আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা বলেন,
إِنَّمَا يَخْشَى اللَّهَ مِنْ عِبَادِهِ الْعُلَمَاءُ إِنَّ اللَّهَ عَزِيزٌ غَفُورٌ
“নিশ্চয়ই তাঁর বান্দাদের আলেমগণই আল্লাহকে সত্যিকার অর্থে ভয় করে। নিশ্চয়ই আল্লাহ শক্তিশালি ও ক্ষমাশীল“।
[আল-ফাতির: ২৮]
এ আয়াতের ব্যাপারে ইবন কাছীর বলেন,
(كلما كانت المعرفة به أتمّ والعلم به أكمل، كانت الخشية له أعظم وأكثر)
“আল্লাহ ও তাঁর ক্ষমতার ব্যাপারে জ্ঞান যত বেশি পূর্ণ হবে তত বেশি তাকে বেশি ভয় করবে তারা যারা এই পুর্নাঙ্গ জ্ঞান ধারণ করে”।
ইমাম কুরতুবি বলেন,
(فَمَنْ عَلِمَ أَنَّهُ عَزَّ وَجَلَّ قَدِيرٌ أَيْقَنَ بِمُعَاقَبَتِهِ عَلَى الْمَعْصِيَةِ)
“আলেম তারাই যারা আল্লাহর ক্ষমতার ব্যাপার জ্ঞান রাখেন। তারা আল্লাহর শাস্তির ব্যাপারে কোনো সন্দেহের মধ্যে নেই (তা বান্দার অপরাধ যা-ই হোক না কেন)”।
আলী ইবন আবি তালহা ইবন আব্বাসের বরাত দিয়ে বলেন,
(الَّذِينَ عَلِمُوا أَنَّ اللَّهَ على كل شي قَدِيرٌ)
“আলেমগণ তারাই যারা জানেন যে আল্লাহ যেকোনো কিছু করার ক্ষমতা রাখেন”।
আল-রাবি’ বর্ণনা করেন যে ইবন আব্বাস বলেন,
(مَنْ لَمْ يَخْشَ اللَّهَ تَعَالَى فَلَيْسَ بِعَالِمٍ)
“যে আল্লাহ (ও তার শাস্তি)-কে ভয় করেনা সে আলেমই নয়”।
আলী ইবন আবি তালিব (রা) বলেন,
إِنَّ الْفَقِيهَ حق الفقيه من لم يقنط النَّاسَ مِنْ رَحْمَةِ اللَّهِ، وَلَمْ يُرَخِّصْ لَهُمْ فِي مَعَاصِي اللَّهِ تَعَالَى، وَلَمْ يُؤَمِّنْهُمْ مِنْ عَذَابِ اللَّهِ، وَلَمْ يَدَعِ الْقُرْآنَ رَغْبَةً عَنْهُ إِلَى غَيْرِهِ، إِنَّهُ لَا خَيْرَ فِي عِبَادَةٍ لَا عِلْمَ فِيهَا، وَلَا عِلْمَ لَا فِقْهَ فِيهِ، وَلَا قِرَاءَةَ لَا تَدَبُّرَ فِيهَا
সত্যিকারের ফকীহ সে-ই যে কখনো মানুষকে হাল ছেড়ে দিতে দেয় না কিংবা আল্লাহর রহমত হতে নিরাশ হতে দেয় না; আল্লাহর অবাধ্যতাকে তুচ্ছ করে দেখেনা; মানুষ আল্লাহর শাস্তির ব্যাপারে নিরাপদ হয়ে গিয়েছে- এ ধরনের অনুভুতি দেয় না; বিচার করার ক্ষেত্রে ইচ্ছাকৃতভাবে কুরআনকে পরিত্যাগ করে না। ইবাদত জ্ঞানভিত্তিক না হলে তা মুল্যহীন, এবং জ্ঞান তার প্রকৃত বুঝ ছাড়া (জেনে রাখা) মুল্যহীন। এবং উপলব্ধি বিহীন তেলাওয়াত এর (প্রকৃতার্থে) কোনো মুল্য নেই”।
আর আল্লাহ শক্তিশালি.. অর্থাৎ, যিনি শাস্তি দেন ও পুরস্কার প্রদান করেন তাকে ভয় করে চলা উচিত।
ইসলামি জ্ঞানের পরিমান ব্যাক্তি হতে ব্যাক্তিতে ভিন্ন হয়ে থাকে। তাই কিছু মানুষ অন্যদের তুলনায় অধিক জ্ঞানী হবেন এবং তারা যাদের জ্ঞান সল্প তাদের শিক্ষা দান করবেন। ইসলামি আইন-কানুনের ব্যাপারে যাদের গভীর জ্ঞান রয়েছে তারাই উলামা হিসেবে পরিচিত। তারা ইসলামে কোনো আধ্যাত্মিক পদে অধিষ্ঠিত নন, তবে তাদের জ্ঞানের আধিক্যের কারণে তাদের অধিক দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। তারাই উম্মাহকে দ্বীন শিক্ষা দিয়ে থাকেন, ইসলামের গুরুত্ব বোঝার ব্যাপারে ও তার ভিত্তিতে জীবনের বিভিন্ন সমস্যা সমাধানের জন্য উম্মাহর সদস্যদের পথ খুজে পাবার ব্যাপারে তারা সহায়তা করে থাকেন। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা পরিষ্কার করে বলেছেন যে আলেমগণকে তাঁর নাযিলকৃত বিধান মানুষের মাঝে প্রকাশ্যে বর্ণনা করতে হবে।
وَإِذْ أَخَذَ اللَّهُ مِيثَاقَ الَّذِينَ أُوتُوا الْكِتَابَ لَتُبَيِّنُنَّهُ لِلنَّاسِ وَلَا تَكْتُمُونَهُ
“আর যারা পূর্বে কিতাব পেয়েছিল তাদের হতে আল্লাহ অঙ্গীকার নিয়েছিলেন যে তারা মানুষকে তা ব্যাখ্যা করে জানাবে এবং তা গোপন করবে না“। [আলে ইমরান: ১৮৭]
তিনি সুবহানাহু ওয়া তা’আলা আমাদের জ্ঞান লুকিয়ে রাখার ব্যাপারে সাবধান করেছেন যা তিনি আমাদের আমানতসরূপ দিয়েছেন। তিনি সুবহানাহু ওয়া তা’আলা বলেন,
إِنَّ الَّذِينَ يَكْتُمُونَ مَا أَنْزَلْنَا مِنَ الْبَيِّنَاتِ وَالْهُدَى مِنْ بَعْدِ مَا بَيَّنَّاهُ لِلنَّاسِ فِي الْكِتَابِ أُولَئِكَ يَلْعَنُهُمُ اللَّهُ وَيَلْعَنُهُمُ اللَّاعِنُونَ
“নিশ্চয় যারা গোপন করে, আমি যেসব বিস্তারিত তথ্য এবং হেদায়েতের কথা নাযিল করেছি (তা) মানুষের জন্য কিতাবের মধ্যে বিস্তারিত বর্ণনা করার পরও; সে সমস্ত লোকের প্রতিই আল্লাহর অভিসম্পাত এবং অন্যান্য অভিসম্পাতকারীগণেরও“।
[বাকারা ২:১৫৯]
আল্লাহর রাসূল আমাদের আলেমদের সম্মান ও গুরুত্ব সম্পর্কে অবহিত করেছেন যখন তিনি (সা) বলেন,
(مَنْ يُرِدْ اللَّهُ بِهِ خَيْرًا يُفَقِّهْهُ فِي الدِّينِ)
“যার জন্য আল্লাহ কল্যাণ কামনা করেন তাকে তিনি দ্বীনের গভীর জ্ঞান দান করেন“। [বুখারি]
তিনি (সা) বলেন,
إِنَّ مَثَلَ الْعُلَمَاءِ فِي الْأَرْضِ كَمَثَلِ النُّجُومِ فِي السَّمَاءِ يُهْتَدَى بِهَا فِي ظُلُمَاتِ الْبَرِّ وَالْبَحْرِ فَإِذَا انْطَمَسَتْ النُّجُومُ أَوْشَكَ أَنْ تَضِلَّ الْهُدَاةُ
“দুনিয়ায় আলেমগণের তুলনা আকাশের তারকারাজির মতো। অন্ধকারে তা দ্বারা জলে ও স্থলে পথপ্রাপ্তি হয়। যদি তারকারাজি অস্ত যায়, তবে (মানুষের) পথপ্রদর্শক (তথা সঠিক পথের দিশা) হারিয়ে ফেলার উপক্রম হবে“। [আহমদ]
সুতরাং, আল্লাহর রাসূলের এসব হাদীস হতে আমরা বুঝতে পারি যে উম্মাহকে পথ দেখাতে ও দ্বীনের অগ্রগতির জন্য আলেমদের ভুমিকা কতটা গুরুত্বপূর্ণ। বর্তমান সময়ে তাদেরকে অত্যন্ত প্রয়োজন যাতে তারা উম্মাহকে পথ দেখাতে পারে যে কিভাবে ইসলাম প্রতিষ্ঠা করতে হবে, কিভাবে উম্মাহকে একটি দেহের মতো ঐক্যবদ্ধ করতে হবে, কিভাবে বিশ্বমঞ্চের নিয়ন্ত্রন নিতে হবে। আলেমগণকেই যালেম শাসকের বিরুদ্ধে উম্মাহর পক্ষে নেতৃত্ব নিতে হবে, সেসব যালেমদের বিরুদ্ধে যারা শুধুমাত্র কুফর শাসন কায়েম করে ক্ষান্ত হয়নি, বরং উম্মাহকে সাম্রাজ্যবাদী প্রভুদের দাসত্বের শৃংখলে আবদ্ধ রাখতে সচেষ্ট, এবং এজন্য উম্মাহর যেসব সন্তানদের জেলে পুড়ছে, অত্যাচার ও হত্যা করছে যারা ইসলাম অনুযায়ী সমাজে জীবনধারণ করতে চায়। অতীতে ইসলামের আলেমগণ নেতৃত্বস্থানীয় ভুমিকা রেখেছেন। তারা সর্বদাই অন্য সকল স্বার্থের বিপরীতে ইসলাম ও মুসলিম উম্মাহর স্বার্থের পক্ষে শক্তিশালি অবস্থান গ্রহণ করেছেন, কখনো কখনো তাদের জীবনবিপন্ন করে হলেও। তারা আল্লাহ ছাড়া আর কাউকে ভয় করেননি, তাই ইসলামের ব্যাপারে কোনোরূপ আপোষ ছাড়াই সবসময় সত্য উচ্চারন করেছেন। বিশেষ করে শাসক ও তাদের কার্যাবলীর ব্যাপারে তারা এ কাজ গুরুত্ব সহকারে করেছেন।
মুহাম্মাদ (সা) বলেন, যে-ই কোনো যালেম শাসককে আল্লাহর হুকুম লংঘন, তাঁর সাথে কৃত চুক্তি ভংগ, সুন্নাহর সাথে দ্বিমত পোষন, পাপকাজ এবং আল্লাহর বান্দাদের সাথে শত্রুতা করতে দেখে, এবং সে সে ব্যাপারে কিছু বলে বা করে না, তবে এটি আল্লাহর দায়িত্ব তাকে সেখানে (জাহান্নামে) পৌছিয়ে দেয়া যেখানে তার থাকার কথা। [তারীখ আত-তাবারি, আল-কামিল লি-ইবন আছীর]
মুহাম্মাদ (সা) বলেন,
سَتَكُونُ بَعْدِي أُمَرَاءُ مَنْ صَدَّقَهُمْ بِكَذِبِهِمْ وَأَعَانَهُمْ عَلَى ظُلْمِهِمْ فَلَيْسَ مِنِّي وَلَسْتُ مِنْهُ وَلَيْسَ بِوَارِدٍ عَلَيَّ الْحَوْضَ
“আমার পরে অচিরেই (যালেম) শাসকেরা আসবে যারা (তাদের জনগণকে দুর্দশায় পতিত করবে)। যে-ই তাদের মিথ্যাকে সমর্থন করবে এবং যুলুমে তাদের সাহায্য করবে, সে আমার মধ্য হতে না এবং আমি তার মধ্য হতে নই এবং সে হাউজে কাওসারে আমার কাছে (পানি পান করতে) আসতে পারবে না”। [আহমদ, নাসাঈ, তিরমিজি]
শাসকদের জবাবদিহী করার ক্ষেত্রে যে আলেমগণ চুপ থাকেননি বরং ইসলামের পক্ষে দৃঢ় অবস্থান নিয়েছেন তার কিছু উদাহরণ নিম্নে তুলে ধরা হলো।
সুফিয়ান আছ-ছাওরী বলেন, “যখন (খলীফা) আবু জা’ফর আল মানসূর হজ করতে আসলে আমাকে ডেকে পাঠান। তার পেয়াদাগণ রাতের বেলা আমার ঘরে এসে খুঁজে আমাকে ধরে নিয়ে যায়। যখন আমি তার সামনে উপস্থিত হই তখন তিনি আমাকে তার কাছে বসান। তিনি বলেন, কেন আপনি আমাদের কাছে থাকেন না যাতে আমরা আপনার সাথে আমাদের (রাষ্ট্রীয়) কাজের ব্যাপারে পরামর্শ করতে পারি? আপনি যা বলবেন আমরা তা-ই করবো। আমি (সুফিয়ান) বললাম, (كم أنفقت في سفرك هذا؟) আপনি আপনার এ (হজের) সফরে কত অর্থ ব্যয় করেছেন? আল-মানসূর বললেন, (لا أدري، لي أمناء ووكلاء) আমার জানা নেই, (তবে) এ ব্যাপারে আমার (নিযুক্ত) বিশ্বাসযোগ্য সহকারী রয়েছে। আমি বললাম, (فما عذرك غدًا، إذا وقفت بين يدي الله تعالى فسألك عن ذلك؟) কিয়ামতের দিন যখন আল্লাহর সামনে দাড়াবেন তখন আপনার কৈফিয়ত কী হবে, যদি আল্লাহ এ বিষয়ে আপনাকে প্রশ্ন করেন? এরপর তিনি উমর (রা)-এর উদাহরণ টেনে বলেন, উমর (রা) একবার তার খাদেমকে ডেকে জিজ্ঞেস করেন, (كم أنفقت في سفرنا هذا؟) আমাদের (হজের) সফরে কত খরচ করেছো? খাদেম বলেছিলেন, (يا أمير المؤمنين، ثمانية عشر دينارًا) হে আমীরুল মু‘মিনীন, ১৮ দিনার। উমর তাতে বলে উঠলেন, (ويحكم أجحفنا ببيت مال المسلمين) দুর্ভোগ তোমাদের! আমরা মুসলিম কোষাগার থেকে বেশি খরচ করে ফেলেছি। সুফিয়ান আরো উদ্ধৃত করে বলেন, ইবন মাসউদ বর্ণিত হাদীসে এসেছে রাসূলুল্লাহ (সা) বলেন, (رب متخوض في مال الله، ومال رسول الله فيما شاءت نفسه له النار غدًا) যে ব্যাক্তি আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের সম্পদ হতে (অমিতব্যায়ীর মতো) নিজের ইচ্ছেমতো ব্যয় করে, তার জন্য রয়েছে জাহান্নাম (অপেক্ষমান রয়েছে)। (সুফিয়ান এসব বলতে থাকলে) আল-মানসূরের এক সহকারী বলে ওঠে, (أمير المؤمنين يُستقبل بمثل هذا) আমীরুল মু‘মিনীনের সাথে এধরণের ব্যাবহার! এতে সুফিয়ান ঈমানদারের আত্মমর্যাদা ও শক্তির বলে জবাব দিলেন, (اسكت إنما أهلك فرعون هامان، وهامان فرعون) খামোশ! হামান-ই ফিরআউনকে ধ্বংস করেছিল এবং ফিরআউন হামানকে। (অর্থাৎ, যে ভুল উপদেশ দিয়েছিল সে তার মাধ্যমে অপরকে ধ্বংস করেছে আর যে উপদেশ গ্রহণ করেছে, সে তা গ্রহণ করেছে, সে সঠিক কাজ না করে, ভুল উপদেশ গ্রহণের মাধ্যমে উপদেশদাতাকেও ধ্বংস করলো)”। [সিরাজুল মুলূক, পৃষ্ঠা-৫১]
যালেম শাসক হাজ্জাজ বিন ইউসুফ ইরাকে ওয়ালি থাকাকালীন সেখানে হাতীত আয-যায়্যাত নামক একজন আলেম ছিলেন। যখন আল-হাজ্জাজ তাকে গ্রেফতার করে প্রশ্ন করে: (فما تقولي في) আমার ব্যাপারে তোমার ধারণা কী? আয-যায়্যাত জবাবে বলেন, (أقول: إنك عدو من أعداء الله في الأرض، تنتهك المحارم، وتقتل بالظنة) আমি বলি তুমি দুনিয়ায় আল্লাহর দুশমনের মধ্য হতে একজন, তুমি আল্লাহর হুকুম ভংগ করো এবং স্রেফ সন্দেহের ভিত্তিতে হত্যা করে থাকো। আল-হাজ্জাজ এরপর জিজ্ঞেস করে: (فما تقول في أمير المؤمنين) আমীরুল মু‘মিনীন (আবদুল মালিক বিন মারওয়ান) সম্পর্কে তোমার ধারণা কী? জবাবে তিনি বলেন, (انه أعظم جرما منك، وانما أنت خطيئة من خطاياه) সে তোমার চেয়েও বড় পাপী, তুমি কেবল তারই পাপের একটি অংশ। এরপর হাজ্জাজ তাকে নিপীড়ন করার হুকুম দেয়। তারা বাঁশের খুটি তার মাংসের মধ্যে গেথে দেয় এবং পরবর্তীতে বাঁশ চিড়তে শুরু করে ফলে আয-যায়্যাতের মাংস ছিড়ে চলে আসতে থাকে। এতে তিনি শহীদ হন। তাঁর বয়স ছিল কেবল ১৮ বছর। আল্লাহ তাঁর উপর রহম করুন।
আদ-দারিমি বর্ণিত এক বর্ণনায় এসেছে: খলীফা সুলাইমান বিন আবদিল মালিক একদা মদীনায় অবস্থান করছিলেন। সেসময় তিনি আবু হাজিম নামক তৎকালীন এক আলেমকে ডেকে পাঠান। আবু হাজিম যখন আসলেন তখন সুলাইমান জিজ্ঞেস করলেন, (ما لنا نكره الموت) আমরা মৃত্যুকে এত অপছন্দ করি কেন? আবু হাজিম বললেন, (لانكم أخربتم الآخرة وعمرتم الدنيا فكرهتم أن تنتقلوا من العمران إلى الخراب) কারণ তোমরা দুনিয়াকে নির্মান করেছ এবং আখিরাতকে ধ্বংস করেছ। তাই তোমরা নির্মান হতে ধ্বংসস্তুপে যেতে অপছন্দ করো। অতঃপর তাকে ভালো উপদেশ দেবার পর সুলাইমান তাকে জিজ্ঞাসা করেন, আমার সম্পর্কে আপনার ধারণা কী? আবু হাজিম বলেন, আমাকে জবাব দিতে বাধ্য করো না। তিনি বলেন, এটা উপদেশ, আপনার বলতে হবে। আবু হাজিম বলেন, (إن آباءك قهروا الناس بالسيف وأخذوا هذا الملك عنوة على غير مشورة من المسلمين ولا رضاهم حتى قتلوا منهم مقتلة عظيمة فقد ارتحلوا عنها فلو شعرت ما قالوه وما قيل لهم) তোমার পুর্বপুরুষগণ মুসলিমদের উপর চড়াও হয়ে তাদের মতামত ও সম্মতি ছাড়াই ক্ষমতা দখল করেছে। তারা অনেকসংখ্যক মুসলিমকে হত্যাও করেছে। তাদের আচরন ও তাদের সম্পর্কে মানুষের ধারণা আপনারতো জেনে থাকার কথা। একজন লোক বলে উঠলেন, (بئس ما قلت يا أبا حازم) আপনি খুব খারাপ কথা বললেন হে আবু হাজিম! আবু হাজিম বললেন, (كذبت إن الله أخذ ميثاق العلماء ليبيننه للناس ولا تكتمونه) আপনি মিথ্যা বললেন, (বরং) আল্লাহ আলেমদের হতে চুক্তি নিয়েছেন যে তারা (প্রকৃত জ্ঞান) মানুষকে ব্যাখ্যা করে বর্ণনা করবে এবং তা লুকায়িত রাখবে না।
ইমাম মালিক বিন আনাস বর্ণনা করেন, যাকে আল্লাহ কিছু জ্ঞান বা ফিকহ দান করেছেন, প্রত্যেক সেই মুসলিমের দায়িত্ব শাসকের মুখাপেক্ষি হওয়া, তাকে সৎকাজের আদেশ দেয়া ও অসৎকাজে নিষেধ করা। এর মাধ্যমে অন্যদের হতে আলেমগণ পৃথকভাবে চিহ্নিত হন যখন তারা শাসকের মুখাপেক্ষী হন।
এ লেখার পাঠকগণের চিন্তা করা উচিত, অতীতে যেখানে আলেমগণ যালেম কিন্তু বৈধ খলীফাদের সাথে এরূপ আচরণ করেছিলেন, সেখানে বর্তমান আলেমগণের ভুমিকা কী হওয়া উচিত? আল-যাহিছ আল-বায়ান ওয়াত-তাবঈনে বর্ণনা করেন যে রাসূলুল্লাহ (সা)-কে প্রশ্ন করা হয়েছিল, হে আল্লাহর রাসূল, কারা সবচেয়ে নিকৃষ্ট মানুষ? তিনি জবাবে বলেন, (العلماء اذا فسدوا) আলেমগণ, যদি তারা দুর্নীতিপরায়ন হয়ে পড়ে।
আলী (রা) এক বর্ণনায় বলেন, দুধরনের ব্যাক্তিকে আমি সহ্য করতে পারিনা। নির্লজ্জ আলেম ও মুর্খ আবেদ। মুর্খ আবেদ তার ইবাদত দ্বারা মানুষকে প্রতারিত করে এবং আলেম তার নির্লজ্জতা দ্বারা।
আলেমগণ যদি সত্যিকারের ইসলামি আলেম হয়ে থাকেন তবে তারা অবশ্যই তাদের নিজেদের আমলের উদাহরণের মাধ্যমে আমাদের পথ দেখাবেন, যদিওবা এতে তাদের জীবন বিপর্যয়ের মুখে পড়ে। ইমাম আহমদ ইবন হাম্বল (রহ) উপলব্ধি করেছিলেন যে আলেম হিসেবে তাঁর দায়িত্ব হচ্ছে উম্মাহকে দেখিয়ে দেয়া যে একজন মুসলিম আল্লাহ ছাড়া আর কাউকে ভয় করবে না। তিনি বলেন, (اذا سكت العالم تقية والجاهل يجهل، فمتى يظهر الحق) যদি আলেমগণ তাকিয়া অবলম্বন করে চুপ থাকেন (অর্থাৎ, নিজের সুরক্ষার জন্য জ্ঞান লুকিয়ে রাখে), আর অজ্ঞ মানুষেরা অজ্ঞতায় পড়ে থাকে, তবে সত্য কখন উন্মোচিত হবে?
(যারা জ্ঞান লুকায়িত রাখে) এ ধরণের আলেমগণ অনেককেই পথচ্যুত করেছে, বিশেষ করে যারা তাদেরকে না বুঝেই আদর্শরূপে গ্রহণ করেছে। বাস্তবতাকে অস্বীকার করে তাদের আলেমগণের কথা পুনরাবৃত্তি করতে থাকেন। এধরণের আলেমগণের মধ্যে কতক পশ্চিমাদের সাথে তাল মিলিয়ে চলার প্রচেষ্টায় ব্যস্ত, কতক হিকমতের দোহাই দিয়ে যুলুমের ব্যাপারে চুপ থাকেন এবং কতক তাদের বিভিন্ন আচার-অনুষ্ঠানের ব্যস্ততায় মগ্ন। মুসলিম বিশ্বের রাজনৈতিক ঐক্য, খিলাফত প্রতিষ্ঠা কিংবা রাষ্ট্রে শরীআহ’র পুর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন নিয়ে তাদের তেমন কথা বলতে দেখা যায় না।
ইমাম গাজ্জালি তার গ্রন্থ ইহইয়া উলূম আদ-দ্বীন এর ৭ম খণ্ডের ৭২ পৃষ্ঠায় উল্লেখ করেন, এই ছিল আলেমগণের পথ ও নীতি: সৎকাজের আদেশ করা ও অসৎকাজের নিষেধ করা। তারা শাসকদের প্রতাপের ব্যাপারে কমই সন্তপ্ত থাকতেন। তারা তাদের নিরাপত্তার জন্য আল্লাহর রহমতের উপর ভরসা করতেন এবং আল্লাহর দেয়া শাহাদাত অর্জনকে মেনে নিতেন। যখন তাদের নিয়ত বিশুদ্ধ ছিল, তাদের কথা অন্তর নম্র করতো। কিন্তু এখন লোভলালসা আলেমগণের জিহ্বাকে বেঁধে ফেলেছে এবং তাদের নিশ্চুপ করে রেখেছে। যদি তারা কথা বলেই, তবে তাদের কথা কোনো কাজকেই সহায়তা করে না এবং এভাবে তারা ব্যর্থই হবে। যদি তারা সত্য বলতো এবং জ্ঞানকে তার নির্দিষ্ট হক প্রদান করতো, তবে তারা সফল হতো। শাসকদের দুর্নীতির ফলে জনগণ দুর্নীতিপরায়ন হয় আর আলেমদের দুর্নীতির ফলে দুর্নীতিপরায়ন শাসকগণ টিকে থাকে। আর আলেমরা দুর্নীতিপরায়ন হয় সম্পদ ও ক্ষমতার লোভের দরুন।
যে-ই দুনিয়ার ভালোবাসা প্রাবল্যে ডুবে থাকবে, সে এতই ব্যস্ত হয়ে পড়বে যে সে সাধারন জনগণকে প্রশ্ন করতে পারবেনা। আর যে সাধারণ জনগণকেই প্রশ্ন করতে পারেনা, কিভাবে সে শাসক কিংবা উচ্চাসনের ব্যাক্তিবর্গকে প্রশ্ন করার যোগ্যতা ও সাহস অর্জন করবে?