মাসলাহাহ মানে হল কোন উপযোগিতা অর্জন করা বা ক্ষতি থেকে মুক্ত থাকা। এটা মনের ভিত্তিতে হতে পারে আবার শরী’আহ দ্বারা ঠিক করা হতে পারে। যদি মানুষের মনকে এ ব্যাপারে দায়িত্ব দেয়া হয় তাহলে মানুষের পক্ষে সত্যিকারের উপযোগিতা খুজে বের করা অত্যন্ত দুরূহ হয়ে যাবে। কারণ আমাদের মন সীমিত। মানুষের মন তার সব প্রয়োজন ও বাস্তবতাকে ধারণ করতে পারে না। সেকারণে সে তার জন্য সঠিক উপযোগিতা নির্ধারণ করতে সক্ষম নয় যেহেতু কোন একটি জিনিস উপকারী না ক্ষতিকর এ বিষয়ের বাস্তবতাকে মানুষ সঠিকভাবে উপলদ্ধি করতে পারে না। স্রষ্টা ব্যতিত আর কেউ মানুষের বাস্তবতা সম্পর্কে যথাযথ জ্ঞান রাখে না। কোনটা কীভাবে হলে মানুষের স্বার্থ রক্ষিত হবে তা মানুষের স্রষ্টা আল্লাহ সুবহনাহানাহুতায়ালা ব্যতিত আর কেউ নির্ধারণ করতে পারে না। মানুষ হয়ত কোন একটি জিনিসকে তার জন্য উপকারী বা ক্ষতিকর মনে করতে পারে কিন্তু এ ব্যাপারে সে নিশ্চিত জ্ঞানলাভ করতে পারবে না। সেকারণে অনুমাননির্ভরতার উপর ভিত্তি করে কোনটি উপকারী, এ ব্যাপারে মনের উপর দায়িত্ব ছেড়ে দেয়া হলে তা বিপজ্জনক এবং মানুষের জন্য তা ধ্বংস নিয়ে আসে। কোন কিছুকে হয়ত সে ক্ষতিকারক ভাবতে পারে কিন্তু পরে এটি তার জন্য উপকারী প্রমান হতে পারে। সেক্ষেত্রে সে একটি ভাল জিনিসকে নিজের কাছ থেকে দূরে সরিয়ে রাখল। আবার কোন কিছুকে হয়ত সে ভাল ভাবতে পারে এবং পরে এটি ক্ষতিকারক বলে আবিভূর্ত হতে পারে এবং এভাবে সে নিজের জন্য ক্ষতি বয়ে নিয়ে আসে। আজকে মন যে জিনিসটাকে ক্ষতিকারক ভাবে আগামীদিন সেটিকেই উপকারী বলে রায় দিতে পারে। অনুরূপে, আজকে যে জিনিসকে ক্ষতিকারক মনে হচ্ছে গতকাল হয়ত সেটি উপকারী ভাবা হয়েছিল। এ ধরনের পরষ্পরবিরোধী সিদ্ধান্ত দেয়া ঠিক নয়। আর ধর্মনিরপেক্ষ ব্যবস্থায় এ ধরনের পরিস্থিতি একটি স্বাভাবিক বিষয়। আইন প্রণেতা হিসেবে মানুষ তার নিজের জন্য ভাল কিছু করার চেষ্টা করে। সে কারণে আমরা দেখি সমস্যার সমাধানকল্পে ব্যবস্থার ক্রমাগত উন্নয়ন সাধনের জন্য পরিবর্তন ও সংশোধন হতেই থাকে। কারণ হল বাস্তবে তারা কোন জিনিস বা কাজের ক্ষেত্রে এমন কোন সিদ্ধান্তে উপনীত হতে পারে না যা চূড়ান্ত ও সঠিক । সে কারণে যাদের ব্যবস্থা সুদৃঢ় ও স্থির তাদেরকে তারা এর জন্য দোষারোপ করে। কাফেরদের এ প্রবণতা দ্বারা আমরা মুসলিমদের আক্রান্ত হতে দেখি। নিজেদের এবং দ্বীনের ব্যাপারে তখন তারা আত্মরক্ষামূলক হয়ে উঠে এবং ইসলামের প্রকৃতির ব্যাপারে তাদের চিন্তা সঠিক উপলদ্ধি থেকে অনেক দূরবর্তী হবার কারণে তারা ইসলামের শত্রুদের চিন্তার প্রক্রিয়াকে ধারণ করে ক্রমান্বয়ে তাদের নিকটবর্তী হতে থাকে।
স্রষ্টাই একমাত্র সত্তা যিনি মানুষের বিষয়সমূহ বিবেচনায় আনতে পারেন এবং জৈবিক চাহিদা ও প্রবৃত্তি থেকে উদ্ভুত সমস্যাগুলো সমাধান করতে পারেন এবং সঙ্গতভাবে এগুলো মেটাবার ব্যবস্থাপনা প্রদান করতে পারেন। যেহেতু মানুষের এসব বাস্তবতা সুনির্দিষ্ট এবং সময়ের সাথে সাথে পরিবর্তিত হয় না সেহেতু সমাধানও অপরিবর্তনীয় ও সুনির্দিষ্ট। একজন পুরুষ মানুষকে স্বাভাবিক প্রবণতার কারণেই একজন নারীর দ্বারস্থ হতে হয়। যেহেতু মানব মানবীর অপরিহার্য প্রয়োজনীয়তাগুলো পরিবর্তনশীল নয় সেহেতু তাদের মধ্যকার সম্পর্কও অপরিবর্তনীয়। এটা কখনওই গ্রহণযোগ্য হবে না যদি আমরা মানব মানবীর সম্পর্কের ক্ষেত্রে একটি ব্যবস্থাপনা প্রদান করি এবং একটি নির্দিষ্ট সময় অতিবাহিত হবার পর উন্নয়নের সাথে সাথে তাদের বাস্তবতা পরিবর্তিত না হওয়া সত্তেও সে ব্যবস্থাপনা পরিবর্তন করি।
যেমন, মদের বাস্তবতা একই রকম আছে এবং এতে কোন পরিবর্তন হয়নি। তাহলে এ ব্যাপারে হুকুম পরিবর্তন করা হবে কেন?
জুয়া খেলার বাস্তবতাও একই রকম ও অপরিবর্তনীয় আছে। তাহলে এ ব্যাপারে হুকুম পরিবর্তন করার কারণ কি? এ ধরনের আরও অসংখ্য উদাহরণ রয়েছে।
সেকারণে ‘ক্রমউন্নয়ন’, ‘উদারতা’ এবং ‘আধুনিকতা’ এগুলো হল মানবরচিত ব্যবস্থার বৈশিষ্ট্য, যা সত্যের দিকে ধাবিত করে না। তারা একটি পরিবর্তনের প্রক্রিয়ার ভেতর দিয়ে ক্রমাগত যেতে থাকে, যা একটি সঠিক ব্যবস্থার দিকে মানুষ নিজেকে পরিচালিত করবার যে ব্যর্থতা বা অক্ষমতা তাকেই প্রকাশ করে। এই পরিবর্তনের প্রক্রিয়া একটি নিশ্চিত অক্ষমতা হওয়া সত্তেও তারা একে ক্রমবিবর্তন বলে অভিহিত করে। এ দৃষ্টিকোণ থেকেই ঐ মূলনীতিটি প্রত্যাখ্যান করা ঊচিত যা মানুষ শরীয়া থেকে ঊদ্ভুত বলে দাবী করে, যাতে বলা হয় ”সময় এবং স্থান পরিবর্তনের সাথে সাথে হুকুমেরও পরিবর্তন ঘটবে”। এ মূলনীতিটি অবশ্যই প্রত্যাখ্যান করা ঊচিত।
সুতরাং কোন একটি বিষয়ে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’আলার হুকুম একটিই এবং তা একাধিক হতে পারে না। যদি এর বাস্তবতা পরিবর্তন হয়ে যায়, তাহলে বাস্তবতার পরিবর্তনের সাথে সাথে ঐ হুকুমও পরিবর্তিত হয়ে যায়। সেকারণে আঙ্গুর অনুমোদিত, কিন্তু যখন স্বীয় বাস্তবতা পরিবর্তিত হয়ে তা মদে রূপান্তরিত হয়, তখন এ সম্পর্কিত হুকুম পরিবর্তিত হয়ে তা নিষিদ্ধ হয়ে যায়। আবার যখন অ্যালকোহল ভিনেগারে রূপান্তরিত হয়, তখন তা অন্য একটি হুকেুম পরিবর্তিত হয় অর্থাৎ অনুমোদিত হয়। সুতরাং এখানে সময় বা স্থানের কোন বিবেচনা নেই। এরকম কিছু নেই যা এক জায়গায় অনুমোদিত এবং অন্য জায়গায় নিষিদ্ধ অথবা উল্টো করে বললে কোন জায়গার নিষিদ্ধ কিছু অন্য এক জায়গায় অনুমোদিত হতে পারে না। শরীয়া হুকুমের উপর সময় ও স্থানের কোন প্রভাব নেই।
অতীতে যে ঘটনাগুলো ঘটে গেছে, বর্তমানে যে সমস্যাসমূহ দেখা দিচ্ছে বা ভবিষ্যতে যে সমস্যাগুলো হতে পারে ইসলামী শরী’আহ-এর মধ্যে তার সবগুলোর সমাধানই রয়েছে । এমন কোন ঘটনা ঘটতে পারে না বা সমস্যা হতে পারে না যে বিষয়ে শরী’আহ’র কোন হুকুম নেই। ইসলামী শরী’আহ মানুষের সব কাজকে পূর্ণাঙ্গ ও সামগ্রিকভাবে বেষ্টন করে। এ সম্পর্কে তিনি ( সুবহানাহু ওয়া তা’আলা) বলেন,
‘আমি আপনার প্রতি কিতাব নাযিল করেছি যাতে রয়েছে প্রত্যেক বস্তুর সুস্পষ্ট বর্ণনা’
(সূরা নাহল: ৮৯)
সুতরাং শরী’আহ একটি বিষয় বা কাজের ব্যাপারে কুরআন ও হাদীসের মাধ্যমে দলিলাদি দিয়েছে অথবা এ বিষয়ে আইনের জন্য ইল্লা-হ বা ঐশী কারণ বিধৃত করেছে। এ ইল্লা-হ শরীয়াগত এবং কখনওই ইল্লা-হ আকলিয়া বা প্রবৃত্তিপ্রসূত নয়। এখানে আমাদের শরীয় ক্বিয়াস এবং আকলিয়াগত ক্বিয়াসের মধ্যে পার্থক্য উপস্থাপন করা প্রয়োজন।