বস্তু ও কর্ম সমূহের মূল হুকুমের পার্থক্য

বস্তুর জন্য শর’ঈ হুকুম:

আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা বলেন:

هُوَ الَّذِي خَلَقَ لَكُمْ مَا فِي الْأَرْضِ جَمِيعًا

“তিনিই আল্লাহ, যিনি তোমাদের জন্য জগতের সকল বস্তু সৃষ্টি করেছেন।” (সূরা বাকারা: ২৯)

তিনি আরো বলেন:

أَلَمْ تَرَوْا أَنَّ اللَّهَ سَخَّرَ لَكُمْ مَا فِي السَّمَاوَاتِ وَمَا فِي الْأَرْضِ وَأَسْبَغَ عَلَيْكُمْ نِعَمَهُ ظَاهِرَةً وَبَاطِنَةً

তোমরা কি দেখ না আল্লাহ নভোমন্ডল ও ভূ-মন্ডলে যাকিছু আছে, সবই তোমাদের কাজে নিয়োজিত করে দিয়েছেন এবং তোমাদের প্রতি তাঁর প্রকাশ্য ও অপ্রকাশ্য নেয়ামতসমূহ পরিপূর্ন করে দিয়েছেন? (সূরা লুকমান: ২০)

قُلْ مَنْ حَرَّمَ زِينَةَ اللَّهِ الَّتِي أَخْرَجَ لِعِبَادِهِ وَالطَّيِّبَاتِ مِنَ الرِّزْقِ قُلْ هِيَ لِلَّذِينَ آَمَنُوا فِي الْحَيَاةِ الدُّنْيَا خَالِصَةً يَوْمَ الْقِيَامَةِ كَذَلِكَ نُفَصِّلُ الْآَيَاتِ لِقَوْمٍ يَعْلَمُونَ

আপনি বলুন: কে হারাম করেছে আল্লাহর সাজ-সজ্জাকে, যা তিনি বান্দাদের জন্যে সৃষ্টি করেছেন এবং পবিত্র খাদ্রবস্তুসমূহকে? আপনি বলুন: এসব নেয়ামত আসলে পার্থিব জীবনে মুমিনদের জন্যে এবং কিয়ামতের দিন খাঁটিভাবে তাদেরই জন্যে। এমনিভাবে আমি আয়াতসমূহ বিস্তারিত বর্ণনা করি তাদের জন্যে যারা বুঝে। (সূরা আ’রাফ: ৩২)

এসকল আয়াতের মাধ্যমে মহান আল্লাহ আমাদের জন্য ভূপৃষ্ঠের সকল বস্তুকে মুবাহ (বৈধ) করে দিয়েছেন। আর এসকল আয়াত থেকে বস্তুসমূহের ক্ষেত্রে নিম্নোক্ত মূলনীতি গ্রহণ করা হয়েছে:

الاصل فى الأشياء الاباحة. مالم يرد دليل التحريم

“সকল বস্তুই হালাল যতক্ষণ না তার মধ্য থেকে কোনটা হারাম হওয়ার দলীল পাওয়া যাবে।”

অর্থাৎ বস্তু সমূহের বৈধ ও হালাল হওয়ার বিষয়টা আম (general)। এরপর এই বৈধতা তথা হালাল থেকে কোন বস্তুকে হারাম বা অবৈধ করতে হলে তার জন্য পৃথক প্রমাণ দিতে হবে।

এর উদাহরণ স্বরূপ বলা যেতে পারে কুরআনের নিম্নোক্ত আয়াত:

إِنَّمَا حَرَّمَ عَلَيْكُمُ الْمَيْتَةَ وَالدَّمَ وَلَحْمَ الْخِنْزِيرِ وَمَا أُهِلَّ لِغَيْرِ اللَّهِ بِهِ

“নিশ্চয়ই তোমাদের জন্য হারাম করা হয়েছে মৃত জন্তু, রক্ত, শুকরের মাংস এবং ঐ সকল প্রাণী -যাকে আল্লাহ ব্যতীত অন্য কারো উদ্দেশ্যে উৎসর্গ করা হয়েছে।” (সূরা নাহল: ১১৫)

এই আয়াত দ্বারা মৃত জন্তু আমাদের জন্য হারাম সাব্যস্ত করা হয়েছে।

মহান আল্লাহ পবিত্র কুরআনে সকল বস্তু সমূহকে হালাল এবং হারাম এই দু’টি মানদণ্ডে ঘোষণা করেছেন। উত্তম, অপছন্দনীয় বা আবশ্যক বলে কোন ঘোষণা দেননি। যেমন বলা হয়েছে অপর আয়াতে:

وَلَا تَقُولُوا لِمَا تَصِفُ أَلْسِنَتُكُمُ الْكَذِبَ هَذَا حَلَالٌ وَهَذَا حَرَامٌ

“কোন বস্তু সম্পর্কে তোমরা অন্যায়ভাবে নিজেদের মুখে সেটি হালাল বা হারাম হওয়ার ঘোষণা করো না।” (সূরা নাহল: ১১৬)

একইভাবে অন্যত্র বলা হচ্ছে:

قُلْ أَرَأَيْتُمْ مَا أَنْزَلَ اللَّهُ لَكُمْ مِنْ رِزْقٍ فَجَعَلْتُمْ مِنْهُ حَرَامًا وَحَلَالًا

“হে নবী আপনি বলে দিন, তোমরা কি ভেবে দেখেছো যে, মহান আল্লাহ তোমাদের জন্য যেই রিযক তৈরী করে দিচ্ছেন তার মধ্যে স্বেচ্ছাচারীভাবে কতককে তোমরা হালাল আর কতককে হারাম সাব্যস্ত করে নিচ্ছ?” (সূরা ইউনূস: ৫৯)

কর্ম সমূহের জন্য শর’ঈ হুকুম:

কোন বস্তু জায়েজ হওয়ার অর্থ কখনই এটা নয় যে, তার সাথে সম্পৃক্ত সকল কাজ এমনি এমনিই জায়েজ ও বৈধ হয়ে যাবে। বরং প্রত্যেকটি কাজের জন্য ভিন্ন দলীল লাগবে। শরীয়তের হুকুম বান্দার কাজ সম্পর্কিত শারে’ বা বিধান দাতার সেই সম্বোধন যা তার বিভিন্ন বিষয়াবলীর সমাধানের জন্য এসেছে। আর বস্তুসমূহের কাজ তো কেবল বিভিন্ন কর্মের ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হওয়া। এজন্যই শরয়ী সম্বোধনের মূল লক্ষ্য হলো যাবতীয় আফআল বা কর্ম আর বিভিন্ন বস্তুসমূহ বান্দার কর্মের অন্তর্গত বিষয়; চাই এটা শর’ঈ সম্বোধনের মধ্যে উল্লেখ থাকুক বা না থাকুক।

উদাহরণ স্বরূপ: কাপড়, বস্তুসমূহের ক্ষেত্রে আম (general) হুকুমের কারণে মুবাহ বা বৈধ। কিন্তু এজন্য এই কাপড়ের যে কোন প্রকার ব্যবসাই স্বয়ং সম্পূর্ণভাবে বৈধ হয়ে যাবে না। বরং প্রথমে সেই ব্যবসার (তথা কাজটির) হুকুম জানতে হবে।

وَأَحَلَّ اللَّهُ الْبَيْعَ وَحَرَّمَ الرِّبَا

“আল্লাহ ব্যবসাকে হালাল করেছেন এবং সুদকে হারাম করেছেন।” (সূরা বাকারা : ২৭৫)

আমরা এই আয়াত থেকে ব্যবসা হালাল হওয়ার প্রমাণ পেলাম। এর দ্বারা আমরা কাপড়ের ব্যবসা হালাল বলেও জানতে পারলাম। এজন্য কাপড় বেচা-কেনা করা মুবাহ বা বৈধ জানবো। আর এটাই কাপড় বিক্রির এই কাজের হুকুম।

একইভাবে উদাহরণ স্বরূপ বলা যায় ছুরি একটি বৈধ জিনিস। কেননা তার হারাম হওয়ার কোন দলীল নেই। হ্যাঁ, তবে এই ছুরি ব্যবহার করে অন্যায়ভাবে কোনো ঈমানদারের জন্য অন্য ঈমানদারকে হত্যা করা হারাম। যেমন বলা হয়েছে:

وَمَنْ يَقْتُلْ مُؤْمِنًا مُتَعَمِّدًا فَجَزَاؤُهُ جَهَنَّمُ

“আর যে কোন মুমিনকে অন্যায়ভাবে হত্যা করবে তার শাস্তি হচ্ছে জাহান্নাম।” (সূরা নিসা : ৯৩)

কর্মসমূহের ক্ষেত্রে শরীয়তের কায়দা বা মূলনীতি হলো:

الاصل فى الافعال التقيد بالحكم الشرعى

“কর্মসমূহের ক্ষেত্রে শরীয়তের নিয়মাবলীর অনুসরণ করতে হবে।” এজন্যই মানুষের জন্য সকল কাজ মূল থেকেই হারামও নয় আবার বৈধও নয়। বরং প্রত্যেক কাজের ক্ষেত্রে তার বাস্তবায়ন ও চুড়ান্ত পরিণতির পূর্বে প্রথমেই তার হুকুম অনুসন্ধান করতে হবে। আর এ কাজটি অত্যন্ত জরুরী।

‘প্রত্যেক হুকুম তার শরয়ী দলীলের উপর নির্ভরশীল।’ এই মূলনীতির প্রমাণ হচ্ছে নিন্মোক্ত আয়াত:

فَوَرَبِّكَ لَنَسْأَلَنَّهُمْ أَجْمَعِينَ ~ عَمَّا كَانُوا يَعْمَلُونَ

“আপনার রবের শপথ! আমি অবশ্যই অবশ্যই তাদেরকে তাদের কৃতকর্ম সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করবো। যা তারা দুনিয়াতে করেছে।” (সূরা হিজর: ৯২-৯৩)

অর্থাৎ মহান আল্লাহ তা’আলা আমাদের সকল কর্মের হিসাব নিবেন। অন্যত্র আরো বলা হয়েছে:

يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آَمَنُوا أَطِيعُوا اللَّهَ وَأَطِيعُوا الرَّسُولَ وَأُولِي الْأَمْرِ مِنْكُمْ فَإِنْ تَنَازَعْتُمْ فِي شَيْءٍ فَرُدُّوهُ إِلَى اللَّهِ وَالرَّسُولِ إِنْ كُنْتُمْ تُؤْمِنُونَ بِاللَّهِ وَالْيَوْمِ الْآَخِرِ

“হে ঈমানদারগণ! তোমরা আল্লাহ এবং তার রাসূলের আনুগত্য করো। আর আনুগত্য করো নিজেদের মধ্যকার নেতৃত্বস্থানীয়দের। এরপর যদি তোমাদের মধ্যে কোন বিষয়ে মতভেদ দেখা দেয়, তবে তোমরা বিষয়টি আল্লাহ ও রাসূলের (নির্দেশনার) দিকে উপস্থাপন করো। যদি তোমরা আল্লাহ ও শেষ দিবসের প্রতি বিশ্বাসী হয়ে থাকো।” (সূরা নিসা: ৫৯)

হাদীসে এসেছে:

من عمل عملا ليس عليه امرنا فهو رد

“যে এমন কোন আমল করবে, যাতে আমাদের নির্দেশনা নেই তবে সেই আমল বাতিল বলে গণ্য হবে।” (সহীহ মুসলিম শরীফ)

এর দ্বারাও এটাই সাব্যস্ত হয় যে, প্রত্যেক কাজের মূল হুকুম বৈধতা নয় বরং শরীয়তের হুকুমের অনুসরণ এবং শরীয়তের নির্দেশনার অনুকরণ। এর ব্যতিক্রম হলে সেই আমলই বাতিল।

কোন কাজকেই এমনি এমনি জায়েজ বলে সাব্যস্ত হবে না, বরং শরীয়ত প্রণেতার পক্ষ থেকে হুকুম অবগত হবার পর তার সম্পর্কে সিদ্ধান্ত দেয়া যাবে। এরপর সেই শরয়ী নির্দেশনারই অনুসরণ করতে হবে। এর থেকেই ‘কর্মের স্বাধীনতা’ (Freedom of Acts Unless Clear Prohibitions are Stated) সম্পর্কিত নিয়ম বাতিল সাব্যস্ত হয়। একইভাবে সাহাবায়ে কিরামের আমলও নিন্মোক্ত মূলনীতির উপর অটল ছিল:

الاصل فى الافعال التقيد بالحكم الشرعى

“কর্মসমূহের ক্ষেত্রে শরীয়তের নিয়মাবলীর অনুসরণ করতে হবে।” এছাড়াও এ বিষয়টির প্রমাণ পবিত্র কুরআনের অসংখ্য স্থানে নিম্নোক্ত শব্দে উল্লেখ হয়েছে: يسئلونك (তারা আপনার কাছে জিজ্ঞাসা করে)।

সাহাবায়ে কিরাম রাসূল (সা)-এর কাছে বিভিন্ন কাজ-কর্মের ব্যাপারে জিজ্ঞাসা করাটাই প্রমাণ করে যে, কাজ-কর্মের মূল হুকুম স্বাধীনতা বা বৈধতা নয়।

Print Friendly, PDF & Email

সাভার হত্যাকান্ড!

হুক্‌ম শর’ঈ

Leave a Reply