পুরুষতান্ত্রিক চেতনার সমাজে কোনো আইনই নারীকে তার সঠিক প্রাপ্য বুঝিয়ে দিতে পারবে না, হয়তো মিডিয়ার চোখে কিছু সফল মামলা দেখে আমরা পুলকিত হব, হাততালি দেব, কিন্তু অন্তরালে নারীরা ঠিকই বৈষম্যের শিকার হবে। শুধুমাত্র সম্পত্তিতে অধিকারের ক্ষেত্রেই বৈষম্যের শিকার হবে না, বরং শিকার হবে ঘরোয়া সহিংসতা, যৌন নির্যাতন ও এসিড-সন্ত্রাসের মত বিভিন্নমুখী বৈষম্য ও নির্যাতনের।
অনেক প্রাচীনকাল থেকেই মানব সমাজে পুরুষতান্ত্রিকতা দেখা গিয়েছে। এ বিষয়টি মানবচরিত্রের সাথেও অনেকটা সম্পর্কিত। যেহেতু অধিকাংশক্ষেত্রেই পুরুষ তুলনামূলকভাবে নারী হতে বেশি পেশী শক্তি বহন করে, তাই উন্নত চিন্তাবিহীন সমাজে পুরুষতান্ত্রিকতা বিস্তার করে। সমাজের এ বাস্তবতায় ধর্ম অনেকক্ষেত্রে ঢাল হিসেবে ব্যবহৃত হয় । আর সে ধর্ম যদি আলোকিত না হয় তবে তো কথাই নেই, অনেকটা সোনায় সোহাগা হয় তা পুরুষের জন্য। উপমহাদেশে ব্রাক্ষন্যবাদের প্রভাব আমাদের কারো অজানা নয়, জীবন সম্পর্কে এ দৃষ্টিভঙ্গি শুধুমাত্র পুরুষতান্ত্রিকই নয়, বরং caste বা জাততান্ত্রিক ও সাম্প্রদায়িক। উপমহাদেশের সমাজে এই দৃষ্টিভঙ্গির প্রভাব উল্লেখযোগ্য।
ইতিহাসের দিকে তাকালে আমরা দেখব, প্রাচীন বাংলায় যখন ইসলাম এসেছিল, তখন নিম্নবর্ণের সনাতন ধর্মাবলম্বী ও বৌদ্ধরাই মূলত ইসলামে প্রবেশ করেছিল। ব্রাক্ষণ্যবাদী আর্য সম্প্রদায়ের নিপীরন ও বৈষম্যের প্রেক্ষাপটে ইসলামকে তারা দেখেছিল মুক্তির বার্তাবাহকরূপে। আমরা জানি ইতিহাসে ইসলামই প্রথম নারীকে দিয়েছিল তার উত্তরাধিকার। আর এটি এমন এক সময়ে ঘটেছিল যখন অনেকেই দ্বিধায় ছিল নারীর মধ্যে আদৌ প্রাণ রয়েছে কিনা নাকি নারী মানুষের বাইরে প্রাণীজগতের বিভিন্ন প্রজাতির মধ্যে আরেক প্রজাতি।
ইসলামী আইনে পুরুষতান্ত্রিকতার কোনো ছোয়া নেই কারণ ইসলাম মানুষকে আলাদাভাবে নারী বা পুরুষরূপে দেখে না। বরং সমানভাবে আল্লাহর বান্দা হিসেবে দেখে। তাই পুরুষতান্ত্রিকতার বালাই ইসলামে কোনো কালেই ছিল না। ইসলাম একটি নির্দিষ্ট সমাজ গড়ার জন্য তার আইনগুলোকে সাজিয়েছে। তাই ইসলামী আইনগুলো একে অপর হতে বিচ্ছিন্ন নয়। বরং ইসলামের ‘আইনী অধিকারের সাথে’ পরিবার ও সমাজে একজন মুসলিমের ‘দায়িত্বের’ সম্পর্ক একই সুতোয় গাথা। উদাহরনসরূপ, ইসলামী সমাজে একজন পুরুষকে বাধ্যতামূলক দায়িত্ব দেয়া হয়েছে পরিবারের ভরনপোষনের জন্য, আর নারীকে এখতিয়ার দেয়া হয়েছে অর্থাৎ, সে চাইলে contribute করতেও পারে, আবার নাও পারে। সুতরাং, এ দায়িত্বশীলতার সাথে আমরা অন্যান্য আইনী অধিকারে correlation খুজে পাব বিশেষ করে ইসলামী উত্তরাধিকার আইনে। ইসলামী উত্তরাধিকার আইনে নারীদের রয়েছে নির্দিষ্ট অংশ। কোনো ক্ষেত্রে কোনো নারী পুরুষ হতে কম পেলেও আবার দেখা যাবে আরেক ক্ষেত্রে নারী পুরুষ হতে বেশি পাচ্ছে। অনেক বিশেষজ্ঞের মতে, সার্বিক দিক দিয়ে নারীই বেশি লাভবান হয়।
এটি সত্য যে আমাদের সমাজে অনেক উত্তরাধিকারীই (বিশেষ করে নারী) তাদের সম্পত্তি সঠিক ভাগ পায় না। ধর্মনিরপেক্ষ বা secular সমাজে public domain এ ধর্মের অনুপস্থির দরুন রাষ্ট্রযন্ত্রের ধর্মের প্রতি নির্বিকার হয়ে যাওয়ার প্রভাবেই সৃষ্টি হয় এই জটিলতা। সম্পত্তির ভাগ ইসলামী আইন অনুযায়ী হলেও, সমাজের কার্যাবলীতে ধর্মীয় চিন্তার অনুপস্থিতি সমাজকে ইসলামী থেকে চিন্তাহীন পুরুষতান্ত্রিক সমাজে পরিনত হওয়ার সুযোগ করে দেয়। কেউ হয়তো বলবেন আইনের শাসনের অভাবেই এটি হয়। কিন্তু এটাও তো ঠিক যে আইন এর philosophical ভিত্তি সমাজে কিরুপে আছে তা-ই অনেকটা নির্ধারন করে সে আইনের সচলতা কতটুকু হবে। Secular সমাজে ইসলামী আইনের ব্যক্তি ও পরিবার সংক্রান্ত কিছু আইনের উপস্থিতি থাকলেও তার সচলতা খুবই সংকটময় অবস্থানে থাকে। কারণ সমাজের কেন্দ্রীয় চিন্তার বলয়ে ইসলামী চিন্তা অবহেলিত। তাই সমাজের চিন্তার ভিত্তি না পরিবর্তন করে secular framework এ ইসলামী আইন বাস্তবায়ন করলে কখনোই উন্নত ফলাফল পাওয়া যাবে না।
আর সমাজের চিন্তার ভিত্তি পরিবর্তন করতে হলে চাই সমাজে ব্যপক বুদ্ধিবৃত্তিক আলোচনা। সমাজকে ইসলামী করতে হলে সমাজের বিদ্যমান চিন্তাগুলোকে address করতে হবে এবং সেগুলোর দুর্বলতা চিহ্নিত করে ইসলামের চিন্তা দ্বারা তার পরিবর্তন করতে হবে। এক্ষেত্রে ইসলামকে বুদ্ধিবৃত্তিকভাবে উপস্থাপন করাটা খুবই গুরুত্বপূর্ন। এর ফলে সমাজের চিন্তাশীল অংশ আলোচনায় স্পৃহা পাবে, অংশগ্রহণ করবে এবং অনেকেই ফলাফলসরূপ ইসলামের বুদ্ধিবৃত্তিক নেতৃত্বকে গ্রহণ করবে। এতে ইসলামী চিন্তা সমাজে দ্রুত বিস্তার লাভ করবে এবং ফলশ্রুতিতে তা সত্যিকারের ইসলামী চেতনাকে সমাজে আরো প্রবল করে তুলবে। এভাবে ইসলামী সমাজ ও রাষ্ট্র গঠনের পথ আরো সুগম হবে এবং মুসলিম সমাজ তার পুনর্জাগরণের পথে তীব্রভাবে এগিয়ে যাবে।