(১ম পর্ব)
১৮০২ সালে আমেরিকান প্রেসিডেন্ট থমাস জেফারসন ডানবুরি ব্যাপিস্টদের কাছে ধর্মনিরপেক্ষতাবাদের নীতি ব্যাখ্যা করে একটি চিঠি লিখেছিলেন। চিঠিটিকে ভিত্তি করে আমেরিকান সংবিধানে ধর্মনিরপেক্ষতা প্রতিষ্ঠা করে প্রথম সংশোধন করা হয়। তিনি চিঠিতে লিখেন “Believing with you that religion is a matter which lies solely between Man and his God, that he owes account to none other for his faith or his worship, that the legitimate powers of government reach actions only & not opinions, I contemplate with sovereign reverence that act of the whole American people which declared that their legislature should “makes no law respecting an establishment of religion, or prohibiting the free exercise thereof,” thus building a wall of separation between Church & State.” অর্থাৎ থমাস জেফারসনের কথায় রাষ্ট্রীয় কর্তৃপক্ষ ধর্মীয় কর্তৃপক্ষের উপর কোনো প্রকার হস্তক্ষেপ না করার বিষয়টি ফুটেছে। যা ধর্মনিরপেক্ষ মতবাদের মুল কথা। থমাস জেফারসনের চিন্তাকে প্রতিষ্ঠার একই সূরে কথা বললেন তসলিমা নাসরীনও। গত ৫ ডিসেম্বর ০৭ বিবিসিকে তসলিমা নাসরীন বলেন, ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দেওয়ার জন্য নয়, ধর্মনিরপেক্ষতা প্রতিষ্ঠার জন্যই আমি লিখি। বিতর্কিত তসলিমা নাসরীনের ন্যায় এ পথের কিছু অনুসারী, লক্ষ ও আদর্শচুত বাম রাজনীতিক সাম্রাজ্যবাদীদের উচ্ছিষ্টভোগী তথাকথিত কিছু বুদ্ধিজীবী সময়ে –অসময়ে দাবি তোলে আমাদের দেশের রাজনীতি থেকে ধর্মকে বাদ দেওয়ার। যে মতবাদের উদ্ভব হয়েছিল সপ্তদশকে অন্ধকারাচ্ছন্ন ইউরোপের বাস্তবতায়। খ্রিষ্টিয় চার্চের ধর্মের (যাজকদের বানানো) নামে জনসাধারনের উপর অত্যাচার ও শোষনের বিরুদ্ধে প্রতিক্রিয়াশীল (Reactionary) আন্দোলনের ভিত্তিতে উদ্ভব হয়েছিল যে ধর্ম নিরপেক্ষতাবাদের। ইউরোপে ১৭৭৯ সালের ফরাসি বিপ্লবের পর প্রতিষ্ঠিত হয় ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ ভিত্তিক জাতিরাষ্ট্রের (national state)। আর পশ্চিমাদের ধর্মনিরপেক্ষ জাতিরাষ্ট্রকে মডেল হিসাবে প্রতিষ্ঠার কৌশলের মধ্য দিয়েই এগিয়ে চলেছে বিশ্বরাজনীতির ঘটনা প্রবাহ। তাই আমাদের দেশের বিভিন্ন সাংস্কৃতিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক বাস্তবতার মধ্যে ধর্মনিরপেক্ষ রাজনীতি প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টা চালানো হয়েছে বারবার। বারংবার ব্যার্থতার পরেও যখন পুনরায় তা সাংবিধানিক ভাবে প্রতিষ্ঠার দাবি ওঠে একটি জনবিচ্ছিন্ন গোষ্টির কাছ থেকে, তখন বিশ্ব রাজনীতিতে মতবাদটির আবির্ভাবের বাস্তবতার নীরিখে এটির বুদ্ধিবৃত্তিক যৌক্তিকতা বিচার খুব প্রাসঙ্গিক। কারণ রাজনীতির ভিত্তি, আদর্শ ও দর্শণের মধ্যে যদি গলদ ও বুদ্ধিবৃত্তিক অসারতা থাকে তাহলে সে রাজনীতি সাইত্রিশ বছর কেন সাতশ বছর চর্চা করলেও তা বিশ্ব মানবতাকে অধিকতর মঙ্গলজনক কিছু দিতে পারবে ন। সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসন, যুদ্ধ ও অসুখকর সাংস্কৃতিক দুষণ দিয়ে বিশ্বকে বসবাসের ক্রমশ অনুপযোগী করে তুলেছে পশ্চিমের ধর্মনিরপেক্ষ পুঁজিবাদী রাজনীতি। নিচে আমরা এ মতাদর্শের আবির্ভাবের প্রেক্ষাপট, কারণ ও ব্যার্থতা; বাস্তবতা ও বুদ্ধিবৃত্তিক যুক্তির আলোকে যাচাই করার চেষ্টা করব।
বিচ্ছিন্নভাবে প্রাচীন গ্রীক ও অন্যান্য সময়ের কিছু চিন্তাবিদদের মাঝে রাষ্ট্র ব্যাবস্থায় ধর্মীয় সমাধানের বিরোধী মনোভাবের খোঁজ পাওয়া যায়। তবে ভাষায় বা সাহিত্যে সেকুলারিজম (secularism) বা ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ কথাটি সর্বপ্রথম ১৮৪৬ সালে বৃটিশ লেখক জর্জ জ্যাকব হলিওয়েক ব্যাবহার করেন। ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ মতবাদ প্রধানত ইহজাগতিক কার্যকলাপের সঙ্গে সম্পৃক্ত। কসমিন এ ব্যারি ও ইংলিশ সেকুলারিজমের কাছ থেকে পাওয়া সেকুলারিজমের সংজ্ঞা নিম্নরূপ-
১। একদিক থেকে বিবেচনা করলে ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ ধর্মীয় স্বাধীনতার কথা বলে এবং রাষ্ট্র নিজে ধর্মীয় বিশ্বাসের ব্যাপারে কোন প্রকার পক্ষপাত মূলক ভূমিকায় অবতীর্ণ হবে না। সরকারও জনগণের উপর চাপিয়ে দেবেনা। অন্য দিক থেকে এটি এমন একটি বিশ্বাসকে বোঝায় যে মানুষের যাবতীয় কার্যাবলি এবং সিদ্ধান্ত সমূহ (বিশেষ করে রাজনৈতিক) গ্রহণ করা হবে তথ্য ও বাস্তবতার ভিত্তিতে, কোন প্রকার ধর্মীয় বিবেচনায় নয়।
[Kosmin, Barry A ‘Contemporary Secularity and Secularism.‘
Secularism & Secularity: Contemporary International Perspectives, Ed. Barry A. Kosmin and Artela Keysar. Hartford, CT: Institute for the study of Secularism in Society and Culture (ISSSC), 2007]
২। ধর্মনিরপেক্ষতা কেবল মানুষের ইহলৌকিক দায়িত্ব সংক্রান্ত নিয়মাবলী এবং যারা ধর্মতত্ত্বকে অপূর্ণ, আস্থা স্থাপনের অযোগ্য এবং অবিশ্বাস্য মনে করে এই আদর্শ তাদের জন্য। এর মূল উপাদান তিনটিঃ ক) ইহলৌকিক জীবনের উন্নয়ন কেবল বস্তুর মাধ্যমেই হওয়া সম্ভব। খ) বিজ্ঞানই মানুষের জন্য একটি প্রাপ্তিসাধ্য ঈশ্বর। গ) যে কোনো ভালো কাজই ভালো। অন্য কোনো ভালো থাকুক বা না থাকুক বর্তমান জীবনের জন্য যা ভালো তার সন্ধানই শ্রেয়। (English Secularism, 35)
ধর্মনিরপেক্ষতার উদ্ভবের প্রেক্ষাপট ও কারন:
ঐতিহাসিকভাবে দেখা যায় মধ্যযুগব্যাপী ইউরোপের চার্চের কর্তৃপক্ষের অত্যাচার ও শোষনের বিরুদ্ধে নেতিবাচক প্রতিক্রিয়ার ফলেই এ মতবাদ বেড়ে উঠে। ঈসা (আ) এর উর্ধ্ব আরোহনের পর তার (আ) ধর্মের আসল বাণী বিকৃত করে মানবীয় চিন্তা-চেতনা, দর্শন ঢুকানো হয়। এমনকি কনসট্যানটাইন নামক এক রোমান সম্রাট খ্রিস্টবাদকে তার রাষ্ট্র ধর্ম হিসাবে ঘোষণা করে। তার তৈরি এই বিকৃত ধর্মের অনুসারী হতে সে জনসাধারণকে চাপ প্রয়োগ করে। সৃষ্টিকর্তার একত্ববাদের ধারণা থেকে সরে আসা খ্রিস্টান ধর্ম যে মানুষের মনগড়া মতবাদ তার হাজার প্রমানের মধ্যে অন্যতম একটি হচ্ছে ৩২৫ সালের নাইসিন সম্মেলন (Nicene Council)। এই সম্মেলেনে রোমান সাম্রাজ্যের ১৮০০ বিশপ যোগ দেয়। যেখানে ইস্টার বানির (Ester Bunny) মতো রোমান সাংস্কৃতিক বিশ্বাসকে খ্রিষ্টীয় বিশ্বাসের মধ্যে ঢুকানো হয়। চারটি সংশোধিত বাইবেলকে তারা এ সম্মেলনে রাষ্ট্রীয় ধর্মগ্রন্থ হিসেবে গ্রহণ করে; এ ভার্সনে বিশ্বাসী খ্রিষ্টানরা এখনও সারা পৃথিবীতে রয়েছে। মানুষের জ্ঞানের মত সীমাবদ্ধ জ্ঞান বাইবেলে ঢুকানোর ফলে ভিন্ন ভিন্ন বাস্তবতায় বাইবেল সকল সমস্যার সমাধান দিতে ব্যার্থ হয় এবং বাইবেলের মধ্যে প্রতিফলিত হয় মানুষের জ্ঞানের সীমাবদ্ধতা, অসম্পুর্ণতা, অসামঞ্জস্যতা ও স্ববিরোধীতা। এভাবে মানুষের বাস্তব জীবনের সমস্যার সমাধান থেকে খ্রিস্টমতবাদ অনেক দূরে সরে যায়। মুলত; খ্রিষ্টীয় যাজক সম্প্রদায় ও চার্চের কর্তৃপক্ষ তাদের মনগড়া চিন্তা-ভাবনা খ্রিস্টবাদের নামে ধর্মীয় বাণী হিসেবে চালাতে থাকে।
মধ্যযুগব্যাপী জনসাধারণের উপর চার্চের এই প্রাধান্য ও কর্তৃত্ব বজায় থাকে। এসময় ইউরোপের সম্রাট ও রাজারা চার্চের প্রতি মানুষের এ দুর্বলতার সুযোগ গ্রহণ করে নিজেদের মসনদকে আরো পাকা-পোক্ত রাখতে চার্চকে ব্যাবহার করে। এসময়ে ইউরোপে বিভিন্ন বৈজ্ঞানিক আবিস্কার ও চিন্তা-ভাবনার প্রসার ঘটতে থাকে। যা খ্রিষ্টীয় যাজক সম্প্রদায়ের ধর্মীয় বাণীর সঙ্গে দন্দ্বের সুত্রপাত ঘটায়। চার্চের প্রভাব হুমকির সম্মুখীন হতে থাকে। ফলে পোপ ও রাজারা বৈজ্ঞানিক গবেষণা ও উদ্ভাবনকে অনুৎসাহিত করতে থাকে। এমনকি গ্যালিলিও ও কপারনিকাসের মত বিজ্ঞানীকে তারা শাস্তি ও প্রদান করে তাদের আবিষ্কারের জন্য। এসব ঘটনা মানুষের কাছে খ্রিস্টবাদের বুদ্ধিবৃত্তিক ও বাস্তব সমস্যা সমাধানের ব্যার্থতাকে পরিস্কার করে তোলে।
খ্রিষ্টীয় চার্চের ধর্মীয় যাজকদের শাসনে (Theocracy) সাধারন মানুষ ও চিন্তাবিদরা অতিষ্ট হয় বটে, কিন্তু ভুলে ভরা মানুষের তৈরি খ্রিস্টবাদের শোষণের তিক্ততায় তারা ভুল ক্রমে ধর্মের প্রতিই নেতিবাচক ধারণা পোষণ করতে থাকে। এ সময়ে প্রধানত দুই শ্রেণীর চিন্তাবিদ ও দার্শনিকের উদ্ভব ঘটে-
১। নাস্তিকতাবাদী ও
২। আপোষবাদী।
নাস্তিকতাবাদী দার্শনিকরা বাস্তব জীবন তথা রাষ্ট্রীয় জীবনে সৃষ্টিকর্তা ও ধর্মকেই অস্বীকার করতে শুরু করে। এদের দু-একজন হলো- বস্তুবাদী হেগেল,মার্ক্স, লেলিন। এদের চিন্তার উপর ভিত্তি করে পরবর্তীতে কমিউনিজম বা সোশালিজমের বিকাশ লাভ করে। আপোষবাদীরা ধর্ম বা সৃষ্টিকর্তাকে অস্বীকার করেনি। তদের আপোষটা ছিল – যদি কেউ ধর্মীয় বিশ্বাস লালন-পালন করতে চায়, তা একেবারে ব্যাক্তিগত জীবনে। চার্চের বা ধর্মের কোন প্রভাব রাষ্ট্র পরিচালনায় থাকবে না। এ ঘরাণার চিন্তাবিদ বা দার্শনিকদের কয়েক জন হলেন- রুশো, ম্যাকিয়াভেলি, হবস, লক, ভলটেয়ার, মন্টেসকু প্রমুখ। আর এই আপোষবাদী (Compromise) চিন্তার ভিত্তিতেই গড়ে উঠেছে আজকের ধর্মনিরপেক্ষ পুঁজিবাদী সভ্যতা।
এ সকল দার্শনিক ও চিন্তাবিদদের আবির্ভাব কালকে পশ্চিমারা আলোকিত যুগ (Enlightenment) বলে আখ্যায়িত করে। এ সময়ে দীর্ঘকালব্যাপী খৃস্টান ধর্ম যাজক ও রাজারা বনাম দার্শনিক ও চিন্তাবিদদের মধ্যে এক তুমুল সংগ্রাম ও সংঘর্ষের সৃষ্টি হয়। অবশেষে আপোষের মাধ্যমে চার্চের কর্তৃপক্ষরা ধর্মীয় বিধিবিধান প্রচার ও পালনকে শুধু মানুষের ব্যাক্তিগত জীবনে সীমাবদ্ধ রাখতে সম্মত হয়।
এ প্রেক্ষাপটেই ম্যাকিয়াভেলি তার ‘দ্যা প্রিন্স’ (The Prince) গ্রন্থে তার দেশের শাসককে ধর্মীয় রাষ্ট্রের পরিবর্তে জাতি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পরামর্শ দিয়েছিলেন। তিনি বলেন, “ভ্যাটিকান ইতালির মাঝখানে বসে চক্রান্তের জাল বুনে চলেছে। অতীতে সে রাজত্ব করছে। এখন তার দিন শেষ। ইতালির গৌরবের জন্য প্রয়োজন হলে ভ্যাটিকান কে রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রাধীন আনতে হবে।” বস্তুতঃ শাসক গোষ্ঠির অত্যাচার ও নিপীড়নের হাত থেকে মুক্তি পেতেই স্বাধীনতার (Freedom) শক্ত দাবি তুলেছিল ম্যাকিয়াভেলি, রুশোর ও লকের মত দার্শনিকরা। এ চিন্তাবিদরা ধর্মকে কুসংস্কারাচ্ছন্ন, সময়ের অনুপযোগী হিসেবে দেখতে পেলেন। বিখ্যাত দার্শনিক হবস, লক, মন্টেস্কু, রুশো ব্যাক্তিকে এই কুসংস্কার ও পশ্চাদপদতার শৃঙ্খল থেকে বেড়িয়ে আসার আহ্বান জানায়। জেইন জ্যাকস রুশো (J.J. Rousseau) বলেন, “মানুষ স্বাধীনভাবে জন্ম গ্রহণ করলেও তার পারিপার্শ্বিকতা তাকে শৃঙ্খলিত করে ফেলে (Man is born free but he is in chains everywhere.)। এই অভিব্যাক্তির মূল দাবি ছিল এমনই- নিজের ভাগ্য নিজের নির্ধারনের ক্ষমতা মানুষের হাতেই আছে। ভাগ্য ঈশ্বর কর্তৃক পূর্বনির্ধারিত নয়। অর্থাৎ মানুষ জন্মগতভাবে উত্তম এবং স্বাধীন। ফলে রুশোও অবশেষে ফরাসী বিপ্লবের (French Revolution) পক্ষে কাজ করে। আর এই বিপ্লবের মাধ্যমেই চুড়ান্তভাবে রাষ্ট্র থেকে ধর্ম আলাদা হয় এবং নিষ্পেষণকারী রাজা ও চার্চেরও পতন ঘটে। সৃষ্টি হয় সকল রাষ্ট্রীয় সমস্যা সমাধানের আইন ও নীতি তৈরিকারী সংসদীয় ব্যাবস্থা (Parliamentary System)। শুরু হয় প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মনিরপেক্ষ সমাজের পথ চলা।
ধর্মনিরপেক্ষতাবাদের ব্যার্থতা:
একটি আদর্শ ও মতবাদের সঠিকতা বিচার করতে চাইলে, আমাদেরকে দেখতে হবে এটা কোনো বাস্তবিক ভিত্তির (Rationality) উপর প্রতিষ্ঠিত কি-না। মহাজগৎ সৃষ্টি, মানুষ, এ জীবনের আগে ও পরে কী আছে; মানব জীবনের এ সকল মূল প্রশ্নের কোনো বুদ্ধিবৃত্তিক সুস্পষ্ট উত্তর সেই মতবাদটি দেয় কি-না তার উপরও। কারণ প্রত্যেকটি সুস্থ্য-স্বাভাবিক মানুষের চিন্তায় এসকল মূল প্রশ্ন শৈশব থেকেই ঘোরা-ফেরা করে। এগুলোর বাস্তব সম্মত কোন উত্তর না পেলে সে সন্তুষ্ট হতে পারে না। এই চিন্তাগুলোর উত্তরের উপরই নির্ভর করে প্রতিটি মানুষের জীবন পদ্ধতি (Life Style)। যেমন; একজন নাস্তিকের জীবন পদ্ধতি এক রকম পক্ষান্তরে আস্তিকের জীবন পদ্ধতি আরেক রকমের। মতবাদের সঠিকতার আরেকটি নির্ণায়ক হলো এটি মানুষের সহজাত প্রবৃত্তির সাথে মানানসই কি-না।
এবার আমরা একটু উপরিউল্লিখিত নির্ণায়ক গুলোর আলোকে ও আমাদের সমাজে ধর্মনিরপেক্ষতাবাদের পক্ষে যে সকল যুক্তি বিদ্যমান সেগুলোর বুদ্ধিবৃত্তিক ভিত্তি ও বাস্তবায়নের ফলাফলগুলো পর্যালোচনা করবো।
১। পশ্চিমের ধর্মনিরপেক্ষতাবাদীরা প্রায়ই বলে থাকে, “Keep your religion to yourself, don’t bring it into politics” একই সুর ধরে আমাদের দেশের কেউ কেউ বলে , “ধর্ম যার যার রাষ্ট্র সবার“ কিন্তু এই ধারণাটা যৌক্তিক কি-না তা সমাজের সর্বোচ্চ সংগঠনটির (রাষ্ট্র) দিকে তাকালে দেখতে পাই। আজ পর্যন্ত পৃথিবীর যত ধর্ম ও ধর্ম প্রচারক এসেছে সকলেই সমাজ সংস্কারের কাজ করেছেন। কিন্তু রাজনীতি ছাড়া সমাজ পরিবর্তন কখনো সম্ভব নয়। সকল ধর্ম প্রচারকরাই রাষ্ট্র ও সমাজ পরিচালনার নীতি গুলোকে পরিবর্তিত ও প্রভাবিত করেছিলেন এবং বিধিবিধান প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। তাই বলা যায় সমাজে মতাদর্শ প্রতিষ্ঠার প্রক্রিয়াই এক ধরনের রাজনৈতিক প্রচেষ্টা। যে সমাজে ধর্ম বিদ্যমান সেখানে ধর্মের চিরায়ত প্রবণতা হলো সমাজ সংস্কার করা। অর্থাৎ ধর্মের প্রবণতা থেকেই ধর্ম ও রাজনীতির সুগভীর সম্পর্ক প্রতিয়মান। উদাহরন হিসেবে বলা যায় আরবে ইসলাম প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর সেখানকার সমাজ ব্যাবস্থা ও রাষ্ট্রীয় কাঠামো পরিবর্তিত হয়ে যায়।
২। “কেউ যেন তার ধর্মীয় বিশ্বাসকে অন্যের উপর না চাপিয়ে দিতে পারে তাই ধর্মকে রাজনীতি থেকে আলাদা রাখা উচিৎ।“ এ যুক্তিটিও একটি খোড়া যুক্তি, কারণ সমাজে বসবাস কারী একজনের চিন্তা দ্বারা সব সময়ই অন্যজন প্রভাবিত হয়। চিন্তার চরিত্রটাই এমন যে তা পূর্ববর্তী কোনো চিন্তার ভিত্তিতেই গড়ে ওঠে। এছাড়া সমাজ বা রাষ্ট্রে ধর্মের প্রভাব থাকবে না, এটাকেও আমরা একটা নতুন এক ধর্মীয় মতাদর্শ বলতে পারি। যে ধর্মের নাম ‘ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ।‘ কারণ ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ সৃষ্টিকর্তা ও ধর্ম সম্পর্কে নতুন চিন্তা সহকারে এক নতুন মতাদর্শ সমাজে নিয়ে এসেছে। যা অন্যান্য ধর্মীয় বিশ্বাসের উপর চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে। যেমন কোনো কর্তৃপক্ষ যদি বলে “এখানে কোনো আইন থাকবেনা।“এটাও একটা নতুন আইন সৃষ্টি করে। উদাহরণ স্বরুপ বলা যায় ইসলাম রাষ্ট্রে সুদ ভিত্তিক অর্থনীতি অনুমোদন দেয় না। ফলে ধর্মনিরপেক্ষ পুঁজিবাদী রাষ্ট্রে সৃষ্টিকর্তার দেওয়া আইন মান্য করা বা ধর্ম পালন করা সম্ভব নয়। বরং ধর্মনিরপেক্ষতাবাদই অন্য ধর্মের স্বাধীনতা দেয়না।
চলবে……।।
খান শরীফুজ্জামান সোহেল