“সাম্প্রদায়িকতা” শব্দের ব্যবহারিক অর্থ হলো রাষ্ট্রের কোন সাম্প্রদায়ের উপর বিশেষ করে সংখ্যালঘু সাম্প্রদায়ের উপর কোন বিশেষ গোষ্ঠী বা দল (কতৃক) জুলুম, নির্যাতন ইত্যাদি। বাংলাদেশ রাষ্ট্রের ভিতর সাম্প্রদায়িকতা বলতে আমরা সচরাচর হিন্দু সাম্প্রদায়ের উপর অত্যাচার-নির্যাতনকে বুঝে থাকি। ১৯৭১ সালে দেশ স্বাধীন হবার পর থেকে হিন্দুদের জমি ও ঘর বাড়ী দখল, ব্যবসা বা সম্পত্তি থেকে উৎখাতের প্রক্রিয়া কাদের দ্বারা সূচিত হয়েছিলো তা আমরা সকলেই জানি। আওয়ামী দাঙ্গাবাজদের দ্বারা শুধু যে হিন্দু সম্প্রদায়ের উপর অত্যাচার-নির্যাতন হয়েছিলো তাই নয়, পার্বত্য চট্রগ্রামের পাহাড়ী জনগোষ্ঠীকে জোর করে বাঙ্গালী বানানোর প্রক্রিয়ায় তাদের উপরও বৈষম্যের সূচনা হয়েছিলো। ধর্মনিরপেক্ষতার রাজনীতির ভারতে যেভাবে কংগ্রেস মুসলমানের উপর বছরের পর বছর অত্যাচার চালিয়ে এসেছে সেই একই চেতনায় বাংলাদেশেও কংগ্রেসের সবচেয়ে বড় বন্ধু আওয়ামী লীগ সংখ্যালঘুদের উপর জুলুম করেছে। আর এই স্বার্থান্বেষী রাজনীতির ধারাবাহিকতায় আওয়ামী লীগের পর যত দল ক্ষমতায় এসেছে জাতীয় পার্টি, বি.এন.পি সকলেই সংখ্যালঘুদের উপর নির্যাতন চালিয়ে গিয়েছে। বিশেষ করে ’৯০ এর পর থেকে তথাকথিত গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থায় আওয়ামী লীগ-বি,এন,পি এর হাতে একই ভাবে নির্যাতনের শিকার হয়েছে হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকজন। পরিহাসের বিষয় হলো এই যে, বি.এন.পি আওয়ামী লীগের ক্যাডারদের অত্যাচারে ভিটে-বাড়ী থেকে উচ্ছেদ হওয়া থেকে শুরু করে, ধর্ষণের শিকার হয়েছেন হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকজন আর এর দোষ চাপানো হয়েছে ইসলামী শক্তি আর ইসলাম পছন্দ মানুষদের উপর। অথচ আমরা চ্যালেঞ্জ দিয়ে বলতে পারি গত ৩০ বছরে ইসলামি শক্তির দ্ধারা কোন হিন্দু নির্যাতিত হয়েছেন এমন উদাহরণ কেউ দেখাতে পারবেন না। বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় সাম্প্রদায়িক শক্তি হিসেবে বি,এন,পি আওয়ামী লীগের ক্যাডাররা একের পর এক হিন্দুদের বাড়ী দখল করেছে, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান থেকে উচ্ছেদ করেছে। নারী নির্যাতন করেছে অথচ এর জন্য দোষারোপ করা হয়েছে ইসলাম ও ইসলামী শক্তিগুলোকে। অথচ ইসলামী শক্তিগুলো উল্টো কাজটাই নিরলসভাবে করে গিয়েছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জগন্নাথ হলের ছাদ ভেঙ্গে যখন শত শত হিন্দু ছাত্র মৃত্যুর সাথে লড়ছিলো, তখন ঢাকা আলিয়া মাদ্রাসার ছেলেরা প্রথম ছুটে গিয়েছিলো তাদেরকে রক্ত দিয়ে বাচাঁনোর জন্য। ভারতে যখন বাবরী মসজিদ ধ্বংস করা হয়েছিলো আর গুজরাটে হাজার হাজার মুসলমানকে পুঁড়িয়ে মারা হয়েছিলো তখন এদেশের সাধারণ ইমাম ও ইসলামি নেতৃবৃন্দ জনগণকে তাদের আবেগ নিয়ন্ত্রণের মধ্যে রাখার, ও হিন্দুদের মন্দিররে নিরাপত্তা রক্ষার আহবান জানিয়েছিলেন। দুঃখের বিষয়ে হলো এই যে আওয়ামী লীগ- বি,এন,পির স্বার্থের রাজনীতির বলির পাঠা হয়েছে হিন্দু সাম্প্রদায়, অথচ তাদেরকে বুঝানো হয়েছে এর জন্য দায়ী ইসলাম ও ইসলামি শক্তি সমূহ। কিন্তু মিথ্যার এই বেসাতি বেশীদিন টিকবেনা। বামপন্থীরা এবং আওয়ামী লীগ মিলে যখনই সাম্প্রদায়িকতা বিরোধী আন্দোলন নামে ইসলামি শক্তিকে দুর্বল করার চেষ্টা করুকনা কেন জনগণ ঠিকই জানে এই দেশে সাম্প্রদায়িক সস্প্রীতি রক্ষা করার সবচেয়ে বড় ঢাল হিসাবে হাজার বছর ধরে ব্যবহার হয়ে আসছে ইসলামি ধারণা ও মূল্যবোধ। ব্রিটিশ আসার পূর্বে এই অঞ্চলের হিন্দু ও মুসলমানরা শত শত বছর ধরে পাশাপাশি শান্তি শান্তিপূর্ণ ভাবে বসবাস করেছে ইসলামের সহনশীলতা ও সহমর্মিতার শিক্ষার কারণেই। ভারতবর্ষে মুঘলদের ৮০০ বছর শাসন আমলে একটিও সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার ঘটনা ঘটেনি। ব্রিটিশরা তাদের নিজেদর স্বার্থ সিদ্ধির জন্য যে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার কৌশল শিখিয়ে দিয়ে গিয়েছে তা গত ৫০ বছর ধরেই ভারত, পাকিস্তান ও বাংলাদেশের শাসকরা সময় সুযোগ মত ব্যবহার করেছেন ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য। এই ধর্মনিরপেক্ষ স্বার্থান্বেষী রাজনীতি ও রাষ্ট্রের বিপরীতে সংখ্যালঘু সাম্প্রদায়ের ব্যাপারে ইসলামের ঐতিহাসিক ভূমিকা ও শরীয়ার অদেশ নির্দেশ পর্যালোচনা করলে দেখা যায় যে, ইসলামী হুকুমত বা রাষ্ট্রই একমাত্র স্থান যেখানে সকল সাম্প্রদায়ের মানুষ শান্তিপূর্ণভাবে বসবাস করতে পারে। ইসলামী রাষ্ট্রে অমুসলিমদের জান-মাল হিফাযতের অধিকার এবং ধর্মীয়, সাংস্কৃতিক, সামাজিক ও নাগরিক অধিকার স্বীকৃত। অমুসলিমদের অধিকার সমূহের মধ্যে অন্যতম হচ্ছে তাদের জীবন রক্ষার অধিকার।
রাসূলুল্লাহ্ (সা) বলেন:
“যদি কোন ব্যক্তি কোন মু’আহিদ (যিম্মী)-কে হত্যা করে তবে জান্নাতের ঘ্রাণ তার নসীবে হবে না। অথচ চল্লিশ বছরের দূরত্ব থেকেও জান্নাতের ঘ্রাণ পাওয়া যাবে। এমন কি যিম্মীদের প্রতি জুলুম করা থেকে বিরত থাকা প্রসঙ্গে রাসূলুল্লাহ্ (সা) ইরশাদ করেন: সাবধান! কেউ যদি কোন মু’আহিদ প্রতি জুলুম করে অথবা তাকে তার অধিকার থেকে কম দেয় কিংবা ক্ষমতা বহির্ভূত কোন কাজ তার উপর চাপিয়ে দেয় বা জোরপূর্বক তার থেকে কোন মালামাল নিয়ে যায় তাহলে কিয়ামতের দিন আমি তার পক্ষ অবলম্বন করবো। যিম্মী হত্যা করা নিষিদ্ধ হওয়া সত্ত্বেও কোন মুসলিম ব্যক্তি যদি কোন যিম্মীকে হত্যা করে তবে বিনিময়ে তাকেও হত্যা করা হবে।“
এতে এ কথা প্রতীয়মাণ হয় যে, ইসলামী রাষ্ট্রে একজন অমুসলিম নাগরিকের প্রাণের মর্যাদা একজন মুসলিমের সমান। এ কারণেই একজন অমুসলিম নাগরিকের রক্তপণ একজন মুসলিম নাগরিকের রক্তপণের সমান ধার্য করা হয়েছে। ইসলামের অমুসলিম যিম্মীদের সম্পদের অধিকার স্বীকৃত। এ কারণেই যিম্মীদের সম্পদের (আত্বস্বাতকারীর) প্রতি রাসূলুল্লাহ্ (ﷺ) কঠোর হুঁশিয়ারী উচ্চারণ করেছেন।
ইসলাম মুসলিম রাষ্ট্রের অমুসলিম যিম্মীদেরকে তাদের ধর্ম ও কৃষ্টি-কালচার রক্ষার ব্যাপারেও পূর্ণ স্বাধীনতা দান করেছে। ইসলামের স্বর্ণ যুগের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, যে সকল বিজিত দেশে অমুসলিম লোকদেরকে বসবাসের অধিকার দেওয়া হয়েছিল, সে সকল দেশে তাদের ধর্ম পালন এবং কৃষ্টি রক্ষার অধিকারও দেওয়া হয়েছিল। আবূ উবায়দ (রা) “কিতাবুল আমওয়াল” গ্রন্থে পরাজিত কয়েক দেশের নাম উল্লেখ করে বলেন, এ সকল দেশের অধিবাসীগণ মুসলমানদের নিকট পরাজিত হয়ে তাদের বশ্যতা স্বীকার করেছিল। অথচ এ সকল দেশের অমুসলিম অধিবাসীদেরকে তাদের ধর্মীয় ব্যাপারে পূর্ববৎ বহাল রাখা হয়েছে। ভারতবর্ষ এর সর্বোৎকৃষ্ট উদাহারণ, যেখানে মুসলিম শাসন আমলে হিন্দুদের সকল প্রকার ধর্মীয় স্বাধীনতা নিশ্চিত করা হয়েছিলো।
অমুসলিম ব্যক্তির সামাজিক ও নাগরিক অধিকারও ইসলামী রাষ্ট্রে স্বীকৃত। ইসলামী রাষ্ট্রের যেসব অমুসলিম অধিবাসী জীবিকা উপার্যনে অক্ষম তাদেরকে ভাতা দানের ব্যবস্থা ইসলামে রয়েছে। হযরত আবূ বকর সিদ্দীক (রা)-খিলাফতের কালে সেনাপতি খালিদ (রা) হিরার অধিবাসীদের সাথে যে চুক্তি করেছিলেন, তাতে ছিল: তোমাদের মধ্যে যে ব্যক্তি বৃদ্ধ হয়ে কর্মে অক্ষম হয়ে যাবে অথবা অন্য কোন কারণে বিপদগ্রস্ত হবে অথবা দরিদ্র হয়ে যাবে তাদের জিযি্য়া মওকূফ করে দেয়া হবে। অধিকন্তু বায়তুল মাল হতে তাদেরকে এবং তাদের পরিবারবর্গকে ভাতা প্রদান করা হবে। আমীরুল মু’মিনীন হযরত উমর (রা) একদা এক বৃদ্ধ ইয়াহুদীকে ভিক্ষা করতে দেখে তাকে বায়তুল মালের খাযাঞ্চির নিকট পাঠিয়ে আদেশ দিলেন, তাকে এবং তার মত অন্যান্য ব্যক্তিদের জন্য বায়তুল মাল থেকে ভাতার ব্যবস্থা করে দাও। যৌবনে তাদের থেকে জিযি্য়া উসূল করে বার্ধক্যে দ্বারে দ্বারে ভিক্ষা করতে দেয়া ন্যায় বিচার নয়। ইসলামী রাষ্ট্রে অমুসলিমদের চাকুরী লাভ করারও অধিকার রয়েছে। খুলাফায়ে রাশিদীনের যমানায় এর বহু উদাহারণ পাওয়া যায়।
সুতরাং আজকের বাংলাদেশের স্বার্থবাদী রাজনীতিবিদদের দ্ধারা হিন্দু ও পাহাড়ী সাম্প্রদায়ের উপর যে অত্যাচার সংঘঠিত হচ্ছে তা থেকে মুক্তির একমাত্র উপায় হলো ইসলামের হুকুম তথা রাষ্ট্রের অধীনে এই সমস্যার সমাধানের চেষ্টা করা। একমাত্র ইসলামী রাষ্ট্রই পারে এদেশের হিন্দু, বৌদ্ধ ও খৃষ্টানদের শারিরীক, সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে। কারণ আল্লাহ্ তৈরী এই পৃথিবীতে তার ব্যবস্থাপনায় পরিচালিত এই বিশ্বে কোন ধর্ম বা সাম্প্রদায়ের মানুষকেই যেমন তিনি আলো, বাতাস, পানি ও রিযিক থেকে বঞ্চিত করেন না বা কারো ব্যাপারে বৈষম্য করেন না। ঠিক সেই একই আল্লাহ্র দেয়া বিধান অনুযায়ী পরিচালিত ইসলামী রাষ্ট্রও ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে সকলের অধিকার নিশ্চিত করতে নিরলস ভাবে কাজকরে যায়। আল্লাহ্ আমাদেরকে সকল মানুষের মুক্তির অবলম্বন সেই রাষ্ট্র ফেরৎ নিয়ে আসার তৌফিক দান করুন। (আমিন)।
শেখ তৌফিক