কর্মকান্ড কি আংশিক হবে নাকি ব্যাপক এবং ভারসাম্যপূর্ণ হবে?

কিছু মুসলিম কর্মী আছেন যারা ইসলামী কর্মকাণ্ডের ব্যাপারে সমন্বিত এবং সুষম পদক্ষেপ গ্রহণ করার একটি ধারণা উপস্থাপন করেন আবার অনেকে আংশিক কর্মকাণ্ড জোরালোভাবে পরিচালনা করার কথা বলেন।

সমন্বিত পদক্ষেপ বলতে বুঝানো হয় অন্যান্য বিষয় ও দিক বাদ দিয়ে কেবল কোনো একটি আংশিক বিষয় বা দিকের উপরে কর্মকাণ্ডকে সীমিত না করা। ইসলামী পদ্ধতির বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, এতে ইবাদাত সংক্রান্ত নিয়ম-কানুন, অর্থনৈতিক ব্যবস্থা, সামাজিক ব্যবস্থা এবং রাজনৈতিক ও সামরিক ব্যবস্থা বিদ্যমান। নবুয়্যতের যুগে ইসলামের প্রথমদিককার কর্মকাণ্ড ছিল স্বয়ংসম্পূর্ণ। রাসূল (সা) তখন ইসলামের সমস্ত দিকের অনুসরণ করছিলেন। কর্মক্ষেত্রে অথবা নৈতিক শিক্ষাদানের ক্ষেত্রে, তিনি ছিলেন একজন মুরব্বী, শিক্ষাক্ষেত্রে তিনি ছিলেন শিক্ষক, জিহাদের ময়দানে ছিলেন নেতৃত্বদানকারী, পরিকল্পনার ক্ষেত্রে ছিলেন উপদেষ্টা। ইসলামী কর্মকাণ্ড পরিচালনার ক্ষেত্রে সর্বত্র রাসূল (সা)-এর পদাঙ্ক অনুসরণ করতে আমরা বাধ্য এবং এক্ষেত্রে তাঁর (সা) অনুসরণ করা বা না করার বিষয়টি আমাদের ইচ্ছার উপরে নির্ভরশীল না।

অন্যদিকে ইসলামী কর্মকাণ্ডের আংশিক দিক হচ্ছে ইসলামের কোনো একটি দিকের মধ্যে নিজেদেরকে সীমিত রাখা। তারা শুধুমাত্র এরই অনুসরণ করে, একে অতিক্রম করেনা। তারা শুধুমাত্র এই আংশিক কাজের উপরেই আস্থা রাখে, অন্যকিছুর উপরে না। আংশিক কর্মকাণ্ডের ফলে বিভিন্ন দল সৃষ্টি হয়, কর্মকাণ্ডের মধ্যে বিভক্তি আসে এবং লোকজনের কর্মপ্রচেষ্টা বিক্ষিপ্ত হয়ে পড়ে। বনী ইসরাঈলের আংশিক কর্মকাণ্ডকে কুরআন প্রত্যাখ্যান করেছে। তিনি (সুবহানাহু ওয়া তাআলা) বলেন:

“তবে কি তোমরা কিতাবের কিছু অংশ বিশ্বাস কর এবং কিছু অংশ অবিশ্বাস কর? যারা এরূপ করে পার্থিব জীবনে দুর্গতি ছাড়া তাদের আর কোনো পথই নেই। কিয়ামতের দিন তাদেরকে কঠোরতম শাস্তির দিকে পৌঁছে দেওয়া হবে।”
(আল কুরআন ২:৮৫) 

এই বিষয়ের পক্ষালম্বনকারীরা আরো বলে থাকে যে, জাহিলিয়্যিাতের ঐক্যবদ্ধ চ্যালেঞ্জ আমাদেরকে বাধ্য করে সমন্বিত কর্মকাণ্ড গ্রহণ করতে।

মুসলিম কর্মীদের এই দলটি মনে করে ইসলামী কর্মকাণ্ডের সমস্ত দিককে গুরুত্ব অনুযায়ী সুষম ও সমন্বিতভাবে পালন করতে হবে, না হলে কিছু বিষয়ে অপর্যাপ্ততা থেকে যাবে এবং অন্যান্য বিষয়ে বাড়াবাড়ি হয়ে যাবে। এই সমন্বিতকরণের ক্ষেত্রে প্রাধান্যদানের যুক্তি বিবেচনা করতে হবে।

সংক্ষেপে বলতে গেলে, সমন্বিতকরণের ধারণাটি পুরো ইসলামের সাথেই জড়িত। এজন্য দলটির কর্মকাণ্ডকেও স্বয়ংসম্পূর্ণ হতে হবে। সুতরাং সমন্বিতকরণের বিষয়টি আমাদের কাছে দাবী করে প্রত্যেকের নিজস্ব গুরুত্ব ও মর্যাদা অনুযায়ী সমস্ত বিষয়ের প্রতি মনোযোগী হওয়া। এক্ষেত্রে মাত্রাতিরিক্ত কিছু করার প্রয়োজন নেই তাহলে তা বাড়াবাড়ি হয়ে যাবে, আবার কোনো বিষয় অপর্যাপ্ত থাকলে সেটাও ত্রুটিপূর্ণ হবে।

সমন্বয় ও সুষমকরণের নিয়মসমূহ বিভিন্ন বস্তু ও কাজের প্রকৃতিকে নিয়ন্ত্রণ করে। মুসলিম-অমুসলিম সবাই এই নিয়মসমূহকে প্রত্যক্ষ করেছে। ফলে তারা নিজেদের জীবনে এসব নিয়মের গুরুত্ব উপলব্ধি করে এবং এগুলোকে বাস্তবায়নের চেষ্টা করে, যাতে কাঙ্ক্ষিত পরিণতি অর্জন করা যায়।

যাই হোক, কেউ লক্ষ্য করলে দেখতে পাবে, বস্তুর সমন্বয় ও ভারসাম্য আনয়নের সিদ্ধান্ত মনের উপরে নির্ভরশীল কিন্তু কাজের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত গ্রহণের বিষয়টি এর বিপরীত অর্থাৎ এটি শরীয়াহ’র উপরে নির্ভরশীল।

কারণ, বস্তুর বাস্তবতা ও বাস্তবতার উপাদানসমূহ এবং এদের নির্দিষ্ট অনুপাত-এগুলো মন উপলব্ধি করতে পারে। এই বিষয়টি বিশেষজ্ঞগণ ভালো বুঝতে পারেন; এক্ষেত্রে রাসূল (সা) এর নিম্নোক্ত হাদীসটি প্রযোজ্য:

“দুনিয়ার ব্যাপারে তোমরা আমার চাইতে অধিক জ্ঞানী।”
[মুসলিম থেকে বর্ণিত]

অতএব, কৃষক, ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার এবং মেকানিক প্রত্যেকে নিজ নিজ ক্ষেত্রের নিয়ম সম্পর্কে বিশেষজ্ঞ। প্রত্যেকেই এই সমন্বয় ও সুষমকরণের নিয়মগুলো বাস্তবায়নের চেষ্টা করে।

কিন্তু কাজের বিষয়টি আল্লাহ কর্তৃক র্নিধারিত এবং এক্ষেত্রে রাসূল (সা)-এর নিম্নোক্ত হাদীসটি প্রযোজ্য,

“যেকোনো কাজ যা আমাদের বিষয়ের (দ্বীনের) মধ্য থেকে না, সেটা প্রত্যাখ্যাত।”
[বুখারী ও মুসলিম থেকে বর্ণিত]

নিম্নোক্ত শরঈ মূলনীতিটি এক্ষেত্রে প্রযোজ্য:

‘প্রকৃতপক্ষে, কাজের আনুগত্য করতে হবে শরঈ হুকুম অনুযায়ী।’ কারণ কোনো কাজ হাসান (ভালো) নাকি কুবহ্ (তিরস্কারযোগ্য) সেটা খোদ কাজ থেকে নয় বরং কাজের ব্যাপারে মানুষের ধারণার সাহায্যে ঠিক করা হয়। কোনো মুসলিম যেসব চিন্তায় বিশ্বাস করে সেগুলোর সাহায্যে সে তার কাজের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবে। যদি আল্লাহর আদেশ ও নিষেধ অনুযায়ী কাজটি সম্পাদিত হয় তাহলে সেটা হাসান (ভালো), অন্যথায় কুবহ্ (তিরস্কারযোগ্য)। শরীয়াহ মূলনীতি অনুযায়ী: ‘শরীয়াহ যাকে হাসান সাব্যস্ত করেছে সেটাই হাসান এবং শরীয়াহ যাকে কুবহ্ সাব্যস্ত করেছে সেটাই কুবহ্।

ফলে কোনো মুসলিম যখন বস্তুর সমন্বয় ও ভারসাম্য আনয়নের চিন্তা করে তখন সে অন্যান্য মানুষের মতোই নিজের মনের উপরে নির্ভর করে। কিন্তু যখন কাজের ব্যাপারে প্রশ্ন আসে, তখন সেটা অবশ্যই শরঈ হুকুম অনুযায়ী হতে হবে।

এখানে আরেকটি বিষয় উল্লেখ করা প্রয়োজন কাজের সমন্বয় ও সুষমকরণের জন্য কোনোরকম বাড়াবাড়ি ছাড়াই শরঈ দিক থেকে কাজের বিশালত্ব আগে বুঝতে হবে। এজন্য নিচের বিষয়গুলো বিস্তারিতভাবে বিবেচনা করতে হবে;

ইসলাম একটি পরিপূর্ণ জীবনব্যবস্থা এবং সমস্ত মুসলিম অর্থাৎ ইসলামী উম্মতকে পুরো ইসলামের দায়িত্ব নিতে হবে।

ব্যক্তি, দল এবং খলিফার সমন্বয় হচ্ছে ইসলামী উম্মত। এদের প্রত্যেকের জন্যই নির্দিষ্ট হুকুম রয়েছে।

ফলে ব্যক্তিগতভাবে মুসলিমরা সেসব দায়িত্ব পালন করে যেগুলো শরীয়াহ তার উপরে ন্যস্ত করেছে। দল তার নিজস্ব দায়িত্ব পালন করে। খলিফা সেসব দায়িত্ব পালন করে যেগুলোর জন্য সে খলিফা হিসেবে নির্দেশপ্রাপ্ত।

দল এবং খলিফার মতো মুসলিমগণও যদি ব্যক্তিগতভাবে নিজেদের পালনীয় কর্তব্যসমূহ পূরণ করে, তাহলে কাজ পূর্ণাঙ্গ ও স্বয়ংসম্পূর্ণরূপে সম্পন্ন হবে। বাধ্যতামূলক দায়িত্ব পালনে যদি (ব্যক্তি, দল বা খলিফার) কেউ কোনোরকম শৈথিল্য প্রদর্শন করে, তাহলে দায়িত্ব পালনে অবহেলাকরী হিসেবে সে অপরাধী হবে।

খলিফা ছাড়া পুরো ইসলাম পরিপূর্ণরূপে বিদ্যমান থাকতে পারেনা। যেহেতু দ্বীনের অনেক হুকুম খলিফার অস্তিত্বের উপরে নির্ভরশীল, সেহেতু তার অস্তিত্বে থাকা এবং তাকে অস্তিত্বে আনার জন্য কাজ করা ফরয। ফলে খিলাফত রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে পুরো দ্বীনকে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য প্রয়োজনীয় সমস্ত কাজ করতে হবে দলটিকে। একে বলা হয় ইসলামী জীবনব্যবস্থা পুনরুজ্জীবিত করার কাজ। দলটির কাছ থেকে সম্পূর্ণরূপে এটিই শরীয়াহ প্রত্যাশা করে এবং এটি পূর্ণাঙ্গ দ্বীন নয়, পূর্ণাঙ্গ দ্বীনের কাজ সে বাস্তবায়ন করতে পারে না এবং এই দায়িত্বটি তার উপরে ন্যস্তও না। বরং এমন অনেক হুকুম রয়েছে যেগুলো বাস্তবায়ন করা এর জন্য হারাম। উদাহরণস্বরূপ, হুদুদ এমন একটি বিষয়। অতএব, দলটি খলিফার ভূমিকা পালন করতে পারে না বরং খলিফা যাতে নিজের দায়িত্ব সম্পাদন করতে পারে সেজন্য সে খলিফাকে অস্তিত্বে আনার জন্য কাজ করে।

“জনগণের জন্য আমীর হচ্ছে মেষপালকের মতো যে তার পালের জন্য দায়িত্বশীল।”
[মুসলিম থেকে বর্ণিত]

“…প্রকৃতপক্ষে আল্লাহ প্রত্যেককে নিজ নিজ দায়িত্ব সম্পর্কে জিজ্ঞাসাবাদ করবেন।”
[মুসলিম থেকে বর্ণিত]

একটি বিষয়ের দিকে আমরা দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাই যে, মুসলিমরা পুরো ইসলামের উপরে বিশ্বাস করে, এবং এর দিকে সাধারণভাবে ডাকে। তবে সে শুধুমাত্র সেসব বিষয়ই পালন করে যেগুলো ব্যক্তি হিসেবে তার কাছ থেকে শরীয়াহ দাবী করে এবং যে দলের সাথে সে কাজ করে সেই দলটি তার কাছ থেকে যা দাবী করে। এসব বিষয় বিস্তারিতভাবে পালন না করলে আল্লাহ তাকে জবাবদিহি করবেন। অনুরূপভাবে ব্যক্তি হিসেবে খলিফার কাছ থেকে শরীয়াহ যা দাবী করে সেগুলো সে পালন করবে। অতএব তাকে সালাত আদায় করতে হবে, সিয়াম পালন করতে হবে, হজ্জ্ব পালন করতে হবে, যাকাত দিতে হবে, মা-বাবার দেখাশোনা করতে হবে এবং ব্যভিচার, সুদ, মিথ্যা বলা ও প্রতারণা থেকে বিরত থাকতে হবে। খলিফা হিসেবে শরীয়াহ তার কাছ থেকে যা দাবী করে সেগুলোও তাকে পালন করতে হবে। ফলে তিনি আইন জারি করবেন, জিহাদ ঘোষণা করবেন, মুসলিমদেরকে রক্ষা করবেন, আল্লাহর নাযিলকৃত বিষয়াদি দিয়ে শাসন করবেন এবং হুদুদ প্রয়োগ করবেন। এসমস্ত বিষয়ে কোনোরকম শৈথিল্য প্রদর্শন করলে আল্লাহ তাকে জবাবদিহি করবেন।

উল্লিখিত বাস্তবতার জন্যই শরঈ হুকুমসমূহ এসেছে। এই বিষয়টি দলের নিকট স্পষ্ট থাকা উচিত, যাতে সে বুঝতে পারে কোন কাজটি তার দায়িত্বের মধ্যে পড়ে কোন কাজটি দায়িত্বের মধ্যে পড়েনা। অতএব, খলিফার জন্য যেসব কাজ রয়েছে সেগুলো দল সম্পাদন করতে পারে না। দল যদি নিজের বাস্তবতাকে সঠিকভাবে সংজ্ঞায়িত করতে পারে তাহলে সে তার দায়িত্বগুলো নির্ধারণ করতে পারবে এবং সেগুলোর জন্যই তাকে জবাবদিহি করতে হবে। সমন্বিতকরণের বিষয়টি চিন্তা করলে আমাদেরকে এরূপ সিদ্ধান্তেই আসতে হবে।

নিজের দায়িত্বসমূহ নির্ধারণ করার পরে যদি দলটি নির্ধারিত কাজসমূহের কোনো একটির মধ্যে নিজেকে সীমিত রেখে অন্যগুলোকে বাদ দিয়ে দেয় অথবা কোনো একটি বিষয়ের দিকে তীক্ষ্ণ নজর দেয় এবং অন্যগুলোকে তেমন গুরুত্ব না দেয় অথবা দায়িত্বসমূহের মধ্যে প্রাধান্যদান না করে তাহলে সে দায়িত্বসমূহের মধ্যে সুষমকরণে ব্যর্থ হবে। তবে এক্ষেত্রে আমাদেরকে অবশ্যই মনে রাখতে হবে যে প্রাধান্যদানের বিষয়টি মন নয় বরং শরীয়াহ নির্ধারণ করে। অতএব, দলটির কাজ হচ্ছে রাজনৈতিক এবং সে ঐ মতাদর্শকে ইসলামী উম্মতের উপরে বাস্তবায়িত করতে চায় যার আলোকে সে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। দাওয়াতের ক্ষেত্রে আক্বীদাহ’র অবস্থান হচ্ছে সর্বাগ্রে, কারণ এটিই সেই ভিত্তি যা থেকে প্রত্যেকটা শাখা বের হয়েছে এবং সমস্ত শরঈ আহকাম এর সাথে সম্পৃক্ত। খিলাফত প্রতিষ্ঠার দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করার গুরুত্ব অনেক বেশি কারণ, এর উপরে প্রচুর আহকাম নির্ভরশীল এবং এজন্য এটি ‘ফরযসমূহের মুকুট’ হিসেবে পরিচিত।

অতএব, দলটি যদি এই দৃষ্টিভঙ্গির বাইরে গিয়ে সমন্বয় ও ভারসাম্য আনয়নের জন্য সংগ্রাম করে তাহলে সে এমনকিছুর জন্য নিজেকে চালনা করবে যা আল্লাহ নির্ধারণ করেননি। তখন সে অপর্যাপ্ততা এবং অসমতার অভিযোগ করবে যেমনভাবে সে একাধিক দল থাকার বিষয়ে অভিযোগ করে। তখন সে এমন একটি দলে পরিণত হবে যে অভিযোগ করে ও হতাশা ব্যক্ত করে এবং নিজের পথ হারিয়ে ফেলে, কারণ সে নিজের দিক নির্দেশনার কম্পাস হারিয়ে ফেলেছে।

ইসলামী ব্যবস্থার বৈশিষ্ট্য যদি হয় ইবাদাতের পদ্ধতি, অর্থনৈতিক ব্যবস্থা, সামাজিক ব্যবস্থা, রাজনৈতিক ব্যবস্থা ও সামরিক ব্যবস্থা প্রভৃতির সমন্বয় তাহলে প্রশ্ন দাঁড়ায় এসব ব্যবস্থার সাথে দলটির সম্পর্ক কী? দলটি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে আল্লাহর আইন প্রতিষ্ঠিত করার জন্য। যখন আল্লাহর আইন প্রতিষ্ঠিত হবে তখন বিভিন্ন ইসলামী ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হবে।

অর্থনৈতিক ব্যবস্থার মধ্যে ভূমি ও মালিকানা, উৎপাদন এবং জাতীয় ও আন্তর্জাতিক বাণিজ্য সম্পর্কিত শরঈ আহকাম রয়েছে। অন্যান্য হুকুমের পাশাপাশি এসব হুকুমসমূহ বিধানদাতা খলিফার হাতে ন্যস্ত করেছেন। এসমস্ত বিষয় দেখাশোনা করার দায়িত্ব দলের নয় বরং খলিফার।

রাজনৈতিক ব্যবস্থার ব্যাপারে বলতে গেলে বলতে হয় যে রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হয় শরীয়াহ কর্তৃক নির্ধারিত নীতিমালা এবং স্তম্ভসমূহের উপর ভিত্তি করে; যেমন: খলিফা, মুওয়ায়িন (সহযোগী) থেকে শুরু করে ওয়ালি (গভর্ণর), কাজী (বিচারক), প্রশাসনিক ব্যবস্থা এবং মজলিস আল উম্মাহ (উম্মাহ কাউন্সিল) পর্যন্ত। খলিফা, মুওয়ায়িন এবং ওয়ালী প্রত্যেকেরই কিছু নির্দিষ্ট ক্ষমতা আছে। সেনাবাহিনী এবং প্রশাসনিক ব্যবস্থার নিজস্ব কর্মক্ষেত্র রয়েছে। প্রশ্ন হচ্ছে এসমস্ত বিষয়ে দলের কি করার আছে?

ইসলামী সেনাবাহিনী ও এর প্রস্তুতিকে অবশ্যই বিশ্বের কাছে ইসলামের বার্তা পৌঁছে দেওয়ার উদ্দেশ্য বাস্তবায়ন করতে হবে, কারণ এর জন্যই একে গঠন করা হয়েছে। এর প্রস্তুতি কেবলমাত্র কৌশলগত দিক যেমন: কীভাবে মেশিনগান ঠিকঠাক করতে হবে, ব্যবহার করতে হবে অথবা কীভাবে গ্রেনেড ছুঁড়তে হবে এতটুকু পর্যায়ে থাকলে চলবেনা বরং একে অবশ্যই বৈশ্বিক পর্যায়ে থাকতে হবে। কিছু অস্ত্র আছে যেগুলো ব্যক্তিগতভাবে ব্যবহার করা যাবে আবার কিছু অস্ত্র আছে যেগুলো কেবলমাত্র রাষ্ট্র ব্যবহার করতে পারবে। এজন্য প্রশিক্ষণকে সর্বাধুনিক পর্যায়ে রাখতে ট্যাংক, সাঁজোয়া বাহিনী, বিমান বাহিনী এবং পারমাণবিক প্রযুক্তি ও মহাশূন্যযান প্রভৃতি বিষয়ে প্রশিক্ষণদান অপরিহার্য। গবেষণাগার, অস্ত্রকারখানা, বিমানবন্দর, প্রশিক্ষণ কেন্দ্র প্রভৃতি এবং এগুলোর বাইরেও আরো অনেককিছু নির্মাণ করতে হবে। প্রশ্ন হচ্ছে এসমস্ত বিষয়ে দলের কী করার আছে? রাসূল (সা) যখন সাহাবাগণকে (রা) প্রস্তুত করতেন ও প্রশিক্ষণ দিতেন তখন তিনি কোনো একটা দলের দায়িত্বশীল হিসেবে তা করেননি বরং একটা রাষ্ট্রের শাসক হিসেবে এগুলো করেছেন। অতএব, এই দৃষ্টিভঙ্গির আলোকেই এক্ষেত্রে রাসূল (সা)-কে অনুসরণ করতে হবে।

এসমস্ত ব্যবস্থাকে বাস্তবায়ন করা নিজের দায়িত্ব বলে মনে করা দলটির জন্য উচিত নয়; বরং দলটির কাজ হচ্ছে খলিফাকে অস্তিত্বে আনা যিনি নিজের দায়িত্ব হিসেবে এগুলোকে বাস্তবায়ন করবেন। উম্মাহ যদি খলিফাকে অস্তিত্বে আনার কাজকে অবহেলা করে এবং খলিফার কাজগুলোকে নিজেরা বাস্তবায়নের চেষ্টা করে তাহলে এর মাধ্যমে শরীয়াহ’কে বিকৃত করা হবে।

আল্লাহ সুবহানাহু তায়ালা যদি দলটিকে তৌফিক দেন তাহলে তারা যেসব আহকামের মাধ্যমে লোকজনের উপরে এসব ব্যবস্থা বাস্তবায়ন করতে ইচ্ছুক সেগুলোকে বুদ্ধিবৃত্তিক উপায়ে গ্রহণ করতে দলটি বাধ্য। এ লক্ষ্যে দলটি ইসলামী ব্যবস্থার কাঠামো এবং ইসলামী রাষ্ট্রের সংবিধানের রূপরেখা নির্ধারণ করবে। জনগণের নিকট ইসলামী আহকামের একটি সাধারণ চিত্র উপস্থাপন করবে দলটি, যাতে জনগণ এসব সমস্যা সমাধানে দলের সামর্থ্যকে অনুভব করে। তখন তারা বিশুদ্ধ শরঈ আহকাম বাস্তবায়নের মাধ্যমে আল্লাহর ইবাদাতের দিকে অগ্রসর হবে এবং আল্লাহর রহমতকে অনুভব করবে।

এবার তাদের ব্যাপারে আসা যাক, যারা শরীয়াহ’র ক্ষুদ্র একটি অংশ নিয়ে কাজ করার পক্ষপাতী। যদি তারা কোনো দাতব্য সংস্থা হয় অথবা নৈতিক সংগঠন হয় অথবা এমন কোনো সংগঠন হয় যারা কোনো একটিমাত্র শরঈ হুকুম যেমন কুরআন শিক্ষাদানের জন্য প্রতিষ্ঠিত সংগঠন হয় তাহলে এগুলো ততক্ষণ পর্যন্ত গ্রহণযোগ্য হবে যতক্ষণ পর্যন্ত এর সদস্যগণ কোনো একটি শরঈ হুকুমের ভিত্তিতে এক থাকে। তবে যদি তারা এরূপ দাবী করে যে তাদের কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে তারা দ্বীন প্রতিষ্ঠা করবে তাহলে সেক্ষেত্রে আমরা বলব যে তারা পরিকল্পিত শরঈ তরীকাহ থেকে বিচ্যুত হয়ে পড়েছে এবং তখন তাদের এই আংশিক কর্মকাণ্ড অবশ্যই বর্জনীয় হবে।

আল্লাহ সুবহানাহু তায়ালার নাযিলকৃত আহকাম পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করতে যে দলটি কর্মরত তাকে অবশ্যই তার প্রয়োজনীয় কর্তব্যসমূহ পালন করতে হবে; যেমন সে খলিফার দায়িত্বসমূহ গ্রহণ করবে না। অথবা ব্যক্তিবিশেষের হুকুমসমূহকে নিজের জন্য গ্রহণ করবেনা অথবা নিজেকে পুরো ইসলামী উম্মত বলেও মনে করবেনা বরং নিজেকে মুসলিম উম্মতের মধ্যকার একটি দল বলে মনে করবে এবং আল্লাহর আহকাম প্রতিষ্ঠিত করা ও ইসলামী জীবনব্যবস্থা পুনরুজ্জীবিত করাকে নিজের উদ্দেশ্য হিসেবে গ্রহণ করবে। এই উদ্দেশ্য বাস্তবায়নের জন্য তখন সে প্রয়োজনীয় সবকিছু গ্রহণ করবে, যেমন: সে ইসলামী আক্বীদাহ’র সঠিক রূপটিকে এবং এর সাথে সম্পর্কিত চিন্তাগুলোকে গ্রহণ করবে এবং গ্রহণকৃত আক্বীদাহ’র আলোকে এর শাবাবদেরকে গড়ে তুলবে। উদ্দেশ্য পূরণের জন্য প্রয়োজনীয় পদ্ধতি, জনগণকে শাসন করার জন্য নির্দিষ্ট সংবিধান এবং মুসলিমদের মধ্যে বিদ্যমান ভ্রান্ত চিন্তাসমূহের ভ্রান্ততা দূর করে শুদ্ধ করার জন্য প্রয়োজনীয় চিন্তাসমূহ দলটিকে গ্রহণ করতে হবে। দলের সাথে যারা কাজ করে তারা যেন নিজেদের ব্যক্তিগত বিষয়াদি যথাযথভাবে পালন করার মাধ্যমে একজন পরহেযগার মুসলিম হতে পারে সে বিষয়টিও দলের নজরে থাকতে হবে। যার ফলে আক্বীদাহ, ইবাদাত, সামাজিক লেনদেন এবং নৈতিকতা প্রভৃতি বিষয়ে সে প্রয়োজনীয় সঠিক পদক্ষেপ গ্রহণ করবে। ইসলামী সমাজ প্রতিষ্ঠার উপরে দলটিকে focus করতে হবে যার সমস্ত সম্পর্ক হবে ইসলামের ভিত্তিতে এবং যার নিরাপত্তা রক্ষিত হবে খিলাফত রাষ্ট্রের মাধ্যমে। শাসকশ্রেণী এবং তাদের প্রভুদের কর্মকাণ্ড দলটিকে পর্যবেক্ষণ করতে হবে যাতে সে বুঝতে পারে মুসলিমদের জন্য কোন কোন ষড়যন্ত্রমূলক পরিকল্পনা গ্রহণ করা হচ্ছে। দলটিকে এসব বিষয় জনগণের সামনে উন্মোচন করতে হবে এবং উম্মাহর জন্য যা কল্যাণকর অর্থাৎ শরঈ আহকাম তা নিজস্ব অবস্থান থেকে দলটিকে গ্রহণ করতে হবে। এসব তাগুত যারা মুসলিমদের সাথে নিষ্ঠুরভাবে আচরণ করে তাদের কাছ থেকে সুষ্ঠুভাবে ক্ষমতা দখল করে নেওয়ার জন্য দলটিকে কাজ করতে হবে। যদি এসব বিষয় যথাযথভাবে দলটি পালন করে তাহলে সে তার দায়িত্ব পরিপূর্ণ করবে।

দলটির চিন্তাভাবনাসমূহ বিস্তৃত হতে হবে এবং এর কর্মক্ষেত্র হতে হবে প্রসারিত। এজন্য প্রয়োজনীয় সবকিছুই দলটিকে সম্পাদন করতে হবে এবং বাস্তবে এর অন্তর্ভুক্ত হচ্ছে অনেক বিষয়। প্রয়োজনীয় সমতা বিধান করে দলটিকে এর কর্মকাণ্ড সম্পাদন করতে হবে; অতএব সে শরীরচর্চা বা নৈতিক বা অর্থনৈতিক কোনো সংগঠন হবেনা … বরং অবশ্যই এটি এর রাজনৈতিক পদক্ষেপ এবং রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডকে অব্যাহত রাখবে। অতএব, এর চিন্তাভাবনাসমূহ হবে উম্মাহর বিষয়সমূহ দেখাশোনা করা এবং উম্মাহর স্বার্থসমূহ সংরক্ষণ করা।

অতএব, পূর্ববর্ণিত উপায়ে আংশিক কার্যক্রম অবশ্যই পরিত্যাজ্য। দলের জন্য নির্ধারিত এবং অনির্ধারিত সমস্ত কর্মকাণ্ডকে ব্যাপকভিত্তিতে বাস্তবায়নের চিন্তাও একটি ভুল চিন্তা যা অবশ্যই পরিত্যাজ্য।   

Leave a Reply