হিজরী দ্বিতীয় সনের রমজান মাসের ৮ তারিখে রাসূল (সা) তিনশত পাঁচ জন সাহাবী ও সত্তরটি উট নিয়ে কাফিরদের উদ্দেশ্যে অভিযানে বের হন। এ সময় তিনি ’আমর ইবন উম্ম মাখতুমকে নামাজে ইমামতির দায়িত্ব এবং আবু লুবাবাহকে মদীনার দায়িত্বে নিযুক্ত করেন। উটের পিঠে চড়ে রাসূল (সা) এর দলটি আবু সুফিয়ানের নেতৃত্বে কুরাইশদের এক বাণিজ্য কাফেলাকে খুঁজে ফিরছিলো। পথ চলতে চলতে তারা আবু সুফিয়ানের কাফেলা সম্পর্কে খোঁজখবর নিতে থাকেন। সৈন্যদল দাফরান উপত্যকায় পৌঁছালে রাসূল (সা) সেখানে অবস্থান করার সিদ্ধান্ত নেন। এ সময় তাদের কাছে খবর পৌঁছে যে, মক্কার কুরাইশরা তাদের বাণিজ্য কাফেলাকে রক্ষা করার জন্য তাদের দিকে ধেয়ে আসছে। মুসলিমদের কাছে এ খবর পৌঁছার সাথে সাথে অভিযানের গুরুত্ব ও উদ্দেশ্য সম্পূর্ন ভিন্ন দিকে মোড় নেয়। কারণ, তখন ব্যাপারটি আর কাফেলাকে ধাওয়া করা নয়, বরং পৌত্তলিক কুরাইশদের সাথে মুসলিমরা মুখোমুখি সংঘর্ষে লিপ্ত হবে কি হবে না সে ব্যাপারে সিদ্ধান্ত গ্রহনের পর্যায়ে চলে যায়। আল্লাহর রাসূল (সা) সাহাবাদের সাথে আলোচনা করেন। আবু বকর ও ওমর (রা) যুদ্ধের পক্ষে তাদের সিদ্ধান্ত জানিয়ে দেন। আল-মিকদাদ ইবন ’আমর উঠে দাঁড়িয়ে বলেন,“হে আল্লাহর রাসূল! আপনি সেখানে যান যেখানে আল-াহ আপনাকে আদেশ করেছেন এবং এ যাত্রায় আমরা অবশ্যই আপনার সাথে থাকবো। বনী ইসরাইল জাতির মতো আমরা কখনোই বলবো না যে, হে মুসা, তুমি আর তোমার আল্লাহ গিয়ে যুদ্ধ করো, আর আমরা ঘরে বসে থাকবো। বরং, আমরা বলবো, (হে নবী) তুমি এবং তোমার আল্লাহ যুদ্ধ করো এবং তার সাথে আমরাও যুদ্ধ করবো।” তারপর মুসলিমরা নিশ্চুপ হয়ে যায়। এ অবস্থায় রাসূল (সা) আনসারদের উদ্দেশ্য করে বলেন, “এবার তোমরা আমাকে কিছু বলো।” একথার মাধ্যমে আসলে তিনি আনসারদের আকাবা উপত্যকায় কৃত তাদের শপথের কথা স্মরণ করিয়ে দিয়েছিলেন।
বস্তুতঃ আনসাররা আকাবার প্রান্তরে রাসূল (সা)কে নিরাপত্তা দেবার অঙ্গীকার করেছিলো যেভাবে তারা তাদের নারী ও শিশুদের নিরাপত্তা দিয়ে থাকে। আবার, অঙ্গীকারের সাথে এ শর্তটিও ছিলো যে, মদীনার বাইরে সংঘটিত কোন যুদ্ধের জন্য তারা দায়ী হবে না। যখন আনসাররা বুঝতে পারলো যে, রাসূল (সা) তাদের মুখ থেকে কিছু শুনতে চাচ্ছেন তখন সা’দ ইবন মু’য়াজ ইসলামের পতাকা দৃঢ় ভাবে আঁকড়ে ঘোষণা করলো যে, “হে আল্লাহর রাসূল! আমার মনে হচ্ছে আপনি আমাদের উদ্দেশ্য করে কিছু বলছেন।” রাসূল (সা) বললেন,“হ্যাঁ, আমি তোমাদের উদ্দেশ্য করেই বলছি।” উত্তরে সা’দ বললো,“আমরা আপনার উপর ঈমান এনেছি, আপনার সত্যতার ঘোষণা দিয়েছি এবং আপনি আমাদের কাছে যে সত্য এনেছেন তার সত্যতার সাক্ষী হয়েছি। এছাড়া, আমরা আপনার কাছে এ মর্মেও অঙ্গীকার করেছি যে, আমরা আপনার আনুগত্য করবো। সুতরাং, আপনার যেখানে ইচছা আপনি সেখানেই যান, আমাদের আপনার সাথেই পাবেন। যিনি আপনাকে প্রেরণ করেছেন সেই সত্তার কসম, যদি আপনি আমাদের সমুদ্রে ঝাঁপ দিতে বলেন তবে, আমরা আপনার সাথে সমুদ্রেও ঝাঁপ দিব। আমাদের মধ্য হতে একজনও এ ব্যাপারে পেছনে পড়ে থাকবে না। আগামীকালও যদি আপনি আমাদের সহ শত্রুপক্ষকে মোকাবিলা করতে চান তবে তাতেও আমাদের কোন আপত্তি নেই। আমরা যোদ্ধা জাতি, আমরা জানি কিভাবে যুদ্ধ করতে হয়। এমনও হতে পারে যে, আল্লাহতায়ালা হয়তো আমাদের মাধ্যমে আপনাকে এমন কিছু দান করবেন যাতে আপনার অন্তর প্রশান্ত হবে। সুতরাং, আল্লাহর রহমতের উপর ভরসা করে আমাদের নিয়ে এগিয়ে যান।” আল্লাহর রাসূল (সা) সা’দ ইবন মু’য়াজের কথায় অত্যন্ত আনন্দিত হলেন এবং বললেন,“তোমরা পরিপূর্ণ আত্মবিশ্বাসের সাথে এগিয়ে যাও। আল্লাহতায়ালা আমার কাছে দুটি দলের মধ্যে একটি দলের ওয়াদা করেছেন। আল্লাহর কসম, আমি যেন কাফিরদের বধ্যভূমি দেখতে পাচ্ছি।”
আল্লাহর রাসূল (সা) বদরের প্রান্তরের কাছাকাছি পৌঁছানো পর্যন্ত তাদের যাত্রা অব্যাহত রাখলেন। যখন মুসলিমরা বললো যে, শত্রুপক্ষ কাছাকাছি কোথাও অবস্থান করছে, তখন কুরাইশ বাহিনীর খবর সংগ্রহের আশায় হযরত ’আলী, আল-জুবায়ির ইবন ’আওওয়াম এবং সা’দ ইবন আবি ওয়াক্কাস সহ কিছু সাহাবী খবরের আশায় বদরের কুপের কাছে গেলেন। তারা কুপের কাছ থেকে দুইজন তরুণ যুবককে পাকড়াও করে ছাউনীতে ফেরত আসলেন। বন্দীদের প্রশ্ন করে তারা জানলেন যে, কুরাইশদের নেতারা নয়শত কিংবা একহাজার সৈন্যদলের একটি বাহিনী সহ তাদের বাণিজ্য কাফেলাকে রক্ষায় বের হয়েছে। রাসূল (সা) তৎক্ষনাৎ বুঝতে পারলেন যে, তাকে তার সেনাদল অপেক্ষা তিনগুন শত্তিশালী একটি দলকে মুকাবিলা করতে হবে এবং তাদের মুখোমুখি হতে হবে এক ভয়ানক সংঘর্ষের। তিনি (সা) সাহাবীদের জানালেন যে, মক্কা তার কলিজার বড় বড় টুকরাগুলোকে (অর্থাৎ, সবচাইতে যোগ্য সন্তানদের) যুদ্ধের ময়দানে ছুঁড়ে ফেলেছে। সুতরাং, তারা (সাহাবীরা) যেন তাদের চেষ্টার কোন কমতি না করে।
মুসলিমরা শত্রুপক্ষকে দৃঢ়ভাবে মুকাবিলা জন্য প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হলো। তারপর তারা বদরের কুপের কাছে অবস্থান গ্রহন করে সেখানে একটি পানির কৃত্রিম জলাশয় তৈরী করলো এবং যুদ্ধের কৌশল হিসাবে অন্য সব কুপ গুলো বন্ধ করে দিলো, যাতে তাদের পান করার মতো পর্যাপ্ত পানি থাকলেও শত্রুপক্ষ পান করার জন্য পানি খুঁজে না পায়। সেই সাথে, তারা আল্লাহর রাসূল (সা) এর নিরাপদ অবস্থানের জন্য একটি ছাউনী তৈরী করলো। এরপর, কুরাইশ যোদ্ধারা যুদ্ধের ময়দানে তাদের অবস্থান নিয়ে নিলো এবং পৌত্তলিক আসওয়াদ ইবন ’আবদ আল আসাদের ইন্ধনেই বদরের যুদ্ধের সূচনা হলো। আল-আসওয়াদ ইবন ’আবদ আল-আসাদ প্রথমে মুসলিমদের তৈরী জলাশয় ধ্বংস করার জন্য এগিয়ে এলো।
হামযাহ (রা) তাঁর তলোয়ার দিয়ে সজোরে আঘাত করে আসওয়াদের পা দুটি উড়িয়ে দিলেন। পা হারিয়ে আসওয়াদ মাটিতে ধপাস করে পড়ে গেলো আর তার কর্তিত পা থেকে রক্তের বন্যা বইতে লাগলো। এ অবস্থায় হামযাহ (রা) আবারও তাকে তলোয়ার দিয়ে আঘাত করলেন এবং জলাশয়ের কাছে তাকে হত্যা করলেন। এরপর, ’উতবাহ ইবন রাবি’য়াহ তার ভাই শায়বা এবং তার পুত্র আল-ওয়ালিদকে সঙ্গে নিয়ে সামনের দিকে অগ্রসর হলো। মুসলিমদের পক্ষ থেকে হামযাহ (রা), আলী (রা) এবং উবাইদাহ ইবন আল-হারিছ তাদের মুকাবিলা করতে এগিয়ে আসলেন। হামযাহ (রা) খুব সহজেই তাঁর প্রতিপক্ষ শায়বাকে পরাস্ত করে ফেললেন, একই ভাবে আলী (রা)ও তাঁর প্রতিপক্ষ আল-ওয়ালিদকে পর্যুদস্ত করলেন। তারপর, হামযাহ ও আলী (রা) উবাইদাহ (রা) এর সাহায্যে এগিয়ে আসলেন, যিনি তখন কুরাইশ নেতা ওতবার বিরুদ্ধে সর্বশক্তি দিয়ে লড়ে যাচ্ছিলেন। ওতবাকে খতম করে তারা তাদের আহত সহযোদ্ধা উবাইদাহ (রা)কে যুদ্ধের ময়দান থেকে উদ্ধার করলেন।
তারপর, রমজান মাসের ১৭ তারিখ শুক্রবার সকালে উভয় পক্ষ পরস্পরের নিকটবর্তী হলো। আল্লাহর রাসূল (সা) মুসলিমদের কাতার সোজা করলেন এবং তাদের যুদ্ধ করতে উদবুদ্ধ করতে থাকলেন। রাসূল (সা) এর কথায় উৎসাহিত ও উদ্বুদ্ধ হয়ে মুসলিম যোদ্ধারা যুদ্ধের ময়দানে এগিয়ে গেলো। এরপর শুরু হলো ভয়ঙ্কর লড়াই। লড়াইয়ের তীব্রতা এতো বেশী ছিলো যে, মুসলিমদের তলোয়ারের আঘাতে কুরাইশদের মাথা তাদের দেহ থেকে ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন হয়ে যাচ্ছিল। মুসলিমদের আত্মবিশ্বাস ক্রমশঃ বৃদ্ধি পাচ্ছিল এবং তাদের আহাদ! আহাদ! (আল্লাহ এক) ধ্বনিতে বদরের আকাশ, বাতাস ও প্রান্তর মুখরিত হচ্ছিল। আল্লাহর রাসূল (সা) যুদ্ধক্ষেত্রের মাঝামাঝি এক অবস্থানে দাঁড়িয়ে এক মুঠো নুড়ি পাথর নিয়ে কুরাইশদের দিকে নিক্ষেপ করে বললেন, “তোমাদের মুখ ধুলিধুসরিত হোক!” তারপর তিনি (সা) সাহাবাদের প্রবল পরাক্রমের সাথে শত্রুকে আঘাত করার নির্দেশ দিলেন যে পর্যন্ত না শত্রুরা সম্পূর্ণভাবে পরাস্ত হয়। অবশেষে, পৌত্তলিকরা পরাজিত হলো। আর বিজয় নির্ধারিত হলো মুসলিমদের জন্য। মুসলিমদের হাতে বহু সংখ্যক কুরাইশ যোদ্ধা ও কুরাইশদের বিভিন্ন গোত্রের নেতা নিহত হলো। বন্দী হলো আরও অনেকে। বাকী কুরাইশরা যুদ্ধ ক্ষেত্র থেকে পালিয়ে বাঁচলো। আর মুসলিমরা বিজয়ীর বেশে মদীনায় ফিরে আসলো ।