“দারুল ইসলাম” হল হুকুম শর’ঈ এর এমন একটি আবশ্যিক শর্ত যেটাকে সংজ্ঞায়িত করার ক্ষেত্রে কখনই মস্তিষ্ক প্রসূত চিন্তা অথবা আবেগ প্রাধান্য পেতে পারে না। এই খিলাফাহ রাষ্ট্র দাঁড়িয়ে থাকে উম্মাহর সাথে রাষ্ট্রের প্রধানের (খলীফার) “চুক্তির” ওপর ভিত্তি করে এই শর্তে যে খলীফা হুকুম শরী’আকে ১০০ ভাগ বাস্তবায়ন করবে। ইসলামী আইনের ইতিহাসে এই “দারুল ইসলাম” কে ফুকাহারা (ফিকহ শাস্ত্রের আলেম) খিলাফাহ বা ইমামাহ বা সুলতানিয়্যাহ হিসেবে উল্লেখ করেছেন এবং কুরআন ও সুন্নাহর নুসুস (দলীল) থেকে এই রাষ্ট্রের সংজ্ঞা নির্ধারণ করেছেন। শাখা প্রশাখা নিয়ে কিছু ইখতিলাফ থাকলেও রাষ্ট্রের মুল সংজ্ঞা এবং শর্ত নিয়ে তেমন মতবিরোধ কখনই ছিল না।
আরবি ভাষায় “দার” এর বেশ কিছু শাব্দিক অর্থ আছে যেমন “বিরাম স্থান” (মাহাল্লু), “ভুমি” (বালাদ), আবাস ইত্যাদি। কিন্তু শরী’য়তের পরিভাষায় ইসলামী দার (রাষ্ট্র) হল সেই ভুমি যেখানে হুকুম শরীয়াহ পরিপূর্ণভাবে বাস্তবায়িত আছে এবং মুসলমানদের হাতেই আছে আভ্যন্তরীণ বিষয়ে এবং বহিঃশত্রুর আক্রমন থেকে “আমান” (নিরাপত্তা) এর নিশ্চয়তা। ইমাম মাওয়ার্দি (রহ) ওনার প্রসিদ্ধ বই “আল-আহকাম আল-সুলতানিয়্যা” এবং “আল-হাউই আল-কাবির” এ একটি হাদীস উল্লেখ করেছেন: “যা কিছু (মুসলিমদের রক্ত ও সম্মান) এই ইসলামী ভুমিতে (দার) এ আছে তা হারাম এবং যা কিছু (মুশরিকদের রক্ত ও সম্মান) ওই শিরকের ভুমিতে (দার) আছে তা হালাল”। সহীহ মুসলিমের একটি বর্ণনায় (# ৪২৯৪) সুলাইমান বিন বুরাইদা থকে একটি বর্ণনা আছে যে রাসূলুল্লাহ (সা) যখনি জিহাদের জন্য কোন দল প্রেরণ করতেন, তখন উনি সেটির আমীরকে বলতেন যারাই ইসলাম গ্রহণ করবে তাদেরকে “দারুল হিজরাহ” তথা ইসলামী রাষ্ট্রে দেশান্তর হওয়ার জন্য আহ্বান করতে এবং তখনি তারা সব রকমের নাগরিক সুবিধা পাবে।
হানাফি মাযহাবের প্রখ্যাত ফকীহ ইমাম আল কাসানি (রহ) লিখেছিলেন: “আমাদের ইমাম (আবু হানীফা) বলেছেন যে ৩টি ক্ষেত্রে দারুল ইসলাম দারুল কুফরে পরিণত হয় – ইসলামের পরিবর্তে কুফরি আইন যখন প্রভাবশালী হয় অথবা কাফের রাষ্ট্রের সাথে চুক্তি ছাড়াই যখন দারুল ইসলামের সীমানা থাকে অথবা মুসলিম এবং যিম্মিদের কোন নিরাপত্তা মুসলিমদের হাতে থাকে না” [বাদা’উস সানা’ই, খণ্ড ৭]
রাসূল (সা)-এর সীরাহ ভালমতো পর্যালোচনা করলে আমরা দেখতে পাই আল-‘আকাবার ঘটনায় এই দুটি শর্তের – আমান (নিরাপত্তা) এবং শরী’য়াহ বাস্তবায়নে আনুগত্য – ওপর আনসারদের কাছ থেকে রাসূলুল্লাহ বা’য়াহ (শপথ) নিয়েছিলেন যা উবাদা ইবন সামিত (রা) থেকে বায়হাকির বর্ণনায় এসেছে। এই দুটি বিষয় বর্তমান বাস্তবতায় খুবই গুরুত্ব বহন করে। কারণ বর্তমানে যদি কোন দল দারুল ইসলাম তথা খিলাফাহ ঘোষণা দিতে চায় তাহলে আমান এবং শরী’য়াহর পূর্ণ বাস্তবায়নের আলোকেই তা করতে হবে।
শরী’য়তের দৃষ্টিতে এ দুটি বিষয়ের দ্বারাই কোন ভুমিতে “তামকীন” (কর্তৃত্ব) কায়েম হয়েছে বলতে হবে। রাসূলুল্লাহ (সা) যখন আরবের বিভিন্ন গোত্র থেকে দারুল ইসলাম প্রতিষ্ঠার জন্য “নুসরাহ” (সাহায্য) তালাশ করছিলেন, তখন ওনার কথোপকথন এবং অনড় অবস্থান থেকেই বুঝা যাচ্ছিল উনি যেনতেন ভাবেই একটি ভূমি দখলের পথকে বেছে নেননি। আমরা দেখেছি রাসূলুল্লাহ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্য “তামনা’উনি” (تمنعوني) শব্দ ব্যবহার করেছিলেন যার অর্থ শক্তিমত্তার সাথে কোন কিছুকে রক্ষা করা। এবং এই রক্ষা (منع) করার বিষয়টি এমন ছিল না যে কোন শক্তিশালী গোত্র ওনাকে কিছু কিছু ক্ষেত্রে সামরিক সহায়তা দিতে চেয়েছিল আর উনিও রাজি হয়ে গিয়েছিলেন। বরং রাসূলের শর্ত ছিল যে দারুল ইসলাম তৈরি হবে তা চারিদিক থেকে হবে সুরক্ষিত; যেটাকে রাসূলের ভাষায় আমরা বলতে পারি “হাতাহু” (حاطَهُ)। আলি (রা) হতে বায়হাকির একটি হাসান বর্ণনায় এসেছে রাসূলুল্লাহ যখন বানু শায়বান গোত্রের কাছে নুসরাহ চাইলেন এবং ওই গোত্র শর্ত দিল তারা শুধু কুরাইশদের কাছ থেকে ইসলামী রাষ্ট্রকে প্রতিরক্ষা করতে পারবে কিন্তু রোমান এবং পারস্যদের কাছ থেকে পারবে না, তখন রাসুলুল্লাহ তাদের ওই প্রস্তাব নাকচ করে দিয়ে বললেন: “…এই দ্বীনকে আল্লাহ তখনি বিজয় দিবেন যখন চারিদিক থেকে (‘হাতাহু) তা সুরক্ষিত হবে”
(ما أسأتم الرد إذ أفصحتم بالصدق إنه لا يقوم بدين الله إلا من حاطه من جميع جوانبه)
তাই খিলাফাহ রাষ্ট্রের শর’ঈ ব্যাখ্যা হল – এই রাষ্ট্র মুসলিমদের সার্বিক নিরাপত্তা দিতে সক্ষম হবে এবং হুকুম শরী’য়াহ সামগ্রিকভাবে কায়েম করবে। বর্তমান প্রেক্ষাপটে যদি চিন্তা করি তাহলে যুদ্ধ চলারত অবস্থায় কিছু ভূমি দখলের মাধ্যমেই খিলাফতের ঘোষণাকে আমরা কখনই “তামকীন” বলতে পারি না, এবং এমন হলেও চলবে না যে আংশিকভাবে কিছু শরীয়াহ বাস্তবায়ন এবং হুদুদ কায়েমের মাধ্যমে কোন ভূমি খিলাফতের দাবীদার হতে পারে। এই দারুল ইসলামকে হতে হবে স্বয়ংভর (self sufficient) একটি রাষ্ট্র যা নিজেই নিজের খাদ্য নিরাপত্তা থকে শুরু করে সামরিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করার সামর্থ্য রাখে । তাই কোন ভঙ্গুর দ্বীপ রাষ্ট্র যেমন খিলাফাহ হতে পারে না, তেমনি যুদ্ধ চলাকালীন অবস্থায় কিছু অঞ্চল দখল করে রাষ্ট্রের শর’ঈ শর্ত পূরণ না করে খিলাফাহ রাষ্ট্রের ঘোষণাও দেয়া যেতে পারে না। অতএব, এই “দারুল ইসলাম” (খিলাফাহ) অবশ্যই ইসলামকে ১০০% বাস্তবায়ন করবে; এই রাষ্ট্রের সংবিধান, কাঠামো এবং প্রতিষ্ঠানসমূহ, অর্থনীতি, মুদ্রানীতি, বিচারব্যবস্থা, বৈদেশিক নীতি ইত্যাদি সব কিছুর ভিত্তি হবে কুরআন এবং সুন্নাহ থেকে নিঃসৃত দলীল। এই রাষ্ট্র হবে ঠিক রাসূলুল্লাহ (সা) এর মদীনার ইসলামী রাষ্ট্র এবং ওনার খুলাফায়ে রাশেদীন তথা আবু বকর, উমর, উছমান এবং আলী (রাদিয়াল্লাহু আনহুম) দ্বারা চালিত রাষ্ট্রের মডেল অনুসারে।