাস স্থাপনকারী কাফের হিসেবে গণ্য। এটা সর্বজনবিদিত, ‘জীবন থেকে দ্বীনের পৃথকীকরণ’  মুসলিমদের মৌলিক বিশ্বাস ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহম্মাদুর রাসূলুল্লাহ্’ এর পরিপন্থী। মুসলিমদের জন্য আক্বীদা হতে উদ্ভুত এবং সামঞ্জস্যপূর্ণ চিন্তা হচ্ছে:

“নিশ্চয় আইন প্রণয়নের মালিক একমাত্র আল্লাহ্। তিনি আদেশ দিয়েছেন যে, তোমরা তাকে ব্যতীত আর কারও ইবাদত করো না। এটাই সরল পথ কিন্তু অধিকাংশ লোকই তা জানে না।
[সূরা ইউসুফ: ৪০]

তাঁর (সুবহানাহু ওয়া তা’আলা’র) বক্তব্যের

“…কিন্তু অধিকাংশ লোকই তা জানে না।” এর অর্থ হল সারা জাহানের প্রভূর প্রদত্ত হুকুমের ক্ষেত্রে অধিকাংশ লোকের মতামতের কোন মূল্য নেই এবং আইন তৈরির ক্ষমতা একমাত্র আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা’র। সুতরাং ইসলামী ব্যবস্থায় সর্বশেষ কথা কেবলমাত্র আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা’র জন্য। আদেশ, নিষেধ, অনুমোদন, নিষিধাজ্ঞা প্রদান কেবলমাত্র সবচেয়ে বড়, সবচেয়ে মহান, সর্বজ্ঞানী, সব বিষয়ে প্রাজ্ঞ সত্ত্বার জন্য; এছাড়া আর কারও জন্য নয়। কোন ব্যক্তি বা দলের আল্লাহ্’র সাথে এ ব্যাপারে সামান্যতম হিস্যাও নেই।

আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা হলেন সে সত্ত্বা যিনি রায় দিয়েছেন,

“নিশ্চয়ই আইন প্রণয়নের মালিক একমাত্র আল্লাহ্।”
(সূরা ইউসুফ: ৪০)

এবং আল্লাহ্’র রায়ের ব্যাত্যয় ঘটানোর অধিকার কারও নেই,

“তার নির্দেশকে পশ্চাতে নিক্ষেপকারী কেউ নেই।”
(সূরা রা’দ: ৪১)

তাহলে কী করে গণতন্ত্রের কালো রাত্রির সাথে ইসলামের জ্যোতিময় দিনের তুলনা চলে? আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা তাঁর সুস্পষ্ট আয়াতে উল্লেখ করেছেন,

“আর যদি আপনি পৃথিবীর অধিকাংশ লোকের কথা মেনে নেন, তবে তারা আপনাকে আল্লাহ্’র পথ থেকে বিপথগামী করে দেবে। তারা শুধু অলীক কল্পনার অনুসরণ করে এবং সম্পূর্ণ অনুমাননির্ভর কথাবার্তা বলে।”
(সূরা আল আনআম: ১১৬)

তিনি (সুবহানাহু ওয়া তা’আলা) আরও বলেন,

“…হয়তো তোমরা এমন বিষয়কে অপছন্দ করছো যা তোমাদের জন্য কল্যানকর এবং এমন বিষয়কে পছন্দ করছো যা তোমাদের জন্য অকল্যানকর। এবং আল্লাহ্ জানেন কিন্তু তোমরা জানো না।”
(সূরা বাক্বারা: ২১৬)

Leave a Reply