দাওয়ার অগ্রগতির জন্য দলের মধ্যে সঠিক পরিবেশ বিরাজমান থাকার বিষয়টি একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ আলোচনার বিষয়। এ বিষয়টি যদি সঠিকভাবে নিয়ন্ত্রন না করা হয় বা অবহেলা করা হয় তবে তা দাওয়ার ফরজিয়্যাত পালনে অবহেলার দিকে নিয়ে যাবে এবং ফলশ্রুতিতে আল্লাহর ক্রোধ আমাদের উপর আপতিত হবে।
নিম্নের আলোচনায় আমরা দলের মধ্যে সঠিক পরিবেশ বজায় রাখার বিষয়টি আলোচনা করব। এক্ষেত্রে আমাদের জানতে হবে, পরিবেশ বলতে আমরা কী বুঝি, ভুল পরিবেশের উদাহরণ এবং তা কিভাবে উদ্ভুত হয়, সবশেষে সঠিক পরিবেশ কী এবং তা কিভাবে বজায় রাখতে হয়।
পরিবেশের অর্থ:
কোনো চিন্তাকে কোথাও ক্রমাগত বাস্তবায়ন করতে থাকলে একটি পরিবেশের সূচনা হয়। সাধারনত মানুষ একটি পরিবেশকে অনুভব করতে পারে। উদাহরণসরূপ, ঘরে কিংবা বাইরে, মসজিদ কিংবা খেলার মাঠে, স্কুল কিংবা মাদ্রাসায় একটি নির্দিষ্ট পরিবেশ বিদ্যমান থাকে। যেমন, কোনো বাসায় যদি নারী ও পুরুষের মধ্যে মধ্যে অবাধ মেলামেশা নিষিদ্ধ থাকে এবং তাদের নিজেদের মধ্যে মিলিত হবার জন্য পৃথক স্থান থাকে, তবে বাইরের কেউ (যে এধরনের বিষয় পালন করেনা) সে এই বাসায় গেলে তার স্ত্রীকে পরিবেশের প্রভাবে অন্যান্য নারীদের সাথেই অবস্থান করার জন্য বলবে। একইভাবে, কোনো স্কুল বা কলেজ যেখানে মনযোগ দিয়ে পড়াশুনা করার প্রতি অত্যন্ত গুরুত্বারোপ করা হয়, শ্রেণীকক্ষে ছাত্র-ছা্ত্রীদের নিজেদের মধ্যে কথোপকথনকে অত্যন্ত গর্হিত হিসেবে দেখা হয়, সেখানে কোনো নতুন ছাত্র বা ছাত্রী ভর্তি হলে সেও পরিবেশের প্রভাবে নিজেকে তার সাথে খাপ খাইয়ে নেয়ার চেষ্টা করবে, যদিওবা হয়তো সে এধরনের অধ্যয়নের পরিবেশে সে আগে কখনো পায়নি।
এই বাস্তবতাকে আরো বৃহত্তরভাবে চিন্তা করলে তাকে জনমত কিংবা জনগণের সাধারন (common) চিন্তা বলতে পারি।
পরিবেশ নিশ্চিতভাবে মানুষকে প্রভাবিত করে। সুতরাং, পরিবেশ যদি ভালো হয় তবে তা ভালো প্রভাব ফেলবে আর যদি বিদ্যমান পরিবেশে ভালোর পরিমান কম হয় তবে মন্দ প্রভাব ফেলবে। উদাহরনসরূপ, একটি শিশু যখন তার গৃহে বেড়ে উঠে তখন তার ঘরের পরিবেশ অবশ্যই তাকে প্রভাবিত করবে। সুতরাং, ঘরে যদি গালাগালি, খবরদারি, কোন্দল ও পাপাচারের পরিবেশ থাকে তবে সে এর কু-প্রভাব শিশুর উপর পড়াটা খুবই স্বাভাবিক। অপরদিকে যদি ঘরের অভ্যন্তরে তাকওয়া, আল্লাহর হুকুম মেনে চলা, কুরআন তেলাওয়াত, ইসলামী আলোচনা ইত্যাদির পরিবেশ থাকে তবে স্বাভাবিকভাবে শিশু তার দ্বারা প্রভাবিত হয়ে সুন্দরভাবে বেড়ে উঠবে।
সাধারনত ধারনা করা হয়ে থাকে পরিবেশ বজায় রাখা মূলত কিছু ব্যক্তির দায়িত্ব। কিন্তু ইসলামী দৃষ্টিকোন হতে আমরা প্রত্যেকেই এর জন্য দায়িত্বশীল। এটি প্রত্যেকের অবশ্য কর্তব্য এবং এ বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বের সাথে নেয়া উচিত। অর্থাৎ, যদি আমি অনুভব করি যে পরিবেশের ব্যাঘাত ঘটেছে, তবে আমার অবশ্যই নিজেকে দায়িত্বশীল মনে করতে হবে, নিজেকে প্রশ্নবিদ্ধ করতে হবে যে, আমি কি সে দায়িত্ব পালন করেছি কিনা যা এ অবস্থায় আমার করা উচিত ছিল। সুতরাং, প্রত্যেককেই সঠিক পরিবেশ সৃষ্টি ও ভুল পরিবেশ অপসারণের জন্য কাজ করে যেতে হবে। রাসূলুল্লাহ (সা) বলেন. তোমাদের প্রত্যেকেই দায়িত্বশীল এবং তোমরা প্রত্যেকেই তোমাদের দায়িত্ব সম্পর্কে জিজ্ঞাসিত হবে। তিনি (সা) আরো বলেন, তোমাদের প্রত্যেকেই ইসলামী সীমান্তসমূহের এক একটি সীমান্ত। তিনি (সা) আরো বলেন, মানুষের মধ্যে কতক রয়েছে যারা কল্যাণের চাবি এবং অকল্যাণের তালা। আবার কতক রয়েছে যারা অকল্যাণের চাবি এবং কল্যাণের তালা।
রাসূলুল্লাহ (সা) সুন্দর পরিবেশের গুরুত্বারোপ করেছেন যখন তিনি (সা) বলেন,
আবু মূসা হতে বর্ণিত হাদীসে রাসূল (সা) বলেন,
مَثَلُ الْجَلِيسِ الصَّالِحِ وَالْجَلِيسِ السَّوْءِ كَمَثَلِ صَاحِبِ الْمِسْكِ وَكِيرِ الْحَدَّادِ لَا يَعْدَمُكَ مِنْ صَاحِبِ الْمِسْكِ إِمَّا تَشْتَرِيهِ أَوْ تَجِدُ رِيحَهُ وَكِيرُ الْحَدَّادِ يُحْرِقُ بَدَنَكَ أَوْ ثَوْبَكَ أَوْ تَجِدُ مِنْهُ رِيحًا خَبِيثَةً
খারাপ সাহচর্যের তুলনায় একটি ভালো সাহচর্যের উদাহরন সুঘন্ধি বিক্রেতা ও কামারের চুল্লির ন্যায়। প্রথম উদাহরণে তুমি হয় সুঘন্ধি কিনবে কিংবা তার সুঘ্রাণ উপভোগ করবে। আর দ্বিতীয় উদাহরণে সেই চুল্লি তোমার কাপড় বা বাড়ি পুরিয়ে দেবে কিংবা তুমি তা হতে একটি বাজে গন্ধ পাবে। [বুখারী]
হাদীসের এই উপমা বিষয়টিকে আরো জোরালোভাবে উপস্থাপন করে যে পরিবেশের প্রভাব ভালো বা খারাপ ঘ্রানের মতোই।
রাসূল (সা) আবারও ভালো ও মন্দ সাহচর্যের উপর গুরুত্বারোপ করেছেন। তারা একে অপরের সাথে মিলিত হলে তাদের মধ্যে একটি নির্দিষ্ট পরিবেশ বিরাজ করে। অর্থাৎ, পরিবার-পরিজনের মধ্যকার পরিবেশ হতে বন্ধু-বান্ধবের মধ্যকার পরিবেশ সাধারনত ভিন্ন হয়। তিনি (সা) বলেন,
الرَّجُلُ عَلَى دِينِ خَلِيلِهِ فَلْيَنْظُرْ أَحَدُكُمْ مَنْ يُخَالِلُ
ব্যক্তি তার ঘনিষ্ট বন্ধুর দ্বীন (বিশ্বাস, স্বভাবচরিত্র)-এর উপর থাকে। সুতরাং, তোমাদের প্রত্যেকেরই দেখা উচিত কার সাথে সে বন্ধুত্ব করছে। [তিরমিযি]
আরেকটি হাদীসে রাসূলুল্লাহ (সা) উল্লেখ করেন, তোমার দুনিয়ার বন্ধুরা আখিরাতেও তোমার বন্ধু হবে।
দলের অভ্যন্তরের পরিবেশ:
এটি অনুধাবন করা খুবই গুরুত্বপূর্ণ, ইসলামী আদর্শভিত্তিক কোনো রাজনৈতিক দল উম্মাহর পুনর্জাগরণে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করে। এর অর্থ এই দলের কর্মীরা নিয়মিত বিভিন্ন পাঠচক্র, আলোচনা, সভা ও বিভিন্ন কর্মকান্ডে নিয়মিত পরস্পরের সাথে মিলিত হবে এবং জনগণের মন জয়ের কাজে নিয়োজিত থাকবে।
সুতরাং, স্বাভাবিকভাবেই দলের মধ্যে একটি পরিবেশ তৈরি হয়। এই পরিবেশটি যদি সঠিক হয়, তবে তা দাওয়াহর কাজকে সহযোগিতা ও এর উন্নয়নে সহায়তা করবে।
সঠিক পরিবেশ বজায় না রাখার কু-প্রভাব:
সমাজের জাহিলিয়্যাত আমাদের ভাইদের প্রভাবিত ও বিচলিত করে। ফলে তারা দলের পরিবেশে এসে তা থেকে আশ্রয় অন্বেষন করে। যদি তারা তা না পায়, তবে দল, দলের কর্মী, দলের চিন্তার প্রতি তাদের বিশ্বাস নিচে নেমে যায়, দূর্বল হয়ে পড়ে এবং অনেক ক্ষেত্রে এ অবস্থা দল থেকে তার ঝরে পড়ার উপলক্ষ্যে পরিনত হয়। এক ভাইয়ের সাথে অপর ভাইয়ের সাক্ষাৎ আমাদের স্বস্তির উপলক্ষ্যে পরিনত হতে হবে এবং এ পরিবেশ দলের অভ্যন্তরে প্রত্যেককেই বজায় রাখতে সচেষ্ট হতে হবে।
সঠিক পরিবেশ বজায় না থাকার কিছু কারণ নিয়ে নিম্নে আলোচনা করা হলো,
১) অধিক হাস্যরস:
কখনো কখনো দেখা যায়, দাওয়াহ ও জ্ঞানের পরিবেশের পরিবর্তে দলের মধ্যে একটি মাত্রাতিরিক্ত হাসি-ঠাট্টা ও পরিহাসে পরিপূর্ণ হয়ে আছে। ফলে দাওয়াহ ভাব-গাম্ভীর্যতা ক্ষুন্ন হয় এবং দাওয়াহ তার লক্ষ্য থেকে বিচ্যুতি হওয়ার সম্ভাবনা দেখা দেয়।
আনাস (রা) হতে বর্ণিত হাদীসে রাসূল (সা) বলেন:
لَوْ تَعْلَمُونَ مَا أَعْلَمُ لَضَحِكْتُمْ قَلِيلًا وَلَبَكَيْتُمْ كَثِيرًا
“আমি যা জানি তা যদি তোমরা জানতে তবে তোমরা হাসতে কম ও কাঁদতে বেশি।” এ কথা শোনার পর সাহাবীগণের মধ্যে এমন কান্নার রোল পড়ে যায় যে তাঁরা মুখ ঢেকে ফেলেন।
অধিকমাত্রায় হাসি-তামাশা করা থেকে দাওয়াকারীদের অত্যন্ত সতর্ক থাকতে হবে। তাদের বুঝতে হবে প্রত্যেক বিষয়েরই নির্দিষ্ট সময়, জায়গা ও পরিমান রয়েছে যার বাইরে তা করা শোভনীয় নয়। তাদের এটিও উপলব্ধি করতে হবে যে অধিক মাত্রায় হাসি-ঠাট্টার ফলে দাওয়ার ভাবগম্ভীর কথা হালকা শোনায়, দাওয়াহ তার উত্তাপ হারায় এবং এর অগ্রগতি শ্লথ হয়ে পড়ে। দাওয়ার পরিবেশ অবশ্যই ফিকহ, উসূল আল-ফিকহ, রাজনৈতিক বিশ্লেষন, উম্মাহর বাস্তবতা ও নাফসিয়্যাহ সংক্রান্ত আলোচনায় ভরপুর হতে হবে।
শায়খ তাকী উদ্দীন আন-নাবহানি (রহ) তার আত-তাফকীর (Thinking) বইয়ে বলেন,
(মানুষের) চিন্তার মধ্যে গুরুতর অবস্থা (seriousness) অবিচ্ছেদ্যরূপে থাকে না, তাই মানুষের অধিকাংশ চিন্তাই ভাবগাম্ভীর্যতা বিবর্জিত। অভ্যাস ও ধারাবাহিকতা রক্ষার তাগিদে মানুষ কাজ করে যায়। আমোদ-প্রমোদ চিন্তায় আলাদারূপে বিদ্যমান দেখা যায়। তাই জোর করে (কৃত্রিমভাবে) হলেও গুরুতর অবস্থা (ধরে রাখার) অনুশীলন করতে হবে যেখানে (এই) ভাবগাম্ভীর্যতার ভিত্তি হবে (ব্যক্তির) সংকল্পবদ্ধতা, বাস্তবতা নয়। মূলত, গুরুতর অবস্থা (seriousness) ধরে রাখাটাই মূল উদ্দেশ্য। সুতরাং, এটি নিশ্চিতভাবে বলতে হবে, ভাবগাম্ভীর্যতা (বা গুরুতর চিন্তা) মানুষের মধ্যে স্বভাবজাত নয়, যদিও কিছু মানুষকে প্রকৃতিগতভাবেই ভাবগম্ভীর হিসেবে প্রত্যক্ষ করা যায়।
মূলত যা বোঝানো হচ্ছে যে, প্রাত্যহিক চিন্তায় মানুষ সাধারনত serious থাকে না। এবং বর্তমান সমাজের পরিবেশে এটি আরো বাস্তব যেখানে মানুষ টেলিভিশন, নাটক-সিনেমা ও গান-বাজনার সস্তা বিনোদনে ডুবে আছে। কিন্তু, আমাদের জোড় করে হলেও ভাবগম্ভীর (serious) পরিবেশ ধরে রাখতে হবে যদি তা আমাদের মধ্যে স্বভাবজাত না।
আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’আলাও গুরুত্বারোপ করে বলেন,
أَفَمِنْ هَذَا الْحَدِيثِ تَعْجَبُونَ ~وَتَضْحَكُونَ وَلا تَبْكُونَ
তোমরা কি এই কথার বিষয়ে আশ্চর্যবোধ করছ? এবং হাসছ, ক্রন্দন করছ না?(আন নাজমঃ৫৯,৬০)
২) অন্যান্য দল নিয়ে অধিক মাতামাতি:
কোনো সত্যিকারের উদ্দেশ্য ছাড়াই অন্যান্য দল নিয়ে আলোচনার আধিক্যও দলের কর্মীদের মধ্যে দেখা দিতে পারে। এর ফলে অধিক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়াদির আলোচনার পরিবর্তে দাওয়াকারীগণ ক্রমাগত অন্যান্য দল নিয়ে আলোচনায় রত থাকে যার অনেকটাই অনর্থক। এ ধরনের অভ্যাস দলের মধ্যে অনেক সমস্যা তৈরি করে। বিশেষ করে এতে কোনো নতুন কেউ কর্মী হিসেবে দলে প্রবেশ করতে মানসিক বাধা অনুভব করে বিশেষ করে যাদের অন্যান্য দলের প্রতি উষ্ণ অনুভূতি রয়েছে। এমনকি সাধারন কোনো ব্যক্তিও অভ্যন্তরের পরিবেশকে কাঁদা ছোড়াছুড়ির পরিবেশ মনে করে দলের সাথে সম্পর্ক তৈরি থেকে বিরত থাকতে পারে। যেহেতু এধরনের আলোচনা আবেগসম্পন্ন এবং তা দলের কর্মীদের নিজেদেরকে অন্যদের হতে শ্রেষ্ঠ হওয়ার অনুভুতি প্রদান করে, তাই এ ধরনের পরিবেশ আমরা কিছু দলের মধ্যে উপস্থিত দেখব। কিন্তু উম্মাহর পুনর্জাগরনের কর্মীদের এ বিপদ থেকে অত্যন্ত সাবধান থাকতে হবে।
শায়খ তাকী উদ্দীন আন-নাবহানি (রহ) তার বই মাফাহীম (Concepts)-এ বলেন,
“এটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ যে দলের ব্যক্তিগোষ্ঠী যে উম্মাহর সাথে বাস করে তাদের হতে নিজেদের এটি যেন পৃথক কোনো সত্ত্বা না মনে করে। বরং তারা নিজেদের উম্মাহর একটি অংশ মনে করবে কারণ উম্মাহর সদস্যরা মুসলিম যেরকম দলের সদস্যরা মুসলিম। দলের সদস্যরা অন্য কোনো মুসলিম হতে কোনো অংশে বেশি উত্তম নয় যদিও তারা ইসলাম বোঝে ও এর জন্য কাজ করে। দলের ব্যক্তিগণের জন্য রয়েছে বেশি দায়িত্ব ও জবাবদিহিতা, মুসলিমদের সেবা করার নিমিত্তে ও আল্লাহর দৃষ্টির আওতায় ইসলামের জন্য কাজ করার নিমিত্তে। ইসলামী গোষ্ঠীর সদস্যদের এটা বোঝা উচিত তাদের সংখ্যা যত বেশিই হোক না কেন, উম্মাহ ছাড়া তারা মূল্যহীন যাদের মধ্যে তারা কার্যক্রম চালায়। ফলে তাদের দায়িত্ব হচ্ছে, উম্মাহর সাথে গণসংযোগ চালোনো, তাকে সঙ্গে নিয়ে সংগ্রামে অগ্রসর হওয়া, নিশ্চিত করা যাতে উম্মাহ অনুভব করে যে সে নিজেই এই সংগ্রাম চালাচ্ছে। দলকে অবশ্যই এমন কোনো কাজ, কথা/মন্তব্য যা দলকে উম্মাহ হতে বিচ্ছিন্ন বা আলাদা হিসেবে চিহ্নিত করে, তা যে আকাড়ের হোক না কেন, তা থেকে বিরত থাকতে হবে।….এটা এজন্য যে এটি দল ও তার দাওয়াকে উম্মাহ হতে পৃথক করে ফেলে এবং দলের ব্যক্তিগোষ্ঠী সমাজের অসংখ্য সমস্যার মধ্যে আরো একটি সমস্যায় পরিনত হয় যা পূনর্জাগরণকে ব্যহত করে। সুতরাং উম্মাহ হচ্ছে একটি অবিচ্ছেদ্য একক সত্ত্বা এবং দলের ব্যক্তিগোষ্ঠী (তার মধ্য হতে) উঠে দাড়িয়েছে রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্য, রাষ্ট্র ও উম্মাহর মধ্যে ইসলামের প্রহরী হিসেবে, যাতে কোনো বিচ্যুতি না হয় তা নিশ্চিত করা যায়। যদি সে (দল) তার (উম্মাহর) মধ্যে এরকম কিছু (বিচ্যুতি) দেখতে পায়, তবে সে তার মধ্যে ঈমান ও মৌলিকত্ব সঞ্চারিত করবে। যদি সে রাষ্ট্রের মধ্যে কোনো বিচ্যুতি দেখতে পায়, তাহলে সে উম্মাহর সাথে ঐক্যবদ্ধ হয়ে ইসলাম অনুযায়ী তা সংশোধন করার জন্য কাজ করবে। এভাবেই দলকর্তৃক বহনকৃত দাওয়াহ উৎকর্ষতার সাথে এর প্রকৃত পথে অগ্রসর হবে।
এটি সত্য যে কিছু দলের মধ্যে ভুল কনসেপ্ট ও পদ্ধতি থাকবে। তথাপি, দাওয়াকারীদের সেসব দলের আলোচনায় অতিমগ্নতা ও আচ্ছন্ন হয়ে যাওয়া হতে সাবধান থাকতে হবে।
আত-তাকাত্তুল আল-হিযবি বইটির ৫০ পৃষ্ঠায় শাইখ তাকী উদ্দীন আন-নাবহানি (রহ) বলেন:
সুতরাং দলের সদস্যরা উম্মাহর সাধারণ সদস্যের মতো থাকবে এবং নিজেদের উম্মাহর সেবক ছাড়া অন্য কিছুই মনে করবে না। তাদের উপলব্ধি করতে হবে যে উম্মাহর সেবায় নিয়োজিত হওয়াটাই তাদের দলের মূল কাজ।
বরং আমাদের কোনো দলের দিকে ক্রমাগত আঙ্গুল না তুলে, ভুল কনসেপ্টের দিকে ফোকাস রাখা উচিত তা সে কনসেপ্ট যেই ধারণ করুক না কেন।
বস্তুতঃ বিভিন্ন দলের সমালোচনা হতে উম্মাহর মধ্যে সাধারনভাবে কনসেপ্ট আলোচনা-সমালোচনা অনেক বেশি ফলপ্রসূ। বাস্তবতা হলো, অধিকাংশ মানুষই দল করে না এবং তাদের দাওয়াহ করে মন জয় করে দাওয়াহর কাজে নিয়ে আসা অনেক সহজ। স্বাভাবিকভাবেই দাওয়াহর কাজ করার সময় অন্যান্য দলের কর্মীদের সাথেও সাক্ষাত হবে, আলোচনা-বিশ্লেষন হবে; তবে এ কাজ আমাদের মূল লক্ষ্য হওয়া উচিত নয়।
কার্যক্রমের অধিক আলোচনার দরূন সুন্দর সংস্কৃতির পরিবেশ হারিয়ে ফেলা:
আরেকটি সমস্যা যা দাওয়াকারীদের মধ্যে বিরাজ করতে পারে তা হলো, তারা দলের গৃহীত চিন্তার পরিবর্তে দলের কর্মকাণ্ড নিয়ে বেশি আলোচনা করছে। দলের অবশ্যই এমন সব দা’ঈ প্রয়োজন যারা ইসলামী চিন্তা অত্যন্ত ভালোভাবে বুঝবে যাতে করে তা দ্বারা তারা উম্মাহকে পুনর্জাগরিত করতে পারে। সুতরাং, দাওয়াকারীদের মধ্যে আলোচনা, প্রশ্ন ও বিতর্কের পরিবেশ বিরাজমান থাকা উচিত। এই ধরনের পরিবেশ দলের তরুনদের বিভিন্ন প্রশ্ন, মতামত ও প্রমানাদির সম্মুখে তাদের চিন্তার উন্নয়নে অনেকটা সাহায্য করবে।
১০ জন গভীর চিন্তাশীল কর্মী ১০০ জন দূর্বল কর্মী হতে উত্তম। কর্মী সংখ্যা বাড়ানোর অবশ্যই গুরুত্ব রয়েছে। তবে এখানে বুঝতে হবে, শরীরে মাংস থাকা যেমন জরুরী, তার থেকে বেশি জরুরী শক্তিশালী হাড় থাকা মাংসকে শরীরের সাথে ধরে রাখে।
স্বাভাবিকভাবেই একজন দাওয়াকারী যখন অপর কোনো দাওয়াকারী ভাইয়ের সাথে মিলিত হবে তখন তারা বিভিন্ন কল্যাণমুখী আলোচনায় রত হবে। এ ধরনের আলোচনার বিষয়বস্তুর মধ্যে রয়েছে, বিশ্ব পরিস্থিতি, ফিকহী বিষয়াদি, আত্ম-উন্নয়ন, হালাকায় আলোচিত বিভিন্ন কনসেপ্ট-এর বিশ্লেষনমূলক আলোচনা ইত্যাদি।
৪) দলবাজি বা উপদলের উপদ্রব:
আরেকটি পরিবেশ যা দাওয়াহর কাজের জন্য খুবই মারাত্মক, তা হলো দলের মধ্যে বিভিন্ন উপদল তৈরি হওয়া যারা দলের গৃহীত চিন্তার প্রতি অনুগত না হয়ে বিশেষ বিশেষ ব্যাক্তির প্রতি অনুগত থাকে। এরূপ পরিবেশ তখনি তৈরি হয় যখন দলের কর্মীরা হুকুম শরীয়াহ ও সাংগঠনিক নীতিমালার ভঙ্গ করে এবং একে অপরের ব্যাপারে নেতিবাচক আলোচনায় লিপ্ত হয়।
এটি স্বাভাবিক যে কিছু কিছু ভাইয়ের মধ্যে সম্পর্কের ঘনিষ্ঠতা অন্যান্য কিছু ভাইদের সাথে সম্পর্কের চেয়ে তুলনামূলকভাবে বেশি হতে পারে। যদিওবা তাদের এটা বোঝা উচিৎ যে, তাদের সকলের মধ্যেই একটি আদর্শিক বন্ধন রয়েছে, যা তাদেরকে দলের মধ্যে বন্ধনে একত্রিত করে। তাই এই বন্ধনটি বন্ধুত্বের বা ব্যাক্তিগত ঘনিষ্ঠতার ভিত্তিতে হওয়া উচিৎ নয় বরং আকিদাহ এবং দলের গৃহীত (adopted) চিন্তার ভিত্তিতে হতে হবে।
এই দুইটি বিষয়ই একে অপরের সাথে বন্ধনের মূল ভিত্তি হতে হবে। তাই ইসলামি দলে দলবাজি করা সম্পূর্ণভাবে নিষিদ্ধ। দলকে অবশ্যই সামগ্রিকভাবে একক একটি সত্ত্বায় পরিনত হতে হবে।
এটিও স্বাভাবিক যে কখনো কখনো দলের বিভিন্ন ভাইয়ের কোনো দোষ কিংবা দূর্বলতা চোখে পড়বে এবং তা আমাদের মধ্যে সন্দেহের বীজ বপন করতে পারে। কিন্তু এই বিষয়গুলো রফাদফা করার ক্ষেত্রে তাড়াহুড়া বা বাড়াবাড়ি থেকে বিরত থাকতে হবে। বরং হুকুম শরীয়াহ ও সাংগঠনিক নীতি অনুসারে এর সমাধান হচ্ছে কিনা তা সতর্কতার সাথে পর্যবেক্ষন করতে হবে। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা বলেন:
يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا اجْتَنِبُوا كَثِيرًا مِنَ الظَّنِّ إِنَّ بَعْضَ الظَّنِّ إِثْمٌ وَلا تَجَسَّسُوا وَلا يَغْتَبْ بَعْضُكُمْ بَعْضًا أَيُحِبُّ أَحَدُكُمْ أَنْ يَأْكُلَ لَحْمَ أَخِيهِ مَيْتًا فَكَرِهْتُمُوهُ وَاتَّقُوا اللَّهَ إِنَّ اللَّهَ تَوَّابٌ رَحِيمٌ
মুমিনগণ, তোমরা অধিকাংশ সন্দেহ থেকে দুরে থাক। নিশ্চয় কিছু কিছু সন্দেহ গোনাহের কাজ। [হুজুরাত:১২]
এই আয়াতের তাফসীরে ইবনে আব্বাস বলেন- আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা মুমিনদের তাদের অন্যান্য ভাইদের ব্যাপারে মন্দ ধারণা পোষন করাকে হারাম করেছেন।
আবু হুরাইরা (রা) থেকে বর্ণিত হাদীসে রাসূল (সা) বলেন: সন্দেহ হতে দূরে থাকো কারণ সন্দেহ (এর ভিত্তিতে বলা কথা) সবেচেয়ে অসত্য কথাবার্তা (এক নিকৃষ্ট মিথ্যাচার)।
একজন মুমিন যিনি আপাতদৃষ্টিতে সৎ ও নিষ্ঠাবান তার ব্যাপারে খারাপ ধারণা পোষন করা বৈধ নয়, বরং তার সম্পর্কে ভালো ধারণা রাখাটাই উৎসাহিত।
ইসলাম গীবত ও অপবাদকে হারাম করেছে ও একইসাথে মানুষদের ব্যাপারে সন্দেহজনক, কু-ধারণাকে থেকে দূরে থাকতে বলেছে। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা বলেন:
وَلَا تَجَسَّسُوا وَلَا يَغْتَبْ بَعْضُكُمْ بَعْضًا أَيُحِبُّ أَحَدُكُمْ أَنْ يَأْكُلَ لَحْمَ أَخِيهِ مَيْتًا فَكَرِهْتُمُوهُ وَاتَّقُوا اللَّهَ إِنَّ اللَّهَ تَوَّابٌ رَحِيمٌ
এবং একে অপরের পিছনে গোয়েন্দাগিরি করোনা। তোমাদের কেউ যেন কারও পিছনে তার দোষচর্চা না করে। তোমাদের কেউ কি তারা মৃত ভাইয়ের মাংস ভক্ষণ করা পছন্দ করবে? বস্তুতঃ তোমরা তো একে ঘৃণাই করবে। আল্লাহকে ভয় কর। নিশ্চয় আল্লাহ তওবা কবুলকারী, পরম দয়ালু। [হুজুরাত: ১২]
তিনি সুবহানাহু ওয়া তা’আলা আরো বলেন,
أَلَمْ تَرَ إِلَى الَّذِينَ نُهُوا عَنِ النَّجْوَى ثُمَّ يَعُودُونَ لِمَا نُهُوا عَنْهُ وَيَتَنَاجَوْنَ بِالْإِثْمِ وَالْعُدْوَانِ وَمَعْصِيَتِ الرَّسُولِ
আপনি কি ভেবে দেখেননি, যাদেরকে কানাঘুষা করতে নিষেধ করা হয়েছিল অতঃপর তারা নিষিদ্ধ কাজেরই পুনরাবৃত্তি করে এবং পাপাচার, সীমালংঘন এবং রাসূলের অবাধ্যতার বিষয়েই কানাঘুষা করে…[মুজাদালাহ:৮]
يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا إِذَا تَنَاجَيْتُمْ فَلَا تَتَنَاجَوْا بِالْإِثْمِ وَالْعُدْوَانِ وَمَعْصِيَتِ الرَّسُولِ وَتَنَاجَوْا بِالْبِرِّ وَالتَّقْوَى وَاتَّقُوا اللَّهَ الَّذِي إِلَيْهِ تُحْشَرُونَ
মুমিনগণ, তোমরা যখন কানাকানি কর, তখন পাপাচার, সীমালংঘন ও রাসূলের অবাধ্যতার বিষয়ে কানাকানি করো না বরং অনুগ্রহ ও খোদাভীতির ব্যাপারে কানাকানি করো। আল্লাহকে ভয় কর, যাঁর কাছে তোমরা একত্রিত হবে। [মুজাদালাহ: ৯]
وَإِذَا جَاءهُمْ أَمْرٌ مِّنَ الأَمْنِ أَوِ الْخَوْفِ أَذَاعُواْ بِهِ وَلَوْ رَدُّوهُ إِلَى الرَّسُولِ وَإِلَى أُوْلِي الأَمْرِ مِنْهُمْ لَعَلِمَهُ الَّذِينَ يَسْتَنبِطُونَهُ مِنْهُمْ وَلَوْلاَ فَضْلُ اللّهِ عَلَيْكُمْ وَرَحْمَتُهُ لاَتَّبَعْتُمُ الشَّيْطَانَ إِلاَّ قَلِيلاً
আর যখন তাদের কছে পৌঁছে কোন সংবাদ শান্তি-সংক্রান্ত কিংবা ভয়ের, তখন তারা সেগুলোকে রটিয়ে দেয়। আর যদি সেগুলো পৌঁছে দিত রাসূল পর্যন্ত কিংবা তাদের উলিল আমর (দায়িত্বশীল) পর্যন্ত, তখন অনুসন্ধান করে দেখা যেত সেসব বিষয়, যা তাতে রয়েছে অনুসন্ধান করার মত। বস্তুতঃ আল্লাহর অনুগ্রহ ও করুণা যদি তোমাদের উপর বিদ্যমান না থাকত তবে তোমাদের অল্প কতিপয় লোক ব্যতীত সবাই শয়তানের অনুসরণ করতে শুরু করত! [নিসা: ৮৩]
আবু দাউদ আনাস (রা) থেকে বর্ণনা করেন, রাসূল (সা) বলেন- “ইসরার রাত্রিতে আমি তামার নখ বিশিষ্ট একদল লোকের কাছ দিয়ে অতিক্রম করি যারা নখগুলো দিয়ে তাদের মুখমন্ডল ও বক্ষদেশে আঘাত করে ক্ষত-বিক্ষত করছিল। আমি জিজ্ঞেস করলাম, হে জিবরাঈল! এসমস্ত লোক কারা? জিবরাঈল (আ) বললেন, এরা দুনিয়াতে মানুষের গোশ্ত ভক্ষন করত এবং তাদের মান-সম্মান নষ্ট করত।” অর্থাৎ তারা মানুষের গীবত ও চুগলখোরী করত।
পশ্চিমা সমাজের সমস্যাগুলো অন্যতম কারণ হিংসা-বিদ্বেষ করাকে ইসলাম নিষেধ করেছে। রাসূল (সা) বলেন, কোনো মুসলিমের প্রতি বিদ্বেষ রেখো না; অন্য মুসলিমদের প্রতি হিংসাত্মক হয়ো না; একজন মুসলিমের বিরুদ্ধে যেয়ো না এবং তাকে পরিত্যাগ করো না। হে আল্লাহর বান্দাগণ, পরস্পর ভাই-ভাই হয়ে যাও। একজন মুসলিমের জন্য এটি বৈধ নয় যে সে তার ভাইয়ের সাথে তিনদিনের বেশি সময় বিচ্ছিন্ন হয়ে থাকবে।
পশ্চিমা সমাজে একে অপরকে ছোট করা অনেকটা অবসর-বিনোদনে পরিনত হয়েছে। রাসূলুল্লাহ (সা) বলেন,
بِحَسْبِ امْرِئٍ مِنَ الشَّرِّ أَنْ يَحْقِرَ أَخَاهُ الْمُسْلِمَ
একজন ব্যক্তি তার মুসলিম ভাইকে ছোট করা থেকে নিকৃষ্ট আর কিছুই করতে পারে না। [মুসলিম]
ভিন্নতা থাকা সত্ত্বেও এক মুসলিমের অপর মুসলিমের প্রতি কোনোরূপ বিদ্বেষ রাখা উচিত নয়। রাসূলুল্লাহ (সা) আমাদের এ ব্যপারে সতর্ক করে গিয়েছেন। তিনি বলেন,
تُفْتَحُ أَبْوَابُ الْجَنَّةِ يَوْمَ الاِثْنَيْنِ وَيَوْمَ الْخَمِيسِ فَيُغْفَرُ لِكُلِّ عَبْدٍ لاَ يُشْرِكُ بِاللَّهِ شَيْئًا إِلاَّ رَجُلاً كَانَتْ بَيْنَهُ وَبَيْنَ أَخِيهِ شَحْنَاءُ فَيُقَالُ أَنْظِرُوا هَذَيْنِ حَتَّى يَصْطَلِحَا أَنْظِرُوا هَذَيْنِ حَتَّى يَصْطَلِحَا أَنْظِرُوا هَذَيْنِ حَتَّى يَصْطَلِحَا
জান্নাতের দরজাগুলো সোমবার ও বৃহস্পতিবার উন্মুক্ত করা হয় এবং প্রত্যেক (আল্লাহর) বান্দাকে ক্ষমা করে দেয়া হয় কেবলমাত্র সেই ব্যক্তি ছাড়া যে তার ভাইয়ের প্রতি কোনোরূপ বিদ্বেষ রাখে। (তাদের ব্যপারে) বলা হবে: এদের দুজনকে (ক্ষমা করা) পিছিয়ে দাও যতক্ষন না তারা মিমাংসা করে নেয়; এদের দুজনকে (ক্ষমা করা) পিছিয়ে দাও যতক্ষন না তারা মিমাংসা করে নেয়; এদের দুজনকে (ক্ষমা করা) পিছিয়ে দাও যতক্ষন না তারা মিমাংসা করে নেয়। [মুসলিম]
আর পবিত্র কুরআনে আমরা একটি চমৎকার দুআ দেখতে পাই:
وَالَّذِينَ جَاءُوا مِنْ بَعْدِهِمْ يَقُولُونَ رَبَّنَا اغْفِرْ لَنَا وَلِإِخْوَانِنَا الَّذِينَ سَبَقُونَا بِالْإِيمَانِ وَلَا تَجْعَلْ فِي قُلُوبِنَا غِلًّا لِلَّذِينَ آَمَنُوا رَبَّنَا إِنَّكَ رَءُوفٌ رَحِيمٌ
যারা তাদের পরে আগমন করেছে। তারা বলে: হে আমাদের পালনকর্তা, আমাদেরকে ও আমাদের ঈমানে অগ্রগামী ভাইদের ক্ষমা কর এবং ঈমানদারদের বিরুদ্ধে আমাদের অন্তরে কোন বিদ্বেষ রেখো না। হে আমাদের পালনকর্তা, আপনি দয়ালু, পরম করুণাময়। [হাশর: ১০]
ভাইয়েরা একে অপরের সাথে থাকতে সাচ্ছন্দ্য বোধ করবে ও ঘনিষ্টতা অনুভব করবে। আমাদের অহংকারবোধকে ইসলাম দিয়ে শান্ত করতে হবে। রাসূল (সা) বলেন, ব্যক্তি তার ঘনিষ্ট সহচরের দীনের উপর থাকে। আর সেই সাহচর্যে কোনো কল্যাণ নেই যাতে একজন (সহচর) তোমার ব্যপারে তার নিজের মতোই উচ্চ ধারনা পোষন করে। [ইহইয়াউ উলূমুদ দীন]
সমস্যা সমাধানের সঠিক পদ্ধতি অনুসরণ:
দা’ঈগণ নিম্নোক্ত পদ্ধতিতে তাদের সমস্যাগুলো সমাধান করে নেয়া উচিত:
যদি কোনো দাওয়াকারী এমন কিছু দেখে যা সে অপছন্দ করে অথবা তার টিম-এর কোনো কর্মীর কোনো ভূল দেখে, তখন সে কোনো বিলম্ব না করে তার সাথে বিষয়টি আলোচনা করবে, একজন ভাই হিসেবে তাকে স্মরণ করিয়ে দিবে ও নসীহত করবে। সে অবশ্যই এ বিষয়টি নিয়ে আর কারো সাথে আলোচনা করবে না, সে কোনো দায়িত্বশীল হোক কিংবা না হোক।
যদি কোনো দাওয়াকারী তার দায়িত্বশীল হতে এমন কোনো কিছু দেখে যা সে অপছন্দ করে, তখন সে কোনো বিলম্ব না করে তার সাথে বিষয়টি আলোচনা করবে, একজন ভাই হিসেবে তাকে স্মরণ করিয়ে দিবে ও নসীহত করবে। সে অবশ্যই সেই নির্দিষ্ট দায়িত্বশীল ভাইয়ের পূর্বে এ বিষয়টি নিয়ে আর কারো সাথে আলোচনা করবে না।
যদি এরপরও বিষয়টির শুরাহা তথা সংশোধন না হয়, তবে দাওয়াকারীর উচিত তার নিজস্ব দাওয়া এলাকা অর্থাৎ যে এলাকায় সে কাজ করে, তার দায়িত্বশীলকে বিষয়টি অবহিত করা ও তার সাথে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করা। সে শুধু ততটুকুই আলোচনা করবে যতটুকু সে জানে এবং এলাকার দায়িত্বশীল ছাড়া আর কারো সাথে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করবে না।
এরপরও যদি দলের কোনো ব্যক্তি সংশয়মুক্ত না হয় কিংবা প্রত্যাশিত চুড়ান্ত সমাধান না পায়, তবে সে এ বিষয়ে তার দেশের মূল দায়িত্বশীল ব্যতিত অন্য কারো সাথে কোনো কথা বলবে না। যদি সে তাকে ব্যক্তিগতভাবে চিনে তবে তাকে সরাসরি তা অবহিত করবে, আর যদি না চিনে তবে তাকে তার নিকট দায়িত্বশীলের মাধ্যমে চিঠি পাঠিয়ে অবহিত করবে। এক্ষেত্রে তার পাঠচক্রের দায়িত্বশীল, তার এলাকার দায়িত্বশীল কিংবা অন্য কোনো ব্যক্তি তা পড়বে না যদি না দেশের মূল দায়িত্বশীল অনুমতি দেন।
যদি সে তার দেশের দায়িত্বশীল সদস্য হতে সমাধান না পায়, তবে সে দলের যোগাযোগের সূত্রের মাধ্যমে তার অভিযোগ দলের আমীরের নিকট তুলে ধরতে পারে।
সামষ্টিক জবাবদিহিতা দলে না থাকাই আবশ্যক। যদি কেউ তার সহকর্মী হতে কোনো ভুল-ত্রুটি কিংবা খারাপ লাগার মতো কিছু দেখে তবে সে তার সাথে ব্যক্তিগতভাবে আলোচনা করে নেবে। হালাকার দায়িত্বশীল, সদস্য, ছাত্র কিংবা এলাকার অন্য কোনো দায়িত্বশীল হোক না কেন – কারো জন্যই দলের অভ্যন্তরে সামষ্টিক জবাবদিহিতার অনুমতি থাকা উচিত নয়।
পাঠচক্রে কোনো ছাত্র যদি মনে করে যে তার প্রশিক্ষক কোনো এক ব্যাখ্যায় ভুল করেছে, তবে তাকে তা শুধরিয়ে দেয়ার সুযোগ দেয়া উচিত। তবে তা বিনয় সহকারে ইসলামী শিষ্টাচার পরিপূর্ণ পরিবেশে হতে হবে। যদি এতেও সে সংশয়মুক্ত না হয়, তবে সে প্রশ্নটি মনে রাখবে এবং জ্ঞানসম্পন্ন কোনো দাওয়াকারীকে জিজ্ঞেস করবে অথবা কোনো প্রশ্ন-উত্তর পর্ব অনুষ্ঠিত হলে তাতে তা উত্থাপন করবে। এরপরও যদি প্রশ্নটি অমিমাংসিত রয়ে যায় তবে সে প্রশ্নটি লিখে দেশের দায়িত্বশীলের কাছে উত্তরপ্রাপ্তির জন্য প্রেরণ করতে পারে।
এর মাধ্যমে আমরা যা অর্জন করতে চাই তা নিম্নরূপ:
কখনো কখনো আমরা অত্যন্ত অধৈর্য হয়ে পড়ি এবং সরাসরি অন্যান্য ভাইদের কাছে গিয়ে নালিশ দেই, সমাধান চাই এবং এই প্রক্রিয়ায় সমস্যাটি অনেক অপ্রয়োজনীয়, অপ্রাসঙ্গিক ও অনাকাঙ্ক্ষিত ব্যক্তির কাছে প্রকাশ করে দেই। এভাবে সমস্যাটি জনে জনে ছড়িয়ে পড়ে, একজন মুসলিমের সম্মান ক্ষুন্ন হয় এবং পুরো বিষয়টি আরো জটিল হয়ে পড়ে। এটি উপলব্ধি করা প্রয়োজন যে, দলের অভ্যন্তরে ফিতনার সম্ভাবনা নির্মূল করা ও ভাইদের সম্মান রক্ষা করা – দুটোই আমাদের উদ্দেশ্য হতে হবে। এক্ষেত্রে, একটির সাথে আরেকটিকে সাংঘর্ষিক অবস্থানে না আনার সর্বোচ্চ চেষ্টা চালাতে হবে।
আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’আলার সন্তুষ্টির জন্য একে অপরকে ভালোবাসা:
আল্লাহর জন্য একে অপরকে ভালোবাসা সংক্রান্ত হাদীসসমূহ থেকে দাওয়াকারীদের অনুপ্রেরণা নেয়ায় সবসময় রত থাকতে হবে এবং সাহাবীদের মতো সবসময়েই সঠিক পরিবেশ ও ভাতৃত্ব বজায় রেখে চলতে হবে।
মুসলিম আবু হুরাইরা (রা) হতে বর্ণনা করেন যে রাসূলুল্লাহ (সা) বলেন,
« أَنَّ رَجُلاً زَارَ أَخًا لَهُ فِى قَرْيَةٍ أُخْرَى فَأَرْصَدَ اللَّهُ لَهُ عَلَى مَدْرَجَتِهِ مَلَكًا فَلَمَّا أَتَى عَلَيْهِ قَالَ أَيْنَ تُرِيدُ قَالَ أُرِيدُ أَخًا لِى فِى هَذِهِ الْقَرْيَةِ. قَالَ هَلْ لَكَ عَلَيْهِ مِنْ نِعْمَةٍ تَرُبُّهَا قَالَ لاَ غَيْرَ أَنِّى أَحْبَبْتُهُ فِى اللَّهِ عَزَّ وَجَلَّ. قَالَ فَإِنِّى رَسُولُ اللَّهِ إِلَيْكَ بِأَنَّ اللَّهَ قَدْ أَحَبَّكَ كَمَا أَحْبَبْتَهُ فِيهِ »
এক ব্যক্তি তার ভাইকে দেখার জন্য অন্য এক গ্রামে গেল । আল্লাহ তার জন্য রাস্তায় একজন ফিরিশতা মোতায়েন করলেন। সে ব্যক্তি যখন ফিরিশতার কাছে পৌছল, তখন ফিরিশতা জিজ্ঞাসা করলেন, তুমি কোথায় যাওয়ার ইরাদা করছ? সে বলল, আমি এই গ্রামে আমার এক ভাইকে দেখার জন্য যেতে চাই । ফিরিশতা বললেন, তার কাছে কি তোমার কোন অনুগ্রহ আছে, যা তুমি আরো বৃদ্ধি করতে চাও? সে বলল, না। আমি তো শুধু আল্লাহ আজ্জা ওয়া জালের জন্যই তাকে ভালবাসি। ফিরিশতা বললেন, আমি আল্লাহর পক্ষ থেকে তোমার কাছে এ পয়গাম নিয়ে এসেছি যে, আল্লাহ তোমাকে ভালবাসেন, যেমন তুমি তাকে আল্লাহরই জন্য ভালবেসেছ।
যেই ঈমানের মিষ্টতা অনুভব করতে চায় সে যেন কোনো ব্যক্তিকে শুধুমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্যই ভালোবাসে। [আহমাদ]
ভাইয়েরা, কিভাবে আমরা উম্মাহর ঐক্যের কথা বলতে পারি যখন আমরা নিজেরাই দলের অভ্যন্তরে ঐক্য আনতে ব্যর্থ হচ্ছি! ইমাম মুসলিম নু’মান বিন বশীর (রা) হতে বর্ণনা করেন,
الْمُسْلِمُونَ كَرَجُلٍ وَاحِدٍ إِنِ اشْتَكَى عَيْنُهُ اشْتَكَى كُلُّهُ وَإِنِ اشْتَكَى رَأْسُهُ اشْتَكَى كُلُّهُ
মুসলিমগণ একটি দেহের মতো। যদি এর চোখ ব্যথায় আক্রান্ত হয়, তবে সমস্ত দেহই ব্যথায় ভোগে, যদি এর মাথা ব্যথায় আক্রান্ত হয়, তবে সমস্ত দেহই ব্যথায় ভোগে।
পরিশেষে একটি হাদীস উদ্ধৃত করে আলোচনায় ইতি টানছি। রাসূল (সা) বলেন,
আল্লাহর বান্দাদের মধ্যে এমন কিছু ব্যক্তি আছে যারা নবীও না, শহীদও না – তবুও শহীদ ও নবীগণ কিয়ামতের দিন আল্লাহ তা’য়ালার নিকট ওই বান্দাদের মর্যাদার কারণে তাদেরকে ঈর্ষা করবেন (মর্যাদার স্বীকৃতি দেবেন)। তারা জিজ্ঞেস করলো, ইয়া রাসূলাল্লাহ, আমাদেরকে বলুন, তারা কারা? তিনি (সা) জবাব দিলেন, তারা এমন লোক যারা একে অপরকে আল্লাহর রূহের জন্য ভালোবাসবে যদিও তাদের মধ্যে কোনো আত্মীয়তার বন্ধন বা সম্পদের লেনদেন নেই। আল্লাহর শপথ, তাদের চেহারায় থাকবে নূর এবং তারা থাকবে নূরের উপর। মানুষ যখন ভীত থাকবে তখন তাদের কোনো ভীতি থাকবে না, এবং মানুষ যখন দুঃখে থাকবে তখন তাদের কোনো দুঃখ থাকবে না। তারপর তিনি এই আয়াত পড়লেন:
أَلا إِنَّ أَوْلِيَاءَ اللَّهِ لا خَوْفٌ عَلَيْهِمْ وَلا هُمْ يَحْزَنُونَ
মনে রেখো, যারা আল্লাহর বন্ধু, তাদের না কোনো ভয়-ভীতি আছে, না তারা দুঃখ পাবে। [সূরা ইউনুস: ৬২]
Posted by Visionary