মুস’আব (রা) মক্কায় ফিরে আসলেন। আনসারদের মধ্য থেকে কিছু মুসলিম তাদের তীর্থযাত্রী মুশরিক লোকদের সাথে হজ্জ করবার জন্য এল। তাশরীকের (১০ জিলহজ্জ থেকে শুরু করে ৪ দিন) মাঝামাঝি এক দিনে তারা রাসূলুল্লাহ (সা) এর সাথে শপথবদ্ধ হলেন। তাদের মধ্যে তেয়াত্তর জন পুরুষ ও দুইজন নারী ছিল। রাসূলুল্লাহ (সা) এর সাথে কেবল তার চাচা ছিলেন। আসাদ বিন জুরারাহ বলেন, ‘ রাসূলুল্লাহ (সা) এর চাচা আল আব্বাস সর্বপ্রথম কথা বললেন। তিনি বললেন, ‘হে খাজরাজের লোকেরা! তোমরা মুহম্মদ (সা) সাথে দেখা করে তাকে আমন্ত্রন জানাচ্ছ। মুহম্মদ (সা) তার গোত্রের লোকদের মধ্য থেকে সবচেয়ে সম্মানিত। আল্লাহর কসম! আমাদের মধ্য হতে যারা তাকে বিশ্বাস করে অথবা না করে, সবাই তার সম্মান ও বংশীয় ধারার জন্য সুরক্ষা দিয়েছে। তোমাদের জন্য মুহম্মদ সবাইকে প্রত্যাখান করেছে। আপনারা যদি ক্ষমতাবান, ধৈর্যশীল, যুদ্ধবিদ্যায় পারদর্শী হন এবং সব আরবদের ঐক্যবদ্ধ বৈরীতা ও শত্রুতা মোকাবিলায় প্রস্তত থাকেন, তাহলে আপনাদের সদিচ্ছার ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত নিন এবং এর উপর দৃঢ় থাকুন। প্রকাশ্যে নিরঙ্কুশভাবে একমত পোষণ করবার পর পরস্পর বিচ্ছিন্ন হবেন না। কারণ সৎ সাক্ষী সর্বোৎকৃষ্ট সাক্ষী।
তারা বলল, ‘আপনি যা বললেন, তা আমরা শুনলাম। কিন্তু হে রাসূলুল্লাহ (সা), আপনি আমাদেরকে আপনার ও আপনার রবের জন্য পছন্দ করুন এবং বলুন আপনার যা ইচ্ছা হয়।’
রাসূলুল্লাহ (সা) তাদের সামনে বক্তব্য দিলেন, কুরআন তেলাওয়াত করে শুনালেন, লোকদের আল্লাহর দিকে আহ্বান করলেন ও ইসলাম গ্রহণের জন্য উৎসাহী করলেন। তাঁর প্রভূকে উপাসনা করা ও তার সাথে কাউকে শরীক না করবার শর্ত দিলেন। তারপর তিনি বললেন, ‘আমি আপনাদের সমর্থন প্রত্যাশা করছি যে, আমাকে সুরক্ষা দিন যেভাবে আপনারা আপনাদের নারী ও শিশুদের সুরক্ষা দিয়ে থাকেন।’ (সীরাত ইবনে হিশাম)
আসাদ বিন জুরারাহ আল বারাহ আরও বর্ণণা করেন যে, ‘মা’রুর শপথ গ্রহণের জন্য তার হাত তুলে নিয়ে বললেন, ‘অবশ্যই, সেই সত্তার কসম যিনি আপনাকে একজন সত্য নবী হিসেবে প্রেরণ করেছেন, আপনাকে আমরা সেভাবে রক্ষা করব যেভাবে আমাদের স্ত্রী ও সন্তানের সুরক্ষা প্রদান করি। হে রাসূলুল্লাহ, সুতরাং আমরা বাইআত প্রদান করলাম। আল্লাহর কসম, আমরা বংশ পরষ্পরায় নেতা থেকে নেতাতে যোদ্ধা ও অস্ত্রচালনায় পারদর্শী।’
যখন আল বারা কথা বলছিল, তখন আবুল হায়সামি ইবনুল তাইহান তাকে থামিয়ে দিয়ে বললেন, ‘হে আল্লাহর রাসূল, আমাদের অন্য লোকদেও (ইহুদী) সাথেও সম্পর্ক রয়েছে। যদি আমরা তাদের প্রতি কঠোর হই এবং সম্ভবত সে সময় আল্লাহ যদি আপনাকে বিজয়ী করেন তাহলে কি আপনি আমাদের প্রত্যাখান করে নিজের লোকদের কাছে ফিরে আসবেন?’ রাসূলুল্লাহ (সা) স্মীত হেসে উত্তর দিলেন,
‘না, রক্ত তো রক্তই; আর রক্তের বদলাও রক্তই। আমি তোমাদের জন্য আর তোমরাও আমার জন্য। তোমরা যাদের সাথে যুদ্ধ করবে আমিও তাদের সাথে যুদ্ধ করব আর তোমরা যাদের সাথে সন্ধি চাইবে আমার সন্ধিও তাদের সাথেই।’
(সীরাত ইবনে হিশাম)
আসাদ বিন জুরারাহ বর্ণণায় আরও উল্লেখ করেন, ‘‘অতপর তারা বলল, ‘সম্পদের ক্ষতি অথবা আমাদের মধ্যকার সম্ভ্রান্তগন উৎসগীর্কৃত হওয়ার সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও আমরা তাঁকে (সা) বাই’য়াত দিলাম। তারপর আল বারা বললেন, ‘হে রাসূলুল্লাহ (সা), আপনার হস্ত প্রসারিত করুন।’ এভাবে তিয়াত্তর জন রাসূলুল্লাহ (সা) এর হাতের উপর হাত রেখে বাই’য়াত সম্পন্ন করল। যখন লোকেরা বাই’য়াত দিল এবং তা সুসসম্পন্ন হল তখন শয়তান আল আকাবায় চিৎকার করে বলে উঠল, ‘হে আখাসীবের (কুরাইশ) লোকেরা, তোমরা কি মুহম্মদ ও তার সাহাবাগন (মুশরিকদের দৃষ্টিতে দ্বীনত্যাগী) কে তোমাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধের জন্য একত্র হওয়া পছন্দ কর?’ রাসূলুল্লাহ (সা) বললেন, ‘তোমাদের মধ্য হতে বারজন নেতা নিয়ে আস যারা তাদের লোকদের দায়িত্ব নিবে, যেমন ঈসা বিন মারিয়মের হাওয়ারীয়ন (শীষ্যগন) ; আর আমি আমার লোকদের পক্ষ থেকে দায়িত্বশীল।’ তারা দু’পক্ষ থেকে নুকাবা (নেতা) নির্বাচন করল। এভাবেই পূর্ণাঙ্গ ঈমানী পরিবেশে বাই’য়াত সুসম্পন্ন হল। এ বিষয়ে আল আব্বাস বিন উবাদা রাসূলুল্লাহ (সা) কে বলেন, ‘সেই সত্তার কসম যিনি আপনাকে একজন সত্য নবী হিসেবে প্রেরণ করেছেন, যদি আপনার ইচ্ছা তাই হয় তাহলে আগামীকালই আমরা মীনাবাসীর বিরুদ্ধে অস্ত্র ধারণ করতে প্রস্তত।’ রাসূলুল্লাহ (সা) বললেন,
‘আমরা এ ব্যাপারে আদিষ্ট হইনি, সুতরাং তোমরা তোমাদের বাহন উটসমূহের কাছে ফিরে যাও।’
(সীরাত ইবনে হিশাম)
হজ্জের মৌসুম শেষ হতে চলল। মক্কার লোকদের কাছে যখন বাই’য়াত খবর পৌছাল তখন তারা তেলেবেগুনে জ্বলে উঠল। ইবনে সা’দ তার ‘আত তাবাকাত’ গ্রন্থে উরওয়া’র বরাতে আয়েশা (রা) এর কাছ থেকে বর্ণণা করেন যে, তারা বলল, ‘যখন সত্তর জন লোক রাসূলুল্লাহ (সা) কে ত্যাগ করল, তখন তিনি বুঝতে পারলেন আল্লাহ তাঁর জন্য সুরক্ষা, যোদ্ধা ও সমর্থন প্রদান করেছেন। তবে মুসলিমদের উপর পরীক্ষা বেড়ে গেল। এ ব্যাপারে সাহাবীগণ (রা) রাসূলুল্লাহ (সা) এর কাছে অভিযোগ করলেন এবং তিনি তাদের হিজরতের অনুমতি দিলেন। তখন রাসূলুল্লাহ (সা) সাহাবা (রা) কে হিজরতের জন্য যে ভূমির কথা জানালেন তা হল ইয়াসরীব বা মদীনা এবং যে হিজরতে আগ্রহী তাকেই অনুমতি দিলেন। তিনি (সা) বললেন, ‘আমি স্বপ্নে দেখলাম, মক্কা থেকে এমন এক ভূমিতে হিজরত করছি যেখানে খেজুর জাতীয় গাছ রয়েছে। আমার মন বলছিল আল ইয়ামা অথবা হাজারের কথা, কিন্তু এটা ছিল আল ইয়াসরীব।’ (বুখারী ও মুসলিম)
অবশ্যই গোত্রসমূহের কাছ থেকে নুসরাহ পাবার প্রচেষ্টা এবং প্রথম ও দ্বিতীয় বায়াতের ঘটনা এসবই প্রমাণ করে যে, রাসূলুল্লাহ (সা) এমন ক্ষমতার অধিকার খুঁজেছিলেন যা তাঁর দ্বীনকে সহায়তা এবং সুরক্ষা দিতে পারবে। বিষয়টি কেবলমাত্র দাওয়াত বহন বা ক্ষতির হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল না। এর সাথে এমন এক ক্ষমতার বিয়য়টি বিজড়িত ছিল যার মাধ্যমে মুসলিমগন আত্নরক্ষা করতে পারবে। বরং এর কলেবর আরও বেড়ে যায়, এটি এমন একটি নিউক্লিয়াস ছিল যাকে কেন্দ্র করে ইসলামি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হবে, সমাজে ইসলাম বাস্তবায়িত হবে, যা মানবতার কাছে শাশ্বত বাণী বহন করে এবং সে ক্ষমতা লালন করে যা ইসলামকে সুরক্ষা দেয় এবং এর বিস্তারের পথে আরোপিত সব বস্তুগত প্রতিবন্ধকতাকে অপসারণ করে। এভাবে সম্পদ, স্বদেশ, স্ত্রী ও পরিবার ছেড়ে হিজরত সম্পন্ন হয়। মদীনার হিজরত আবিসিনিয়ার হিজরত থেকে সম্পূর্ণ আলাদা ছিল।
আবিসিনিয়ায় হিজরত ছিল দ্বীন ও অত্যাচারের ভয়ে কিছু ব্যক্তির নিজ ভূমি থেকে পলায়ন। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা মক্কায় নির্যাতিত মুসলিমদের জন্য এমন এক নিরাপদ আশ্রয়ের ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন যাতে করে তারা নির্যাতনের যাঁতাকলে নিষ্পেষিত না হয়ে তাদের অবস্থার পরিবর্তন ঘটাতে পারে এবং তাদের অন্তরাত্মাসমূহ পূণরায় শক্তিশালী ও দৃঢ়তার সাথে দাওয়াত বহনের জন্য পর্যাপ্ত সুযোগ পায়। এটা দাওয়াতের পদ্ধতির কোন ধাপ নয় যেখানে মুহাজিরনগণ প্রবাসে থেকে দাওয়াত বহন করতে পারে অথবা প্রবাসী শাসকদের সহায়তা নিয়ে তার মূল ভূমির শাসককে উৎখাত করতে পারে।