নিম্নোক্ত প্রবন্ধটি হিযবুত তাহরীর প্রণীত “খিলাফত রাষ্ট্রের খসড়া সংবিধানের ব্যাখ্যা – এর প্রয়োজনীয় দলিলসমূহ, সাধারণ বিধিসমূহ” বইটি থেকে নেওয়া হয়েছে
ধারা ১
ইসলামী আক্বীদাহ হলো রাষ্ট্রের মূল ভিত্তি। সুতরাং, রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা, কাঠামো, জবাবদিহিতা কিংবা রাষ্ট্রের সাথে সম্পর্কিত অন্য কোন বিষয়, যা কিনা ইসলামী আক্বীদাহ হতে উৎসারিত নয়, তা রাষ্ট্রে বিরাজ করতে পারবে না। একই সময়ে, ইসলামী আক্বীদাহ রাষ্ট্রের সংবিধান এবং আইন-কানুনের ভিত্তি হিসেবেও কাজ করবে; তাই, সংবিধান এবং আইন-কানুনের সাথে সম্পর্কিত এমন কোন বিষয়ও রাষ্ট্রে বিরাজ করতে পারবে না, যা কিনা ইসলামী আকীদাহ হতে উদ্ভূত নয়।
দলিলসমূহের বিস্তারিত ব্যাখ্যা
কোন একটি রাষ্ট্রের অভ্যুদয় ঘটে কিছু নতুন চিন্তার আবির্ভাবের ফলে, যার উপর ভিত্তি করে রাষ্ট্রটি প্রতিষ্ঠা লাভ করে। নতুন চিন্তার আবির্ভাবের দরুণ শাসনক্ষমতারও (জনগণের বিষয়াদি ব্যবস্থাপনা ও পরিচালনা করার নিয়মতান্ত্রিক কর্তৃপক্ষ) পরিবর্তন ঘটে, কেননা এই চিন্তাগুলো দৃঢ়বিশ্বাসে পরিণত হওয়ায় তা মানুষের আচরণকে প্রভাবিত করে। এই দৃঢ় চিন্তাগুলোর উপর ভিত্তি করেই মানুষের কর্মকান্ড বিকশিত হতে থাকে। এভাবে জীবনের প্রতি মানুষের দৃষ্টিভঙ্গী পরিবর্তিত হতে থাকে, যার ফলে তার স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়ের ব্যাপারে তার দৃষ্টিভঙ্গীও পরিবর্তিত হয়। সরকার হচ্ছে এমন কর্তৃপক্ষ যে জনগণের স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়সমূহের অভিভাবক এবং এগুলোর তত্ত্বাবধানে নিয়োজিত। ফলে, রাষ্ট্র বিকশিত হয় এবং সরকারব্যবস্থা গড়ে উঠে ঐ ভিত্তিকে কেন্দ্র করে, যে ভিত্তির উপর জীবনের প্রতি দৃষ্টিভঙ্গী গড়ে উঠে। বলাবাহুল্য, জীবন সম্পর্কে নির্দিষ্ট একটি চিন্তার উপর ভিত্তি করেই জীবনের প্রতি দৃষ্টিভঙ্গী গড়ে উঠে। তাই, মূলত এ চিন্তাটিই রাষ্ট্র এবং সরকারব্যবস্থার ভিত্তি হিসেবে কাজ করে।
যেহেতু একগুচ্ছ চিন্তা, মাপকাঠি এবং দৃঢ় বিশ্বাসকে কেন্দ্র করেই জীবনের প্রতি দৃষ্টিভঙ্গী বিকশিত হয়, তাই এগুলোকেই ভিত্তি হিসেবে বিবেচনা করা হয়। এগুলোর উপর ভিত্তি করেই সরকার জনগণের বিষয়াদি পরিচালনা করে এবং জনস্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিষয়ের ব্যবস্থাপনা করে। সে কারণে, কোন একটি একক চিন্তার পরিবর্তে একগুচ্ছ চিন্তাকে ভিত্তি হিসেবে গ্রহণ করা হয়। এই একগুচ্ছ চিন্তার পরিপূর্ণ প্রভাব জীবনের প্রতি দৃষ্টিভঙ্গীর উন্মেষ ঘটায়, যার ধারাবাহিকতায় স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়সমূহের প্রতিও একটি নির্দিষ্ট দৃষ্টিভঙ্গী গড়ে উঠে এবং যার ভিত্তিতে এগুলোর (স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়সমূহের) ব্যবস্থাপনার জন্য শাসনকর্তৃত্বও নির্ধারিত হয়। সুতরাং, রাষ্টের্র সংজ্ঞা হচ্ছে কোন একটি জনগোষ্ঠী কর্তৃক গৃহীত একগুচ্ছ চিন্তা, মাপকাঠি এবং দৃঢ় বিশ্বাস বাস্তবায়নকারী একটি নির্বাহী প্রতিষ্ঠান।
এটি হচ্ছে রাষ্ট্র সম্পর্কিত, যা রাষ্ট্রের সংজ্ঞা থেকে নিরূপিত, অর্থাৎ যা জনগণের স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়সমূহ তদারকি করে এবং তা সুষ্ঠুভাবে পরিচালনা করার ব্যাপারে দায়িত্বশীল।
বলাবাহুল্য, এই একগুচ্ছ চিন্তা যার উপর ভিত্তি করে রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হয়, অর্থাৎ একগুচ্ছ চিন্তা, মাপকাঠি এবং দৃঢ় বিশ্বাস একটি মৌলিক চিন্তা থেকে উৎসারিত হতেও পারে আবার নাও হতে পারে। যদি রাষ্ট্র একটি মৌলিক চিন্তার ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত হয়, তবে এটি মজবুত ভিত্তি এবং দৃঢ় কাঠামো সম্পন্ন হবে, কেননা এটি মৌলিক ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত। এর কারণ হচ্ছে মৌলিক চিন্তা এমন একটি চিন্তা যা অন্য কোন চিন্তা হতে উদ্ভূত নয়, বরং এটা নিজেই একটি বুদ্ধিবৃত্তিক আক্বীদাহ। ফলে এক্ষেত্রে বলা যাবে যে, রাষ্ট্র একটি বুদ্ধিবৃত্তিক আক্বীদাহ’র উপর প্রতিষ্ঠিত। অন্যদিকে, রাষ্ট্র যদি কোন মৌলিক চিন্তার উপর ভিত্তি করে গড়ে না উঠে, তবে খুব সহজেই এর পতন সাধিত হবে এবং এর কর্তৃত্ব ও অস্তিত্ব উপড়ে ফেলা খুব কঠিন কিছু হবেনা। কারণ এটি কোন বুদ্ধিবৃত্তিক আক্বীদাহ’র উপর প্রতিষ্ঠিত হয়নি। তাই রাষ্ট্রের শক্তিশালী উপস্থিতির জন্য প্রয়োজন একটি বুদ্ধিবৃত্তিক আক্বীদাহ’র উপর ভিত্তি করে একে প্রতিষ্ঠিত করা, যে আক্বীদাহ হতে রাষ্ট্র সম্পর্কিত অন্যান্য চিন্তাসমূহ উৎসারিত হবে। অর্থাৎ এটি এমন একটি বুদ্ধিবৃত্তিক আক্বীদাহ, যা হতে জীবন সম্পর্কে রাষ্ট্রের দৃষ্টিভঙ্গী প্রতিফলিত হয় এমন একগুচ্ছ চিন্তা, মাপকাঠি এবং দৃঢ়বিশ্বাসের উন্মেষ ঘটবে, এবং যার ধারাবাহিকতায় জীবনের প্রতি রাষ্ট্রের একটি নির্দিষ্ট দৃষ্টিভঙ্গী জন্ম নিবে, যা জনস্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিষয়সমূহের মানদন্ড নির্ধারণ করবে।
শুধুমাত্র ইসলামী আক্বীদাহ’র উপর ভিত্তি করেই ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হয়, কেননা যে চিন্তা, মাপকাঠি এবং দৃঢ়বিশ্বাস উম্মাহ (মুসলিমদের সমষ্টি) নিজের মাঝে ধারণ করেছে সেগুলো একটি বুদ্ধিবৃত্তিক আক্বীদাহ হতে উৎসারিত। প্রথমত, উম্মাহ এ আক্বীদাহ’কে গ্রহণ করেছে এবং সুস্পষ্ট প্রমাণের ভিত্তিতে এটিকেই একমাত্র সত্য আক্বীদাহ হিসেবে আলিঙ্গন করেছে। তাই, এ আক্বীদাহ হতেই সে (উম্মাহ) জীবন সম্পর্কে সামগ্রিক চিন্তা গ্রহণ করেছে, এবং এরই ভিত্তিতে জীবন সম্পর্কে তার দৃষ্টিভঙ্গী গড়ে উঠেছে এবং ঐ সমস্ত বিষয়কে অগ্রাধিকার প্রদান করেছে যাকে এই আক্বীদাহ অগ্রাধিকার প্রদান করেছে। এ আক্বীদাহ হতে উৎসারিত জীবন সম্পর্কিত বিভিন্ন চিন্তা, মাপকাঠি এবং দৃঢ়বিশ্বাসসমূহকেও উম্মাহ গ্রহণ করেছে। আর তাই ইসলামী আক্বীদাহ ইসলামী রাষ্ট্রের ভিত্তি।
উপরন্তু রাসূল (সা) একটি নির্দিষ্ট ভিত্তির উপর ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন, তাই সকল যুগে, সকল স্থানের জন্যই ইসলামী রাষ্ট্র এই ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত হতে হবে। আহকাম সম্পর্কিত আয়াত নাযিল না হওয়া সত্ত্বেও, মদীনার কর্তৃত্ব গ্রহণের প্রথম দিন থেকেই রাসূল (সা) একে ইসলামী আক্বীদাহ’র উপর ভিত্তি করেই প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন। অতঃপর রাসূলুল্লাহ (সা) মুসলিমদের জীবনধারণ, পারস্পরিক সম্পর্কের বিষয়াদি, বিভিন্ন দূর্দশা অপসারণ এবং পারস্পরিক বিবাদ বিসম্বাদ নিরসণের ভিত্তি হিসেবে ‘আল্লাহ ছাড়া কোন ইলাহ নেই এবং মুহাম্মদ (সা) আল্লাহ’র প্রেরিত রাসূল’ এই সাক্ষ্যকে মানদন্ড হিসেবে প্রতিস্থপন করেন। অন্য কথায়, জীবনের সকল বিষয়, সরকারব্যবস্থা, এবং শাসন কর্তৃত্বের ভিত্তি হিসেবে একে গ্রহণ করা হয়। তিনি (সা) এখানেই ক্ষান্ত হননি, বরং আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা জিহাদের আহকাম নাযিলের মাধ্যমে এই আক্বীদাহ-কে অন্য জাতির মাঝে ছড়িয়ে দিতে বাধ্যবাধকতা আরোপ করেছেন। আবু হুরায়রা (রা.) হতে আবু দাউদ বর্ণনা করেন, রাসূল (সা) বলেছেন: “আমি (আল্লাহ’র পক্ষ থেকে) আদিষ্ট হয়েছি যেন মানুষের সাথে যুদ্ধ করতে থাকি যতক্ষণ না তারা ‘আল্লাহ ছাড়া কোন ইলাহ নেই এবং আমি মুহাম্মদ (সা) আল্লাহ’র প্রেরিত রাসূল’ এ কথার স্বীকৃতি দেয়। যদি তারা তা করে, তবে তাদের জীবন ও সম্পদ আমার কাছ থেকে নিরাপদ, তবে যেটা আল্লাহ’র আইন (অর্থাৎ শারীআহ লঙঘনে প্রাপ্য শাস্তি) তা ব্যতীত। আর তাদের হিসাব নিকাশ আল্লাহ’র কাছে।” [মুত্তাফাকুন আলাইহি; বুখারী হতে বর্ণিত]
এছাড়াও, রাসূল (সা) রাষ্ট্রের ভিত্তি হিসেবে আক্বীদাহ’র সার্বক্ষণিক উপস্থিতির বিষয়টি নিশ্চিত করতে মুসলিমদের উপর বাধ্যবাধকতা আরোপ করেছেন। তিনি মুসলিমদেরকে তলোয়ার শাণিত করার নির্দেশ প্রদান করেছেন, যাতে করে শাসন¶মতায় কুফর স্পষ্টভাবে প্রতীয়মান হলে অর্থাৎ কর্তৃত্ব এবং আইনের উৎস হতে যদি আক্বীদাহ অপসারিত হয়ে পড়ে, তবে যেন তার বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়া যায়। রাসূল (সাঃ)-এর উক্তি “সবচেয়ে নিকৃষ্ট শাসক” তথা যালিম শাসকদের ব্যাপারে সাহাবাগণ (রা.) জিজ্ঞাসা করেছিলেন, “আমরা কি তাদের বিরুদ্ধে তলোয়ার উত্তোলন করবো না?” তিনি (সাঃ) উত্তর দিলেন, “না, যত¶ন পর্যন্ত তারা তোমাদের মধ্যে সালাত কায়েম রাখে।” [মুসলিম]; তিনি শাসকের প্রতি জনগণের আনুগত্যের বিষয়টি অর্থাৎ বাই’য়াতের (শাসকের প্রতি আনুগত্যের শপথ) বৈধতা সম্পর্কিত করেছেন ততক্ষণ পর্যন্ত, যতক্ষণ না শাসক হতে সুস্পষ্ট কুফর পরিলক্ষিত হয়। নিকৃষ্ট শাসকদের ব্যাপারে আউফ বিন মালিক (রা.)-এর বর্ণনা হতে পাওয়া যায়, “রাসূল (সা)-কে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল, “হে আল্লাহ’র রাসূল (সাঃ) আমরা কি তাদের বিরুদ্ধে তলোয়ার উত্তোলন করব না?” তিনি (সা) উত্তর দিলেন, “না, যতক্ষণ পর্যন্ত তারা সালাত কায়েম রাখে।” [মুসলিম]; বাইয়াত বিষয়ে উবাদা বিন আস সামিত (রা)-এর বর্ণনা হতে পাওয়া যায়, “… এবং আমরা কর্তৃত্বশীলদের সাথে বিবাদে লিপ্ত হবো না যতক্ষণ পর্যন্ত না কুফরের চিহ্ন পরিলক্ষিত হয়”, এবং তাবারানীর বর্ণনায় শব্দগুলো এভাবে এসেছে, “সুস্পষ্ট কুফর”। ইবনে হিব্বানের সহীহ বর্ণনায় বলা হয়েছে, “যতক্ষণ পর্যন্ত না আল্লাহ’র প্রতি অবাধ্যতা সুস্পষ্ট হয়”। এই সবকিছু হতে এটাই প্রতীয়মান হয় যে, রাষ্ট্রের ভিত্তি হতে হবে ইসলামী আক্বীদাহ। যেহেতু, রাসূল (সা) নিজে এর উপর ভিত্তি করে রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন, এবং এর সুরক্ষায় তলোয়ার শাণিত করার নির্দেশ দিয়েছিলেন এবং এর প্রসারে জিহাদের নির্দেশ প্রদান করেছিলেন।
পূর্বে বর্ণিত নীতিমালার অনুসরণে খসড়া সংবিধানের প্রথম ধারাটি প্রণয়ন করা হয়েছে। এ ধারাটি রাষ্ট্রকে এমন কোন চিন্তা, দৃঢ়বিশ্বাস কিংবা মাপকাঠিকে রাষ্ট্রের ভিত্তি হিসেবে গ্রহণ করতে নিষেধ করেছে, যা ইসলামী আক্বীদাহ হতে উৎসারিত নয়। শুধুমাত্র আনুষ্ঠানিকভাবে ইসলামী আক্বীদাহ’কে রাষ্ট্রের ভিত্তি হিসেবে গ্রহণ করলেই চলবেনা, বরং রাষ্ট্রের যেকোন গুরুত্বপূর্ণ কিংবা গুরুত্বহীন বিষয়াদির ক্ষেত্রেও আক্বীদাহ’র প্রতিফলন থাকতে হবে। তাই, রাষ্ট্রের পক্ষে জীবন বা শাসন সম্পর্কিত এমন কোন মতবাদ গ্রহণ নিষিদ্ধ যা ইসলামী আক্বীদাহ হতে উদ্ভূত নয়, কিংবা যার উদ্ভব ঘটেছে ইসলামী আক্বীদাহ’র সাথে সাংঘর্ষিক অন্য কোন আক্বীদাহ হতে। ইসলামী আক্বীদাহ হতে উদ্ভূত নয়, এমন যেকোন মতবাদ ইসলামী রাষ্ট্র প্রত্যাখ্যান করবে। সে কারণে, ইসলামী রাষ্ট্র, গণতন্ত্রকে মেনে নিবে না, যেহেতু এটি ইসলামী আক্বীদা হতে উদ্ভূত হয়নি এবং এই আক্বীদাহ হতে উদ্ভূত অন্যান্য চিন্তার সাথে সাংঘর্ষিক। একইভাবে, ইসলামী রাষ্ট্র জাতীয়তাবাদ গ্রহণ করবেনা কারণ এটি ইসলামী আক্বীদাহ হতে আসেনি, বরং ইসলামী আক্বিদাহ হতে উৎসারিত চিন্তাসমূহ একে প্রত্যাখ্যান করেছে, এর অনুমোদন নিষিদ্ধ করেছে এবং এর বিপজ্জনক পরিণতি বিস্তারিতভাবে উল্লেখ করেছে। একইভাবে, দেশপ্রেমের মত চিন্তারও কোন অস্তিত্ব থাকবেনা, যা ইসলামী আক্বীদাহ হতে উদ্ভূত নয় এবং এর সাথে সাংঘর্ষিক। একইভাবে ইসলামী রাষ্ট্রের শাসন কাঠামোতে গণতন্ত্রের অনুকরণে কোন মন্ত্রী পরিষদ থাকবেনা, এবং এই রাষ্ট্র ব্যবস্হা, সাম্রাজ্যবাদী, রাজতান্ত্রিক কিংবা প্রজাতান্ত্রিক কোন মতবাদের উপর ভিত্তি করেও গড়ে উঠবেনা। কেননা এগুলোর কোনটাই ইসলামী আক্বীদাহ হতে উদ্ভূত নয়, বরং এর সাথে সাংঘর্ষিক। উপরন্তু, ইসলামী আক্বীদাহ বহির্ভূত কোন মতবাদের ভিত্তিতে রাষ্ট্রকে জবাবদিহিতার সম্মুখীন করা যেকোন ব্যক্তি, দল বা আন্দোলনের জন্য নিষিদ্ধ। তাই, এই ধরনের যেকোন জবাবদিহিতা নিষিদ্ধ এবং অনুরূপভাবে ইসলামী আক্বীদাহ বহির্ভূত মতবাদের ভিত্তিতে কোন দল বা আন্দোলন গড়ে উঠাও নিষিদ্ধ। বাস্তবতা হচ্ছে ইসলামী আক্বীদাহ রাষ্ট্রের ভিত্তি হিসেবে কাজ করে, যা রাষ্ট্র এবং নাগরিকদের আবদ্ধ রাখে। কারণ, এর রাষ্ট্রীয় সত্ত্বা এবং পাশাপাশি তা হতে উৎসারিত হিসেবে জীবনের সকল বিষয়, এবং রাষ্ট্রীয় সত্ত্বা হিসেবে এর সম্পর্কিত সকল কর্মকান্ড, এবং রাষ্ট্রীয় সত্ত্বা হিসেবে এর বিভিন্ন সম্পর্কের একমাত্র ভিত্তি হতে হবে এর আক্বীদাহ, অর্থাৎ ইসলামী আক্বীদাহ।
ধারার ২য় অংশ এ সত্য হতে গৃহীত যে, সংবিধানই হচ্ছে রাষ্ট্রের মৌলিক নীতিমালা (কানুন আল আসাসি), এভাবে এটি নিজেই একটি আইন, আর আইন হচ্ছে কর্তৃপক্ষের জারিকৃত বিধান। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা যা কিছু তাঁর রাসূল (সা)-এর উপর নাযিল করেছেন, তা দ্বারা শাসনকার্য পরিচালনা করতে শাসককে নির্দেশ দিয়েছেন এবং তিনি ঐ সমস্ত শাসককে কাফির আখ্যায়িত করেছেন, যারা আল্লাহ’র নাযিলকৃত বিধানকে অপরিপূর্ণ, অযোগ্য মনে করে এবং নিজের বিধানকে উপযুক্ত মনে করে। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা ঐ সকল শাসককে ‘আসি’ (অবাধ্য) হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন, যারা আল্লাহ’র বিধানের পরিবর্তে অন্য বিধান দ্বারা শাসনকার্য পরিচালনা করে, কিন্তু ঐ বিধানকে উপযুক্ত মনে করে না। এ থেকে এটি সুস্পষ্টভাবে প্রতীয়মান হয় যে, শাসকের জারিকৃত বিধান, তথা যেকোন আইন এবং সংবিধান অবশ্যই আল্লাহ এবং তাঁর রাসূল (সা)-এর প্রতি পূর্ণাঙ্গ বিশ্বাসের ভিত্তিতেই হতে হবে। আল্লাহ’র কিতাব এবং তাঁর রাসূল (সা)-এর সুন্নাহ হতে শাসককে শারী’আহ আইন দ্বারা শাসনকার্য পরিচালনার নির্দেশ সুস্পষ্ট। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা বলেন:
فَلاَ وَرَبِّكَ لاَ يُؤْمِنُونَ حَتَّى يُحَكِّمُوكَ فِيمَا شَجَرَ بَيْنَهُمْ
“কিন্তু না, তোমার রব-এর শপথ! তারা ততক্ষণ পর্যন্ত ঈমানদার হতে পারবেনা, যতক্ষণ তাদের বিবাদ-বিসম্বাদের বিচার ভার তোমার উপর ন্যস্ত না করে। ” [সূরা আন-নিসা: ৬৫] এবং
وَأَنْ احْكُمْ بَيْنَهُمْ بِمَا أَنزَلَ اللَّهُ
“আপনি তাদের পারস্পরিক ব্যাপারাদিতে আল্লাহ যা নাযিল করেছেন তদনুযায়ী ফায়সালা করুন। ” [সূরা আল-মা’য়েদাহ: ৪৯]
আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা তাঁর নাযিলকৃত বিধান বহির্ভূত অন্য কোন আইন দ্বারা শাসনকার্য পরিচালনার ব্যাপারে সতর্ক করার মাধ্যমে রাষ্ট্রের আইন প্রণয়ণের ক্ষমতাকে তাঁর বিধানের মধ্যেই সীমাবদ্ধ করে দিয়েছেন। তিনি (সুবহানাহু ওয়া তা’আলা) বলেন:
وَمَنْ لَمْ يَحْكُمْ بِمَا أَنزَلَ اللَّهُ فَأُوْلَئِكَ هُمْ الْكَافِرُونَ
“যারা আল্লাহ যা নাযিল করেছেন তদনুযায়ী শাসন করেনা, তারা কাফির। ” [সূরা আল-মা’য়েদাহ: ৪৪]
এ ছাড়াও রাসূলুল্লাহ (সা) বলেছেন, “যে ব্যক্তি আমাদের এই দ্বীনের মধ্যে এমন নতুন কিছু প্রবর্তন করে, যা তার অন্তর্ভুক্ত নয়, তা প্রত্যাখ্যাত। ” [বুখারী]; সহীহ মুসলিমের বর্ণনায় এসেছে: “এমন কিছু যা আমাদের দ্বীনের নির্দেশ বহির্ভূত”, এবং ইবনে হাজমের আল-মুহাল্লা এবং ইবনে আবদ আল-বার-এর আল-তামহীদ-এর বর্ণনায় এসেছে: “এমন প্রত্যেকটি কাজ যা আমাদের নির্দেশের ভিত্তিতে নয়, তা প্রত্যাখ্যাত। ” এগুলো থেকে এই ইঙ্গিত পাওয়া যায় যে, ইসলামী রাষ্ট্রের আইন অবশ্যই ইসলামী আক্বীদাহ হতে উদ্ভূত হতে হবে; এগুলোই হচ্ছে শারী’আহ আইন, যা আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা তাঁর রাসূল-এর উপর নাযিল করেছেন বলে আমরা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি, হোক এই নাযিলকৃত বাণীর অর্থ পরিষ্কারভাবে বর্ণিত (explicit); যেগুলোকে কুর’আন, সুন্নাহ এবং সাহাবী (রা.)-দের ইজমা-এর মধ্যে প্রতিফলিত আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা প্রদত্ত হুকুম হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে; অথবা হোক এই নাযিলকৃত বাণীর অর্থ পরোক্ষভাবে বর্ণিত (implicit); যেগুলোকে শারী’আহ প্রদত্ত ইল্লাহ (reason)-এর সাথে কিয়াস করে পাওয়া যায় এবং এগুলোকে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা প্রদত্ত হুকুমের ইঙ্গিত বহনকারী হুকুম হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে। এজন্যই ধারাটির ২য় অংশকে খসড়ায় স্থান দেয়া হয়েছে।
সেইসাথে, বান্দার যেকোন কাজ যেহেতু তাঁর (সুবহানাহু ওয়া তা’আলা) নির্দেশে পরিচালিত হতে বাধ্য, তাই তাদের বিভিন্ন বিষয়ের ব্যবস্থাপনাও আল্লাহ’র নির্দেশ অনুযায়ী পরিচালিত হতে বাধ্য। ইসলামী শারী’আহ নাযিল করা হয়েছে মানুষের সকল সম্পর্ক পরিচালনা করার জন্য, এ সম্পর্ক হতে পারে স্রষ্টার সাথে ব্যক্তির সম্পর্ক, ব্যক্তির নিজের সাথে নিজের সম্পর্ক কিংবা ব্যক্তির সাথে সমাজের সম্পর্ক। শারী’আহ আইনের বাধ্যবাধকতার দরুণ, নিজেদের বিষয়াদি যথেচ্ছভাবে পরিচালনা করার কোন সুযোগ ইসলামে নেই। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা বলেন:
وَمَا آتَاكُمْ الرَّسُولُ فَخُذُوهُ وَمَا نَهَاكُمْ عَنْهُ فَانْتَهُوا
“…রাসূল তোমাদেরকে যা আদেশ করেন, তা গ্রহণ করো এবং যা নিষেধ করেন, তা থেকে বিরত থাকো।” [সূরা আল-হাশর: ৭]
তিনি (সুবহানাহু ওয়া তা’আলা) আরও বলেন:
وَمَا كَانَ لِمُؤْمِنٍ وَلاَ مُؤْمِنَةٍ إِذَا قَضَى اللَّهُ وَرَسُولُهُ أَمْرًا أَنْ يَكُونَ لَهُمْ الْخِيَرَةُ مِنْ أَمْرِهِمْ
“আল্লাহ ও তাঁর রাসূল যখন কোন বিষয়ে নির্দেশ প্রদান করেন তখন কোন মু’মিন পূরুষ কিংবা মু’মিনা নারীর সে বিষয়ে ভিন্ন সিদ্ধান্ত গ্রহণের কোন অধিকার থাকবে না। ” [সূরা আল-আহযাব: ৩৬]
রাসূল (সা) বলেছেন: “নিশ্চয়ই আল্লাহ কিছু বিষয়কে ফরয (অবশ্যই পালনীয়) করেছেন, সুতরাং সেগুলোকে অবহেলা করো না; এবং তিনি (সুবহানাহু ওয়া তা’আলা) কিছু বিষয়কে হারাম (অবশ্যই বর্জনীয়), সুতরাং সেগুলো লংঘন করো না।” (আবি ছা’লাবাহ হতে আল-দারাকুতনি কতৃক সংকলিত, এবং আল-নববী তার আল-রিয়াদ আল-সালিহিন-এ এটাকে হাসান হিসেবে নিশ্চিত করেছেন)। তিনি (সা) আরও বলেছেন: “যে ব্যক্তি আমাদের এই দ্বীনের (ইসলাম) মধ্যে এমন নতুন কিছু প্রবর্তন করে, যা তার অন্তর্ভুক্ত নয়, তা প্রত্যাখ্যাত। ” [মুত্তাফাকুন আলাইহি; আয়েশা (রা.) হতে মুসলিম কর্তৃক বর্ণিত]
সুতরাং, এটা সুনিশ্চিত যে, শাসক নয়, বরং আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা-ই হচ্ছেন আইন প্রণয়নকারী। তিনিই সেই সত্ত্বা, যিনি জনগণ এবং শাসককে তাদের পারস্পরিক সম্পর্ক এবং কর্মকান্ডে তাঁর বিধান মেনে চলতে বাধ্য করেছেন, তাঁর বিধান দ্বারা নিয়ন্ত্রণ করেছেন এবং অন্য যেকোন বিধান অনুসরণে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছেন। এ কারণে, জনগণের বিষয়াদি পরিচালনার ক্ষেত্রে মানবরচিত বিধানের কোন গ্রহণযোগ্যতা নেই এবং শাসক কর্তৃক মানবরচিত বিধান পালনে জনগণকে বাধ্য করারও কোন সুযোগ নেই।
পরবর্তী ধারা