তাদের মতে আল্লাহ সুদ(রিবা) একবারে হারাম করেননি বরং বিভিন্ন পরিস্থিতিতে ধাপে ধাপে তা নিষিদ্ধ করেছেন। যেমন তিনি (সুবহানাহু ওয়া তাআলা) বলেন:
“মানুষের ধন-সম্পদে তোমাদের ধন-সম্পদ বৃদ্ধি পাবে এই আশায় তোমরা উপহার(রিবা) হিসেবে যা কিছু দাও আল্লাহর কাছে তা বৃদ্ধি পায়না। পক্ষান্তরে আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের আশায় পবিত্র অন্তরে যারা দিয়ে থাকে, অতএব, তারাই দ্বিগুণ লাভ করবে।”
(আল-কুরআন ৩০:৩৯)
তিনি (সুবহানাহু ওয়া তাআলা) বলেন:
“তোমরা চক্রবৃদ্ধি হারে সুদ খেয়োনা।”
(আল-কুরআন ৩:১৩০)
তিনি (সুবহানাহু ওয়া তাআলা) বলেন:
“হে ঈমানদারগণ, তোমরা আল্লাহকে ভয় কর এবং সুদের যে সমস্ত বকেয়া আছে, তা পরিত্যাগ কর, যদি তোমরা ঈমানদার হয়ে থাক।”
(আল-কুরআন ২:২৭৮)
তিনি (সুবহানাহু ওয়া তাআলা) বলেন:
“তারা সুদ গ্রহণ করত অথচ এ ব্যাপারে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছিল”
(আল-কুরআন ৪:১৬১)
তিনি (সুবহানাহু ওয়া তাআলা) আরো বলেন:
“আল্লাহ ব্যবসাকে হালাল করেছেন এবং সুদকে করেছেন হারাম।”
(আল-কুরআন ২:২৭৫)
এসব আয়াতের প্রেক্ষিতে যারা ক্রমধাপে ইসলাম বাস্তবায়নের সুযোগ খুঁজে তারা বলে, প্রথম আয়াতে সুদ ছিল মুবাহ। সরল সুদকে বৈধ রেখে চক্রবৃদ্ধির সুদকে নিষিদ্ধ করা হয় দ্বিতীয় আয়াতে এবং পরবর্তীতে সরল সুদকেও নিষিদ্ধ করা হয় তৃতীয় আয়াতের মাধ্যমে।
তিনি (সুবহানাহু ওয়া তাআলা) বলেন:
“সুদের যে সমস্ত বকেয়া আছে, তা পরিত্যাগ কর।”
(আল-কুরআন ২:২৭৮)
তাদের মতে চতুর্থ আয়াত দ্বারা এটা প্রমাণিত যে, সুদ নিষিদ্ধ হওয়ার সুচনা হয়েছিল প্রথমে পরোক্ষ উপদেশদানের মাধ্যমে অর্থাৎ ইহুদীদেরকে সম্বোধিত করার মাধ্যমে এবং এক্ষেত্রে আল্লাহ কোন স্পষ্ট নির্দেশনা দেননি। ধাপে ধাপে বিভিন্ন আয়াত নাযিলের মাধ্যমে শেষ পর্যন্ত আল্লাহ সুদকে নিষেধ করেন তাঁর এ কথার মাধ্যমে—
“আল্লাহ ব্যবসাকে হালাল করেছেন এবং সুদকে হারাম”
(আল-কুরআন ২:২৭৫)
কেউ যদি উপরোক্ত আয়াতসমুহের সঠিক ফিক্হের (আইনগত জ্ঞান) অনুসন্ধান করে, তাহলে দেখতে পাবে এক্ষেত্রে ক্রমান্বয়িকতার ধারণার কোন সত্যতা নেই।
— প্রথম আয়াতটি সুদ নিষিদ্ধ হওয়ার সাথে কোনভাবেই সম্পৃক্ত নয় বরং এর বিষয়বস্তু হচ্ছে উপহার সামগ্রী। আয়াতটির মানে হচ্ছে কেউ যদি কাউকে কিছু উপহার দেয় এবং বিনিময়ে তার চাইতে বেশি কিছু আশা করে অথবা তা ফিরিয়ে দেয়ার দাবী জানায় তাহলে আল্লাহর কাছে এর কোন বৃদ্ধি নেই অর্থাৎ আল্লাহ তাকে এর জন্য কোন পুরস্কার দিবেন না। রাসূল (সা) বলেন:
“কেউ যদি তার হালাল উপার্জন থেকে খেজুরের সমপরিমাণ কিছু দান করে এবং আল্লাহ হালাল ছাড়া অন্যকিছু কবুল করেননা, তিনি তখন সেটা তার ডান হাতে ধারণ করেন এবং দানকারীর জন্য তা বাড়াতে থাকেন যতক্ষণ না তা পাহাড়সম হয়ে যায় যেমনভাবে তোমরা তোমাদের ছোট্ট অশ্বকে প্রতিপালন করতে থাক।”
[বুখারী থেকে বর্ণিত]
এ ব্যাপারে ইবনে আব্বাস (র) বলেন: “তোমরা উপহার (রিবা) হিসেবে যা কিছু দাও।” (আল কুরআন ৩০:৩৯) এর অর্থ হচ্ছে যদি কেউ কাউকে উপহার হিসেবে কিছু দেয় এরং বিনিময়ে এর চাইতে বেশি কিছু আশা করে তাহলে আল্লাহর কাছ থেকে তার বেশি কিছু পাওয়ার নেই এবং এজন্য সে পুরস্কৃত ও হবেনা। যাইহোক এতে তার গোনাহ ও হবেনা। এ অর্থেই আয়াতটি নাযিল হয়েছে (আল-কুরতুবী থেকে বর্ণিত)। ইবনে কাছীর (র) এ আয়াত সম্পর্কে বলেন কেউ যদি উপহার হিসেবে কাউকে কিছু দেয় এবং বিনিময়ে সে উত্তম কিছু আশা করে তাহলে এজন্য সে আল্লাহর কাছ থেকে কোনরকম পুরস্কার পাবে না। ইবনে অব্বাস, মুজাহিদ, আদ-দাহহাক, কাতাদাহ, ইকরামাহ, মুহাম্মদ বিন কাব এবং আশ-শাবী প্রমুখ এর নিকট থেকে এরকম ব্যাখ্যাই এসেছে আয়াতটি সম্পর্কে। এ ধরনের কাজ হচ্ছে মুবাহ (অনুমোদিত)।
ইবনে আব্বাস বলেন; “সুদ (রিবা) দু ধরনের; একটি হচ্ছে অবৈধ যা ব্যবসায়ের ক্ষেত্রে হয়ে থাকে এবং অন্যটিতে ক্ষতির কিছু নেই যেখানে একজন কাউকে উপহার হিসেবে কিছু দেয় এবং বিনিময়ে তার কাছ থেকে বহুগুণ আশা করে।”
— এবার দ্বিতীয় আয়াতের ব্যাপারে আসা যাক:
“তোমরা চক্রবৃদ্ধি হারে সুদ খেয়োনা।” (আল-কুরআন ৩:১৩০) চক্রবৃদ্ধির সুদপ্রথা নিষিদ্ধ করার জন্য এ আয়াতটি নাযিল করা হয়েছিল,যা ছিল জাহিলি যুগের একটি বাস্তবতা। এখানে এমন কোন নির্দেশনা নেই যা থেকে এটা বুঝা যাবে যে সুদকে সীমিতভাবে (অর্থাৎ সরল সুদকে বৈধ রেখে কেবল চক্রবৃদ্ধির সুদকে) নিষিদ্ধ করা হয়েছে।
মুফাস্সিরগণের মতে (তাফসীরকার) সুদ নিষিদ্ধ করা হয় সুরা বাক্বারাহ তে এবং এটি ছিল মদীনায় নাযিলকৃত প্রথম সুরা। বহুগুণের সুদ নিষিদ্ধ করা হয় যে সুরাতে অর্থাৎ আলি ইমরানে তা নাযিল হয় সুরা বাক্বারাহ এর পরে। সুতরাং স্বল্পমাত্রার সুদকে আল্লাহ বৈধতা দিয়েছেন এরকম যেকোন ধারণাকে খণ্ডন করে এই ঘটনাটি। স্পষ্টতই বুঝা যাচ্ছে যে, সুদ সম্পর্কিত আলি ইমরানের আয়াতটি কোন ক্রমান্বয়িকতার ফসল ছিল না বরং তা ছিল কাফিরদের সুদ চর্চার স্বভাবিক অভ্যাসের একটি উল্লেখমাত্র। সুতরাং সুদ নিষিদ্ধ হওয়ার হুকুম প্রথমেই নাযিল হয়েছিল।
— এবার তৃতীয় আয়াতের প্রসঙ্গে আসা যাক:
“হে ঈমানদারগণ,তোমরা আল্লাহকে ভয় কর এবং সুদের যে সমস্ত বকেয়া আছে,তা পরিত্যাগ কর,যদি তোমরা ঈমানদার হয়ে থাক।” (আল-কুরআন ২:২৭৮) এই আয়াতের অর্থ এরকম কিছু নয় যে, প্রথমদিকে মুসলিমদের জন্য স্বল্পমাত্রার সুদ গ্রহণের অনুমোদন ছিল যা পরবর্তীতে নিষিদ্ধ করা হয়। বরং এই আয়াতটি নাযিল হয়েছিল তাদের ব্যাপারে যারা ইসলামে নতুন এসেছে এবং ইসলাম গ্রহণের পূর্বে তারা সুদের উপর টাকা ধার দিত। সুদের অংশবিশেষ তারা ইতিমধ্যেই গ্রহণ করে ফেলেছিল এবং কিছু অংশ বাকি ছিল। এজন্য যে অংশ তারা গ্রহণ করে ফেলেছে সেটি আল্লাহ(সুবহানাহু ওয়া তাআলা) মাফ করে দিয়েছেন এবং যা বাকি আছে তা গ্রহণ করতে নিষেধ করে দিয়েছেন। এই বিষয়টি আল্লাহর নিম্নোক্ত কথার দ্বারাও সমর্থিত:
“অতঃপর যদি তোমরা পরিত্যাগ না কর, তবে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের সাথে যুদ্ধ করতে প্রস্তুত হয়ে যাও কিন্তু যদি তোমরা তওবা কর, তবে নিজেদের মূলধন পেয়ে যাবে।” (আল-কুরআন ২:২৭৯) অনুরূপভাবে রাসূল (সা) এর নিম্নোক্ত হাদিস:
“জাহিলি যুগের সুদকে সমাপ্ত করা হয়েছে সম্পূর্ণরূপে এবং প্রথমে আমি যে সুদের সমাপ্তি ঘটিয়েছি তা হচ্ছে আল—আব্বাস বিন আব্দুল মুত্তালিবের সুদ।”
[সীরাতে ইবনে হিশাম]
— সবশেষে চতুর্থ আয়াতের প্রসঙ্গে আসা যাক:
“তারা সুদ গ্রহণ করত অথচ এ ব্যাপারে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছিল” (আল-কুরআন ৪:১৬১) The Riba intended here is the haraam money from bribery and other such money, which the Jews used to take, as Allah swt said;
“(তারা) হারাম ভক্ষণ করে।”
(আল-কুরআন ৫:৪২)
এখানে সুদকে শর’ঈ অর্থে বুঝানো হয় নি।
অতএব এ সম্পর্কিত বিধানের শুরু থেকেই সুদ নিষিদ্ধ ছিল এবং এমন কোন নির্দেশনা নেই যা থেকে বুঝা যাবে যে সুদ ধাপে ধাপে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। বেশকিছু প্রমাণের মাধ্যমে নিশ্চিতরূপেই বিষয়টি প্রমাণিত হয়েছে যে সুদ নিষিদ্ধ হওয়ার সাথে ক্রমান্বয়িকতার কোন সম্পর্ক নেই।